অলিখিত শর্ত (৩য় পর্ব)
শায়লা শিহাব কথন
শামীমা আহমেদ
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে শায়লা দোতালায় উঠে এলো। দোতালায় ওরা থাকে আর নীচতলায় বহুদিনের পুরনো একটি ভাড়াটিয়া পরিবার।
সুখে দুখে একসাথে। অনেকটা ঘরের মানুষের মতই হয়ে গেছে তারা।শায়লার বাবা দোতালা পর্যন্ত বাড়িটি তুলতে পেরেছিলেন।
এরপর চাকরির অবসরের সাথে জীবনেরও অবসর নিলেন। পরিবারটির আমূল পরিবর্তন এসে গেলো।শায়লার মা তিনটি সন্তান নিয়ে একেবারেই ভেঙে পড়লেন।
স্বামীর নির্ভরতায় মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা স্বামীকে হারিয়ে একা চলতে যেমন
অসহায় বোধ করেন। শায়লাকেই ধৈর্য্য ধরে সব সামাল দিতে হলো।ছোট ভাই রাহাত তখন কলেজে পড়ছে আর ছোট বোন নায়লা এসএসসির প্রস্তুতিতে।শায়লার অনার্স প্রায় শেষের দিকে ছিল। আর কিছুদিন ক্লাসের পরেই ফাইনাল। তা আর দেয়া হলো না।
একটা চাকরি নিতে হলো সংসারের আয় বাড়াতে। দিন রাত্রির পরিশ্রমে নিজের দিকে তাকানোর সময় হলোনা।আর তখুনি জীবন থেকে অনেককিছুই খসে গেলো নিতান্তই নিছক অজুহাতে। শরীর ও মন দুটোই ভেঙে পড়লো শায়লার।সে সব দুঃসহ স্মৃতি শায়লা ভুলে থাকতে চায়।জীবনের উঠতি বয়সে ভালোবাসার রঙ লাগতে না লাগতেই তা ফিকে হয়ে গেলো।তবে চলমান জীবনধারা কখনোই থেমে থাকে না। বয়ে যায় আপন গতিতে।তাতে হয়তো পাহাড়সম বাধা, উঁচু নীচু কন্টকময় পথ পাড়ি দিতে হয়।
শায়লা সবকিছুর সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিলো। জীবনকে এক সরলরেখায় নিয়ে এলো।যেখানে শুধু মা ছোট ভাই রাহাত আর ছোট বোন নায়লা।নিজেকে অচেনা করে রাখল নিজের কাছেই।
দোতালায় দরজায় কলিং বেল দিতেই মা দরজা খুলে দিলো। রাহাত এখনো ফিরেনি?
শায়লার প্রশ্নে মা জানালেন, না, ওর দেরি হবে জানিয়েছে। সেই কলেজ পড়ুয়া ভাইটি একে একে ইউনিভার্সিটির দিনগুলো পেরিয়ে আজ দারুণ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে। বিবিএ এমবিএ করেছে।শিক্ষাগত যোগ্যতায় যেন পিছিয়ে না পড়ে তাতে শায়লার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল। এখন সোনালী ভবিষ্যৎ উঁকি দিচ্ছে।রাহাতেরও অনেক স্বপ্ন মা বোনদেরকে নিয়ে।দারিদ্র্যতা ঘুচিয়ে আনবে স্বচ্ছল জীবন।
শায়লা ফ্রেস হয়ে মাকে সবকিছু বের করে দেখালো।একে একে সুটপিস, শার্ট, মিলিয়ে টাই আর শেভিং কিটস উইথ ডিওডোরেন্ট।
সুট পিসের সাথে ওদের দেয়া ফ্রি একটি চমৎকার ব্যাগ।
ছোট বোন নায়লার পছন্দের বিয়ে।ওর অনার্সের পর পাত্রপক্ষও বেশ আগ্রহ করে তাকে গ্রহন করেছে।ওদের পারিবারিক অবস্থাও বেশ ভালো।মাস্টার্স তারাই করিয়ে নিবে।নিজস্ব ব্যবসায় দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিবেন। এমন পরিবারে আত্মীয়তা করে শায়লার পরিবারকে একটু নিচু হয়েই থাকতে হয়।তবুও মায়ের মন।যতটুকু পারা যায়।
ছোটবেলা থেকেই নায়লা বেশ চটপটে ও উজ্জ্বল গাত্রবর্ণে শায়লার সাথে বরাবরই তুলনায় এসেছে।মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আর কবে পাল্টাবে? বিয়েটাই যেনো জীবনের মূলমন্ত্র।একটা মেয়ের ভালো বিয়ে হয়েছে বলতে আমাদের সমাজে কোন স্ট্যান্ডার্ড কে বুঝায়? এসব কথা শোনা শায়লার সয়ে গিয়েছে।
---নায়লা ও মূর্শেদ ওরা সুখী দম্পতি। ছয় মাস হলো বিয়ের।
প্রায়ই গাড়ি হাঁকিয়ে মায়ের বাড়ি বেড়াতে আসে।চোখে মুখে সুখের ছোঁয়া।ওদের দেখে শায়লাও আনন্দিত হয়!ভালোবাসার মানুষকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া ও সুখী দাম্পত্য জীবন চালিয়ে যাওয়া এটা ভাগ্যবান মেয়েদের জন্যই লেখা থাকে।
মা বলে উঠলো, তবে তো ওদের একদিন আসতে বলতে হয়।
ওরা বসুন্ধরাতে শ্বশুরের বিশাল ফ্ল্যাটে আছে। পারিবারিক ব্যবসা।একমাত্র ছেলের বউ।বেশ আদর আহ্লাদেই নায়লার দিন কাটছে।
শায়লা বললো --হ্যাঁ, বলো,, এভাবেই প্রতিটি বিষয়ই শায়লাকে দেখতে হয় যেন মাকে খুশি রাখা যায়।
---কিংবা রাহাত গিয়েও দিয়ে আসতে পারে বা মুর্শেদের সাথে একসাথে গিয়ে টেইলারিংয়ে দিয়ে আসতে পারে।শায়লা ভাবলো, বাবা বেঁচে থাকলে আজ তার জীবনটা অন্যরকম হতো। শায়লা বড় মেয়ে, হয়তো তাকে নিয়েই ভাবনাটা আগে আসতো।
মাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে শায়লা নিজের ঘরে এলো।পাভেলের কথা খুব মনে পড়ছে!
অনার্সের সহপাঠী ছিল।প্রথম বছর থেকেই একটু একটু ভালোলাগা এগিয়ে যাচ্ছিল।
ফাইনাল ইয়ারে তার পূর্ণতাও এসেছিল।
শায়লার বাবার মৃত্যুতে পাভেল একেবারে পালটে গেলো। শায়লার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। শায়লার খোঁজ রাখা মানেই ভবিষ্যতে তার পরিবারের দায়িত্ব নেয়া।একটা শিক্ষিত ছেলের এমন ভাবনায় শায়লার মন ভেঙে যায়। আর শায়লাও পারিবারিক কারণে পড়াশুনাটা গুটিয়ে নেয়। একে একে আটটি বছর হারিয়ে যায় ওর জীবন থেকে।
চলবে....