উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭৩
'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা'
মমতা রায় চৌধুরী
রেখা খুব তাড়াতাড়ি কাজগুলো সেরে গেল পার্থদের বাড়ি। রেখা গিয়ে দেখছে পার্থ মাসিমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর বলছে আমি তো আছি মা তোমার চিন্তা কি?
মাসিমা মাঝে মাঝে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন
আমার শুভ টা আর কোনদিন আসবে না রে? আদর করে মা বলে ডাকবে না? আমার কলিজা আমায় ছেড়ে চলে গেছে ।আমি কি করে বাঁচবো?
পার্থ বলছে 'মা আমি কি তোমার কেউ নই? আমি কি তোমার সন্তান নই?'
মাসিমা একদৃষ্টিতে পার্থর দিকে তাকিয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। এক সময় পার্থর হাত দুটোকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন' বাবা তুই তো আশা ভরসা। তুই তো আছিস বাবা আমার শিবরাত্রির সলতে।'
তখন পার্থ বলে 'তাহলে তুমি কি চাও না আমি ভাল থাকি?
মাসিমা বললেন 'সব মায়েরা চায় তার সন্তান ভালো থাকুক।
পার্থ বলল' আমি কি চাই সেটা তুমি জানো না?'
মাসিমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।
পার্থ বলল' আমি চাই তুমি আবার আগের মত স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসো।'
রেখা বলল 'পার্থ ঠিকই বলেছে মাসিমা। জানি অত সহজ নয় ।কিন্তু তাহলেও পার্থর কথা ভেবে আপনাকে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরতেই হবে।'
মাসিমা হাউ হাউ করে কেঁদে বললেন' আমি কি করে পারব বলো ?তোমার মেসোমশাই ছেড়ে চলে গেলেন আবার ছেলেটাও...।'
রেখা বললো 'জানি তো কিন্তু তা হলেও জীবন তো থেমে থাকে না। সুখ দুঃখ ,হাসি কান্না
শোক তাপ নিয়েই জীবন। এভাবেই চলে কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা'।
মাসিমা বললেন 'আমি জানি বৌমা কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলে ...এটা আমি ভাবতে পারছি না।
হাউমাউ করে কেঁদে বললেন এতটা সহজ নয়।'
রেখা বলল 'কিন্তু আপনাকে তো ভাবতেই হবে। এখন আপনার সামনে ভবিষ্যৎ তার কথা না ভেবে অতীতটাকে নিয়ে আপনি ভাবছেন মাসিমা?'
মাসিমা কেঁদে কেঁদে বললেন 'চেষ্টা তো করছি ।পারছি কোথায়?'
রেখা বলে রবি ঠাকুরের ওই কবিতার লাইন মনে করুন
"সত্য সে কঠিন।'
আবার তিনি বলেছেন 'আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন।'
এই সত্যটা উপলব্ধি করুন।
মাসিমা বললেন' বাস্তব বড় কঠিন বৌমা।'
রেখা বলল' আমিও তো সেই বাস্তবের কথাই বলছি মাসিমা'।
রবি ঠাকুরের ভাষায়-
'সে কখনো করে না বঞ্চনা'।
মাসিমা এবারে রেখার হাত দুটো ধরে বললেন 'আমি চেষ্টা করব বৌমা।'
রেখা বলল' বলছিলাম না পার্থ তোমাকে ।মাসিমার মনের বল অনেক বেশি ।সেই জোরেই মাসিমা এবার ঘুরে দাঁড়াবেনএই আশা রাখি। '
পার্থ ঘাড় নাড়তে লাগল।
পার্থ বলল 'বৌদি মা কে ছেড়ে তো এইজন্য আমি কোথাও যেতেও পারছি না।'
রেখা বলল' পার্থ চিন্তা করো না। তোমাদের কাজের মেয়েটা তো আসছে না?'
পার্থ বলল 'ও তো আমার যবে থেকে জ্বর তবে থেকেই আসছে না।'
রেখা বলল 'সব কাজের মেয়েগুলোই না একই ধরনের হয়।'
পার্থ বলল বৌদি তাহলে আপনি মায়ের কাছে থাকুন আমি একটু কাজগুলো সেরে আসি।'
রেখা বলল 'ও শিওর। আরও বলল শোন আমি খাবার বাড়িতে রেডি করছি ।আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি মাসিমার জন্য?'
পার্থ বলল' ঠিক আছে মা খাবে।কিন্তু আমার জন্য তো পাঠাতে পারবে না। কারণ আমি তো হবিস্যি করবো।'
রেখা বলল 'ও ভুলেই গেছি ।তুমি তো কাজটা করবে হ্যাঁ।'
পার্থ বলল 'বৌদি তাহলে এগোই গো?
রেখা বলল' হ্যাঁ ভাই এগোও। হবিস্যির তো একটা নির্দিষ্ট টাইম আছে।'
এরমধ্যে রেখার ফোন বেজে উঠলো' ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা, প্রভু তোমার পানে..।'
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো বলো?'
মনোজ বলল 'ওই ভদ্রলোক আবার এসেছে?'
রেখা বলল 'কে?'
মনোজ বলল' আরে মিলির বাচ্চাদের নেবে বলে যে বলেছিল।'
রেখা বলল 'ও বাবা লোকটা পাগল করে দেবে গো?'
মনোজ বলল' কি বলবো বলো?'
রেখা বললো 'কি বলি বলো তো?'
মনোজ বলল 'আমি বলেছি আমি বাচ্চার ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।'
রেখা বললো 'তা ওই ভদ্রলোক কি বললেন?'
মনোজ বললো 'ও বাবা ,সে তো জেরা করছে আপনাদের বাড়ীর বাচ্চা আপনি বলতে পারবেন না তাহলে কে বলবে বলুন?'
রেখা তো কপালে হাত দিয়ে বললো হায়রে কপাল বলে কি?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ গো এরকমই বলছেন?'
রেখা বলল 'বলো বাচ্চার ব্যাপারে কথা বলতে হলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে?'
মনোজ বলল'ঠিক আছে তাই বলে দিচ্ছি।'
রেখা বলল' শোনো শোনো' এর মধ্যে ফোন কেটে গেছে।
পার্থ বলল' কি হয়েছে বৌদি?'
রেখা বলল 'আর বোলো না ভাই ,মিলির বাচ্চাদের নেবে বলে নাছোড়বান্দা।'
পার্থ বলল 'কি সুন্দর হয়েছে বেবিগুলো গো।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ গো মিলির বাচ্চা মাতৃহৃদয় তো একটা আলাদা কাজ করেই।কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকে থেকে না আমারও কেমন যেন হয়।যখনই কেউ বলে যে বাচ্চা নেবে আমার না হৃদয় হুহু করে ওঠে।'
পার্থ বলল 'সে তো হবেই বৌদি। মিলি তো বাচ্চা দিয়েছে কিন্তু যা কিছু করার তো আপনি করছেন ।মিলি জন্মদাত্রী আর আপনি হচ্ছেন পালিতা মা যশোদা।'
রেখা বলল 'ওদের মধ্যে দিয়ে না খুব ভালো সময় কেটে যায়। মনে একটা আলাদা প্রশান্তি আসে।'
পার্থ বলল 'একদমই ঠিক। আসলে দাদা আর আপনার মনটা সত্যিই ভীষণ সংবেদনশীল আর মানবিক।'
রেখা হাসলো তারপর বলল 'পার্থ আর সময় নষ্ট করো না । তুমি এগোও।'
পার্থ বলল 'হ্যাঁ বৌদি ,এই এগোচ্ছি ।আপনি আছেন তাই নিশ্চিন্ত।'
রেখার আবার ফোন বেজে উঠল'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা....।'
রেখা আনমনে ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
রিম্পাদি বলল' হ্যাঁ রে আমি রিম্পাদি বলছি ।'
রেখা বলল' হ্যাঁ বলো,রিম্পা দি?'
রিম্পাদি বলল' তুই কালকে স্কুলে আসলি না আবার আজকেও আসলি না?'
রেখা বলল 'একটু অসুবিধে ছিল গো?'
রিম্পা দি বলল হ্যাঁরে মানুষ ঠিক আছে তো তুই ঠিক আছিস মিলিরা ঠিক আছে?
রেখা বললো 'হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা সবাই ঠিক আছি।
রিম্পা দি' বলল তাহলে..?'
রেখা বলল 'তোমাকে পরে গিয়ে বলব?'
রিম্পা দি বলল'এখন বলতে তোর অসুবিধা আছে?'
রেখা শুধু সংক্ষেপে বলল 'হ্যাঁ।'
রিম্পা দি বলল ঠিক আছে। তুই কালকে আসছিস তো স্কুলে?
রেখা বলল 'দেখি?
রিম্পা দি বলল'না অনিন্দিতার বিয়েতে যাবি তো?'
রেখা বলল 'অনিন্দিতার কবে বিয়ে?'
রিম্পাদি বলল 'সে কি তুই জানিস না?'
রেখা বলল ' না। বড়দি একবার বলছিলেন অনিন্দিতার বিয়ে।'
রিম্পা দি বলল সে কিরে স্কুলে কার্ড দিয়েছে তা তুই ছিলিস না তাহলে তোকে তো ব্যক্তিগত ভাবে বলা উচিত ছিল অন্তত মেসেজ করে দেয়া উচিত ছিল।
রেখা বলল 'হয় তো ভুলে গেছে।'
রিম্পাদি অবাক হয়ে বলল' ভুলে গেছে?'
রেখা বলল' তাহলে কি তুমি অন্য কিছু গেস করছো ?যেটা আমি করছি এখন।'
রিম্পা দি বলল'তুই কি কাজ করছিস আগে বল?'
রেখা বলল বলবো?
রিম্পা দি বলল আমার তোর মাঝে কোনো ফারাক আছে বল?
রেখা বলল' আমার হাজবেন্ডের করোনা হয়েছিল বলে ভয় পাচ্ছে?
'রিম্পা দি বলল' এগজ্যাক্টলি?'.)
রেখা বলল 'তাহলে আমার না যাওয়াই উচিত কি বল?'
রিম্পা দি বলল' স্কুলে সবার উদ্দেশ্যে নেমন্তন্ন করেছে?'
রেখা বললো' কি জানি যেতেও পারবো কিনা কে জানে?
'রিম্পাদি বলল 'দেখিস পারলে অবশ্যই যাবি।খেলা হবে?'
রেখা বলল 'দেখি পরিস্থিতি কি হয়?'
রিম্পা দিয়ে বলল ঠিক আছে সাবধানে থাকিস ভালো থাকিস ।রাখছি হ্যাঁ।'
তার মধ্যে আবার বলে উঠলো এই শোন শোন শোন।
লেখাগুলো কি?
তোর নাতি নাতনি গুলো ভালো আছে তো?
রেখা বলল হ্যাঁ বিন্দাস আছে।
রিম্পা দি বলল 'পরে তো আবার আমাকে বলবি আমার নাতি নাতনিগুলোকে ভুলে গেলে ।একবারও জিজ্ঞেস করলে না?'
রেখা বলল 'সে তো ঠিক ই?'
রেখা এবং রিম্পা দি দুজনেই হাসতে লাগলো।
ফোনটা রেখে সবে মাসি আমার দিকে তাকিয়ে আছে রেখা তখন মাসিমা বললেন বৌমা তোমার ওই রিংটোন টা আমার খুব ভালো লেগেছে ওই গানটা আমাকে শোনাবে একটু।
রেখা বলল ও রবীন্দ্র সংগীতটা 'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা...।'
রেখা বললো নিশ্চয়ই মাসিমা আপনি ওয়েট করুন আমি গানটা চালিয়ে দিচ্ছি'।রেখা ইউটিউব খুলে সার্চ করে গানটা চালিয়ে দিল। গান বাজতে লাগল'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু ,তোমার পানে , তোমার পানে ,তোমার পানে।
যায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু ,তোমার কানে ,তোমার কানে ,তোমার কানে।।
চিত্ত মম যখন যেথা থাকে সাড়া যেন দেয় সে তব ডাকে,
যত বাঁধন সব টুটে গো যেন
প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে ,তোমার টানে।।
......
......
...
..
প্রভু,তোমার গানে, তোমার গানে ,তোমার গানে।।''
..
.তোমায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার কানে তোমার কানে তোমায় এ যেন