উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭১
তরতাজা প্রাণ ঝরে গেল
মমতা রায়চৌধুরী
বাপরে বাপ আগুন লেগেছে যেন বাজার দরে। বাজার থেকে ফেরার পর রেখার মাথাটা গরম হয়ে গেল। সাধারণত মনোজ ই বাজার ঘাট করে।
আজ ছুটির দিন যদিও মনোজই চেয়েছিল বাজারে যেতে কিন্তু রেখা বেরোতে দেয় নি ।সবেমাত্র এত বড় একটি রোগের কোপ থেকে উঠলো। কি করে ওই বাজারে আবার ওকে যেতে দেয়? এই ভাবনা থেকেই গেছিল বাজারে করতে ।পার্থর শরীর খারাপ ,নইলে ওই করে দিচ্ছিল। তাহলে সাধারণ মানুষ কি খাবে?
দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নামিয়ে বকবক করছিল। মনোজ ঘর থেকে শুনতে পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল' কি হলো ?কার সঙ্গে কি জন্য বকবক করছ?
রেখা মাক্স টা খুলে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত পা হাত ধুয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেলো তারপর হাত ছেড়ে বলল আর বোলো না বাজার নিয়ে কথা বলছিলাম আপন মনে।
মনোজ বলল-কেন কি হয়েছে বাজারে?
রেখা বলল মূল্যবৃদ্ধি বাজারে আগুন লেগেছে দেখলাম। তবে জানো তো একটা ব্যাপার আমার একটু সন্দেহ লাগলো।
মনোজ বলল 'কি ব্যাপারে,?'
রেখা বলল' বাজারে আজকে দেখলাম যে কাঁচা আনাজ এর দাম জিজ্ঞেস করছেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ।ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা ও বলছেন?'
মনোজ বলল 'হঠাৎ এই কথা বলছ কেন?'
রেখা বলল 'আমার না একটা সিক্স সেন্স কাজ করছে জানো ।তার আগে বল তো বাজারে কি প্রতিদিনই এরকম কিছু মানুষ দরদাম জিজ্ঞেস করে?'
মনোজ বলল 'বাবা একদিন বাজার করতে গিয়ে তো তুমি একদম রিপোর্টারের মত কথা বলছ?'
রেখা বলল 'দেখলে তোমাকে আমার একটা বিষয়ে সন্দেহ হওয়াতেই তো আমি তোমাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করছি ,উত্তর দাও?'
মনোজ বলল 'না তুমি যেভাবে বলছে সেভাবে লোক দাম দর করে না ।যারা বাজার করতে যায় তারা।'
রেখা একটু ভাবতে ভাবতে বললো 'দেখো আজকে একটা কিছু বাজারের খবর পাব?'
এরকম কথা হতে হতে হঠাৎ পার্থর বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো।
রেখা বেশ হকচকিয়ে যায় আর মনোজকে বলল 'হঠাৎ পার্থদের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ কেন?'
মনোজ ও কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো।
মনোজ বলল-হ্যাঁ পার্থদের বাড়ি থেকেই পাওয়া যাচ্ছে কি ব্যাপার বল তো?'
লেখাগুলো কাকিমার কান্নার আওয়াজ পাচ্ছো ?
মনোজ বলল' পার্থর কিছু হল?'একটু ওয়েট করো ফোন করি।
রেখা বলল ফোন করাটা শোভনীয় নয় এই মুহূর্তে কেউ ফোন রিসিভ করবে না তার থেকে বরং যায় দেখে আসি।
মনে যে বললে ঠিকই বলেছ চলো যাই।
দেখা বলল-তোমার যাওয়াটা ঠিক হবে না তুমি থাকো। আমি যাচ্ছি।
মনোজ বলল' তাই হয় ?পাশাপাশি থাকি আমরা।
রেখা বলল' আরে আমি তো যাচ্ছি বাবা ।আমি আগে দেখি কি হচ্ছে। তারপরে না হয় ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে ।হঠাৎই তোমার অত ছুটোছুটি করে যেতে হবে না।
মনোজ বলল ঠিক আছে যাও তুমি।
রেখা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল দরজাটা খুলতে গিয়ে কলাপসিবল গেটে লাগলো চিৎকার করে উঠল উফ উফ বাপরে বাপ একটু তাড়াতাড়ি যেতে চাইছি সেখানে দেখো দরজা ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
মনোজ বলল-'এসো হাতে একটু জল দাও।'
রেখা বললো 'থাক আর লাগবে না।
রেখা পার্থ দের বাড়ি নিয়ে পৌঁছালো । যাবার সময় রেখার বাজানো উঠছিল এই না কি একটা চাপা উদ্বেগ কাজ করছিল কি জন্য কিসের জন্য কার এই ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। রেখা গিয়ে প্রার্থীদের বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল আর বাজাতে হলো না দেখলেও দরজাটা খোলাই আছে রেখা বাড়ির ভেতরে ঢুকলো সরাসরি ওদের ড্রইং রুমে গেল। সেখানে যেতেই শুনতে পায় পাশের ঘরে কাকিমার কান্নার আওয়াজ আসছে ।রেখা সেখানে গেল ।সেখানে গিয়ে দেখছে পার্থর জেঠতুতো ,খুড়তুতো পরিবারের লোকজন এসে হাজির ।রেখা বুঝতে পারছে না ,কি বলবে ?'
হঠাৎ পার্থ দিকে তাকিয়ে রেখা ঈশারায় জানতে চাইল কি হয়েছে?
দিশা বলল 'পার্থর ভাই শুভায়ন কে দেখিয়ে ইশারায় বোঝালো নেই?
রেখা সবটুকু বুঝতে পেরে একটু ধাতস্থ হবার চেষ্টা করছে কিন্তু ভেবে উঠতে পারছে না কেন একইভাবে এই ঘটনা ঘটলো।
রেখা জানে পার্বত্য প্রেমী এই ছেলে। আবার নিশ্চয়ই কোন দুর্গম স্থানে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল।
শুভায়ন এর বন্ধু অনীক বলল'একদম ঠিক বলেছেন।'
রেখা বলল'2019 সালে এক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় টেকিং করতে গিয়েছিল।
অনীক বলল তারপর থেকেই তো রীতিমতো কি নেশায় পেয়ে গেছিল।'
রেখা বলল' সত্যি তো পার্বত্য পথ কত দুর্গম হয়।'
অনীক বলল'জানেন আপনারা ।ও দিন রাত গুগলে পার্বত্য পথের এডভ্যাঞ্চার খুঁজতো?'
রেখা তো শুনে অবাক।
পার্থ বলল''করোনা কালে লকডাউন চলায় ২০২০কোথাও যেতে পারে নি।"
অনীক বলল'পুরনো ট্রেকিং এর ছবি ফেসবুকে দিয়ে স্মৃতিচারণা করেই সে বছর টা কাটিয়ে দিয়েছিল দিব্য ।আর ফোনে ফোন করে বল তো ভাই পাহাড বড্ড মিস করছি।'
অনীক বলল '২০২১ সালে করোনা গ্রাফ নামতেই
উত্তরাখণ্ডের টিকিট কেটেছিল।'
রেখা বললো ' কোথায় যেতে চেয়েছিল?'
অনীক বলল 'দেশের মধ্যে সবথেকে দুর্গম স্থান।'
এর মধ্যে থেকে থেকে পার্থ শুভায়ন এর মা সেন্স হারিয়ে যেতে থাকলো।
অনীক বললো জানেন 'আন্টি পার্বত্য পথ দুর্গম বলে সেগুলো সঙ্গে নিয়েছিল'.।'
রেখা বললো 'কি কি নিয়েছিল?'
অনীক বলল' জাতীয় পতাকা?'
রেখা বলল'ও জাতীয় পতাকা নিয়ে শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্ন দেখেছিল তাই তো?'
পার্থ বলল'জানেন বৌদি থেকে ছিটকুল যাওয়ার পথেই ও নিখোঁজ হয়ে যায়। '
রেখা বলল "ওরা তো সঙ্গে তো আরো পর্বতারোহী ছিল?
পার্থ বলল 17 ও 18 অক্টোবর প্রবল তুষারপাত হয় ওই এলাকায় ।'
রেখা বললো 'ঐ সময়ে কি অঘটনটা ঘটে?'
পার্থ বলল'ওদের হোদিশ না পাওয়াতে
19 তারিখ থেকে তল্লাশি শুরু করে বাহিনী।'
রেখা বলল" তারপর আর কোন খবর পাও নি তোমরা?'
পার্থ বলল গত বৃহস্পতিবার নামখানা পাশ থেকে 100 সেন্টিমিটার পুরু বরফের আস্তরণ সরিয়ে..
পার্থ আর কথা বলতে পারলো না চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল আর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
শুভায়ন এর বন্ধু অনেক বলল বরফের পুরু আস্তরণ সরিয়ে আমার প্রিয় বন্ধু শুভর উদ্ধার করা হয় নিথর দেহ।'
এরপর শুভায়ন এর বন্ধু অনীক ও কাঁদতে শুরু করে আর বলতে থাকে দুর্গম ট্রেকিং প্রাণ কাল আমার বন্ধুর।'
রেখার চোখ ও জলে ভরে উঠলো ।শুভায়ন খুব মিশুকে ছেলে ছিল। বাড়িতে গেলেই সব সময় বৌদি বৌদি বলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতো।
রেখা শুভায়ন এর মা দাদা পরিবারের অন্যান্যদের সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
ইতিমধ্যেই দেখা গেল তরতাজা এক তরুণের মৃত্যুতে পরিবার-পরিজনদের পাশাপাশি স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে এবং আস্তে আস্তে সুকান্তের বাড়ির লোকজন এ ভর্তি হয়ে যায়। রেখার অন্তরে ধ্বনিত হতে থাকে 'জীবন ও মরণের সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে..।'
রেখা আর একটু থাকত কিন্তু বাড়িতে আসতে হল মনোজের খাবার-দাবার ,মিলি ও তার বাচ্চাগুলোর খাবার- দেবার জন্য।
রেখা বাড়িতে এসে দেখছে কলাপসিবল গেট টা ভেজানো আছে তার মধ্যেই দেখছে মন কার সাথে কথা বলছে এসে দেখছে সুমিতার সঙ্গে।
রেখাকে দেখে মনোজ বলল জানো তো তোমার আই ডিয়াটাই ঠিক।'
রেখা বলল' কি ব্যাপারে?'
মনোজ বলল 'আজ করুণাময়ী বাজারে ই'বির অভিযান হয়েছিল।'
রেখা বললো 'বললাম না আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল লোকজনগুলোকে দেখে।
তারপরেই মনোজ বলল' ও বাড়িতে কি খবর?
রেখা মধ্যে কাঁদতে বলল 'শুভায়ন...
মনোজ বলল 'তাহলে দুর্গম ট্রেকিং প্রাণ কাড়ল শুভায়ানের ।'
রেখা বলল 'সেটা তো আছেই। সেইসঙ্গে কাকিমার মনে কি টানাপোড়েনই না চলছে ভেতরে ভেতরে ।কত ই না ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন।এক বছর কাকু চলে গেলেন। দুটো ধাক্কা সামলানো মুশকিল ব্যাপার।