উপন্যাস
টানাপোড়েন ৬৭
চিন্তার ভাঁজ
মমতা রায়চৌধুরী
টানা বৃষ্টিতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে, আজকের সোনা ঝরা রোদ বেরিয়েছে। রেখা সকালে উঠেই ঘরের জানলাটা খুলে দিয়েছে ,সেই সোনা ঝরা আলো জানলা দিয়ে এসে উঁকি মারছে। মনোজ দুচোখ ডলতে ডলতে হঠাৎই জানালা দিয়ে আসা আলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে 'অ্যাই ,রেখা। আজ আকাশে নির্মল রোদ উঠেছে ।
মনোজ গান শুরু করল' ও আকাশ সোনা সোনা, এ মাটি সবুজ ,সবুজ। নূতন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রেঙেছে,আলোর জোয়ারে খুশির বাঁধ ভেঙেছে।'
রেখা গান শুনে ঘরে ঢুকতেই মনোজ রেখাকে জড়িয়ে ধরল।
রেখা বললো 'কি হচ্ছে ?এগুলো কি হচ্ছে ?আমি বুঝতে পারছি না। '
মনোজ বলল 'প্লিজ, চুপ করো ।এই কদিনে হাঁপিয়ে উঠেছি ।একটু শরীর ঠিক হয়েছে ।কোথায় একটু ওয়েদার ভালো থাকবে ,সে নয়।'
রেখা মজা করে বলল''তাতে কি হয়েছে ?মেঘলা ওয়েদারতে তো অনেক বেশি কাছাকাছি আসা যায় ।মনোজ রেখার চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো আর বলল 'হ্যাঁ ,তুমি ঠিকই বলেছ ।কিন্তু তা হলেও অসময়ে এটা একদমই ভালো লাগে না ।দেখো কালকে যখন আমার হৃদয় তোমাকে চাইছিল কাছে পেতে ।তুমি কালকে স্কুলে চলে গেলে ,তার মানেটা কি হলো? সেই তো আমাকে একাকী থাকতে হলো। তার থেকে যদি একটু ওয়েদারটা ভালো থাকতো ,তাহলে আমিও একটু বাড়ির বাইরে না ,এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করতে পারতাম বলো? আমরা তো পুরুষ মানুষ। আমরা এক জায়গায় বসে থাকতে পারি না। বন্ধু-বান্ধবও ছাড়া ।'
রেখা বলল 'খুব বুঝলুম মহাশয় ।ঠিক আছে ।এবার ছাড়ো আমাকে ব্রেকফাস্ট বানাতে দাও ।'
তখনও রেখার হাতে আটা লেগে আছে।
রেখা চলে যাচ্ছে মনোজ তখন আবার ডাকে 'অ্যাই রেখা এই শোনো না।'
রেখা কৌতুহলী হয়ে বলল 'আবার কি হলো ?'
মনোজ আমতা আমতা করে বলল 'না ,বলছিলাম মানে সুমিতাকে কবে থেকে আসতে বলবে?'
রেখা বলল ' দাঁড়াও ।এই তো ভাবছি দুদিন পরে ফোন করবো?'
তারপর রেখা রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে গিয়ে আবার একটু পেছন ফিরে বলল'পার্থর খবর কি বল তো ?'
মনোজ বলল 'কোন পার্থ ?'
রেখা বলে' এই মশকরা করো না তো ।আরে আমাদের প্রতিবেশী পার্থ ভাই? '
মনোজ বলল 'হ্যাঁ ,ঠিক বলেছ তো ।ওর তো খবর নেয়া হয় নি । দাঁড়াও আমি একটু ফোন করি ।'
রেখা বলল ' তুমি ফোন করো আমি বরং রান্নাঘরে কাজগুলো করি ।শুনতে পাচ্ছ না বাচ্চাগুলোর চিৎকার?'
মনোজ বলল 'না, ওদের খেতে দেয়ার ব্যবস্থা করো।'
মনোজ ফোন করল পার্থকে। রিং হয়ে গেল ।আবার ফোন করল'ফোসকে গেলে এমন ছেলে আর পাবে না তাই তো বলি ও সুন্দরী আমায় ছেড়ে যেও না...।'
মনোজ রিং টোন শুনে মাথা নাড়তে লাগল আর ভাবতে লাগলো 'বাবা পার্থ ,বেশ মজার রিং টোন লাগিয়েছে তো ।'
ফোন ধরলেন এক ভদ্রমহিলা'হ্যালো'।
মনোজ বলল 'কে মাসিমা বলছেন?'
সুনীতা দেবী বললেন'হ্যাঁ বলছি আপনি কি বলছেন?'
মনোজ বলল 'আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি মনোজ বলছি পাশের বাড়ির।'
সুনীতা দেবী বলেন 'ও তুমি? কেমন আছো বাবা?'
মনোজ বলল' এখন আমি ভালো আছি ।আপনারা সবাই ভাল আছেন?'
সুনীতা দেবী বলেন' আমরা ঠিকই আছি কিন্তু পার্থর একটু শরীরটা খারাপ বাবা।'
মনোজ বলল 'কি হয়েছে পার্থর? ওই জন্য ভাবছি পার্থ ফোন করছে না কেন?'
সুনীতা দেবী বলেন' ওর জ্বর এসেছে বাবা। আজ তিন দিন হল?'
মনোজ কেমন একটু শিউরে উঠলো ।কি জানি বাবা মনোজের সংস্পর্শে থাকা থেকে কি পার্থর জ্বরটা এল?ভয়ে ভয়ে বলল' কিছু টেস্ট করিয়েছেন?'
সুনীতা দেবী বললেন 'না, বাবা ।ডাক্তার দেখানো হয়েছে।ডাক্তারবাবু বলেছেন' চারদিন পর যদি জ্বর না কমে তাহলে টেস্ট করাতে বলেছেন?'
মনোজ বলল 'পার্থকে কি একটু ফোনটা দেয়া যাবে মাসিমা?'
সুনীতা দেবী বলেন 'এভাবে বলছো কেন?একটু ধর ওই ঘরে যাচ্ছি গিয়ে ফোনটা দিচ্ছি।'
সুনীতাদেবী ডাকছেন 'পার্থ, পার্থ , বাবা পার্থ ।'
পার্থ কম্বল সরিয়ে নিয়ে মুখ বের করে বলল' কী মা?'
সুনীতা দেবী বলেন 'মনোজ ফোন করেছে বাবা?'
পার্থ হাত বাড়িয়ে বলল' দাও ফোনটা।
সুনীতা দেবী ছেলের পাশে গিয়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকেন, তারপর টেম্পারেচার দেখতে থাকেন।
পার্থ বলল 'হ্যালো ,মনোজ দা কেমন আছো?'
মনোজ বলল 'আমি তো ভালো আছি । কিন্তু পার্থর জ্বর।এখন টেনশন হচ্ছে , তুমি আমার সঙ্গে থাকার জন্য আবার কিছু না হয়ে যায়?'
পার্থ বলল 'দাদা, এসব কথা কেউ বলে নাকি? মানুষ হয়ে মানুষের পাশে থাকবো না ?বিপদের দিনে তাই কখোনো হয়?'
মনোজ বলল' সব ঠিক আছে। তবুও নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে জানো তো?'
পার্থ বলল' দেখবেন ,আমার কিছুই হবে না ।আমার আজকের মধ্যে জ্বর কমে যাবে। '
মনোজ বলে 'তাই যেন হয় ভাই।'
পার্থ বলল'তাই হবে , তুমি অত টেনশন নিও শরীরের দিকে নজর দাও।'
মনোজ বলল 'আমাকে নিয়ে ভাবিস না ভাই ।এবার নিজের শরীরের দিকে একটু নজর দে।আমি তোকে দেখতে যেতাম এই মুহূর্তে যাওয়াটা ঠিক হবে না।'
পার্থ বলল' না ,না দাদা। আপনি পুরোপুরি আগে সুস্থ হন।'
মনোজ বলল" আমি না গেলেও মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নেব।'
পার্থ বলল 'ঠিক আছে ,তাই করবেন।'
মনোজ বলল 'ঠাকুর করে তোর যেন আজকেই টেম্পারেচার নেমে যায় ।ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। নইলে যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না ভাই।'
পার্থ বলল' দাদা ,আপনি খামোখা নিজের প্রতি দোষারোপ করছেন ।'
এরইমধ্যে রেখা এসে কথাগুলো শুনতে থাকে তারপরে বলে 'কি হয়েছে পার্থর?'
মনোজ বলে 'পার্থর জ্বর হয়েছে?'
রেখা তড়িঘড়ি করে মনোজকে বলে 'ফোনটা আমাকে দাও তো?'
রেখা বলল' পার্থ ,পার্থ ভাই?'
পার্থ বলল' হ্যাঁ ,বৌদি বলুন?'
রেখা বলল 'তোমার জ্বর হয়েছে ,আজ কদিন হলো ?'
পার্থ বলল '৩দিন ।দাদার টেনশন শুরু হয়েছে ।আচ্ছা বলুন তো তার ওপর নিজের ওপর দোষারোপ করছেন?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ, সেটা তো করারই কথা ভাই ।কদিন আগেই তোমার দাদা যে মহামারী রোগ থেকে রক্ষা পেলেন?'
পার্থ খুব হেসে বললো 'বৌদি দেখবেন আমার কিছু হয় নি ।আজকে ই আমার জ্বর কমে যাবে। দেখুন না ?ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখুন।'
রেখা বলল 'সেটা তো একশো বার ভাই। আর ওটাই তো চাই।'
পার্থ বলল 'আচ্ছা, বৌদি বলুন তো ?আজকে যদি আমি বাড়ি না থাকতাম, আমার মায়ের যদি কিছু হতো ,কোনো অসুবিধা হতো ?আপনারা কি আমাদের পাশে থাকতেন না?'
রেখা বললো 'এটা আবার কি কথা বলছ ভাই ।আমরা পাশে থাকব না?'
পার্থ বলল 'তাহলে ভাবুন আজকে আমার জ্বর যদি না কমে , সেইজন্য দাদা নিজেকে ,নিজের প্রতি দোষারোপ করবে ?তাই কখনো হয়?'
রেখা বললো' হ্যাঁ। তোমার দাদা দেখো ,মনমরা হয়ে বসে আছে। আজকে একটু প্রাণ খুলে হেসে গান ধরেছিল জানো তো, ভাই?'
পার্থ বলল' দাদা যদি মনমরা হয়ে বসে থাকে তাহলে আমি কি শিখবো? তার থেকে দাদাকে গান গাইতে বলুন আমি একটু শুনি।'
সুনিতা দেবী বললেন 'কি হয়েছে রে বাবা পার্থ ?কে কথা বলছে বৌমা?'
সুনীতা মাসিমা সত্যিই অমায়িক ভদ্রমহিলা। সবসময় মা-বাবা করে কথা বলেন আর এত সুন্দর ব্যবহার ।নিজের শ্বশুরবাড়ির পরিবার থেকেও পায় নি।'
সুনিতা দেবী বললেন 'বাবা পার্থ ফোনটা আমার কাছে...।'
পার্থ বলল 'মা, একটু এদিকে এসো ।হাত বাড়াও।'
সুনিতা দেবী বলেন 'এই যাই বাবা ।দাও ফোনটা আমাকে ।আচ্ছা শোনো তোমার কিন্তু এরপরে খাবার টাইম আছে। বৌমার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। তারপর তোমার খাবার দেব ।লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে নেবে কিন্তু।'
সুনিতা দেবী বললেন' বৌমা, কেমন আছো মা তোমরা?'
রেখা বলল 'আমরা তো ভালো আছি মাসিমা কিন্তু..?"
সুমিতা দেবী বলেন' ও সব নিয়ে একদম ভেবো না তো ।শরীর থাকলে শরীর খারাপ হবে ।তার জন্য ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে ,খাওয়া -দাওয়া ঠিকঠাক করতে হবে, যা যা ডাক্তার বলেন। সেগুলো মেনে চলতে হবে ।আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি না ।তোমরাই ভয় পাইয়ে দিচ্ছ আমাদেরকে।'
রেখা হেসে বলল 'হ্যাঁ ,মাসীমা ।আপনার মত মনের জোর সবার তো হয় না। তবে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।'
সুনিতা দেবী বললেন 'দেখি কালকে তো ডাক্তার ওকে টেস্ট করতে বলেছেন ।আশা রাখি আজকেই জ্বর কমে যাবে। এরমধ্যেই সুনীতা দেবীকে কেউ যেন বলছেন 'ও কাকিমা ,ও কাকিমা...।'
সুমিতা দেবী রেখাকে বললেন 'বৌমা তুমি একটু ধর মা ।দেখি আমার ওই কাজের মেয়েটা কি বলতে চায়? গলাটা বাড়িয়ে-'কি বলছিস রে পেঁচি।'
পেঁচি বলল 'আমি কাল থেকে কাজে আসব না?'
সুনিতা দেবী বলেন 'কেন কাজে আসবি না কেন? তোর কি হয়েছে?'
কাজের মেয়েটি চুপ করে আছে। তারপর সুনীতা দেবী আবার বলেন কি হলো বলছিস না কাজে আসবি না কেন ?কোথাও যাবি?'
পেঁচি বললো 'না ,দাদার জ্বর এসেছে না । আমি কাজে আসব না।'
সুনিতা দেবী বলেন' দাদার জ্বর এসেছে তো তোর কি ?তোর তো আর জ্বর আসে নি ?'
পেঁচি বলল 'না ,না ,এখন করোনার সময়।'
সুনীতা দেবী বলেন'ওই জন্য কাজে আসবি না? তবে আসিস না ।তোমার বাড়িতে যদি তোমাদের কারোর জ্বর হয় ,তখন তুমি কি করবে?'
কাজের মেয়েটির চুপ করে আছে দেখে , সুনীতা দেবী বলেন 'ঠিক আছে মা ,তোমায় কাজে আসতে হবে না ।তোমার দাদার জ্বর সারুক। তারপর তুমি কাজে এসো ,কেমন?'
পেঁচি বলল'কাকিমা আমাকে ভুল বুঝলে হবে না ।আমি কিন্তু..?'
সুনীতা দেবী বলেন 'না মা, ভুল বুঝবো কেন ?সাবধানতা অবলম্বন। ভালো কথা।'
কাজের মেয়েটি চলে যাবার পর রেখাকে বললো কথা শুনলে বৌমা ?ওরা আমাদের থেকে কত সচেতন। বাহ এটা কিন্তু ভাল দিক কি বল?'
রেখা হাসতে হাসতে বলল' হ্যাঁ, কাকিমা। আমার যে কাজ করে সুমিতা ।ও তো এমনি কাজে কামাই ।তারপর ওর যখন এই করোনা পজিটিভ হল তারপর থেকে ওকে আমরা নিজের থেকেই ছুটি দিয়ে দিয়েছি ।আজ অব্দি এখনো ডাকি নি।'
সুনিতা দেবী বললেন 'তা বেশ করেছ। ভালো থেকো মা ।এসো তোমরা। বাবুর আবার খাবার টাইম হয়ে গেল তো ফোনটা এখন রাখি মা?'
রেখা বলল-হ্যাঁ ,মাসিমা রাখুন।'
রেখা মনোজের দিকে তাকিয়ে আছে তারপর বলল 'কি হল তোমার? তুমি এমন হয়ে গেলে কেন ?এই সোনা ঝরা রোদে গান গেয়ে উঠল' ও আকাশ সোনা সোনা ...।আজকে আমার সোনার মনে অন্ধকার কেন?'
মনোজ শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে 'কেন বুঝতে পারছ না ?ভীষণ ভয় লাগছে আমার ।আজ সোনা রোদও মনের অন্ধকার দূর করতে পারবে না।'
মনোজের এসব নেগেটিভ কথাবার্তা শুনে রেখার ও চিন্তার ভাঁজ পরল।