উপন্যাস
টানাপোড়েন ৬৮
সামাজিক ব্যাধির বলি
মমতা রায় চৌধুরী
গতকাল স্কুল থেকে ফিরে এতোটাই ট্রায়াড লাগছিল রেখার যে ভালো করে ভেন্দুদের বাড়ির খবরটা নিতে পারে নি, চৈতির মার কাছ থেকে। আসলে এতদিন পর স্কুল আর এত চাপ ছিল। আবার বাড়িতে এসে মনোজের দেখভাল, মিলি তার বাচ্চাদের দেখভাল ,সঙ্গে বাড়ির কাজ কম্ম ।কাজের মেয়েটা তো কাজে আসছে না। আজ ছুটির দিন তাই কাজ করতে করতেই মনে মনে ভাবছিল আমরা মেয়েরা কতটা স্বাধীনতা লাভ করেছি। সমাজ বদলায়। বিজ্ঞানের অভিষেক হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞানের বিজয় অধিকার। মানুষ ছুটে চলে গ্রহ গ্রহান্তরে ।তবু প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার ঘন হয়। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনগ্রসরতার কালিমাও বেড়ে চলে ।সমাজে উপেক্ষিত হয় নারীর মর্যাদা। তাই একবিংশ শতাব্দিতেও নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় ।আজও লক্ষ লক্ষ নারীর স্বপ্ন অকালে শেষ হয়ে যায়। পুরুষ শাসিত সমাজের অবহেলায়, অবজ্ঞায় এখনো হাজার হাজার শিশু কন্যার জীবন অন্ধকারে ই। আজ ও নারী লাঞ্ছনার শেষ হয় না। হয়তো মেয়েরা বহু ক্ষেত্রে অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে।কিন্তু তারপরেও সমাজের কাছে অবস্থিত সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় ।কিছু ক্ষেত্রে কটাক্ষ বিড়ম্বনা। রাজা রামমোহন রায় ,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহান মনীষীদের দয়ায় আজ নারীরা সমাজে কিছুটা নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে ,শিক্ষার আলোতে আসতে পেরেছে। এটুকুই আশার কথা ।কিন্তু সামাজিক ব্যাধি এখনো নির্মূল হয় নি।
ভেন্দুর বউ কি তাহলে সেই ব্যাধির বলি হলো?
এসব ভাবতে ভাবতেই মিলিদের খাবারগুলো রেডি করে ওদের দিয়ে এসে মনোজকে ব্রেকফাস্টটা টেবিলে দিচ্ছে।
এরমধ্যে মনোজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলো এবং বলল ' কি ব্যাপার? আজ কি বানিয়েছো?'
রেখা বলল 'বেশি কিছু বানাই নি ।আসলে একটু স্বাদটা চেঞ্জ করার জন্য মেথি মালাই আর রুটি করেছি।'
মনোজ বলল 'বাহ'
রেখা বলল 'দেখি আজকে তুমি কটা রুটি খাও?'
মনোজ বলল দেখবে আজকে আমি অনেক রুটি খাব?
রেখা হাসতে হাসতে বলল 'আমি তো জানি মশাই তোমার দৌড়টা কত দূর?'
মনোজ বলল'রেখা তুমি কিন্তু আমাকে শরীর খারাপের পর থেকেই খাবার ব্যাপারে আন্ডারএস্টিমেট করছো? কিন্তু ভীষণ রেগে যাচ্ছি।
রেখা বলল বারে তো তুমি তো প্রমান করবে আমার ধারণাটাকে ভাঙার দায়িত্ব তোমারি ।'একটু মুচকি হেসে মনোজের দিকে তাকালো।
মনোজ বলল 'ঠিক আছে আজ আমি প্রমাণ দেবো।'
রেখা বলল-'তোমার কিন্তু টাইম স্টার্ট হল।
এবার মনোজ হেসে ফেললো।
অ সময়ে পাশের বাড়ির চৈতির মা ডাকছে ' ও দিদি ,দিদি ,ও দিদি?'
রেখা জানলার নীল পর্দাটা সরিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল 'কিছু বলছ?।'
চৈতির মা বললো ও দিদি সেই গত দিনের সেই কেসটা গো?
রেখা বলল ভে'ন্দুদের বাড়ির?'
চৈতির মা মাথা নেড়ে বলল 'হ্যাঁ দিদি।
রেখা বলল' পুলিশ এসেছিল?'
চৈতির মা বললো 'কি জানি ,কি হয়েছে ?তবে তো শোনা যাচ্ছে মেয়ের বাবা এসেছিল?'
রেখা বলল' ও মা তাই বুঝি ?তারপর কি হলো?'
চৈতির মা বলল 'কি আর হবে ?গরিব বাবা হলে যা হয়?'
রেখা বলল 'ওর তো টাকার অঙ্কে পেরে উঠবে না।'
চৈতির মা বললো 'ওরা তো সবকিছুকে টাকা খাইয়ে রেখেছে। থানা বল আর যাই বল?'
রেখা বললো 'সত্যিই একটা মেয়ে তার জীবন দিয়ে দিল?'
চৈতির মা বলল 'অথচ সমাজে তার মূল্য নেই।'
রেখা বলল' তবে এক্ষেত্রে মেয়ের বাবা যদি কেসটা করে ।তাহলে কিন্তু অনেক কিছু হতে পারে?'
চৈতির মা সংশয়ের সঙ্গে বলল' কেস অবধি যেতে পারবে ?'
রেখা বলল' সেটাই আসল কথা।'
চৈতির মা বলল' কেন বললাম বলুন তো?'
রেখা বলল 'কেন?'
চৈতির মা বলল' 'কেস ডিসমিস হয়ে গেছে।'
রেখা বলল 'কি বলছ?'
চৈতির মা বললো 'ঠিকই বলছি দিদি।'
রেখা বলল 'কিছু শুনতে পেয়েছো?'
চৈতির মা বলল'মেয়ের বাবা কে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছে?'
রেখা আশ্চর্য হয়ে বলল 'কী?'
চৈতির মা বলল মেয়ের বাবাকে বসানো হয়েছিল ওদের সাথে।'
রেখা বলল 'তাই নাকি?'
চৈতির মা বিষন্নভাবে বলল'তবে আর বলছি কি?'
রেখা বলল' কী হয়েছে সেটা বলো তো?'
চৈতির মা বলল'গরিব বাবা 100000 টাকা চেয়েছিল?'
রেখা বলল বা দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো?
চৈতির মা বলল 'শুনুন'।
রেখা বলল 'হ্যাঁ তারপর?'
চৈতির মা বলল 'ছেলের বাড়ির পক্ষ থেকে 50 হাজার টাকা দেবে বলেছে।'
রেখা বললল 'মেয়ের বাবা ,রাজি হয়ে গেল?'
চৈতির মা বলল 'হবে না অভাবের সংসার?'
রেখা বলল মেয়ের বোন আছে নাকি?
চৈতির মা বলল' হ্যাঁ, সে ও তো বিবাহযোগ্যা শুনেছি।'
রেখা বলল 'তাহলে তো কিছু করার নেই।'
চৈতির মা বললো' আমার ও খুব ভয় হয় ,জানেন দিদি?'
রেখা বললো 'কেন তোমার আবার কি জন্য ভয়?'
চৈতির মা বলল' 'আমার মেয়েটাকে নিয়ে?''
এর মধ্যেই মনোজ আবার ডাকতে শুরু করল' রেখা রেখা, রেখা বলে।'
রেখা বলল 'যাচ্ছি একটু পরে।'
চৈতির মা বলল 'দাদা বোধহয় আপনাকে ডাকছে ?কিছু দরকার?'
রেখা বলল ' জানেন তো দিদি ভেবে অবাক লাগছে একটা মেয়ের প্রাণের মূল্য মাত্র 50000 টাকা?'
চৈতির মা বলল 'সেই থেকে তো আমিও দ্বন্দ্বে পড়ে আছি।'
রেখা বলল 'কন্যাসন্তান দরিদ্র পিতা মাতার কাছে এখনো বোঝা স্বরুপ গো?'
চৈতির মা বলল 'একদমই তাই?'
রেখা বলল'এজন্য শিশুকন্যাদের সামনে যথার্থ শিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা দরকার?'
চৈতির মা বলল 'সমস্যার সমাধানের কি এটাই রাস্তা?'
রেখা বলল অবশ্যই শিক্ষায় মনের অন্ধকার দূর করতে পারে ।পারে অন্ধ ধারণার অচলায়তন ভাঙতে?'
চৈতির মা বলল 'এই মেয়েটি তো বিএ পাশ ছিল গো?'
রেখা বলল 'বলতে চাইছো ,মেয়েটিতো শিক্ষা পেয়েছে তাই তো?'
চৈতির মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো 'হ্যাঁ।'
রেখা বলল 'শিক্ষা তো মেয়েটি কাজে লাগাতে পারলো না?'
চৈতির মা'বললে একদম ঠিক!'
রেখা বলল' মেয়েটির মরার কি দরকার ছিল? বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত?'
চৈতির মা বলল' আদপে মেয়েটি মরেছে ,না ওকে মারা হয়েছে ।সেটাই তো রহস্যজনক।'
রেখা বলল অথচ জগতে বহু নারী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছে না।'
চৈতির মা বলল 'সে তো জানি। '
রেখা বলল'খুব খারাপ হয়ে গেল'।
চৈতির মা বলল'তাহলে দিদি আমাদের এই কন্যারা কি এভাবেই সমাজে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে যাবে?'
রেখা বলল'যেদিন সমাজের প্রতিটি পিতা-মাতা বুঝবে তাদের শিশুকন্যারা ভবিষ্যতে জায়া জননী তাদের এ জন্য যথার্থ শিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে স্বাবলম্বী করা।'
চৈতির মা বলল 'সবক্ষেত্রে তো সবার সেই আর্থিক বল থাকে না?'
রেখা বলল 'সেটাই তো হয়ে গেছে সব থেকে বেশি দুর্ভাগ্যজনক।'
চৈতির মা বলল আমার মেয়েটাকে যদি তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিতাম তাহলে বোধহয় ভাল হত।'
রেখা বলল 'তখন তো কতোবার বারন করেছিলাম শুনলে না?'
চৈতির মা বলল হ্যাঁ দিদি আমরা ছাপোষা মানুষ ভাবলাম ভালো ছেলে দিয়ে দিই।'
রেখা বলল এখানেই তোর ম্যাক্সিমাম বাবা-মা ভুল করেন।
কন্যা সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য পিতামাতাকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য রাষ্ট্রের ও দায়বদ্ধতা রয়েছে।'
চৈতির মা বলল 'হ্যাঁ এখন তো আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেয়েদের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছন।'
রেখা বললে অবশ্যই এটাতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ কন্যাশ্রী প্রকল্প সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে এটা কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাহায্য নিয়ে মেয়েরা পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী হতে পারে নিজের ভবিস্যত নিজে করবে।
চৈতির মা বলল একদম ঠিক বলেছেন দিদি।
মনোজ আবারো ডাকতে লাগল রেখা রেখা
রেখা বলল যাই..ই.ই।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও বললো নারীদেরকেও
আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার দিতে হবে।
চৈতির মা বলল'পরে এই নিয়ে কথা বলব দিদি।'
রেখা বলল' চৈতি কে নিয়ে ভাবছো?'
চৈতির মার চোখে জল আর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
চৈতির মা বলল' তবে আমি হলে না 50000 টাকায় আমার মেয়ের মূল্য চুকিয়ে দিতাম না। আমি লড়তাম।
রেখা বলল 'প্রতি ঘরে ঘরে কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার এরকম মানসিকতা তৈরি করা উচিত।
ঠিক আছে দিদি অত ভেবো না পরে এসো একদিন বাড়িতে তা হবে।'
চৈতির মা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
রেখা বলল 'কবির ভাষাতেই বলতে ইচ্ছে করছে-
'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'
এটা সবাইকে মেনে চলতে হবে। নারী শুধু যে বিকিকিনি সহজ পণ্য নয় এটা সমাজের প্রতিটি স্তরের বুঝতে হবে।