উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৫৬
সমস্যা
মমতা রায় চৌধুরী
বাড়িতে ফিরে রেখার তখনো ঘোর কাটেনি। উত্তেজনা টা যেন রয়েই গেছে। মনোজ বলল'উফ কি ভালো খেলাম রিম্পাদির বাড়ি।'
রেখা কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না বলে মনোজ আবার বলল'কি ভালো খেলাম বলো রিম্পাদির বাড়ি?'
হ্যাঁ, রিম্পা দি এরকমই।
'বড়ো আন্তরিক তাই না?'
'একদমই তাই।'
'মানুষটাই অন্যরকম।'
রেখা হঠাৎ করে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে উঠলো
"ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..।'
বাববা ,রাত্রিতে তুমি হঠাৎ গান শুরু করলে যে?'
'মনেতে পুলক তাই মশাই।'
'ও তাই?'বলেই মনোজ রেখার দিকে এগোতে লাগলো।
রেখা বলল' ভালো হবেনা কিন্তু। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।"
মনোজ বললো কেন কেন কি সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, ঝরঝরে মেজাজ, খেয়ালী মন বলেই রেখাকে বাহু বন্ধনে জড়াল।
রেখা বলল-'হঠাত তোমারই বা মনে এত প্রেম জেগে উঠল কেন?'
মনোজ হেসে রেখার গাল দুটোকে ধরে একটু আদর করে দিয়ে বলল'বসন্তের মধুমাস না তাই?'
'হ্যাঁ ,হ্যাঁ বুঝেছি।'
'বসন্ত চলে যেতে বসেছে বুঝেছ মশাই।'
'সে যাক। তবে আমাদের কাছে বসন্ত ।'ফুল ফুটুক না ফুটুক ,আজ বসন্ত'।
বসন্তের একটা গান গাও।
তাহলে তুমিও গলা মেলাও।
' ...তোমার অশোকে কিংশুকে অলক্ষ্য রং লাগল আমার অকারণের সুখে…।'
হঠাৎ একটা কিসের' কিউ, কিউ 'আওয়াজে রেখা গান বন্ধ করে দিল। মনোজ ইশারায় বললো কি হলো বন্ধ করলে বেশ তো চলছিল।'
রেখা আঙ্গুল দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বললো 'কেমন আওয়াজ পাচ্ছো না কিউ কিউ কিউ?'
'কই কোথায় আওয়াজ? তুমি একটু যেন সব কিছুতে বেশি শুনছো। কর্নন্দ্রিয় খুব ভালো কাজ করছে।'
'তুমি মজা করছ ভালো করে কান খাড়া করে শোনো?'
মনোজ অনেকক্ষণ কান খাড়া করে শুনে বলে 'হ্যাঁ তাই তো ।চলো, চলো ,চলো গিয়ে দরজা খুলি।'
কলাপসিবল গেট খুলল, তারপর দরজা
খুলল ।দেখছে হ্যাঁ বাচ্চাগুলো ও রকম আওয়াজ করছে।'
রেখা বলল 'ওরে দুষ্টুরা ,বাচ্চাদের আজকে ভালো করে আদর করা হয়নি বুঝেছো ?আদর খাবার জন্য এরকম করছে?'
মনোজ বলল' খিদে পেয়েছে।'
'ঠিক আছে তুমি বিস্কিট দাও দেখি
তারপর 'আওয়াজ করে কিনা।
'হয় তো খিদেও পেয়েছে।'
মনোজ ঘর থেকে বিস্কিট এনে দিল। ওরা খেলো তারপর রেখা মনোজ যখন দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে তখন আবার ' কিউ , কিউ, কিউ 'আওয়াজ করছে।'
'দেখলে আবার আওয়াজ করছে।'
'ওমা তাই তো !কি অবাক কান্ড।'
'এবার দেখ তো ওদের আদর করে।'
শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে লাগলো।
এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের খুব ভালো করে আদর করলো।
তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকলো।
মনোজ বললো 'ঠিকই তো দেখো এখন আর কোন আওয়াজ নেই গো?'
রেখা বলল' এদের ছেড়ে আমরা কোথায় ও যেতে পারবো?'
'একদমই তাই।'
তারপর মনোজ বড় একটা হাই তুলে বলল
' না গো খুব ঘুম পাচ্ছে?'
'সেকি রাতে কিছু খাবে না?'
মনোজ পেটটাকে দেখিয়ে বলল
' যা খাইয়ে দিয়েছে? এরপর আর কোনো ইচ্ছে নেই?'
'তুমি তো ঘুমিয়ে পড়লেই হল ।আমার তো আর ঘুমোলে হবে না ।কালকে স্কুলে যাব। কালকের রান্নার সবজিগুলো কেটে রেডি করে রাখতে হবে।'
'তুমি ভুল করেছো মাসিকে বললেই পারতে ,মাসি কেটে রেখে দিত।'
'সেটাই ভুল হয়ে গেছে।'
'মাঝে মাঝে পরামর্শগুলো নেবে আমার কাছ থেকে বুঝলে?'
'হুঁ'
' না যাই রান্নাঘরে।'
রেখা রান্নাঘরে গেল ফ্রিজটা খুলল।
তখন মনোজ বলল' শোনো কালকে হালকা কিছু রান্না করবে । রিচ খাবার করবে না।'
'তাহলে কি খাবে ?'ফ্রিজ থেকে সবজি বের করতে করতে বলল রেখা।
'ওই তো ডাল করো তাহলেই হবে।'
রেখা হাসতে হাসতে বলল' বাহ শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেবে, দারুন ব্যাপার তো?'
রেখা বুঝে নিল এবার আপন-মনে রেখা সবজি কাটতে বসল।
"হ্যাঁ ,মুগডাল করবে মাছের মাথা তো আছেই ফ্রিজে। তার সঙ্গে বেগুন ভাজা আর পাট শাকের ঝোল।'
এমন সময় রেখার ফোন বেজে উঠল"প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তর লজ্জা….।'
মনোজ ঘর থেকে চেঁচাতে লাগল' রেখা রেখা রেখা রেখা.আ .আ .আ….।'
রেখা সাড়া দিল 'কি হয়েছে?'
'তোমার ফোনের কান্না।'
'কে করেছে?'
"ধেত্ততেরি 'আমি জানি না ।তুমি এসে দেখো।'
রেখা বেগুন কাটছিল বেগুন টা নামিয়ে রেখে আস্ তে আস তে আবার সেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো 'প্রাণ চায় চক্ষু না….।'
রেখা এসে ফোনটা ধরল বলল 'হ্যালো'।
'কিরে পৌছে গেছিস?'
'ও রিম্পা দি সরি গো ।তোমাকে বলতে ভুলে গেছি অনেকক্ষণ পৌছে গেছি।'
'ঠিক আছে ,ঠিক আছে ।ওইটাই খবর নেবার জন্য । ভালো থাকিস ।শুভরাত্রি।'
'হ্যাঁ গো ,তুমিও ভালো থেকো আর তোমার বাড়ির খাবার খেয়ে তো কতবার মনোজ নাম করছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই ।'
রিম্পা দি হো হো হো করে হেসে উঠল আর বলল 'ওকে আবার একদিন আসতে বলবি।'
'হুঁ''
শুভরাত্রি।
ফোনটা কেটে দিয়ে রেখা রান্না ঘরের দিকে যাবে বলে পা টা বাড়িয়েছে ,ঠিক তখন আবার ফোন বেজে উঠল।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল ''হ্যালো'
'আমি বড়দি বলছি।'
'হ্যাঁ বলুন দিদি। আসলে আপনার যে নম্বরটা সেভ করা আছে সেটা থেকে করেননি তো…।'
'হ্যাঁ ,আমি অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন করছি
তোমার শরীর ঠিক আছে তো?'
'হ্যাঁ দিদি তবে একটু টায়ার্ড আছি।'
'কেন বলুন তো দিদি।'
'না পরপর দুদিন স্কুলে আসলে না। জানালে না।'
'আসলে দিদি ,হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছিল তাই দেশের বাড়িতে গেছিলাম।'
'ও ওখানে তো তোমার কাকু কাকিমা থাকেন তাই না? সবাই ভাল আছেন তো?'
'হ্যাঁ ,ওই মোটামুটি আছেন দিদি।'
'আর আজকে স্কুলে আসলে না কেনো?'
'আসলে দিদি আজকে আমার একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল ।ওখান থেকে আমাকে একটা সম্মাননা দেয়া হয়েছে, আমার লেখার জন্য।'
বড়দি বললেন 'কনগ্রাচুলেশন্স।'
'থ্যাংক ইউ দিদি।'
'তুমি এভাবে আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যাও আরো সম্মাননা তোমার ভান্ডারে আসুক। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।'
'থ্যাংক ইউ দিদি।'
'রেখা একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমাকে আমি ফোনটা করেছি কালকে যদি না আসো তাহলে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হবে।'
"কি দিদি?'
'আসলে একটা ওয়ার্কশপ আছে সেটা অনিন্দিতা ই জেদ করেছিল যাবে তাই ওর নামটা পাঠানো হয়েছিল কিন্তু ও কালকে স্কুলে আসেনি ।আজকে সন্ধ্যের দিকে ফোন করে আমাকে জানালো ওর বাচ্চাকে নিয়ে একটু প্রবলেম আছে। তাই ও অ্যাটেন্ড করতে পারবে না।'
'কি হয়েছে ওর বাচ্চার দিদি।'
'আর বোলো না ।ও তো কিছুদিন যাবত এসেই বলছিলো যে ওর বাচ্চা কথা বলছে না।'
'কেন তুমি ব্যাপারটা জানতে না?'
'আপনি তো জানেন দিদি, ও কি কারনে আমার প্রতি এতটা রাগ ,আমি জানিনা ।আমার সামনেও কখনো ওর ফ্যামিলির কথা আর বলে না ।আর আমিও কোন ইন্টারেস্ট দেখাই না।'
'হ্যাঁ ওর বাচ্চার দু'বছর কমপ্লিট হয়ে গেছে আড়াই বছর হয়ে গেছে এখন অব্দি কোন কথা বলে না।
কিন্তু ও সব বোঝে নাকি?'
'এইরকম একটা ভাষা ভাষা কথা শুনছিলাম তবে স্পষ্ট করে আমি কিছু জানি না দিদি।'
"ওইটা নিয়েই এখন নাকি ওর কি মনে হয়েছে ওর হাজবেন্ড আর ও মিলে ডিসিশন নিয়ে একটা স্কুলে ভর্তি করেছে।'
"বাহ ,ভাল করেছে তো দিদি।'
'হ্যাঁ সে তো ভালো করেছে কিন্তু ওখানে আর একটা কান্ড হয়েছে। ক'দিন হয়েছে তিন চারদিন স্কুলে গেছে এর মধ্যে ও নাকি অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মারামারি করেছে।
গত পরশু দিন নাকি একটা বাচ্চাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।'
'ও বাবা কি সাংঘাতিক?'
'স্বাভাবিক ভাবেই প্রিন্সিপাল কল করেছেন।'
'ও বাবা তাই নাকি?'
'আর বোলো না'
'প্রিন্সিপাল কল করার পর কি বলছেন দিদি?'
'ওনারা বলছেন বাচ্চা কে অন্য জায়গায় ভর্তি করিয়ে দিতে ।এই স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে।'
'তাড়িয়ে 'দেয়া হবে এই শব্দ টা কখনো ব্যবহার করতে পারেন?'
'হ্যাঁ ও দুঃখ করে কাঁদছিল আমার কাছে। তখন 'আমি বললাম এটা তো ওনারা বলতে পারেন না।'
এই সমস্যা থেকে ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।'
'তা আমি বললাম ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই ।তোর বাচ্চাতো এমনি সুস্থ-স্বাভাবিক সবই আছে অত চিন্তা করিস না বরং বলে আসতে পারতিস সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার
রয়েছে ।কখনো বলতে পারেন না যে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবো ,সে যদি লেখাপড়া শিখতে চায়।'
"তা তো ঠিকই দিদি।'
'এইরকম একটা সমস্যা চলছে।'
ওকে বেশি জোরজবস্তি করলাম না ,. ও একটা মেন্টাল প্রেসারে আছে বাচ্চাকে নিয়ে।'
'তাহলে শেষ পর্যন্ত কি হলো দিদি?'
'ওকে স্পিচ থেরাপির ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললাম।'
'বাহ দারুন সিদ্ধান্ত।'
'এখন দেখা যাক ও কি করে?'
'হ্যাঁ ওর একবার স্পিচ থেরাপির সঙ্গে কথা বলা উচিত আর একবার এমনি ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।'
'যাই হোক তা কালকে তুমি আসছো তো সিওর?'
'এখন অব্দি তো ঠিকই আছে।'
'ব্যস এটুকু হলেই যথেষ্ট আমি তো তোমাকে
চিনি '।বড়দি হাসতে হাসতে বললেন।
'তাছাড়া তুমি আসলে কোন সমস্যা হবে না ।আর আমি জানি তুমি সমস্যায় ফেলবে ও না।'
রেখা বললেন 'আমি চেষ্টা করি দিদি।'
'ব্যস ,এই চেষ্টাটাই রেখো সব সময়।'