টানাপোড়েন ৫১
বিরক্ত
হঠাৎ রেখার ফোনে ফোন বেজে উঠলো"দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে'। রিং হয়ে কেটে গেল। আচ্ছা জ্বালাতন মূলত এ বাড়িতে এসে একটু ভালো করে ঘুমাতে পারবো না। কাঁথাটা মুড়ি দিয়ে ,আবার শুয়ে পরল।
আবারো রিং হয়ে যাচ্ছে ।
বাধ্য হয়েই রেখাকে ফোনটা রিসিভ করতে হলো' ।বলল-হ্যালো"।
অপরপ্রান্ত থেকে বলল 'দিদি জামাইবাবু আছে?'
রেখা বলল 'কে রে সোমু?'
সোমদত্তা বলল"হ্যাঁ দিদি।'
ততক্ষণে কাকিমা এসে হাজির। কাকিমা ইশারায় বোঝাতে চাইলেন ,সোমু হলে ,তুই এখানে আছিস বলবি না।
রেখা ফোনটা মিউট করে বলল ' কি করে বলব ?এবার তো জানতে চাইবে জামাইবাবুকে ফোনটা দে। তাহলে কি বলবো?'
কাকিমা ইশারায় বোঝাতে চাইল' কায়দা করে কিছু একটা বলতে।'
রেখা বললে ' কেন রে?":
সোমদত্তা বলল 'আজকে কেসের ডেট আছে না?'
রেখা এবার হ্যালো হ্যালো করে শুনতে না পাবার নাটক করলো।
কাকিমা ওদিক থেকে হাসতে লাগলো। কাকিমা যে সোমুর ওপর ভীষণ বিরক্ত বোঝা গেল।
ফোনটা ছেড়ে রেখা কাকিমাকে বলল'এবার তো মনোজকে ফোন করবে ।ও যদি বলে দেয়।'
কাকিমা বলল' বলে বলুক গে।'
রেখা মনোজকে ফোন করল। মনোজের ফোন রিং হয়ে গেল। ধরল না।
রেখা 'ভাবলো ৯টা বাজে,।ও কি করছে?''
আবার ফোন করল রিং হয়ে গেল।
কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন "কিরে জামাইকে ফোন করছিস?'
রেখা বলল" হ্যাঁ,কিন্তু রিং হয়ে গেল জানো কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'চিন্তা করিস না। পুরুষ মানুষ ।দেখ কিছু একটা করছে হয় তো ,শুনতে পায় নি।'
রেখা বলল 'গতকালকেও তো ফোন করি নি ।ফোনটা করা উচিত ছিল কাকিমা ।কি করছে ,কে জানে?'
কাকিমা বললেন 'আয় তো ননী ,জল খাবারটা খেয়ে নে'।'
রেখা বলল 'কাকুকে আগে দাও।'
কাকু বললেন সবাই একসাথে খাব। কেউ কারোর আগে-পরে নয় ,আয় ননী।'
রেখা বলল 'আজ জলখাবারের কি মেনু কাকিমা?'
কাকিমা বললেন ,' হিঙের কচুরি আর হচ্ছে আলু চচ্চড়ি।'
রেখা বল ল 'দারুন ব্যাপার। ছুটে গিয়ে আগে একটা গরম পুরি তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল।
কাকিমা বললেন 'এই তো আমরা পুরনো ননী ফিরে পেলাম'
কাকু উৎসুকভাবে বললেন ' কেন কি করেছে ননী ?
কাকিমা বললেন ও যখন ছোট ছিল। আমরা যখন বাড়িতে ওর পছন্দ মাফিক কোন খাবার বানাতাম। তখন কি করত?'
কাকু হো হো করে হেসে বললেন 'দু'চারটে তুলে নিত।'
কাকিমা বললেন 'ওটা দেখে আমার সেই ছোট্টবেলার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।'
কাকু বললেন 'একবার মনে আছে ওর মা এজন্য কে একদিন মেরেছিল?'
কাকিমা বললেন 'মনে আর নেই।এক চোখে হাত দিয়ে চোখের জল মুছছিল, আর এক হাত দিয়ে খাচ্ছিল।'
কাকু বললেন 'তখন আমরা ওর কান্নার আওয়াজ শুনে কি করেছিলাম?'
কাকিমা বললেন 'এসে খুব বকাবকি করছিলে তোমরা আমাদের ওপর?'
কাকু বললেন ' আর কি?'
কাকিমা বললেন 'ওর খাবার ইচ্ছে মঞ্জুর হয়ে গেছিল যখনই কিছু হবে ও খেতে চাইলে ওকে দিতে হবে।''
রেখা বলল 'আর সেই নিয়ে সোমু আমার সাথে কি ঝগড়াটাই না করেছিল।'
কাকিমা বললেন 'সেই দিনগুলো কত ভালো ছিল বল?'
কাকু বললেন 'একান্নবর্তী পরিবার দাদা ভাইয়ের সম্পর্ক কত দৃঢ় ছিল।'
কাকিমা বললেন 'পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ,আস্থা ,ভালোবাসা পরিবারকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেত।'
রেখা খেতে খেতে বলল' অথচ কাকিমা দেখো আমরা জয়েন্ট পরিবারের মেয়ে হয়েও যে পরিবারে বিয়ে হয়ে গেলাম ।সেখানে কোন মূল্য নেই।'
কাকিমা বললেন 'মন খারাপ করিস না মা।'
আবার ফোন বেজে উঠলো' দুর্গে ,দুর্গে, দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে...'।
কাকিমা বললেন 'এবার তোর রিংটোনটা আমার জানা হয়ে গেল।'
রেখা বলল 'বোধহয় তোমাদের জামাই ফোন করেছে।'
রেখার আবার ফোন বেজে উঠল।
রেখা ফোন ধরে বলল 'হ্যালো বলো।'
সোমদত্তা বলল ' দিদি আমি।'
রেখা মিউট করে কাকিমাকে বলল 'কাকিমা সোমু ফোন করেছে, কি বলব ( ইশারায়)?'
কাকিমা বললেন ' কি বলি বল তো ?যদি সেরকম কিছু জিজ্ঞেস করে বলে দে আর কিছু বলার নেই।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ বল।'
সোমদত্তা বলল 'জামাইবাবুকে তো পেলামই না ফোনে ।তাহলে কি আজকে কোর্টে আসতে পারবে না জামাই বাবু?'
রেখা বলল ' তুই তো আমাকে আগে জানাস নি কোর্টের ব্যাপারে? আমি তো কিছু জানি না ।'
সোমদত্তা বলল ' কি জানি আজকে ফাইনাল ডিসিশন নেবেন কিনা জজ?'
রেখা বলল 'এসবের কি দরকার ছিল সোমু?'
সোমদত্তা বলল তুই বুঝবি না দিদি?
রেখা বলল 'আমার বুঝে কাজ নেই বোন? তবে তুই যেটা করছিস, সেটা মোটেই ঠিক করলি না?'
সোমদত্তা বলল 'দিদি ,আমি তোর কাছ থেকে কোন এডভাইস চাই নি।'
রেখা বলল 'আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি ,এখনো সময় আছে।'
সোমদত্তা বলল ' আমার পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়?'
কাকিমা নিজেকে কন্ট্রোলে না রাখতে পেরে বললেন 'অসভ্য মেয়ে কোথাকার? কি করে আমার পেটে জন্ম নিয়েছে জানি না।'
রেখা বলল 'কাকিমা তুমি চেঁচিয়ো না ।তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে।'
সোমদত্তা বলল ' তুই ওখানে আছিস? ভালোই
আছিস তাই না?'
রেখা বলল 'বাবার বাড়িতে আসলে সবাই ভালই থাকে বোন। তুইও চলে আয়।''
সোমদত্তা বলল ' বাড়িটা কি আর আমাদের জন্য ?আমরা নিজের মেয়ে হয়েও এত আদর পাই না। আর তুই...?'
রেখা বলল ' সেটা তোর দুর্ভাগ্য।'
সোমদত্তা বলল 'তোর কপালটা সবদিক থেকেই ভালো দিদি।'
রেখা বলল 'তোকে একদিনই বলেছি এডজাস্ট করতে শেখ।'
কাকিমা বললেন'একই বাড়ির মেয়ে হয়ে দিদির কাছ থেকে কিছু শিখতে পারো নি? শুধু বড় বড় কথা।'
সোমদত্তা বলল'ছোট থেকেই দেখে আসছি দিদিকে সবাই বেশি পছন্দ করে।'
কাকিমা বললেন 'পছন্দ করার মত ওর অনেক গুণ আছে তাই?'
এর মধ্যেই পাবলো বায়না ধরেছে দিদুনের সাথে কথা বলব ?ফোনটা আমাকে দাও মাম মাম।'
সোমদত্তা বলছে' আমাকে বিরক্ত করো না ।মার খেয়ে মরে যাবে তুমি।'
রেখা বলল 'এসব কি বলছিস তুই সোমু'?
সোমদত্তা বলল 'ঠিকই তো বলছি দিদি ।বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় ছোটরা কেন কথা বলবে?'
রেখা বললো ' আহা,ঠিক আছে ।তুই অন্য সময় ওকে এগুলো শেখাবি ।এখন তোর বাবাকেও কাছে পাচ্ছে না ।একটু দিদার সাথে কথা বলবে দে না ফোনটা?'
সোমদত্তা বলল 'তোমার তো বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। তুমি বুঝবে কি করে?'
কাকিমা রেখার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বলেন ''তুমি তো একদম সার্থক মা হয়েছ, তুমি তো সব বোঝো?'
সোমদত্তা বললো 'মা ,তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না?'
কাকিমা বললেন 'তোমাকে তো কেউ ফোন করতে যাই নি ।তুমি কেন সবাইকে বিরক্ত করো ফোন করে।'
সোমদত্তা বলল ' দরকার ছিল বলেই করেছি ।না হলে করতাম না।'
কাকিমা বললেন 'সে জন্যই তো বলছি ,দরকারের সময় তোমার মনে পড়ে,। বাকি সময়েগুলো তো তোমার মনে পড়ে না কিছু?'
রেখা বলল 'কাকিমা ছেড়ে দাও।ও তো ছোট ,বুঝতে পারছে না।'
কাকিমা বললেন 'তুই থাম তো ননী ।বড্ড বাড় বেড়েছে ওর।'
সোমদত্তা বলল 'সামনের সপ্তাহে আমি পাবলোকে তোমার কাছে রাখতে যাচ্ছি।'
কাকিমা বললেন ' খবরদার এমুখো হবে না।'
সোমদত্ত বলল 'মা?'
কাকিমা ফোনটা কেটে দিলেন। কেঁদে ফেললেন।
রেখা কাকিমাকে ধরে বসালো।
কাকিমাকে কেদেঁ কেঁদে বললেন 'কি শত্তর জন্ম দিয়েছি রে ননী?'
রেখা বলল ' সব ঠিক হয়ে যাবে কাকিমা ।তুমি এত কষ্ট পেয়ো না।'
কাকু ও ঘর থেকে বলেন 'কী হয়েছে রে ননী?'
রেখা বলল 'কিছুই না কাকু?'
কাকু আবার বললেন 'কাকিমার চেঁচানোর আওয়াজ পেলাম। নিশ্চয়ই সোমু ফোন করেছিল । '
রেখা আর কাকিমা চুপ করে রয়েছে।
কাকু আবার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন' 'বলতে পারিস ননী ও সবাইকে কেন এত বিরক্ত করে ্?''
কাকিমা বললেন ' তুমি অস্থির হোয়ো না ।শরীর খারাপ হবে?'
কাকু বললেন 'আমার এই দুই সন্তান সব সময় আমাদেরকে একটা টানাপোড়েনের যন্ত্রনায় রেখে দেয়,। হায় ভগবান আমাদেরকে মুক্তি দাও।'(কপাল চাপড়াতে লাগলেন)
রেখা কাকার কাছে গিয়ে বলল 'কাকু এরকম করলে কিন্তু আমি থাকবো না ।তুমি শান্ত হও।'
কাকু বললেন 'শান্ত হবো একবারে চিতায় গিয়ে।
বেশ আনন্দে ছিলাম ননী মা ,তুই আসাতে। কপালেতে সুখ সহ্য হবে না রে ।বলেই গান ধরলেন 'এই তো 'জীবন। হিংসা বিবাদ লোভ ,ক্ষোভ বিদ্বেষ।চিতাতেই সব শেষ'।
হঠাৎই কেমন একটা থমথমে পরিবেশ হয়ে গেল।