ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭৯)
শামীমা আহমেদ
শিহাবের অফিস এসিস্ট্যান্ট কবির অফিস রুমের বাইরেই ছিল। শিহাব কবিরকে ডেকে জানিয়ে দিলো, আমি আর শায়লা ম্যাডাম একটু বাইরে যাচ্ছি। আমি আবার অফিসে ফিরবো। তুমি লাঞ্চ করে রেস্ট নিয়ে নিও।
কবির সব নির্দেশনা মন দিয়ে শুনে নিলো। শিহাব শায়লাকে নিয়ে বেরুতে যেতেই শায়লা কিছু একটা বলতে উদ্যত হলো। শিহাব তা শুনবার জন্য থামলো।শায়লার কাছে জানতে চাইলো,শায়লা কিছু বলবে ?
শায়লা হ্যাঁ সূচক অভিব্যক্তি দিয়ে জানালো, একটু রাহাতকে জানিয়ে যেতে হবে।আসলে আমি খুব অল্প সময়ের কথা বলে বাইরে এসেছি।রাহাতের সাথে একটু কথা বলতে হবে।
শিহাব তৎক্ষণাৎ তা মেনে নিলো এবং বললো, অবশ্যই, এখুনি কল করে জানিয়ে দাও।
কিন্তু শায়লা চাইছে শিহাব নিজেই যেন তা জানায়। শিহাব খুব সহজেই তা মেনে নিলো। নিজের মোবাইল বের করে রাহাতকে কল করলো।
হয়তো রাহাত বিজি ছিলো। দুবার কল করাতে রাহাত তা রিসিভ করলো। ভেতরে ভেতরে রাহাত একটু ভয়ই পেলো। কি জানি কি শুনবে! কেন শিহাবের কল !
শিহাব বেশ স্পষ্ট করেই বললো, রাহাত, তোমার আপুকে নিয়ে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।আমাদের কিছু জরুরী কথা আছে।
তোমার আপুর ফিরতে একটু সময় লাগবে।
রাহাতের আর কিছুই বলার থাকলো না।শিহাবকে রাহাত এমনিতেই খুব পছন্দ করে।কিন্তু সিচুয়েশন আজ অন্যরকম হওয়াতে আপুর এই সম্পর্কটা মেনে নেয়া গেলো না। এর জন্য রাহাতের মনে ও যথেষ্ট খারাপ লাগে। কিন্তু সবার সামনে তা প্রকাশ করা যায় না।
শায়লা শিহাব লিফটে নিচে নেমে এলো।আশেপাশের অফিস থেকে সবার উৎসুক দৃষ্টি। শিহাবের সাথে শায়লাকে দেখে তারা বুঝে নিলো কিছু ক্ষন আগে আসা মেয়েটি তাহলে কার সাথে দেখা করতে এসেছিলো।
শায়লা বাইকে উঠে বসতেই শিহাব বাইক স্টার্ট দিলো।ফ্রন্ট মিররে শায়লাকে এক ঝলক দেখে নিতেই দুজনার চোখ পড়লো। শায়লার অনুমতি নিয়ে শিহাব বেশ জোরে হর্ণ তুলে জনবহুল মার্কেট এরিয়া ছেড়ে গেলো।
শিহাব এক টানে বাইক চালিয়ে
দিয়াবাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। একটা খোলামেলা জায়গায় বাইক থামালো। বাইক একপাশে পার্ক করে একটা গাছের ছায়াযুক্ত উঁচু জায়গায় দুজনে বসলো। সামনে পিছনে মানুষের চলাচল স্বাভাবিকভাবে হলেও এই ভরদুপুরে তুলনামূলক লোকজন কমই দেখা যাচ্ছে।
শিহাব কথা বলতে শুরু করলো।
শায়লা আমি রিশতিনার ব্যাপারে কিছু বলার জন্য এখানে আসতে চাইলাম।কিন্তু তুমি ইতিমধ্যেই জেনেছো যে রিশতিনা এখন আমার ফ্ল্যাটে আছে। তবে আমি তাকে আজ চলে যেতে বলেছি। ক'দিন আগে তার বাবা মারা গেছে। এখন শুধু তার মা আছে।যদিও সে বলছে সে মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমার কাছে একেবারে চলে এসেছে।কিন্তু আমি নিশ্চিত, কদিন পরই ওর মা লোক পাঠিয়ে আবার মেয়েকে নিয়ে যাবে। আমি তাই নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাইছি। তোমার মনে নানান ভাবনা আসতে পারে।শিহাব শায়লার হাত ধরে জানালো, তুমি নিশ্চিত থেকো রিশতিনাকে নিয়ে আমি আর আগাতে চাই না। আইন আদালত পুলিশ র্যাব ওদের হাতের মুঠোয়। ওর পরিবার আমাকে নানানভাবে বিরক্ত করবে।আমি সেসব ঝামেলায় আর যেতে চাইনা। রিশতিনার বয়স কম। সে চাইলে আবার নতুন করে তার জীবন সাজাতে পারে। তাদের মত উন্নত জীবনের কাউকে সে বেছে নিতে পারে। সে উন্নত জীবনে অভ্যস্ত। আমাকে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করা। আর এই বিয়ে পরবর্তীতে আমাদের সন্তানের জন্ম আর ঐটুকু দুধের শিশুকে মা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের কাছে তাচ্ছিল্য ভরে ছুড়ে দেয়া।অন্তত এই কারণটিতে আমি আর কোনদিন ঐ পরিবারের সাথে যুক্ত হবো না। রিশতিনাকে নিয়ে বারবার আমার পরিবারের কাছে আমি বিব্রত হয়েছি। কিন্তু আমি এবার স্বস্তি চাই। আমি এবার শান্তি চাই। আমার সন্তান যেন সুস্থ পরিবেশে বড় হতে পারে।
শায়লার দিকে তাকিয়ে শিহাব আরো বলেই চলেছে, শায়লা আমি তোমাকে আমার বাকী জীবনে সঙ্গী করে পেতে চাই।তোমাকে পেয়ে আমার আবার নতুন করে বাঁচবার, সংসার সাজাবার ইচ্ছে জেগেছে। আরাফ তোমাকে আপন করে নিয়েছে। তুমি, আমি আর আরাফ একসাথে থাকবো। আমাকে ভালোবেসে তুমি
কি আমার সাথে থেকে যেতে পারোনা ? খুব শক্ত করে শায়লার হাত ধরে শিহাব শায়লাকে এ দেশে থেকে যেতে অনুরোধ করে যাচ্ছে। একজন অচেনা মানুষের সাথে তুমি তোমার জীবন শুরু করতে পারো না। শায়লা শুধু অধিকার দিয়ে কেউ কাউকে গ্রহন করতে পারে না যদিনা তাতে ভালবাসা থাকে।তুমি এতদিনেও যাকে ভালবাসতে পারোনি তার সাথে কিভাবে বসবাস করবে ? শায়লা আমার নিঃসঙ্গ জীবনে তোমায় আমি সঙ্গী করে নিতে চাইছি। শিহাবের ভেতরে যে এত আবেগী অনুনয় জমে আছে শায়লা তা ভেবে অবাক হচ্ছে।
শিহাবের কথায় শায়লা নীরব শ্রোতা হয়ে সব শুনছিলো। সে বুঝতে পারছে না সে কি করবে? কিভাবে সে শিহাবকে বুঝাবে তাকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।একেবারেই সে অনিচ্ছুক হয়ে পারিবারিক সব আয়োজনকে মেনে নিচ্ছে। শায়লা শিহাবের কাঁধে মাথা রাখলো। চলাচল করা লোকজন আড়চোখে ওদের দেখে নিচ্ছে।
যদিও এতে দুজন ভ্রুক্ষেপহীন হয়েই কথা চালিয়ে যাচ্ছে।দুজন দুজনার মাঝে যেন তন্ময় হয়ে আছে।
শিহাব শায়লার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাইছে। শায়লার ভেতরে অনেক কথা জমলেও তা বলা হচ্ছে না। সে বলতে পারছে না, শিহাব তোমার মত একই ভাবনা চাওয়া আমার মনেও। মনে মনে শায়লা আজ আর ঘরে ফিরে যেতে চাইছে না। আর মাত্র একদিন পরেই কানাডা থেকে নোমান সাহেব আসবেন আর শায়লা আজ বাসায় ফিরে গেলে আর কোনোদিন শিহাবের কাছে ফেরা হবে না। কিন্তু শিহাবতো তার সম্পূর্ণ অন্তর আর স্বত্বা জুড়ে।শায়লা শিহাবের শার্ট আকড়ে ধরলো।ফিসফিস করে বললো, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না শিহাব। আমি কানাডা যাবো না। আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই।বলেই শায়লা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।শিহাব কথাগুলো খুব স্পষ্টই শুনতে পেলো। শিহাবের যেন শায়লার প্রতি আস্থা ফিরে পেলো। সে শায়লাকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, তবে আজ তুমি আমার সাথে চলো। আজ আর তোমার বাসায় ফিরে যেও না!
শায়লা মনস্থির করে নিলো আজ আর সে বাসায় ফিরে যাবে না। আজকে সাহসী সিদ্ধান্ত না নিলে সারাজীবন এর জন্য পস্তাতে হবে। যার সাথে মনের কোন বন্ধন নেই শুধু তার সন্তান প্রতিপালনের জন্য এখন শায়লাকে কানাডায় নিয়ে যেতে চাইছে, সেখানে তো তাহলে কোন সংসার হবে না। শুধুই দ্বায়িত্ব পালন করা। শায়লার মনের ভেতর বিদ্রোহ করে উঠলো। সে শিহাবকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো। শিহাবের শরীর থেকে অপূর্ব মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণে শায়লা বিমোহিত হয়ে গেলো! সে চোখ বন্ধ করে শিহাবের সবটা ঘ্রাণ শুষে নিলো।
চলবে....