০৮ মার্চ ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২৫




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১২৫
ময়ূরকণ্ঠী নীল আকাশ ডাকে
মমতা রায় চৌধুরী



১৪.০২.২২ সন্ধ্যে ৭.৪০
রেখার বরাবরই নিজের রুম ছাড়া ঘুম আসে না।
আলাদা রুমে গিয়ে শুতে হচ্ছে যদিও ,এখন তো এই ঘরটাকেই নিজের করে নিতে হবে ।কিন্তু প্রথম প্রথম তো ঘুম আসাটা খুবই মুশকিলের 
ব্যাপার ।তারপর যদি মানসিক শান্তি থাকে তবে
তো । যদি অশান্তি রয়েই যায়, সেখানে ঘুম কোত্থেকে আসবে?
এখন মনোজ রেখাকে একই রুমে শুতে 
হয় ।মনোজের উপায় নেই ।শুতেই হবে। না হলে বসার ঘরে গিয়ে শুতে হবে ,সেটা দৃষ্টিকটু ।
সেটা মনোজ করবে না।
এসব ভাবতে ভাবতেই কিরকম পেটের ভিতর অশান্তি শুরু হয়েছে। একদম ভালো লাগছে
 না। কেমন আনচান করছে ,ভেতরে  অস্থিরতা কাজ করছে। মনোজ মায়েদের ঘরে গিয়ে কথা বলছে। 
এই যা বমি বমি পাচ্ছে।
শীতে লেপ গায়ে থেকে ফেলে দিয়েছে।
আর রেখা থাকতে পারছে না ।
রেখাকে এবার বাথরুমে ছুটতেই  হচ্ছে।
তাড়াতাড়ি রেখা বাথরুমে গেল ', ওয়াক ওয়াক করে বমি করছে।  যা খাবার খেয়েছে সব বেরিয়ে গেল শুধু টক টক লাগছে।চোখেমুখে ঠান্ডা জল দিল।
বমি করে যেন একটু আরাম লাগলো কিন্তু তবুও ভেতরের অস্বস্তি কাটছে না। আবার শুয়ে পড়ল আবার বমি পাচ্ছে এবার  রেখা আবার উঠলো আবার বাথরুমে গেল।
আবার বাথরুমে গিয়ে ওয়াক ওয়াক ওয়াক করে বমি করল। এবার অনেকটা বমি করেছে।
এ বাবা এ কি এবার তো পায়খানা পাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি জামা কাপড় ছেড়ে ল্যাট্রিনে গেল।
মনোজ কোন কারনেই একটা আওয়াজ পেয়ে ঘরে এসে দেখল রেখা নেই। মনোজ ভাবলো নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছে রেখা।
বাথরুম থেকে এবার আবারো ওয়াক ওয়াক এর আওয়াজ পেল। 
সন্ধিগ্ধ চিত্তে মনোজ ভাবল
'ঠিকই শুনেছে। তাহলে কি রেখা বমি করছে?'
মনোজ বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে দরজা নক করে বলে 
"রেখা, রেখা, রেখা।'
'কি হলো আওয়াজ দিচ্ছ না কেন ?
কি হয়েছে ?
তুমি কি বমি করছ?'
বাথরুম থেকে উত্তর দিল ' শরীরটা কেমন করছে।'
"সেকি কখন থেকে?'
"অনেকক্ষণ থেকে।'
'বললে না ?ডাকতে তো পারতে,,?'
"হ্যাঁ, পারতাম ।তুমি তো গল্প করছিলে তাই ভাবলাম….।"
Ok
'কিন্তু শরীর খারাপ হলে তো ডাকতে হবে না?'
'এখন কেমন বোধ করছ?'
'পটিও করলাম।'
'এ বাবা ,ক' বার করলে?
"চারবার হয়ে গেছে।'
 "সে কি জ্বর আছে?'
"না।'
"থ্যাংকস গড।'
" বাথরুম থেকে বেরোতে পারবে তো?'
এরমধ্যে আবার রেখা ওয়াক ওয়াক করে বমি করল।
"হ্যাঁ।
ঠিক আছে। আস্তে আস্তে বেরোও।
এতক্ষণ কষ্টের মধ্য ও  মনোজের এই কথার জন্য রেখার মনটা ভাল হয়ে গেল। এ যেন তৃষ্ণার্ত হৃদয় এক পশলা বৃষ্টির শ্রাবন'এর ঘনঘটা ।
রেখা শুধু কি চেয়েছে একটু ভালোবাসা, একটু ভালোবেসে কথা বলা ব্যস। আর কি চাই?'
মনোজ  আবার দরজায় নক করল' রেখা, রেখা ,রেখা. আ. আ. আ
বেরোচ্ছে না কেন? খুব খারাপ লাগছে।
শরীরটাও উইক লাগছে।
 দরজা খোলো।'
রেখা দরজা খুলে দিল।
মনোজ এসে রেখার হাতটা ধরল।
উফফফ এক ঝটকায় যেন রেখার শরীর ভালো হয়ে গেল। পরম বিশ্বাস ভালবাসার হাতটাই
  সারা জীবন খুঁজে গেছে রেখা।
ওদিক থেকে ওর শাশুড়ি মা আর ননদ  বলছে 'দেখো তোমার ছেলের কান্ড দেখো গে।'
" কেন রে কি হয়েছে ?'
"দেখলাম তো রেখাকে বাথরুম থেকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে। যতসব আদিখ্যেতা।'
রেখার কানে সব কথাগুলো এসে পৌঁছাচ্ছে কিন্তু রেখা এসব কোন কিছুই ধরতে চাইছে না ।
মনোজের দিকে তাকিয়ে আছে।
 মনোজ বলল 'কি হল? তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ?'
"তোমাকে দেখছি কত দিন পর…।'
"তুমি আমাকে কতদিন পর দেখলে?'
"হ্যাঁ ,সেরকমই  ।মনে হয় প্রায় এক যুগ পর।' মাঝে মাঝে তুমি যে কি বল না ?আমি কিছু বুঝতেই পারিনা তোমার কথা।'
ছাড়ো ওসব। চলো ওষুধ খাবে। ডাক্তারকাকাকে ফোন করছি । তারপর ওষুধ খাইয়ে দিই।
শোনো আজকে রান্না বান্নার দিকে যেতে পারবে না।
 মিলিদের রান্নাটা দেখছি আমি চাপিয়ে দিচ্ছি।
রেখা ভাবছে কোন মনোজকে দেখছে । পানকৌড়ির মত টুক করে ডুব দিয়ে  যে ভালোবাসা নিমিষেই মিলিয়ে গেছিল বলে মনে হয়েছিল ।তার হিসেব নিকেশ কষতে কষতে মনে হয়েছিল জীবনে নিট ফল জিরো এসে 
দাঁড়িয়েছে ।কই না তো সেরম কিছু না। তাহলে কি সে মনোজের মনটাকে বুঝে উঠতে পারছে
না ।তার ভেতরে কি শুধুই চলছে
 টানাপোড়েন ?কি জানি? জানি না।
কি হলো কিছু বলছো না ।
"আজকে স্কুলে যাবার কথা ছিল । '
"স্কুল এ যেতে হবে না।"
ওদিকে কলিং কে বেল বাজাচ্ছে' জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা'গান হয়ে যাচ্ছে।
আবার কলিংবেল বাজছে ।
মনোজ এবার চিৎকার করে বলল কেউ কি দরজাটা খুলতে পার না? দিদি, একটু দরজাটা খোলো না ,দেখো না কে আসলো?'
মনামী গিয়ে দরজাটা খুলল অনেক বিরক্তি নিয়ে 'কাজের মাসী কাজে এসেছে,। মনোজর ঘরে এসে দিদি বললো" তোদের কাজের মাসি 
এসেছে ।'
"ও আচ্ছা, দরজাটা ভেজিয়ে দে।'
কাজের মাসি একটু অবাক হয়ে গেল  রোজ বৌমা  দরজা খোলে । আজ কি হল ?জিজ্ঞেস করলো বৌমার কি কিছু হয়েছে?
রেখার ননদ মুখটা বাঁকিয়ে বলল 'কি হয়েছে জানি না।যাও তুমি গিয়ে দেখো।'
মাসি গজগজ  করতে করতে আসলো। একটা কথা সহজ ভাবে জিজ্ঞেস করলে, এরা উল্টো উল্টো জবাব দেয়। কিরে বাবা।
'বৌমা ,ও বৌমা।'
রেখা ঘর থেকে আওয়াজ দিল
" হ্যাঁ, মাসি এসো।'
রেখার ননদ আবার বলল' যে রকম ক্লাস সেরকম ক্লাসের সঙ্গেই তো পড়বে, তাই না গো মা?
কি জানি দেখি তো গিয়ে সত্যি সত্যি কিছু হয়েছে কিনা?
চল দেখে আসি?'
'তুমি থামো তো মা। আমরা এসেছি করে খাওয়াতে হচ্ছে না, কাজের অজুহাত আর কিছু না।'
'কি হয়েছে বৌমা?'
'মাসি হঠাৎ করে শরীরটা এত কষ্ট হচ্ছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল ,কয়েকবার বমি হলো ।প্রচুর বমি হয়েছে আর পটিও হলো।'
মনোজ এসে ওষুধ খাইয়ে দিল।
'ঠিক আছে তোমায় উঠতে হবে না তুমি বসো।'
'চা করতে হবে তো মাসি?'
'না চা করতে হবে না ।আমি খাব না চা ।আগে সুস্থ হও।'
তুমি না খেলে কি হবে, বাড়ির লোকজনের জন্য তো করতে হবে।'
'আরে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তুমি আগে সুস্থ হও ।উনারা করে নেবেন।'
রেখার ননদ কান পেতে শুনছিল।
মনামী গিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে লাগলো 'মা কাজের মাসি অব্দি দেখো কিরকম বলছে গো?'
ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা মন আমি তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল। রেখার শাশুড়ি তো একেবারে ভস্মে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
রেখার শাশুড়ি ননদ চলে আসলো রেখার ঘরের সামনে। তারপর কাজের মাসি কে উদ্দেশ্য করে বলল' 
' বাড়িটা কার বুঝতে পারছি না তো?
তোমার এত বড় আস্পর্ধা মাসি,?'
মাসি তো একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হতভম্ব হয়ে বলল
'কি করলাম আমি আবার।'
রেখার শাশুড়ি তো একেবারে রণচন্ডী মূর্তি ধারণ করে বলল
'তুমি একটু আগে কি বলছিলে চা করা নিয়ে।'
কাজের মাসি খুব শান্ত গলায় বলল' ও এই কথা। আমি বললাম বৌমা অসুস্থ আমার জন্য চা করতে যাবে সেজন্য  বারণ করেছি। কি এমন বলেছি?'
'আর কিছু বলনি আমাদের চা করা নিয়ে।'
কাজের মাসী বললো ও হ্যাঁ আর আর একটা কথা বলেছি যে 'তুমি অসুস্থ থাক ,বাড়ির লোক করে নেবে ।কি খারাপ কথা বলেছি ?দেখতে পাচ্ছেন না বৌটা অসুস্থ। আমরা পরের লোক হয়ে বুঝতে পারছি আর আপনারা বুঝতে পারছেন না?'
রেখার শাশুড়ি তো একেবারে বলে উঠলো
'হায় হায় হায় ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। ((গালে হাত দিয়ে রেখার শ্বাশুড়ি বললো।) তারপর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল
'মনু এ বাড়িতে থাকতে পারবো না রে, হায়, হায়, হায় । বাড়ির বউ কাজের বউ সব এক হয়ে যদি আমাদের সঙ্গে এভাবে লড়তে থাকে,আমরা কি করে পারব বল?'
 মনোজ বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল'
' কি হয়েছে ?
তোমরা এরকম হা-হুতাশ কেন করছো?
একটু চুপ করতে পারোনা মা ।সবসময় তোমাদের মুখে যা আসে তাই বলে যাচ্ছ ।'
তুই আমাদেরকে বলছিস আর এতক্ষণ যে কাজের বৌ আমাদেরকে কত কথা বলল।'
রেখা কাজের মাসিকে বলল মাসি তুমি গিয়ে কাজ করো যাও।'
এখান ননদ বললো সকাল থেকে এক কাপ চা ও পেলাম না।
'আজকে আর চা খাওয়া হলো না বোধহয়।'
মনোজ দিদিকে বলল 'তুই একটু কর না 
দিদি ।দেখছিস তো ওর শরীরটা খারাপ।'
'আমি চা করব?
"কেন বাড়িতে চা করিস না।'
"হ্যাঁ, বাড়িতে করি কিন্তু এখানে এসে করব। 'তাহলে চা না খেয়ে বসে থাক।
রেখা বলল 'ঝগড়া করো না তো ,ভালো লাগছে না  আমি যাচ্ছি চা বানাতে।'
রেখা উঠে রান্না ঘরের দিকে যাবার চেষ্টা করল।
মনোজ বললো' তুমি উইক আছো। তুমি কি করে এখন চা করবে ?একটু রেস্ট নাও।'
রেখা আস্তে আস্তে রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাস জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দিল । অন্যদিকে মিলি আর তার বাচ্চাদের জন্য ভাত বসিয়ে দিল।'
মাঝেমাঝেই পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে আর বমি পাচ্ছে।
কাজের মাসি একফাঁকে রান্না ঘরে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বলল,_ বৌমা তুমি উঠে আবার এই রান্না ঘরে ঢুকেছ?'
এক গাল হেসে বললো 'কী করবো মাসি বলো?'
তুমি কিন্তু চা খেয়ে যাবে মাসি।'
'তোমার বাচ্চাগুলো তো চেঁচাচ্ছে গো।'
কটা বিস্কিট দিয়ে দাও না ওদেরকে।
'আমি দেব? কেন তুমি ভয় পাচ্ছ তোমাকে তো চিনে গেছে। এর আগের দিন খেতে দিলে না?'
'ঠিক আছে, দাও দিয়ে দিচ্ছি।'
রেখা ৮-১০ ব্রিটানিয়া বিস্কিট মাসির হাতে দিল।
মাসিকে দেখে বাচ্চাগুলো আরো চেঁচাতে লাগলো। মাসি আদর করে করে ডাকছে' তুলি, পাইলট, এই নাও বিস্কিট খাও।
রেখার ননদ বলল' মাগো মা  কান্ড দেখে মরে
 যাই। কুকুরের জন্যএত আদিখ্যেতা।'
রেখা চা করে নিয়ে মনোজ, শাশুড়ি মা আর ননদকে দিল।
এমন সময় মনোজের ফোনে ফোন আসলো। মনোজ ফোনটা রিসিভ করে বলো হ্যালো'
'হ্যাঁ রে কেমন আছিস?"
"কে রে সুরো?'
'ছিলাম একঅধম কোন এক সময়।
তোরা তো একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠেছিস?'
'কেন কেন?'
কেন আবার দেখা তো হয়ই না। ফোন করতেও ভুলে গেছিস আজকাল।'
'ও তাই ?আর তুই বুঝি খুব ফোন করিস?'
'ফোনটা কে করলো শুনি?'
'ঠিক আছে। শোন আজকে রেখাকে পাব?'
"কেন কি হয়েছে বল না?'
শিখার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোদেরকে কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আসতে হবে toআগেই বলে 
দিলাম ।কোন অজুহাত আমি শুনবো না।'
মনোজ  যেন আকাশ থেকে পড়ল ।অতি আশ্চর্য হয়ে বলল
"এক সপ্তাহ আগে?'
হ্যাঁ আমার যেমন বোন তোরও তো তেমনই বোন।'
'সে তো ঠিকই।'
" তাহলে কোন কথা নয় ফেব্রুয়ারি মাসের 28 তারিখে বিয়ে।'
'কার সাথে বিয়ে হচ্ছে?
'কার সাথে আবার। আমার শালার, শালার সঙ্গে।'
'ও কল্যাণের সঙ্গে।'
' হ্যাঁ রে ,খুবই ভালো ছেলে।'
'কল্যান বরাবরই ভালো ছেলে। তারপর কলেজের প্রফেসর বলে কথা। খুব ভালো হয়েছে।'
'এই সমন্ধ টা তো অনেক আগেই দিয়েছিল।  শিখা কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। যাই হোক এবার পুজোতে গ্রামে গিয়ে কল্যাণের সঙ্গে শিখার আলাপ হওয়াতে, দুজনারই ভালো লেগেছে।'
'ভালো খবর।'
'রেখাকে একটু ডেকে দে।'
'রেখার শরীরটা একটু খারাপ আছে রে সুরো।'
"কি হয়েছে রে?'
"কাল রাত থেকে বেশ কয়েক বার বমি
 করেছে ।পায়খানা হয়েছে।'
"সে কিরে! ওষুধ খাইয়েছিস?'
"তাহলে একটু রেস্টে থাকতে বল।'
'আর রেস্ট রান্নাঘরে ঢুকে বসে আছে।'
'বড্ড বাড়াবাড়ি তোর । ওর হাতের রান্না না খেলে তো পেট ভরে না।'
"বাড়িতে দিদি,মা এসেছে না?'
'ও শোন, বিয়েতে কিন্তু তাহলে দিদি আর মাসিমা কেও নিয়ে আসবি কেমন?'
আর শোন, থাক আজকে রেখাকে ডাকতে হবে
 না ।আমি অন্য সময় আবার ফোন করে 
নেব ।ভালো থাকিস সবাই।'
'তোরাও ভালো থাকিস।'
'ফোন কেটে দিল।'
এরপর মনোজ রান্নাঘরের দিকে গেল।
  রেখাকে দুটো গোলাপ ফুল হাতে দিয়ে বলল 'হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।'
রেখা তো একেবারে অবাক। কাকে দেখছে? চিনতে পারছে না মনোজকে? মাঝে মাঝে কেন তাহলে রেখার সাথে এরকম করে?'
মনোজ বেশিক্ষণ ওয়েট করল না শুধু বললো' 'অবাক হয়ে গেছ, আমি ভুলে গেছি ভাবলে?'
রেখা হতভম্ব হয়ে গেল
 আর ভাবলো কেন তাহলে এরকম হয়। মনোজকে যেন চিনতে পারে না মাঝে মাঝে।
ভ্যালেন্টাইন্সডের কথা আসতেই রেখার মনে আবার পানকৌড়ির এর মত উঁকি দেয় স্বপ্নীলের কথা। সে এক অন্যরকম ভ্যালেন্টাইন্স কাটিয়েছে।
সে যেন ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীল আকাশে তারাদের ঐ মিছিলে ভেসে গেছিল ।
মনোজ কি পারবে  রেখাকে নিয়ে ময়ূর কণ্ঠী নীল আকাশে তারাদের মাঝে হারিয়ে যেতে?
এর মধ্যেই ভাবনার ছন্দপতন ঘটায় মাসির ডাকে 'ও বৌমা, বৌমা আমি আসছি।'
রেখা হেসে বলে' হ্যাঁ ,মাসি এসো।'

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২৪




উপন্যাস 

টানাপোড়েন১২৪
রোদ্দুর হোক অবেলায়
মমতা রায় চৌধুরী




সময় বয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায় ঢেকে গেছে 
বেলা ।তাই স্বপ্ন দেখতে ভয় লাগে। কি হবে স্বপ্ন দেখে এই অবেলায়? তবুও পোড়ামন স্বপ্ন দেখে 
রোদ্দুর ডাকটিকিট নিয়ে বেঁধে রাখবে তাদের এক আঁচলে। তাই রেখা ভালোবাসার 
কাঙাল ।ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
  সকালে উঠে রেখা কাজ করতে করতে এসবই  ভাবছে। তার শাশুড়ি মা  তাকে এখন মেনে নেবে তো? গতকাল এসেছেন ওনারা ।কালকে সেইরকম খারাপ ব্যবহার কিছু করেন নি। যদিও ননদের কথার মধ্যে লঙ্কার ঝাল মেশানো ছিল। কিন্তু রেখা সেগুলোতে মনে রাখেনি।
সকাল থেকে নতুন উদ্যমে শাশুড়ি মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শীতকাল শাশুড়ি মার কষ্ট হবে তাই আগেই গিজার চালিয়ে জল গরম করে রেখেছে ,বাথরুমে গিয়ে যাতে ঠান্ডা জল স্পর্শ করতে না হয়।
সারারাত একটা উত্তেজনা কাজ করেছে এবার বোধহয় মায়ের ভালবাসাটুকু ফিরে পাবে। রেখার মা তো কবেই স্বর্গে চলে গেছেন। মায়ের প্রতিচ্ছবি শাশুড়ি মার মধ্যে দিয়েই খোঁজার চেষ্টা করছে । 
সকাল সকাল আজ কলিংবেল বাজছে' জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।'
লেখার আজকে নতুন রুমে ঘুম হয়নি তারপর একটা ভাব নাতো ভেতরে ছিল একটা আশার ভাবনা তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলেছে।
মাসিকে দেখে এক গাল হেসে বলেছে 
"মাসি সকাল-সকাল এসেছ ,বেশ ভালো হয়েছে।'
'আর বোলো না আজকে এক জায়গায় যাব। তাই তাড়াতাড়ি আসলাম।'
'বেশ করেছো। এসো এসো ভেতরে এসো।'
সকালে কাজের মাসি এসেছে ।কাজের মাসিকে বুঝিয়েছে।
'মাসি এখন থেকে তোমাকে একটু এক্সট্রা কাজ করতে হবে ।তার জন্য তোমাকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হবে।'
'কেন গো তোমাদের আবার বাড়তি কাজ কি হলো এইতো দুটি প্রাণী।'
'হ্যাঁ গো, এখন থেকে আমার শাশুড়ি মা থাকবেন তো, তাই উনার কাপড় জামাগুলো কেঁচে দেবে ঠিক আছে। আর যদি কিছু বলেন সেগুলো একটু করে দিও।
"হ্যাঁ গো ,বৌমা তুমি বলছো, আর করে দেবো না?
উনি আবার আমার সাথে খ্যাচ খ্যাচ করবেন না তো বৌমা?'
"ও মাসি যদি দুটো কথা বলেও থাকেন, তুমি কিছু মনে ক'রো না ।বয়স হয়ে গেছে তো। আমার শাশুড়ি মা খুব ভালো মানুষ।'
'ঠিক আছে, বৌমা। তুমি এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে ,তাই হবে।'
ইতিমধ্যেই শাশুড়ি মা ঘর থেকে বেরিয়ে রেখাকে এমন শাড়ি পড়িয়ে দিলেন তাতে উনার ভালো মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে গেল আর রেখা জীবনেও ভুলতে পারবে না।
'সকালে উঠে কাজের বউ এর কাছে আমার নামে নিন্দা করছো বৌমা?
'এক দিনও হলো না এসেছি বাড়ীতে, এর মধ্যে নিজের স্বরূপটা দেখিয়ে দিলে?'
'মা আমি..।'
রেখা কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল সেটা সম্পূর্ণ করতে দিল না।
তবুও রেখা ব্যাপারটা বোঝার জন্য আরেকবার বলতে যাচ্ছিল
 'মা আমি…।'
শাশুড়ি মা হাত তুলে রেখার দিকে দেখিয়ে বললেন-
'আর তোমাকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না বাছা।আমি সব শুনেছি।'
'না মাসিমা বৌমা সেরকম….।'
কাজের মাসিও বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিল,.
'এই তুমি কাজের বউ।। কাজের লোকের মতো থাকো ।আমাদের মধ্যে কথা বলতে এসো না তো?
যতসব আদিখ্যেতা।'
কাজের মাসি ও রেখা দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আর চোখের ইশারায় বুঝাতে চাইলো এসব কি হচ্ছে?
'একেতে রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর 'এবার
ননদ এসে ফোড়ন দিল।
'শুনলে মা, কেমন কাজের লোকের কাছে তোমার নিন্দে করছে । তোমার এ বৌ ঠিক হবার নয় গো মা?'
"তাইতো দেখছি মনু এমন মেয়েকে বিয়ে করে আনলো সংসারে। আমার হার মাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল।'
মনোজ ঐএসব কথা কাটাকাটির মাঝে এসে উপস্থিত হলো
'কি হলো তোমরা সাতসকালে চিৎকার করছো কেন ?এটা বাড়ি না অন্য কিছু?'
'তোর বৌকে জিজ্ঞেস কর না?'
মায়ের দিকে তাকিয়ে মনোজ' বললো ' কি বলছো, তুমি এসব?'
কাঁদতে কাঁদতে বলল'' আমি ঠিকই বলেছি রে ,তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না, তাই 
তো ? মেয়েকে কাছে টেনে নেয় বললেন 'মনামির কাছে শোন।'
'হ্যাঁরে ভাই তোর বউ আর কাজের মাসি দুজনে মিলে কুটকাচালি করছিল।'
মনোজ বলল' রেখা ওরকম মানসিকতার মেয়ে নয় ।
মনামী বলল 'দেখলে মা, কেমন গায়ে ফোসকা পড়ে গেল।
'হ্যাঁ ,তা একটু পড়লে বটে।
অকারনে তোমরা অনেক কথা বলছো।
মনোজের কথাগুলো  রেখার কানে আসলো।
যত সব মেয়েলী কুটকাচালি।মনোজ কথাগুলো বলে চলে গেল।
রেখা তো ওখানে ধপ করে বসে পড়েছে, মাথায় হাত দিয়ে।
কাজের মাসি কাজ করে এসে বলল 
'বৌমা এখানে বসে আছো ?যাও চা খেয়ে নাও।'
' মাসি তোমাকেও চা দেয়া হয়নি ।তুমি বসো, আমি চা বানিয়ে আনছি'। রেখা কথাগুলো যখন বলছে তখন ওর  কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে, চোখের কোনে জল।
মাসি বলল " ও বৌমা , রোজই তো  চা খাই, আজ না হয় নাই খেলাম।'
"চলো বৌমা দরজাটা লাগিয়ে দেবে আমি 
যাই ।দেরী হয়ে গেল।"
"চলো মাসি '
মাসি যাবার সময় গজগজ করতে করতে বলল "এত ভালো বৌমা, কারণে-অকারণেই কথা শোনানো। বৌমা শাশুড়ির নামে প্রশংসা করল। কত ভালো মানুষ বলে আমার সামনে পরিচয় দিল।
আর শাশুড়ি মা দেখো… '।
দরজার কাছে এসে মাসী বললো
' বৌমা যাও ,ভেতরে যাও। চা করে খেয়ে নাও গা।'
রেখা দরজা বন্ধ করতে করতে ও দিক থেকে মনোজের চেঁচানোর আওয়াজ পেল। কিন্তু কোন আওয়াজ দিল না ।
মনোজ আবার তার  আর্তি প্রকাশ করল
'রেখা ,রেখা, রেখা .আ. আ. আ।
রেখা মনোজের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বলল "কি বলছ?'
আজকের চা টা কিছু হবে,না হবে না?
'কেন চা হবে না কেন?'
সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি এতটা বেলা হলো এখনো চা পেলাম না।
"একটু ওয়েট করো এখনি পাবে' বলেই রেখা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
ঘরের মধ্যে শাশুড়ি মা আর ননদ বসেছিল।
দুজনাই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিল।
"সে কিরে তোকে কি এত বেলা করেই চা খেতে হয় নাকি?'
মনোজ কোন কথার উত্তর দিলে না।
মনামী বলল' 'চাকরি করা বউ এনেছো ,অত কিছু চাইলে হবে?'
খোঁচা মারা কথা হৃদয়ে তীর বিদ্ধ হয়।
সব কথাগুলোই রেখার কানে গেল।
রেখা গতরাত্রে যে আশা নিয়ে বুক বেঁধেছিলো তা যেন ভষ্মে ঘি ঢালার মতো হলো।
তবুও চেষ্টা করছে সোনা মিললেও মিলতে 
পারে।
ওদিকে রেখার গলার আওয়াজ পেয়ে মিলি আর ওর বাচ্চারা চিৎকার শুরু করেছে।
মনোজের মা বলল
' তোকে বলেছিলাম না ,যে ওই অসভ্য , অপয়া জীবগুলোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবি।'
মনোজ বলল '-কি বলছ মা তুমি ,।ওরা অবলা জীব। আর ওরা অপয়া হতে যাবে কেন? ওরা প্রভুভক্ত জীব।'
মনামী বললো' এসব কথা বলো না মা ।তোমার বৌমার কাছে এরা চোখের মনি। এইজন্যই তো ভাই কিছু বলতে পারেনা ।চাকরি করা মেয়ে না?'
সব কথাগুলোই রেখা শুনতে পাচ্ছে। আসলে রেখা শুনিয়েই বলা হচ্ছে।
রেখা চা করতে করতে ভাবছে আজ স্কুলে যাবে কিনা? আজ স্কুলে গেলে তো আর রক্ষে নেই। এমনি অশান্তি শুরু হয়ে গেছে।
তবুও মনে মনে ভাবছে এখানে সব মেনে চলার দরকারটাই বা কি সে তো ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে কিন্তু না রেখার বিবেক বলে একটা কথা বলে যদি মিলেমিশে শান্তিতে থাকা যায় সেটাই ভালো। যদি নিজেকে কিছুটা সেক্রিফাইস করতে হয়, সেটাই ভালো।
চা করে কাপগুলো সাজিয়ে নিয়ে গেল ঘরে। মনোজকে দিল ,শাশুড়ি মাকে দিল, ননদ কে দিল।
তারপর রেখা  মিলিদের কাছে গেলো ওদের কিছু খাবার নিয়ে।
এরমধ্যে মনোজ গিয়ে বলল' তুমি আজকে স্কুলে যাবে না?'
'কি করব বলো স্কুলে যাব, কি যাব না?'
' তুমিই জানো স্কুলে যাবে, কি যাবে না?
তবে এটা বলতে পারি মা, দিদিরা এসেছে আজকে না গেলে ভালো হয়  এবার তুমি বিবেচনা কর, কি করবে,?"
রেখা কোন কথা বললা না।
 মনোজ বলল 'তোমাকে তো জিজ্ঞেস করছি তুমি কিছু বলছো না?"
রেখে শুধু মনোজের দিকে তাকিয়ে রইল।

মনোজ বিরক্ত হয়ে বলল' এখন দেখছি তুমি বোবা হয়ে গেছো।
 নাকি, আমার সাথে কথা বলতে তোমার কষ্ট?'
রেখা বলল আমি স্কুলে গেলে তোমার ভালো লাগবে তো?
আমার ভালো লাগা, না লাগা তোমার কী এসে যাবে?'
আমার তো অনেক কিছু এসে যায় কিন্তু তোমার কি কিসে, কি এসে যায় _সেটা এখনো বুঝতে পারলাম না।'
'দেখো রেখা এরকম  বাঁকা বাঁকা কথা বলো না তো। আমার ভালো লাগছে না।'
'সেজন্যই তো চুপ করে ছিলাম।'
মনোজ ওখান থেকে চলে গেল গজ গজ করতে করতে।
রেখার দুচোখের জল পড়তে লাগলো।
রেখা ভাবছে সময় যত বয়ে যাচ্ছে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে বেলা ।স্বপ্নগুলো তাই অবেলায় পড়ে থাকে অনাদরে আর এই স্বপ্নের ঘোরে কোন ঝড় উঠবে 
কিনা, বাতাসে কোন ফুলের গন্ধ ছড়াবে কিনা?
তার মন দোলাচলাতায় দুলছে।
তবু ভাবছে শুধু বেঁচে থাক অভিমানগুলো নতুন কপাল ছুঁয়ে ।তবু প্রান ভরে দেখি আকাশে মেঘের আনাগোনা , মেঘ আসুক এলোকেশে। যদি বেঁধে রাখতে যদি পারি। তারপরেই আলসে পিয়ন ডাকটিকিট দিয়ে যাক রোদ্দুরের। মিল আর তার বাচ্চাদের আদরে ক্লান্ত প্রভাতের স্মৃতিগুলো
দূরে সরিয়ে প্রত্যাশায় থাকে রোদ্দুর নিশ্চয়ই তার জীবনে আসবে নতুন প্রভাত হয়ে। ফিরে পাবে মায়ের ভালোবাসা, স্বামীর বিশ্বাস -ভালোবাসা ভরা এক আকাশ।

কবি মহুয়া চক্রবর্তী এর কবিতা




নারী
মহুয়া চক্রবর্তী


  মানুষ হয়ে এলে তুমি
                 এই ভুবনে, 
  তবু তোমার হুঁশ এলো না
                     এই জীবনে।
    
  বনের পশু ও বোঝে যখন
           নিখুঁত ভালোবাসা 
   পুরুষ শুধু মেটায় তার
                     নিছক পিপাসা।
 
      পথে পথে পুড়ছে দেখো
                   নারীর সম্মান, 
      নিজের জীবন পণ্য করে
                       করছে জীবন দান।
  
      নারীকে বিবস্ত্র করে
                  ওদের আসে সুখ,
        অমন সন্তান জন্ম দিয়ে
                           পুড়ছে মায়ের মুখ।
      
           সে যুগ হয়েছে বাঁশি
                    যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না
            নারী রাই ছিল দাসী। 
  এল বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি
      কেউ রবে না বন্দী কাহারও-
                       বেজেছে ঢাক আজি।
  
       নারী তোমার জন্মদাত্রী
                     নারী তোমার গৃহিণী
        নারীবিহীন পিতা নামের
                               পরিচিতি যে আসেনি।।