একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন ৫০
উদাসী মন তারে খোঁজে
হঠাৎই শীতের সকালে বৃষ্টি শুরু হল। ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানিয়েছে নিম্নচাপের জন্য। রেখা যেন আজ 16 বছরের তরুণী সেই আগের মতই বিছানায় পড়ে রয়েছে ,কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছে না। আজ কোন তাড়া নেই, কারোর জন্য চিন্তা -ভাবনা নেই। শুধুই একান্তে নিজেকে জানা। উদাসী বাউল মন টাকে খুঁজে বেড়ানো।তাই জানলার কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হাতে নিয়ে অনাবিল আনন্দ অনুভব করতে।
এমন সময় কাকিমা এসে ডাকছেন ' ননী, ননী, ননী?'
রেখা বলল ' কি কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'তোর ফোন বাজছে?'
রেখা আলস্য জড়িত কন্ঠে বলল ' এত সকালে কে ফোন করছে?"
মনে মনে ভাবল মনোজ ফোন করল ,নাকি রিম্পাদি এই দুজন ছাড়া আর কে ফোন করার আছে?
এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠলো।
ফোনটা রিসিভ করতেই কণ্ঠ ভেসে আসলো
'হ্যালো রেখা ,আমি বড়দি বলছি'।
রেখা এবার বড়দির' গলার আওয়াজ পেয়ে বিছানায় উঠে বসলো, বলল ' 'হ্যাঁ, বলুন দিদি।'
বড়দি বললেন "১৬ * তারিখ থেকে তো স্কুল খুলে যাচ্ছে ।একটা তো মোটামুটি রুটিন তৈরি করা হচ্ছে যারা দূরের টিচার অনেকে বলছেন যে ওদেরকে সময়টা একটু বাড়িয়ে দিতে অর্থাৎ সাড়ে নটায় স্কুলে আসার কথা সেখানে ওরা সাড়ে দশটায় আসতে চাইছে?
তুমি তাহলে সাড়ে নটায় আসবে তো?'
রেখা বলল 'দিদি ,আমাকে 10:30 থেকেই রাখুন না ,তাহলে আমার সুবিধা হয়।'
বড়দি বলেন ' বুঝতে পারছি কিন্তু আপনি তো ল্যাঙ্গুয়েজ এর টিচার। ক্লাস শূরু ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই হবে ।সেই ক্ষেত্রে আপনাকে তো আসতেই হবে।'
রেখা বলল 'কিন্তু দিদি তা কি করে হয়? আমাদের কি প্রতিদিনই সাড়ে নটায় যাওয়া সম্ভব ?এটা যদি হয় যে বাধ্যতামূলক সকলের, সেটা তখন মেনে নেয়া যায়।'
বড়দি বললেন 'তাহলে তো আমি স্কুল চালাতে পারবো না।'
রেখা বলল 'আপনি আমাকে কি করে লোকাল টিচার ভাবলেন ,আমি বুঝতে পারলাম না। আমার বাড়ি থেকে স্কুলে ডিস্টেন্স টা তো কম নয়?'
বড়দি বললেন ' হ্যাঁ সেটা আমি জানি ।
রেখা বলল ' বাচ্চাকাচ্চা নেই সেইজন্য?'
বড়দি বললেন 'রেখা তুমি রেগে যাচ্ছ'।
রেখা বলল 'একটু রেগে যাচ্ছি দিদি। সব সময় আমাদেরকে কম্প্রোমাইজ করতে হয় ।এইজন্য
জানি আপনি যেখানে বসে আছেন ,সেখান থেকে কাজ করাটা ওটা কঠিন ব্যাপার ।কিন্তু আমাদের কথাগুলো তো ভাবতে হবে দিদি? হ্যাঁ সপ্তাহে ক'দিন যেতে হবে বলুন ¿আমি ঠিক যাবো । কিন্তু বাকি কটা দিন আমাকে একটু দেরিতে আসতে বলুন ,বাকিদের মতো।'
বড়দি বলেন' আচ্ছা দেখছি, অন্য কারো সাথে তিনদিন করা যায় কিনা?'
রেখা বলল 'অসংখ্য ধন্যবাদ দিদি।'
ফোনটা কাটার পর রেখা বলল ' আচ্ছা তো ,আমাকেও লোকাল টিচার এর মধ্যে ফেলে দিলেন দিদি। লোকাল টিচার আর বাইরে টিচার কি সবাইকে একদিন করে আসতে বললে তো কারোর কোন অভিযোগ থাকে না। কাকিমা বললেন ' কী হয়েছে রে?'
রেখা বললো 'শুনলে না আমাকে সাড়ে নটা থেকে স্কুলের টাইম করে দিয়েছে আর কিছু টিচারের সাড়ে দশটা থেকে।'
কাকিমা বললেন 'এ আবার কি কথা সবার ক্ষেত্রে এক হওয়া উচিত।'
রেখা বলে 'কি সুন্দর ঘুমচ্ছিলাম কোন বাইরের টান ছিল না। কি করতে হবে না করতে হবে কোনো দায়িত্ব নেই। কি সুন্দর সেই শৈশবের দিনের মতো একটা দিন পেলাম ।তাও সাতসকালে মেজাজটা বিগড়ে গেল।
কাকিমা বললেন' ঘুমো তো ঘুমো?'
রেখা বলল ' ঘুম তো কেটে গেল কাকিমা? আর ঘুম হবে না।'
কাকিমা বললেন 'দিল তো আমার মেয়ের মেজাজটা বিগড়ে?' '
রেখা বলল 'কাকিমা ,আজকে বুলু জেঠিমার
কাছে নিয়ে যাবে?'
কাকিমা বললেন ' যা বৃষ্টি পড়ছে এর মধ্যে বেরোবি? 'শুধু বুলু জেঠিমা কেন আরো কত জায়গা আছে অমিয় কাকার বাড়ি যাবি না? কত ভালবাসতেন তোকে?'
রেখা বলল' 'যেতে তো সব জায়গায় ইচ্ছে করছে কাকিমা? কিন্তু এই দুদিনে কি ঘুরবো বলো?
কাকিমা বলেন এই দুদিন থাকবি? তারমধ্যে তো একদিন হয়ে গেল আজকে ধরে।"
রেখা বলে ' কি করবো বলো, স্কুল খুলে যাচ্ছে দীর্ঘ প্রায় এক বছরের পর ।স্কুলে যাওয়া হয় না সেভাবে । এখন তো রেগুলার মাফিক স্কুল শুরু হয়ে যাচ্ছে।
কাকিমা বললেন ,'কিছু তোর বলার নেই। কি বলবো বল? তুই এসেছিস আমাদের কত ভালো লাগছে।'
রেখা বলল ' সময় পেলে চেষ্টা করবো আসার।'
কাকিমা বললেন-'আসবি। তোদের ই তো বাড়ি? আমরা আর কতদিন?'
রেখা মনে মনে ভাবল ' কাকিমা ছেলের নামে তো লিখে রেখেছ? যদিও জমি ফেরত চেয়ে মামলা করেছ।'
রেখা বলল কাকিমা 'বিপাশা কতদিন পর এসেছিল গো?'
কাকিমা বলেন ,'বিপাশা না তোর কাকার অসুস্থ হবার আগে এসেছিল ।কী একটা দরকারে তখন আমাদের সঙ্গেও দেখা করে গেছে।'
রেখা বলল-'হ্যাঁ বিপাশা আমাকে ফোন করেছিল?'
কাকিমা বলল 'বিপাশা মেয়েটা কত ভালো বল অথচ শুনতে পায় যে ওর পর নাকি ওকে অতটা পছন্দ করে না।
রেখা বলল-কি বলছ কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ রে ,ঠিকই বলছি ও যতবার আসে ওর বর সঙ্গে আসে না ।তারপর কোথায় কারো কাছে কিছু বলেছে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে।'
রেখা বলে অথচ দেখো বিপাশার ভেতরে কত কোয়ালিটি ছিল ।অমি ও কাকা ঠিকঠাক করে ওকে যদি পড়াশুনা ও আরো অনেক দূর যেতে পারত কিন্ত ও বিএড বা পিএইচডি যদিও করত?'
কাকিমা বললেন হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস অমিয়দাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই রে, ওই তো দোকান থেকে যায় তাই দিয়ে সংসার চলে।
রেখা বলল তা ঠিকই বলেছ দেখেছি
কাকিমা বললেন'জানিস ননী বিপাশা নাকি একটা গানের স্কুল খুলেছে?
দেখা বলল "আরিব্বাস দারুন ব্যাপার তো?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ রে ওর গানের গলা খুব সুন্দর ছিল ।গানটা তো ভালোই গাইত?'
রেখা বললো 'হ্যাঁ তা ঠিক বলেছ? কাকা দেখো ওই দোকান থেকে আয়ের ভেতরে মেয়েকে গান শেখানো ,পড়াশোনা করানো সব ই তো করিয়েছেন বল?'
কাকিমা বললেন' হ্যাঁ রে'। সবাই কত সংসারে কত প্রতিবন্ধকতা ।তারা তো সংসার করছে আর তোর বোনটাকে দেখ?
রেখা বলল 'ওদের ভেতরে কি সমস্যা হয়েছে সেটা কি তোমাকে জানিয়েছিল কখনো কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'না রে সেরকম কিছু বলে নি।'
রেখা বলল 'আমিও অনেক ওকে বুঝিয়েছি কিন্তু ও আমাকে সব সময় উল্টো কথা বলেছে।'
কাকিমা বললেন 'ও তো ভালো কথা শুনবে না ।ও যেটা ভালো বুঝবে সেটাই। তুই বল পার্থ মতো ছেলে হয়?
রেখা বলে 'আমিও তো সেটাই ভাবার চেষ্টা করেছি ।পার্থ যখন হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল 'সেটা কি তুমি জানতে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন ,' , না তো?
রেখা বলল 'ও আমাকে ফোন করেছিল। দেখতেও গিয়েছিল ,ভেবেছিলাম ,তোমাকে জানাব কিন্তু ..?তোমাদের জামাই বলল 'কাকিমা, কাকু ব্যাপারটা নিতে পারবেন না থাক।'
কাকিমা বললেন 'কেন রে কি হয়েছিল?'
রেখা বলল 'তোমাকে বলি নি?আমিও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলব না ।যাইহোক পার্থ তো এখন ভালোই আছে।'
কাকিমা বললেন 'সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়'। ওর
কাকিমা বললেন 'যা ভাল বোঝে করুক আর কি বলব?'
এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। কাকিমা বলেন ' দেখ মনে হচ্ছে যেন বর্ষাকাল।'
এমন সময় ভোলা কাকা এসে বলল 'মামনি, দেখো কেমন বৃষ্টি হচ্ছে,?'
রেখা বলল 'কিন্তু তুমি তো ভিজে গেছ কোথায় গিয়েছিলে?''
ভোলা বলল 'এই জমি দেখতে গেছিলাম।
কাকিমা বললেন 'ভোলা খেয়ে যাবে কিন্তু আবার পালিয়ে যেও না।'
রেখার দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছাঁটে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাইল,।
এমন সময় গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠল ' দেখেছ কি তাকে, ওই নীল নদীর ধারে ।বৃষ্টি পায়ে পায়ে তার কি জানি কি নাম ।জলে ভেজা...
সেই রামধনুকে চায়'।
রেখার কাছে আজকে যেন সব কিছুই ফিকে ধূসর মনে হচ্ছে। আজ যেন সেই রামধনুর রঙকে বারবার খুঁজে পেতে চাইছে।'
উদাসী বাউল মন পৌঁছে যায় তার নীল নদীর ধারে। সেখানে গেলে কি খুঁজে পাবে তারে?