অলিখিত শর্ত
(পর্ব২)
শায়লা শিহাব কথন
শামীমা আহমেদ
---লিফটে উঠে শিহাব লিফটম্যানকে ইশারায় টপফ্লোর দেখালো। শায়লা বেশ অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকালো!
---চলো একটু বসি।শিহাবের এমন কথায় শায়লা অজান্তেই মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিল।
আজ সবই অন্যরকম ঘটে যাচ্ছে!শায়লা বর্তমান অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিলো। টপফ্লোরে নেমে ওরা ক্যাফেতে বসলো। এখনো বিকেল সন্ধ্যার জমজমাট ভাবটি হয়নি।একটু ফাঁকাই আছে। ওরা বাইরের দিকের কিনারায় একটি টেবিল বেছে নিলো। সেখান থেকে চারপাশের রাস্তা,বাড়িঘর, ছোট ছোট মানুষের চলাচল শায়লা নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে দেখছিল। ওয়েটার, সার্ভিস বয়গুলো নিজেদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করে নিল ঈঙ্গিত ইশারায়। ওদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ওরা ঠিকই বুঝে যায় কারা কাপল,কারা স্রেফ ফ্রেন্ড আর কারা প্রেমিক প্রেমিকা জুটি আর কারা আসে ঘরকে ফাঁকি দিয়ে সুখী-অসুখীর হিসেব করতে।এসব ব্যাপার শিহাবকে খুব একটা ভাবালো বলে মনে হয় না।শায়লাও শিহাবের দিকেই মনযোগী হলো।
----শিহাব কথা বলে উঠলো।
শায়লা কী খাবে? মেনু চার্টটি এগিয়ে দিয়ে বললো,চয়েস করো।
শায়লা না সূচক ভঙ্গিতে বললো, না এসব নয়।জাস্ট লাঞ্চ করেই বেরিয়েছি। হালকা জুস বা কফি একটা হলেই হবে। শিহাব দু'কাপ কফির অর্ডার করে সানগ্লাসটা খুলে টেবিলে রেখে এবার শায়লার দিকে একটু তাকালো। শায়লা চমকে উঠল! ছেলেদেরও কি এত সুন্দর চোখ হতে পারে! তাইকি সে এতদিন আড়ালে ছিল। নিজেকে ভেবে নিল শায়লা,আজ বাসায় ফিরে আয়নায় নিজের চোখদুটো ভালো করে দেখবে।শিহাবের সাথে শায়লার পরিচয়ের প্রায় ছয় মাস হতে চললো তবুও শায়লার এখনো জড়তা কাটেনি। অবশ্য শিহাব ইচ্ছে করেই তা কাটতে দেয়নি।এমন কোন আবেগী কথা আজো হয়নি যে সম্পর্কটির একটি নাম দেয়া যায়!
শায়লা যেন কোন ভুল করে না বসে তাই এই দূরত্বটা বজায় রাখা।আর এটাও একটি অলিখিত শর্ত।কোন ভালোবাসার দৃষ্টিতে তার প্রতি তাকানো যাবে না।জাস্ট পরিচয় আর তা থাকবে বন্ধুত্ব আর দায়িত্ববোধ আর শুভকামনার ঘেরাটোপে। সেটাকে অতিক্রম করে কোন ভালোবাসার সম্পর্কের আভাস পেলেই শিহাব নিজেকে সরিয়ে নিবে চিরতরে।
শায়লার একার জীবনে অন্তত তাকে বুঝবার বা সময় দেবার একজন সঙ্গী পেয়েছে। তাই এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার লোভ সে সংবরণ করেছে। অবশ্য শায়লা বরাবরই খুব অল্পে সন্তুষ্ট একটি মেয়ে। তবুও এতটুকু পাওয়াও যেন তার জন্য এক চাতকিনীর চাওয়ায় এক আকাশ পাওয়া!
শিহাব জানতে চাইলো,কেমন আছো? শায়লা বেশ স্পষ্ট করেই বললো, ভালো আছি। যেমনি থাকুক না কেন, কষ্ট বিষন্নতা দিয়ে সময়টা নষ্ট করতে চাইলো না শায়লা।
পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিল সে,তুমি কেমন আছো শিহাব?
এই 'তুমি' করে ডাকতে অনুমতি পেতেও শায়লার লেগেছে প্রায় দুইমাস।শিহাবের মতে এই 'তুমি' ডাকে অন্যরকম চাওয়া পাওয়ার সম্পর্কে দাঁড়িয়ে যায় ।রাতারাতি তা এক সমুদ্র দূরত্ব কমিয়ে দেয়। অলিখিত শর্তে এটাও বেঁধে দেয়া আছে, তুমি করে বলায় কোন বিশেষ সুবিধা নেয়া যাবে না। বন্ধুত্বের নামে কল্পনায় কিছু ভেবে নেয়া যাবে না। শায়লা একে একে সব শর্তই মেনে নিয়েছে কে জানে সময় পেরুলে কখনো চাই কী তুইতেও চলে যেতে পারে---এমনটির আশায়।
কিছু ভাবছো কি?শিহাবের ডাকে শায়লা স্বাভাবিক হলো!
শিহাব জানালো সেও ভালো আছে। যদিও তার চোখমুখ বিষন্নতায় ছাওয়া। শিহাব বললো,বেশ কিছুদিন যাবৎ খুব ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে দেখা করার।তাইতো তুমি একবার বলাতেই রাজি হয়ে গেলাম। আসলে ইচ্ছে চাওয়া যদি খুব গভীরের হয় বিধাতা সেটায় নিরাশ করেন না। আজ যেন কথার খই ফুটেছে!শায়লা হাসিহাসি মুখে তা শুনে যাচ্ছে। কথার মাঝে ছেদ ঘটাচ্ছে না। শিহাব বলেই চলেছে, জানো,দিন শেষে যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরি কি একটা টান যেন পা দুটোকে টেনে বেঁধে রাখতে চায় এদিকটায়।খুব ইচ্ছে হয় তোমায় কল করি, আসতে বলি, দেখা করি,কথা বলি,বসে একটু সময় কাটাই। কিন্তু সবকিছুই তো সাময়িক। এতে তো একেবারে সবকিছু ধুয়ে যাবে না। তাইতো যেমন দিন যাচ্ছে সেভাবেই বিকেল রাত্রি কাটুক তেমনটিই মেনে নেই। ভাগ্যিস তোমার সাথে পরিচয় আছে নয়তো,
নয়তো কী? শায়লা এবার থামিয়ে দিলো।যেন খুব গুরুত্ব নিয়ে ভেবে শিহাব উত্তরটা দেয়।
নয়তো, নয়তো রিশতিনার স্মৃতিতাড়িত হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় সময় কাটতো।
এভাবে স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুরই নামান্তর। তোমাকে নতুন করে সব সাজাতে হবে শিহাব।শায়লা কথার এদিকটায় গেলেই শিহাব অচেনা হয়ে উঠে।শায়লার মন্তব্য, কথা কোন কিছুই কানে তোলে না।নিজের ভেতর আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এজন্যই কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে শায়লার সাথে দেখা করা।শায়লাও সীমানার গন্ডি পেরোয় না কখনোই।কারণ শায়লা শিহাবকে, শিহাবের একাকীত্বটাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আর দেখবেই না বা কেনো, শিহাবের জীবনের আইডোলজিটা শায়লাকে ভীষণ আকৃষ্ট করে। এ যুগে এ সময়ে এমন সুন্দর আচরণের মানুষ পাওয়া ভাগ্যই বটে!
---কফি চলে এলো। কফিতে চুমুক দিয়ে শিহাব জানতে চাইলো,কানাডার খবর কী?
শায়লা হঠাৎ যেন নড়েচড়ে বসলো।এতক্ষণ শিহাবের জগতে ডুবে ছিল।নিজেরো যে একটা জীবন আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিল।
শায়লারও সেই একই উত্তর।চেস্টা চলছে।
নতুন কোন খবর শুনতে পারলে শিহাব যেন একটু স্বস্তি পেতো।
শিহাব শায়লা দুজন দুজনার দিকে তাকালো।
ভেতরে ভেতরে দুজনার একই সুর বাজে।
কিছু প্রকাশের কঠোরতায় তা বাকহীন।দু'টি নীড়হারা পাখি দুজনার কাছে আশ্রয় খোঁজে।কিন্তু কেউ প্রকাশ করে না তা অলিখিত শর্তকে ডিঙিয়ে।
শায়লার ফোন বেজে উঠলো। মায়ের ফোন। ফিরতে হবে। শিহাব বিল চুকিয়ে উঠে দাঁড়াল।কোন রকম অনুরোধে আরেকটু বেশি সময় থাকার জন্য বলবে না,, শায়লা তা ভালো করেই জানে।আর যেখানে মায়ের ফোন! আর কোন প্রশ্নই উঠেনা।শিহাব যথারীতি শপিং ব্যাগগুলো আবার হাতে নিয়ে লিফটে নেমে শায়লাকে রিকশা অব্দি এগিয়ে দিলো।
রিকশা এগিয়ে চললো। দুজনার মাঝে পথের দূরত্ব বাড়লো কিন্তু আজ বিকেলের সময়টায়
যেন দুজনার মনের দূরত্ব অনেকখানি ঘুচল।
---আপা,কোথায় নামবেন? রিকশাওয়ালার জিজ্ঞাসায় শায়লা নিজের মাঝে ফিরে এলো!
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much