শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
( পর্ব ১৯)
শামীমা আহমেদ
শাওয়ার থেকে বেরিয়ে শিহাব দ্রুত তৈরি হয়ে নিলো।সারাদিনের কাজের ম্যাপটা একবার এঁকে নিলো মনে মনে। শায়লার সাথে দেখা করা, হসপিটালে যাওয়া, কুরিয়র অফিসে গিয়ে আবার বাসায় ফেরা তারপর গুলশানে যাওয়া। আপাতত দিনের প্রথম ভাগে যা যা করণীয় তার ছক কেটে মাথায় বসিয়ে নিল ।শিহাব কোন কিছুই ঝোঁকের মাথায় করে না।খুব ধীর স্থিরভাবে ভেবে চিন্তে করে। রিশতিনাকে নিয়েও তার কোন তাড়াহুড়া ছিল না কিন্তু কিভাবে কি ঘটে গেলো! আজ তাই পরিস্থিতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো।
পোষাকের ব্যাপারে ভীষণ চুজি শিহাব,
বাইকে লং ড্রাইভে যেতে হলে ধুলাবালি এড়াতে জিন্সের ভারী শার্ট প্রেফার করে। শার্ট আয়রন করাই ছিল। সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট। আজ কেডস পরতে মন চাইছে। সাদা নীল কম্বিনেশনের নতুন এডিডাস কেডস প্যাকেট থেকে বের করে নিলো। হায়! নয়টা বেজে গেছে! শিহাব চট করে তৈরী হয়ে এক ঘড়া পারফিউম ঢেলে দ্রুতই ছুটলো গন্তব্যের দিকে। আয়নায় তাকানোর সময় নেই।শিহাব রুম লক করে নীচে নেমে এলো।
পথটা শায়লার চেনাই ছিল ।রিকশা একটানে চলে এলো।শুধু শায়লার মনের ভেতরের অস্থিরতা উৎকন্ঠা সামনের সবকিছুকে অদৃশ্য করে রাখল।
আফা কোন গেটে নামবেন? রিকশাওয়ালার কথায় শায়লা নিজেকে রিকশায় আবিষ্কার করলো!
ওহ! এখানেই এখানেই।রাখেন রাখেন।
শায়লা রিকশাভাড়া চুকিয়ে নামল।
আশেপাশে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি। এটা এই দেশে খুবই কমন দৃশ্য। একজন মহিলা দেখবে আর তাকাবে না সেটা আমাদের দেশে খুবই রেয়ার ঘটনা।শায়লা দেখলো হ্যাঁ, কোনায় একটা চায়ের টং ঘর দেখা যাচ্ছে জনাকয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে তবে কোনো মুখ চেনা লাগছে না। শায়লা তাই সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
অনেক অফিসযাত্রী মানুষজন কর্মক্ষেত্রে ছুটছে। শায়লার নিজের অফিস টাইমের কথা মনে পড়লো।
হঠাৎই উল্কার বেগে একেবারে উর্ধ্বশ্বাসে একটা লেটেস্ট মডেলের বাইক এসে থামল। শায়লা খুবই নিখুঁত দৃষ্টি ফেলে হেলমেটের আড়ালের মুখটা চিনে নেয়ার চেষ্টা করছে। লোকটি বাইকটা সাইড করে স্টার্ট বন্ধ করলো।চাবিটা হাতে নিয়ে হেলমেট খুলে সানগ্লাসে ঢাকা চোখের একটা লুক এদিক সেদিক ঘুরছে। শায়লা এফবির পিকের সাথে মেলাতে চাইছে। হু, বুঝা গেলো ইনিই সেই কাংখিত ব্যক্তি। শায়লার ভেতরে ধক ধক শব্দ স্পষ্ট! দেখলো অপূর্ব মুখশ্রী! হিরো হিরো টাইপ।নীল জিন্স শার্টের সাথে শুভ্র মুখখানি যেন এক খন্ড শরতের আকাশ! বেশ পরিপাটি পোষাকের ব্যক্তিটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে আর সুগন্ধি তা জানান দিচ্ছে। শায়লা কিছুক্ষণের জন্য যেন এই মহাবিশ্বের বাইরে ছিটকে পড়েছিল।একেবারে ভাবলেশহীনতায় হাত পা অবশ হয়ে আসছিল।
শায়লার কাছে এসে বেশ কনফিডেন্স নিয়েই লোকটি বললেন, আমি শিহাব। আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো, আমি দুঃখিত! অনেক রাতে ঘুমিয়েছি।উঠতে তাই লেট হয়ে যায়।
শায়লা বলে উঠল,না না, ঠিক আছে। আমি শায়লা।
আমি বুঝেছি।
কিভাবে বুঝলেন,শাড়ির রংতো বলিনি।
ফেসবুকের ছবির সাথে মিলিয়েছি। কোন ধরণের ভনিতা বা অতিনাটকীয় কোন ভাব নেয়নি বলে শায়লা খুব দ্রুতই সহজ হয়ে গেলো।
দুজনে টি স্টলের দিকে এগিয়ে গেলো। আশেপাশে মানুষের চোরাচাহনী, চাপা হাসি, হাত আড়াল করে বিড়বিড় করে পাশের জনকে কিছু বলা।যেন তারা অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে। কার বউ আর কার স্বামী আজ ঘর পালিয়ে এখানে দেখা করতে এসেছে তারা যেন তার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে রইল!
মামা, দুই কাপ চা দেন, বলে শিহাব শায়লাকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলো, ওদের আদা লাল চা খুব ভালো হয়। আমি সকালে কাজে বেরুলে এখানে একটু থেমে যাই।
পারিপার্শ্বিক পরিবেশের লোকজনের তুলনার শায়লা আর শিহাবের বেশভূষা বেশ উন্নত। বুঝাই যাচ্ছে এমন একটা যায়গায় তারা এসেছে লোক চক্ষুর আড়াল হয়ে নিছক সময় কাটাতে।
ধোঁয়া ওড়া চা এলো।হাত বাড়িয়ে শিহাব প্রথম কাপ হাতে নিয়ে শায়লাকে এগিয়ে দিল। শায়লা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শি্হাবকে এক নজর দেখে নিল।বেশ সাবলীল ভঙ্গীতে কথা বলছে। আর হাইটটাও তার বরাবরই মনে হচ্ছে।শায়লাও নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। আড়ষ্টতা নিয়ে থাকলে শিহাবকে মানুষ খারাপ ভাবতে পারে। জনসমক্ষে মানসন্মান রক্ষা করা শুধু যে মেয়েদের জন্যই, সেটা নয়, ভদ্র পুরুষদেরও সেটা রক্ষা করতে হয়। আর যাদের আত্মসম্মান জ্ঞান নেই তারা তো চিরকালের বেহায়া।সমাজ সংসার এদের কাছে তুচ্ছ।ব্যক্তিত্বহীন এইসব পুরুষের কর্মকান্ডে লজ্জিত হয় হয় দেশ সমাজ তথা পরিবারের লোকজন। সন্তানের নিস্পাপ মুখটাও এরা ভুলে যায়।
শিহাব নীরবতা ভাঙল,
আপনার মা কেমন আছেন? কি হয়েছে উনার?
শায়লা বললো, না না তেমন কিছু না, রুটিন একটা চেকাপের জন্য টেস্টগুলো করা।
শিহাব বললো, তাও তো ভালো! আমার মাকে তো চেকাপের জন্য রাজীই করানো যায় না।
এরপর টুকটাক কিছু কথা হলো। এই পারিবারিক অন্য খোঁজ খবর নেয়া ।
আপনারা কতদিন উত্তরায়? কোথায় পড়াশুনা করেছেন?বাবা কী করতেন? কবে মারা গেলেন?
শায়লা একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শিহাবকে নিয়ে তার কোন প্রশ্ন মনে আসছে না। নাকি শিহাবই তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে?
স্টলের ক্রেতা বিক্রেতা সবাইকে স্বাভাবিক দেখালেও কানটা কিন্তু তাদের দিকেই খোলা!কোন প্রেমালাপ হচ্ছে কিনা কিংবা কথা থেকে কোন ক্লু ধরা যায় কিনা? এরা যে স্বামী স্ত্রী নয় সেটা তারা শতভাগ নিশ্চিত। বিদেশে হলে এসব ওরা একেবারেই ওভারলুক করে।
কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের প্রতিবেশীর ঘর নিয়েই বেশি কৌতুহল।
শায়লা চায়ের পোকা হলেও খুব গরম চা সে খেতে পারে না৷ প্রচন্ড গরম কাপটা ধরে সে দাঁড়িয়েই আছে।
শিহাব চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথার ফাঁকে ফাঁকে শায়লাকে আপাদমস্তক দেখছে। যদিও সানগ্লাসের আড়ালে তার চোখের দৃষ্টি বুঝা মুশকিল।
ছেলেরা কিন্তু খুব সহজেই মেয়েদের স্টাডি করে নিতে পারে।যেখানে মেয়েরা শুধু তাদের ড্রেস আপ আর প্রেজেন্ট করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেখানে ছেলেরা একটা মেয়েকে পাঁচবার এসেস করে ফেলে।
শিহাব বুঝে নিলো শায়লা খুবই সিম্পল এবং সহজ সরল একটা মেয়ে। পোশাকের শালীনতায় সভ্যতা ভব্যতা স্পষ্ট হয়। একটা শাড়ি পরার ধরণেই একটা মেয়ের চারিত্রিক গুনাবলী বুঝা যায়। অবশ্য যদি সে সেটাতে কোন চালাকির আশ্রয় না নেয়।
শিহাব ইশারায় শায়লাকে খেয়াল করিয়ে দিল, চা খেয়ে নিতে। শায়লাকে চায়ে ব্যস্ত করে আবার এক ঝলক দেখে নিল শায়লাকে।নেভি ব্লু শাড়িটায় শায়লাকে খুব সুন্দর লাগছে। চোখ দুটোতে বেশ গভীরতা আছে। ফিগারের ব্যাপারে অতটা সচেতন না হলেও অতিরিক্ত কিছু চোখে পড়ছে না।হাইট নরমাল বাঙালি মেয়েদের তুলনায় একটু লম্বাটে ধরা যায়, যেহেতু পায়ে ফ্ল্যাট জুতা।
শিহাব শায়লার মুখটায় রিশতিনাকে ভেবে নিলো। এমনি হয়তো লাগতো রিশতিনাকে।
যদিও শাড়ি পরায় রিশতিনা অতটা এক্সপার্ট ছিল না।
শায়লা চায়ে চুমুক দিলো। নিজের বোকামিতে লজ্জা পেল। দুজনে চা শেষ করলো। খুব বেশি ব্যক্তিগত কথায় শিহাব যেতে চাইল না। শত হলেও একেবারেই অচেনা একজন মহিলা । আর এখানে ওরা স্থায়ী বাসিন্দা।
শায়লার চা খাওয়ার অপেক্ষায় শিহাব বলে উঠল, চলেন লুবানার দিকে যাওয়া যাক।আপনাকে নামিয়ে আমার কুরিয়র অফিসে যেতে হবে।
শায়লা ইতস্তত করছিল।কিভাবে অচেনা একজন মানুষের সাথে বাইকে চড়ে যাবে!
না না! আমি চলে যেতে পারবো। আপনি কুরিয়র অফিসে চলে যান।
আরে নাহ! মায়ের রিপোর্টটা জেনে যাই। আসেন। শায়লা বুঝতে পারলো আশেপাশের লোকজন থেকে বাঁচতে শিহাব তাড়া দিচ্ছে।শায়লা শিহাবকে অনুসরণ করে এগিয়ে এলো। শায়লার বাইকে চড়ার অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই।কিভাবে মানুষ খোলাভাবে এত স্পীডে বাইক চালাতে পারে সে অবাকই হয়। যখনি রিকাশায় করে কোথাও গিয়েছে পাশে সিগনালে কোন বাইক থামতে দেখলেই খুব ইচ্ছে হতো একটু চড়বার!
আজ অজান্তেই তা ঘটে যাচ্ছে। শায়লা পিছনের সীটে উঠে বসলো।শিহাব তাকে বেশ ফ্রি করে দিলো।বললো ভয় পাবেন না। আমাকে শক্ত করে ধরে বসবেন। শায়লা শিহাবের জিন্সের শার্টের কলার শক্ত হাতে খামচে ধরল।খুব স্বল্প সময়ের পথ। শিহাব চোখের পলকে একেবারে রকেটের বেগে লুবানার গেটে পৌছে গেলো।
খুবই সাধারণভাবে নেমে দুজন রিপোর্ট কালেকশন বুথে গিয়ে রিপোর্টগুলো কালেক্ট করলো। শিহাব একে একে সব কয়টা রিপোর্ট খুলে দেখলো। শিহাব কোন জড়তা বোধ করলো না বা অনুমতি নেবার প্রয়োজন মনে করলো না। তারওতো মা আছে।একজন মায়ের মেডিকেল রিপোর্ট পুত্রসম সন্তান শিহাব তা দেখতেই পারে।
শিহাব সব দেখে শায়লাকে জানালো, আলহামদুলিল্লাহ,আপনার আম্মার সব রিপোর্ট ভালো এসেছে। আল্লাহ উনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
শিহাব সব কয়টি রিপোর্টের প্যাকেট নিজের সাথে নিয়ে নিলো।
দুজনে বেরিয়ে এলো। একটা রিকশা ডেকে শায়লাকে ইশারায় উঠতে বললো। শায়লা ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। রিকশায় উঠতেই হাতে প্যাকেটগুলো দিয়ে বললো, সাবধানে যাবেন।আপনার আম্মাকে আমার সালাম জানাবেন। আবার দেখা হবে। বলে নিজের বাইকের দিকে এগিয়ে গেলো।
সো মাচ কেয়ারিং পার্সন!!
শায়লা একরাশ মুগ্ধতা আর কৃতজ্ঞতার অনুভুতিতে বিগলিত হয়ে গেলো! মুখে বিজয়িনীর হাসি ফুটে উঠল!
আফা কোনদিকে জাইবেন?
ওহ! সাত নম্বরে চলো।
শায়লা দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া বাইকটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much