উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৭৮
জীবনের নতুন স্বাদ
মমতা রায় চৌধুরী
আজ রেখা আর একটু হলেই ট্রেন মিস করতো,কপালগুনে পেয়েছে । রেখা ভাবার চেষ্টা করলআজ কি বার?কি বার ,কি বার। ট্রেনে বসে বসে ভাবছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভাবার পর মনে পড়লে , রেখা চিৎকার করে উঠল "ইউরেকা ,ইউরেকা ,আজ মঙ্গলবার। কি করে ভুলে গেল,,বজরংবলীর পুজো দিয়ে আসল'। বজরংবলীই রক্ষা করেছে।।
কিন্তু লেডিস কম্পার্টমেন্ট উঠতে পারে নি। উঠেছে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে। এই কম্পার্টমেন্টে ওঠা মানেই এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। পুরুষের সমাবেশ । শুধু তাই নয়,বিভিন্ন বয়সের পুরুষের সমাবেশ ,কিছু বলার উপায়ও নেই। বেশিরভাগ পুরুষরাই মহিলাদের দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকায় ।তাই ব'লে ভালো কেউ
নেই ?ভালো ও আছে। আর আছে বলেই পৃথিবীটা চলছে। আর এই কম্পার্টমেন্টে সিটে বসা মানে যদি দুই দিকে পুরুষ থাকে তাহলে তো মহিলাদের স্যান্ডউইচ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কেউ কেউ তো এমন ভান করেন যেন এত ঘুম পেয়েছে ঘুমিয়ে পড়েন ঘাড়ের ওপর। আবার কেউ এমন ভাবে কনুইটাকে রাখেন তা দিয়ে যে আরো কি মারাত্মক কাজ করা যায় তা সেই ধরনের পুরুষ বলতে পারবেন আর পারবেন যার সাথে ঘটনাটি ঘটেছে সেই মহিলা। তবে সেই মহিলা হয়তো বলতে গেলেও বলতে পারবে না,যে কাজটি করছে তার কিন্তু কোনো রুচি বোধ বলে কিছু নেই। রেখা এই অস্বস্তিকর পরিবেশ এর হাত থেকে বাঁচার জন্যই লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকে যদি লেডিস কম্পার্টমেন্ট উঠতে হতো তাহলে হয়তো ট্রেনটাই পেত না।
তবে আজকে রেখার কপালটা মনে হচ্ছে ভালো আজকে সিট পেয়েছে এমন জায়গায় একপাশে ভদ্রমহিলা মাঝখানে রেখা তার পাসে আর একজন ভদ্র লোক। সিটে বসে আছে কয়েকজন
যুবা ,মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এরমধ্যে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ছেলে ছোকরা আড্ডা দিচ্ছে তারা তাদের মত ।আড্ডা দিচ্ছে মাঝবয়সীরা। সেই বয়সীদের মধ্যে একজন বছর চল্লিশের নিচে ভদ্রলোক আর এক ভদ্রলোককে বলছে (এদের দেখে মনে হল যে এরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোমতো চেনে,)
"কিরে আজকে কি অফিসে ডুব দিবি নাকি?
"না ভাই , সেটি হবার জো নেই।"
"কেন কেন?"
বাড়িতে হেড অফিসে র বড়বাবু নয় বড় কর্ত্রী তারা আবার টাইম এর ব্যাপারে ভীষন পাংচুয়াল।"
"তা যা বলেছ ভাই।"
"তারপর বাড়তি পাওনা তো রয়েছে ই।"
*একদম হাঁপিয়ে উঠছি দিনকে দিন ভাই।"
"হ্যাঁ ,প্রথম অনুরাগের সেই মুহুর্তগুলো যেন ক্রমশই চাপা পড়ে যাচ্ছে এখন যেন সম্পর্ক গুলো শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য প্রয়োজন মিটে গেলেই…..?'
"হা হা হা" করে প্রত্যেকে হেসে উঠলো।"
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এদের কথাবার্তাগুলো শুনছিলেন , তখন বললেন এগুলো এনজয় করো।
যারা এতক্ষণ গল্প করছিল বিষয়টা নিয়ে তারা তা তো হ্যাঁ করে চেয়ে রইল ।
'মানে আপনি বলতে চাইছেন বিরক্তিকর মুহূর্ত গুলো এনজয় করব।"
"আমার তো মাঝে মাঝে সংসার ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে।"
ভাগ্যিস অফিস টুকু আছে, বাড়ির বাইরে বেরোতে পারি তাই যেন অক্সিজেন নিতে পারি।"
বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন এই জায়গাটাই তো তোমাদেরকে ধরাতে চাইছি।
বাড়িতে যারা থাকে তারা তো সবসময় বাড়ীতেই ব্যস্ত ।বাইরে তারা বেরোতে পারে না ।তাদের অক্সিজেনের জায়গা কোথায়?
মধ্য বয়স্ক একজন বলল "তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন জায়গাটা এই ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে।"
বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন 'ঝগড়া করছেন কেন?
কি বলছেন আপনি বাড়িতে যতক্ষণ থাকবো ততক্ষণ হয় মা বাবাকে নিয়ে কান ভারি করা,না হয় বাচ্চাদের বায়নাক্কা নিয়ে কথা ,না হয় টিভি দেখা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা ,না হয় সিগারেট কেন এত খাচ্ছি ।তারপর তো রয়েছেই নানা আচার বিচার ।"
বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন "এইগুলো আছে বলেই জীবন এতটা মধুর সুন্দর।
আজ আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন বাড়িতে একা সন্তানেরা যে যার মত প্রতিষ্ঠিত তারা নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। যে সব থেকে কাছের সে তো কত আগেই টা টা করে চলে গেছে।"
প্রত্যেকে খেয়াল করল ভদ্রলোকের চোখের কোনে জল।
রেখা ব্যাপারটাকে এনজয় করছিলো।
তারপর বয়স্ক ভদ্রলোক আবার বললেন 'আজকে আমাকে কেউ বলার নেই এটা করো না ,ওটা করো না। আজ যেন সব কিছুই উঁকি দেয় নিজের মত করেই সবকিছু করা যায় কিন্তু তার পরেও মনে কোন শান্তি নেই। জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো এখন নস্টালজিক হয়ে হৃদয় তটে ঢেউ তুলে
যায় ।আর সারাক্ষণ সেই ঢেউ গুনতে গুনতে কখন যে চোখ দুটো জড়িয়ে আসে তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন।"
রেখা বয়স্ক ভদ্রলোকএর কথাগুলো খুব ভালো লাগলো।
রেখা অনুভব করলো সত্যিই তো এরকম করে তো ভাবা হয়নি। আমাদের দাম্পত্য জীবনে আমরা তো কত বিষয় নিয়ে ঝগড়া করি।তার স্বামী যদি তার মনের মত এরকম হতো তার স্বামী যদি ধূমপান না করত ,তার স্বামী যদি সবসময় স্ত্রী যা বলে সেই ভাবেই চলত। শুধু প্রত্যাশা আর প্রত্যাশা।
অপর পক্ষেরও যে কিছু প্রত্যাশা থাকতে পারে সেসব তো একবারও আমরা ভাবি না।'
ভদ্রলোক বললেন 'আর জীবনে নিজেকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রয়েছে শুধু কিছু নিখাদ ভালোবাসা ,বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ।তারাই এখন তার জীবন সায়াহ্নে এসে কখনো কখনো 'আলোর নিশানা দেখিয়ে যায় ।তারাই সবুজের হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে'তুমি আছো তুমি আছো তোমার অস্তিত্বের শাখা-প্রশাখা গুলি শুধু প্রসারিত করে দাও।'
রেখা মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছে ।সত্যিই জীবনটাকে এভাবে ভাবলে তো কোন দুঃখ কষ্ট আর মনের ভেতরে দাগ ফেলতে পারে না।
ভদ্রলোকের শেষ কথাগুলো এখনও রেখার কানে বাজছে'জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তখন মনে হবে চারিদিকটা শুধু ধূসর মরুভূমি, কিন্তু এর মধ্যেই বেঁচে থাকা ।বেঁচে থাকতে হবে ছোট ছোট সুখের অনুভূতিগুলো,মুহূর্তগুলোকে অবলম্বন
করে ।শীতের জীর্ণতাকে সরিয়ে দিয়ে ভালবাসার বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে আঁকড়ে ধরে সবুজ প্রাণে বেঁচে ওঠা ।
ভদ্রলোক নেমে গেলেন শিমুরালি স্টেশনে। যাবার সময় প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে আর একগাল হেসে দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনায় যেন সকলকে আপ্লুত করে মনে দাগ দিলেন।
রেখা জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো কিছু বয়স্ক ব্যক্তি আর ছোট ছোট বাচ্চারা হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।ছোট বাচ্চারা ভদ্রলোককে দেখে হামলে পড়ল। যেন খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
সেই ট্রেনের যে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভদ্রলোক এতগুলো কথা বললেন তারাও এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেছে।
একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ওই বাচ্চারা অনাথ আশ্রম এর বাচ্চা। প্রতিমাসে এই ভদ্রলোক এখানে আসেন আশ্রমটি তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন '।
উনাকে কে না চেনেন?
ট্রেনের হুইসেল বেজে গেল ট্রেন ছেড়ে দিল কিন্তু ভদ্রলোক যেভাবে মানুষকে বাঁচার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে গেলেন ।সেটা যেন হৃদয় তটে তীরের মত বিদ্ধ হল।
রেখা মনে মনে ভাবল জীবনটা ক্ষণিকের জন্য তাহলে কেনই বা এই জীবনে সবসময় দুঃখ কষ্ট গুলো কে প্রাধান্য দিয়ে ,না পাওয়া মুহূর্তগুলোকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ,সামনের দিনগুলো কে অবহেলায় দূরে ঠেলে দেওয়া।
সংসারের প্রতি মুহূর্তগুলোকে এখন বাঁচিয়ে রাখতে হবে আর মনের ভেতরে থাকবে দৃঢ় সংকল্প এ পৃথিবীতে যখন এসেছি তখন কিছু ভাল কর্ম করে তার কীর্তি রেখে যেতে হবে।
রেখার ও ভাবল ভদ্রলোকের ওই কথাগুলো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, শরীরের পেশী গুলো আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকে, আগের মত সেই প্রথম আর থাকেনা। নানা অসুখ তখন বাসা বাঁধে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর ঔষধেরদের সমারোহে জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু তা হলেও প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত বয়স একটা সংখ্যা মাত্র ।বয়স এর দিকে না তাকিয়ে মনটাকে সজীব রেখে নতুন উদ্যমে কাজ করে যাওয়া।
এই সময়ে মানুষের অফুরান সময় ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তারা নিজেদের সংসার , ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে ব্যস্ত ,মা-বাবার প্রতি দায়দায়িত্ব তখন শুধুমাত্র কয়েকটি ফোন কল কিছু টাকা পাঠানো হয়তো বা ফোনের সংখ্যাও কমতে থাকে ।তখন যে মানসিক অবসাদ ,বিষন্নতা মানুষের জীবনকে গ্রাস করে সে গুলোকে ভুলে গিয়ে এই জগত সংসারে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে নতুন করে আইডিন্টিটি তৈরি করা। সেটাই হবে সার্থক বাঁচা। সন্তানদের দোষ দিয়ে লাভ নেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলাতে থাকে মন-মানসিকতা চরিত্র। তাই নিজেকে বদলে ফেলতে হয়।'
পাশের দুই ভদ্রলোক পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল জীবনে এটাও একটা দরকার ছিল শিক্ষার। বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচ। জীবন্মৃত অবস্থায় বেঁচে কোনো লাভ নেই।'
ভদ্রলোক দুজন জানলা দিয়ে যেন সেই জীবনের আস্বাদ পেতে নূতন সূর্য রশ্মিকে স্বাগত জানাতে বদ্ধপরিকর।
রেখা মনে মনে ভাবছে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে জীবনের যে নতুন অভিজ্ঞতা হলো তাতে সত্যিই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন সময় ট্রেন কৃষ্ণনগর জংশন থামল প্লাটফর্মে প্রচুর ভিড় এই ভিড়কে উপেক্ষা করে ট্রেন থেকে নামলো ।বিশাল জনসমুদ্রে দিকে তাকিয়ে রেখা আরো ভাবল প্রতিদিনের এই ব্যস্ততা এক সময় থেমে
যাবে ।তখন শুধু সময় আর সময় এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। রেখা ভিড় ঠেলে প্লাটফর্মে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো ,ঠিক তখনই রেখার ফোন বেজে উঠল রেখা বলল হ্যালো'
তারপর বলল আমি আপনাকে পরে কল ব্যাক করছি।