১৮ এপ্রিল ২০২২

কবি মহুয়া চক্রবর্তী এর কবিতা "পরিচয়"





পরিচয়
মহুয়া চক্রবর্তী 

আমি কে কিবা আমার পরিচয়
সারাজীবন ভেবেই মরলাম 
কি আছে আমার বিষয়-আশয়।
এই মানবজমি জ্ঞানের অভাবে 
অজ্ঞানেতেই রয়ে গেল
তিল তিল করে এবার 
যাবার সময় যে ঘনিয়ে এলো।

যতই আমি আমার আমিকে 
খুজেঁ মরি শত মানুষের ভিড়ে
ততোই আজ একাকিত্ত এসে
ভিড় করে আমার মনের ঘরে।
আমি যেন এক আঁধারের পথে 
হেটে চলেছি বহুকাল ধরে
আজ আর কেউ সঙ্গী নেই 
আমার হাতদুটো ধরবার। 

নিজের অহং ত্যাগ করো একটি বার ভাবো
টাকা-পয়সার রূপের ছটা কিছুইতো স্থায়ী নয়
একদিন এই মানব দেহ মাটিতেই বিলীন হয়। 

মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেছিলেম আমি
আজ মান আর হুশ ভুলে
আমার আমি'তে মত্ত হয়েছি আমি। 

জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালো এবার
নিজের মনের মাঝে,
প্রভুর নাম স্মরণ করো
ও মন তুমি সকাল সাঁঝে।
তবেই তুমি হবে পার এই ভবসিন্ধু হতে
এক টুকরো সাদা কাপড় ছাড়া
কিছুই যে যাবেনা তোমার সাথে।

মমতা রায় চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৫৬




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১৫৬
সমস্যা
মমতা রায় চৌধুরী



বাড়িতে ফিরে রেখার তখনো ঘোর কাটেনি। উত্তেজনা টা যেন রয়েই গেছে। মনোজ বলল'উফ কি ভালো খেলাম রিম্পাদির বাড়ি।'
রেখা কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না বলে মনোজ আবার বলল'কি ভালো খেলাম বলো রিম্পাদির বাড়ি?'
হ্যাঁ, রিম্পা দি এরকমই।
'বড়ো আন্তরিক তাই না?'
'একদমই তাই।'
'মানুষটাই অন্যরকম।'
রেখা হঠাৎ করে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে উঠলো
"ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..।'
বাববা ,রাত্রিতে তুমি হঠাৎ  গান শুরু করলে যে?'
'মনেতে পুলক তাই মশাই।'
'ও তাই?'বলেই মনোজ রেখার দিকে এগোতে লাগলো।
রেখা বলল' ভালো হবেনা কিন্তু। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।"
মনোজ বললো কেন কেন কি সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, ঝরঝরে মেজাজ, খেয়ালী মন বলেই রেখাকে বাহু বন্ধনে জড়াল।
রেখা বলল-'হঠাত তোমারই  বা মনে এত প্রেম জেগে উঠল কেন?'
মনোজ হেসে রেখার গাল দুটোকে ধরে একটু আদর করে দিয়ে বলল'বসন্তের মধুমাস না তাই?'
'হ্যাঁ ,হ্যাঁ বুঝেছি।'
'বসন্ত চলে যেতে বসেছে বুঝেছ মশাই।'
'সে যাক। তবে আমাদের কাছে বসন্ত ।'ফুল ফুটুক না ফুটুক ,আজ বসন্ত'।
বসন্তের একটা গান গাও।
তাহলে তুমিও গলা মেলাও।
'   ...তোমার অশোকে কিংশুকে অলক্ষ্য রং লাগল আমার অকারণের সুখে…।'

হঠাৎ একটা কিসের' কিউ, কিউ 'আওয়াজে রেখা গান বন্ধ করে দিল। মনোজ ইশারায় বললো কি হলো বন্ধ করলে বেশ তো চলছিল।'
রেখা আঙ্গুল দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বললো 'কেমন আওয়াজ পাচ্ছো না কিউ কিউ কিউ?'
'কই কোথায় আওয়াজ? তুমি একটু যেন সব কিছুতে বেশি শুনছো। কর্নন্দ্রিয়  খুব ভালো কাজ করছে।'
'তুমি মজা করছ ভালো করে কান খাড়া করে শোনো?'
মনোজ অনেকক্ষণ কান খাড়া করে শুনে বলে 'হ্যাঁ তাই তো ।চলো, চলো ,চলো গিয়ে দরজা খুলি।'
কলাপসিবল গেট খুলল, তারপর দরজা 
খুলল ।দেখছে হ্যাঁ বাচ্চাগুলো ও রকম আওয়াজ করছে।'
রেখা বলল 'ওরে দুষ্টুরা ,বাচ্চাদের আজকে ভালো করে আদর করা হয়নি বুঝেছো ?আদর খাবার জন্য এরকম করছে?'
মনোজ বলল' খিদে পেয়েছে।'
'ঠিক আছে তুমি বিস্কিট দাও দেখি 
তারপর 'আওয়াজ করে কিনা।
'হয় তো খিদেও পেয়েছে।'
মনোজ ঘর থেকে বিস্কিট এনে দিল। ওরা খেলো তারপর রেখা মনোজ যখন দরজা লাগিয়ে  দিচ্ছে তখন আবার ' কিউ , কিউ, কিউ 'আওয়াজ করছে।'
'দেখলে আবার আওয়াজ করছে।'
'ওমা তাই তো !কি অবাক কান্ড।'
'এবার দেখ তো ওদের আদর করে।'
শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে লাগলো।
এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের খুব ভালো করে আদর করলো।
তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকলো।
মনোজ বললো 'ঠিকই তো দেখো এখন আর কোন আওয়াজ নেই গো?'
রেখা বলল' এদের ছেড়ে আমরা কোথায় ও যেতে পারবো?'
'একদমই তাই।'
তারপর মনোজ বড় একটা হাই তুলে বলল
' না গো খুব ঘুম পাচ্ছে?'
'সেকি রাতে কিছু খাবে না?'
মনোজ পেটটাকে দেখিয়ে বলল
' যা খাইয়ে দিয়েছে? এরপর আর কোনো ইচ্ছে নেই?'
'তুমি তো ঘুমিয়ে পড়লেই  হল ।আমার তো আর ঘুমোলে হবে না ।কালকে স্কুলে যাব। কালকের রান্নার সবজিগুলো  কেটে রেডি করে রাখতে হবে।'
'তুমি ভুল করেছো মাসিকে বললেই পারতে ,মাসি কেটে রেখে দিত।'
'সেটাই ভুল হয়ে গেছে।'
'মাঝে মাঝে পরামর্শগুলো নেবে আমার কাছ থেকে বুঝলে?'
'হুঁ'
' না যাই রান্নাঘরে।'
রেখা রান্নাঘরে গেল ফ্রিজটা খুলল।
তখন মনোজ বলল' শোনো কালকে হালকা কিছু রান্না করবে । রিচ খাবার করবে না।'
'তাহলে কি খাবে ?'ফ্রিজ থেকে সবজি বের করতে করতে বলল রেখা।
'ওই তো ডাল করো তাহলেই হবে।'
রেখা হাসতে হাসতে বলল' বাহ শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেবে, দারুন ব্যাপার তো?'
রেখা বুঝে নিল এবার আপন-মনে রেখা সবজি কাটতে বসল।
"হ্যাঁ ,মুগডাল করবে মাছের মাথা তো আছেই ফ্রিজে। তার সঙ্গে বেগুন ভাজা আর পাট শাকের ঝোল।'
এমন সময় রেখার ফোন বেজে উঠল"প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তর লজ্জা….।'
মনোজ ঘর থেকে চেঁচাতে লাগল' রেখা রেখা রেখা রেখা.আ .আ .আ….।'
রেখা সাড়া দিল 'কি হয়েছে?'
'তোমার ফোনের কান্না।'
'কে করেছে?'
"ধেত্ততেরি 'আমি জানি না ।তুমি এসে দেখো।'
রেখা বেগুন কাটছিল বেগুন টা নামিয়ে রেখে আস্ তে আস তে  আবার সেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো 'প্রাণ চায় চক্ষু না….।'
রেখা এসে ফোনটা ধরল বলল 'হ্যালো'।
'কিরে পৌছে গেছিস?'
'ও রিম্পা দি সরি গো ।তোমাকে বলতে ভুলে গেছি অনেকক্ষণ পৌছে গেছি।'
'ঠিক আছে ,ঠিক আছে ।ওইটাই খবর নেবার জন্য । ভালো থাকিস ।শুভরাত্রি।'
'হ্যাঁ গো ,তুমিও ভালো থেকো আর তোমার বাড়ির খাবার খেয়ে তো কতবার মনোজ নাম করছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই ।'
রিম্পা দি হো হো হো করে হেসে উঠল আর বলল 'ওকে আবার একদিন আসতে বলবি।'
'হুঁ''
শুভরাত্রি।
ফোনটা কেটে দিয়ে রেখা রান্না ঘরের দিকে যাবে বলে পা টা  বাড়িয়েছে ,ঠিক তখন আবার ফোন বেজে উঠল।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল ''হ্যালো'
'আমি বড়দি বলছি।'
'হ্যাঁ বলুন দিদি। আসলে আপনার  যে নম্বরটা সেভ করা আছে সেটা থেকে করেননি তো…।'
'হ্যাঁ ,আমি অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন করছি 
তোমার শরীর ঠিক আছে তো?'
'হ্যাঁ দিদি তবে একটু টায়ার্ড আছি।'
'কেন বলুন তো দিদি।'
'না পরপর দুদিন স্কুলে আসলে না। জানালে না।'
'আসলে দিদি ,হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছিল তাই দেশের বাড়িতে গেছিলাম।'
'ও ওখানে তো তোমার কাকু কাকিমা থাকেন তাই না?  সবাই ভাল আছেন তো?'
'হ্যাঁ ,ওই মোটামুটি আছেন দিদি।'
'আর আজকে স্কুলে আসলে না কেনো?'
'আসলে দিদি আজকে আমার একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল ।ওখান থেকে আমাকে একটা সম্মাননা দেয়া হয়েছে, আমার লেখার জন্য।'
বড়দি বললেন 'কনগ্রাচুলেশন্স।'
'থ্যাংক ইউ দিদি।'
'তুমি এভাবে আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যাও আরো সম্মাননা তোমার ভান্ডারে আসুক। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।'
'থ্যাংক ইউ দিদি।'
'রেখা একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমাকে আমি ফোনটা করেছি কালকে যদি না আসো তাহলে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হবে।'
"কি দিদি?'
'আসলে একটা ওয়ার্কশপ আছে সেটা অনিন্দিতা ই জেদ করেছিল যাবে  তাই ওর নামটা পাঠানো হয়েছিল কিন্তু ও কালকে স্কুলে আসেনি ।আজকে সন্ধ্যের দিকে ফোন করে আমাকে জানালো ওর বাচ্চাকে নিয়ে একটু প্রবলেম আছে। তাই ও অ্যাটেন্ড করতে পারবে না।'
'কি হয়েছে ওর বাচ্চার দিদি।'
'আর বোলো না ।ও তো কিছুদিন যাবত এসেই বলছিলো যে ওর বাচ্চা কথা বলছে না।'
'কেন তুমি ব্যাপারটা জানতে না?'
'আপনি তো জানেন দিদি, ও কি কারনে আমার প্রতি এতটা রাগ ,আমি জানিনা ।আমার সামনেও কখনো ওর ফ্যামিলির কথা আর বলে না ।আর আমিও কোন ইন্টারেস্ট দেখাই না।'
'হ্যাঁ ওর বাচ্চার দু'বছর কমপ্লিট হয়ে গেছে আড়াই বছর হয়ে গেছে এখন অব্দি কোন কথা বলে না।
কিন্তু ও সব বোঝে নাকি?'
'এইরকম একটা ভাষা ভাষা কথা শুনছিলাম তবে স্পষ্ট করে আমি কিছু জানি না দিদি।'
"ওইটা নিয়েই এখন নাকি ওর কি মনে হয়েছে ওর হাজবেন্ড আর ও মিলে ডিসিশন নিয়ে একটা স্কুলে ভর্তি করেছে।'
"বাহ ,ভাল করেছে তো দিদি।'
'হ্যাঁ সে তো ভালো করেছে কিন্তু ওখানে আর একটা কান্ড হয়েছে। ক'দিন হয়েছে তিন চারদিন স্কুলে গেছে এর মধ্যে ও নাকি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মারামারি করেছে।
গত পরশু দিন নাকি একটা বাচ্চাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।'
'ও বাবা কি সাংঘাতিক?'
'স্বাভাবিক ভাবেই প্রিন্সিপাল কল করেছেন।'
'ও বাবা তাই নাকি?'
'আর বোলো না'
'প্রিন্সিপাল কল করার পর কি বলছেন দিদি?'
'ওনারা বলছেন বাচ্চা কে অন্য জায়গায় ভর্তি করিয়ে দিতে ।এই স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে।'
'তাড়িয়ে 'দেয়া হবে এই শব্দ টা কখনো ব্যবহার করতে পারেন?'
'হ্যাঁ ও দুঃখ করে কাঁদছিল আমার কাছে। তখন 'আমি বললাম এটা তো ওনারা বলতে পারেন না।'
এই সমস্যা থেকে ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।'
'তা আমি বললাম  ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই ।তোর বাচ্চাতো এমনি সুস্থ-স্বাভাবিক সবই আছে অত চিন্তা করিস না বরং বলে আসতে পারতিস  সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার 
রয়েছে ।কখনো বলতে পারেন না যে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবো ,সে যদি লেখাপড়া শিখতে চায়।'
"তা তো ঠিকই দিদি।'
'এইরকম একটা সমস্যা চলছে।'
ওকে বেশি জোরজবস্তি করলাম না ,. ও একটা মেন্টাল প্রেসারে আছে বাচ্চাকে নিয়ে।'
'তাহলে শেষ পর্যন্ত কি হলো দিদি?'
'ওকে স্পিচ থেরাপির ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললাম।'
'বাহ দারুন সিদ্ধান্ত।'
'এখন দেখা যাক ও কি করে?'
'হ্যাঁ ওর একবার স্পিচ থেরাপির সঙ্গে কথা বলা উচিত আর একবার এমনি ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।'
'যাই হোক তা কালকে তুমি আসছো তো সিওর?'
'এখন অব্দি তো ঠিকই আছে।'
'ব্যস এটুকু হলেই যথেষ্ট  আমি তো তোমাকে
 চিনি '।বড়দি হাসতে হাসতে বললেন।
'তাছাড়া তুমি আসলে কোন সমস্যা হবে না ।আর আমি জানি  তুমি সমস্যায় ফেলবে ও না।'
রেখা বললেন 'আমি চেষ্টা করি দিদি।'
'ব্যস ,এই চেষ্টাটাই রেখো সব সময়।'

কবি সেলিম সেখ এর কবিতা "মায়ের কোল"




মায়ের কোল
সেলিম সেখ

ওই দেখো খোকন সোনা
মায়ের কোলে বসে,
বলছে সে অনেক কিছু
আপন-মনে খুশে।

মিষ্টি মধুর চেহারা তার
জুড়াতো মায়ের কোল,
মা হীনা আঁখিতে তার
আসতো দুখের জল।

মায়ের কোলে মাথা রেখে
পেত সে চিরসুখ,
মা যে নেই এখন
রয়ে গেছে তাই দুখ।

দুঃখ ভরা জীবন নিয়ে 
চলে সমুখ পানে, 
মা হীনা জীবন যে তার 
দুর্বিষহ তা জানে।

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৯৩





ধারাবাহিক উপন্যাস 


শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯৩)
শামীমা আহমেদ 

খুবই অনিচ্ছা সত্বেও শিহাব দোতালার
হাসান সাহেবকে তার ঘরে প্রবেশের জন্য স্বাগত জানালো। যদিও এই মূহুর্তে শিহাবের মনের সবকিছু ভীষণ এলোমেলো  হয়ে আছে তবুও সামাজিকতা মেনে হাসান সাহেবের সাথে কিছু কথা চালিয়ে যেতে হবে। বিল্লাল খাবারের ট্রে  ডাইনিং টেবিলে রাখলো।  হাসান সাহেব বিল্লালকে তার  খাবার নেয়ার জন্য বাসায় যেতে বললে বিল্লাল বিদায় হলো। এবার শিহাব, হাসান সাহেবকে উদেশ্য করে বললেন, এসবের কী দরকার ছিলো ?  আর আমি একা মানুষের জন্য এত খাবার !
এবার যেন হাসান সাহেব তার মনোবাসনা প্রকাশের একটা মওকা পেলো। খুবই বিগলিতভাবে বললেন, না,  না,এ আর এমন কি।আজকের সামান্য আয়োজন। প্রতিদিন তো আর এমনটা হয়না।
সামান্য আয়োজন ! শিহাব অবাক হলো, এই যদি হয় সামান্য আয়োজন তবে অসামান্য বলতে কী বুঝবো ? শিহাব শুনেছে,
হাসান সাহেব একটা ওষুধ কোম্পানীতে চাকরী করেন।স্বল্প বেতনভোগী হলেও নানান হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সাথে তার দারুন সখ্যতা।সবার সাথেই কমিশন পাইয়ে দেয়ার আর নিজের পকেটে ভরার লাইনঘাট তার ভালই জানা। ছেলেকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছে যা ভীষণ ব্যয়বহুল।
শিহাব আরাফের কথাও একঝলক ভেবে নিলো।আরাফকেও স্কুলে দিতে হবে।আরাফের তিন শেষ হয়ে চা'রে পড়েছে।
হাসান সাহেব কিছু একটা বলার জন্য যেন উসখুস করছেন। কিন্তু অনেকরাত হয়ে গেছে।শিহাব এখনো খায়নি তাই কথা শুরুও করতে পারছে না। কিন্তু শিহাব বুঝতে পারছে এমনি এমনি তিনি তার বাসায় আসেননি।নিশ্চয়ই কিছু একটা বলার অভিপ্রায়ে এত কিছুর অবতারণা। 
শিহাব তাকে সহজ করতে বলে উঠলো, হাসান সাহেব, কিছু বলবেন ?
না না তেমন কিছু না। আপনি খেয়ে নিন। আমি ড্রইং রুমে বসছি। বলেই তিনি উঠতে চাইলেন। শিহাব বললো,না,এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যায় ভাবী অনেক নাস্তা করিয়েছে। সেগুলোতে এখনও পেট ভরে আছে। 
তক্ষুনি যেন হাসান সাহেবের শিহাবের সেই কথা মনে পড়ে গেলো, আচ্ছা তখন আপনি বলছিলেন আপনার পরিবারের কে যেন অসুস্থ ? আপনার মা ? 
না, না,  আমার মা ভালো আছেন। শিহাব যতই কথা সংক্ষিপ্ত করতে চাইছেন কিন্তু হাসান সাহেব বারবার আঠার মত লেগে থাকতে চাইছেন।শিহাব বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তার এখানে আসা।
তাহলে কে অসুস্থ ? আপনার বাবা ?
তার আবার প্রশ্ন। 
এবার শিহাব তাকে শান্ত করতে জানালো, আমার ছেলে আরাফ। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কপালে কেটে গেছে। হাসপাতালে আছে।
শুনে হাসান সাহেব ভীষণ ব্যথিত হলেন। আহা ৷ এত ছোট বাচ্চাটা। তা শিহাব সাহেব বাচ্চার মাকে কি খবর দিয়েছেন ?  শুনেছি উনি দেশের বাইরে থাকেন। শিহাব বুঝতে পারলো, সব খবরই সে রাখে তাহলে।
শিহাব বেশ স্পষ্ট করেই বললো, না জানাইনি।
এবার যেন তার আফসোসের পাল্লা বোঝাই হলো।আহা,মা ছাড়া বাচ্চাটা এমন ব্যথা পেলো। তা আমি শুনেছি, উনি এখানে এসেছিলেন। দুদিন থেকে চলেও গেছেন। আপনি নাকি তাকে চলে যেতে বলেছেন।
শিহাব এবার ভীষণ অবেক হলো!ঘরের কথা বাইরে জানলো কিভাবে ?
শিহাবের মনে কৌতুহল হতেই সে সন্দিগ্ধ মনে জানতে চাইলো, আপনি কিভাবে জানলেন এইকথা ? 
হাসান সাহেব এবার যেন ধরা পড়ে গেছেন এমন অভিব্যক্তি দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে তার স্ত্রীর উপর তা চাপিয়ে দিলেন,, ইয়ে মানে,আপনার ভাবী বলেছে । যাওয়ার সময় আপনার মিসেস, বিল্লালকে বলে গেছে,উনি একেবারেই চলে যাচ্ছেন।বিল্লাল যেন তার স্যারকে দেখে রাখেন।  এবার শিহাব বুঝতে পারলো,তাহলে বিল্লালই হচ্ছে সবকিছুর মেসেঞ্জার। শিহাব বুঝতে পারছে না, অন্যের ব্যাপারে মানুষের কেন এত কৌতুহল ! 
এবার হাসান সাহেব তার মনের কথাটা বলার জন্য যেন উপযুক্ত যুক্তিটা খুঁজে পেলেন। তিনি অকপটে বলেই ফেললেন, দেখুন আপনার স্ত্রী এত ছোট একটা বাচ্চা রেখে চলে গেছেন,আপনিও একা একা কষ্ট করছেন। এভাবে আর কতদিন থাকা যায় বলুন। ঘর সংসার তো করতে হয়। বাচ্চাটাকেও তাহলে কাছে এনে রাখতে পারতেন। শিহাব হাসান সাহেবের  কথায় বেশ অবাক হচ্ছেন ! মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে এ দেশের  মানুষ অনুমতি নেবারও প্রয়োজন মনে করে না।
হাসান সাহেব বলেই যাচ্ছেন, তা আপনার ভালোর জন্যই একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম।যদি সহজভাবে নেন তো বলতে পারি।
শিহাবের প্রান্ত থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে চললেন,আমার শ্যালিকা চৈতীকে তো একটু আগেই দেখেছেন।
শিহাব কিছুক্ষন আগে হাসান সাহেবের দরজায় কথা বলার সময় একটি মেয়েকে দেখেছিল। তাহলে তার নাম চৈতী ! 
শিহাবের আর বুঝতে কিছু বাকী রইল না। হাসান সাহেবের আগমনের হেতু আর ইনিয়ে বিনিয়ে এত কিছু বলার পেছনের কারণ।
শিহাব ভাবলো, ঐটুকু মেয়ে মাত্র মাস্টার্স পড়ছে কেমন করে এরা আমার সাথে এমন সম্পর্ক ভাবে ? শিহাবের ভাবনা শিহাবের মনের ভেতরেই রইল।
হাসান সাহেব বললেন,নাহ,এখুনি কিছু জানাতে হবে না।আপনি সময় নেন। হাসান সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে  বললেন, বলছিলাম কি,ওরা দুইবোন, এক বিল্ডিংয়ে থাকলে ভালোই হতো।বাপ মা মরা ওরা এই দুটি বোন। আর আপনাকেও আমি ভায়রা  করে নিতে পারলে আমি খুবই খুশী হতাম! আপনাকে আমার খুবই পছন্দ শিহাব সাহেব।এতদিন হয় আপনি এখানে আছেন কোনদিন কোন খারাপ  কিছু  শুনিনি। এতসব কথা বলে এবার হাসান সাহেব শিহাবের ফ্ল্যাট থেকে বেরুনোর জন্য আগালো।পরক্ষণেই তিনি তার শ্যালিকার  দুইটি  থ্রী আর সাইজের রঙিন ছবি শিহাবের বিছানায় বালিশের পাশে রেখে গেলেন। শিহাব বাধা দিয়ে কিছু বলতে চাইতেই হাসান সাহেব শিহাবের বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। শিহাব ভাবলো,এতো দেখছি আরেক মহা যন্ত্রণা ! শিহাব এগিয়ে গিয়ে ছবি দুটো হাতে নিলো। একটি ছবিতে  ডাগর চোখের  মেয়েটি রঙিন ঝলমলে শাড়িতে  তার কলেজের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে, আরেকটি ছবিতে ঘরে সোফায় বড় বড় চুল ছেড়ে গালে হাত দেয়া ভঙ্গিমায় মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শিহাব মনে মনে ভাবলো, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও আজো মেয়েদের বিয়ের পাত্র খোঁজে সেই সনাতন প্রথা রয়ে গেছে। শিহাব ছবি দুটো উল্টো করে তার সাইড টেবিলে রেখে দিলো। তবে একবার ভাবলো, এখুনি বিল্লালকে ডেকে ছবি দুটো ফেরত পাঠাতে।কিন্তু  এতে তারা অপমানিত বোধ করতে পারেন। কাল সকালেই তবে ফিরিয়ে দেয়া হবে।  শিহাব ছবি দুটো খাটের  সাইড টেবিলে রাখতেই তার মোবাইলের দিকে চোখ পড়লো। হাতে নিতেই দেখতে পেলো,মোবাইল একেবারে ডার্ক এন্ড ডেড হয়ে আছে। তার মনে পড়লো হাসপাতালে থাকতেই ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এসে আর হাসান সাহেবের জন্য চার্জে দেয়ার একটু  সময় মিলেনি। আরাফেরও খবর নেয়া হয়নি।শিহাব দ্রুতই মোবাইল চার্জে লাগিয়ে দিলো। টেবিলের খাবার সব ফ্রিজে তুলে রেখে সময় দেখলো,রাত বারোটা। শিহাব একটা সিগারেট  ধরিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।শায়লার কথা খুব  মনে পড়তে লাগলো। শায়লা নিশ্চয়ই তার স্বামীর সাথে এখন গল্প করছে। কিন্তু কেমন করে শায়লা তাকে এভাবে ভুলে আছে? এ কথা ভেবে শিহাব ভেতরে অস্থিরতায় খুব ঘন ঘন সিগারেটে টান দিতে লাগলো।
রাহাত অনেকবার ফোন করেও  শিহাবের মোবাইলে কল পৌছাতে পারেনি।বারবার তা বন্ধ পাচ্ছিল। রাহাত একথা শায়লাকে জানাতে শায়লা ভীষণ চিন্তিত হলো।সে নিজেও কয়েকবার ট্রাই করে শিহাবের মোবাইল বন্ধ পেলো। শিহাব বাইক চালিয়ে চলাচল করে। পথে কিছু হলোনাতো আবার ?
শায়লা অজানা আশংকায় কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে মনে মনে এমনটি ভাবছিল। বুবলী অনেক অনুরোধ করে শায়লার মুখে একটু খাবার দিয়েছে। শায়লা তার নিজের ঘরে সাজানো খাটের এক কিনারায় শুয়ে রইল। দেয়াল ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখলো রাত্রি বারোটা। শায়লা ভীষণ অবাক হলো, আজ দুপুরের পর থেকে শিহাব তার সাথে একেবারেই যোগাযোগে নেই ।  তবে কী আরাফ বেশী অসুস্থ হলো ? 
শায়লা কিছুই বুঝতে পারছে না কি করবে ? সারাটাদিন নানান ঘটন অঘটনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে।কিন্তু এমনি ভাবে শিহাব কোনদিনই নীরব থাকেনি। শায়লা শিহাবের অফিস থেকে পাঠানো শিহাবের কালো শার্ট পরা সেই সেল্ফিটির দিকে একমনে তাকিয়ে রইল।


চলবে...