উপন্যাস
টানাপোড়েন /২০৬
প্রচ্ছন্ন করুন বেদনা
মমতা রায়চৌধুরী
অনেকদিন পর ইচ্ছে হলো রাত্রের দিকে ছাদে যেতে। আজ পূর্ণিমা । পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে কি মিষ্টি লাগছে। চাঁদ উঠলে মনটা যেন কেমন উদাস হয়ে যায়। চাঁদ উঠলে মিষ্টি সুবাস হাতছানি দেয় বারবার। কেন যে বারবার রেখার মনটা এমন উথাল পাথাল হয় কে জানে? কার মায়াবী সুবাস ঘোরে চারপাশে। আজকেই কেন ছাদে আসতে হলো নিজের মনকে নিজেই জিজ্ঞাসা করছে রেখা।
বুঝেছি আজ আবার স্বপ্নিলের কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে ,সেটা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে তাই তো??
"হয়তো তাই।"
"হয়তো তাই কেন বলছো? বল তাই।"
"হ্যাঁ, যদি তাই হয় তাতে কি?"
"তাতে কি মানে এ বাবা তোমার চোখ দুটো তো লাল হয়ে গেল। চোখের কোনে জল কেন! তুমি খুশী হওনি?"
"খুশি, আমার খুশি তে কী এলো-গেল।'
"বাবা, সে তো অনেক কিছু…. তুমি তো সব। ওর মন প্রাণ জুড়ে।"
"কে বলেছে তোমাকে এ কথা?,"
"নিজের মনকেই প্রশ্ন করো।"
যদি তাই হয়, তাহলে কি একবারও…
তোমার অভিমান হয়েছে তো?
"সেটা তো ওর ক্ষেত্রেও হতে পারে।'
কি হলো বাকি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও।
নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।
কেন যে মনের কোণে বারবার দাগ কাটে ওই নাম
নাম ।
মনে পড়ছে সেদিনের কথা"স্কুল থেকে ফেরার পথে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দুজনে একটা ব্রীজের ধারে।
কতক্ষণ যে একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল কতটা সময় পেরিয়ে গেছিল ,কত কথা চোখে চোখে হয়েছিল ,তার হিসেব কেউ রাখেনি।
স্বপ্নীল বলেছিল"একদিন হয়তো তুমি ভুলে যাবে!'
রেখা বলেছিল" আর তুমি?'
"কক্ষনো নয়।"
"সবাই বলে কাজে করে দেখাতে হয়।"
"কাজেই করে দেখাবো।"
"কিভাবে?"
স্বপ্নীল হাতদুটো কাছে টেনে বলেছিল লিখব তোমাকে নিয়ে ,তোমার সৌন্দর্য ,তোমার অমন সুন্দর ঘন কালো চুল, অমন মিষ্টি দুটো গোলাপের পাঁপড়ি র মত ঠোঁট শুধু মনে হয় এঁকে দিয়ে যাই ভালোবাসার চির চিহ্ন। অমন মিষ্টি হাসি দেখলেই তৃষ্ণার্থ প্রাণ জুড়িয়ে যায়।"
রেখা বলল" কাব্য করা ছাড়ো বাস্তব নিয়ে ভাবো।"
"এটাই আমার বাস্তবতা। তুমি বোঝনা?'
"বোঝার চেষ্টাও করলে না?"
"সবকিছু তুমি জানো তারপরেও কেন যেরকম বল?"
"যেদিন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো সেদিন বুঝবে।"
"সে তো এখনো বুঝি ,তখনো বুঝবো।"
স্বপ্নীল হো ,হো করে হেসেছিল ,সেই হাসির ভেতরে ছিল একটা প্রচ্ছন্ন বেদনা ।সেটা স্পষ্টই রেখা দেখতে পেয়েছিল ,উপলব্ধি করতে পেরেছিল ।
স্বপ্নীল বলেছিল"এখন ইচ্ছে করলে তুমি আমাকে দেখতে পাও স্পর্শ করতে পারো ।হ্যাঁ, এই স্পর্শের ভেতরে কিন্তু কোন মলিনতা নেই কালিমালিপ্ত হব না কেউ আমরা শুধু হৃদয়ের দুটো টান তার বাইরে কিছু নয়। মন নিয়ে টানাটানি, মনের কাছাকাছি শুধু তুমি আমি। তোমার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে তুমি কি কখনো শরীরটাকে চাওনি। মিথ্যা কথা বলবো না তোমার শরীরটাকেও আমি চাই । তবে সে চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে কেমন জানো, আমি শুধু তোমার হাতে হাত রেখে স্পর্শ করেই সমস্ত শরীর টাকে আমি নিজের ভেতরে অনুভবে অনুভবে ভালবেসে যেতে চাই, তাতেই আমার পাওয়া।আর যদি তুমি কখনো আমার কাছে চলে আসো সেদিনকার পাওয়াটা হবে অন্যরকম তবে আমি জানি তুমি কোনদিনও সংসারের গণ্ডি ছেড়ে সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পারবে না এ কাজ করতে ।আমি তা জানি। আমি বুঝি। তার পরেও আমি তোমাকে ভালবেসে যাই। কেন জানো? কারণ শ্রীকৃষ্ণ দেখো রাধাকে ভালোবেসেছিল রাধাকে কিন্তু জীবনসঙ্গিনী করেন নি। রাধাকৃষ্ণের ভালোবাসাটা কি হারিয়ে গেছে ?সে তো চিরন্তন অমর প্রেম।"
রেখা মুগ্ধ হয়ে স্বপ্নিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুধু মনে হয় ওর কথা শুনে যায় এই কথাটুকুই যেন চির শান্তি দেয়।
স্বপ্নীল বলে "আমি তো তোমার মধ্যেই আছি। তুমি আমার আগে আগে চলো ।কোন মাটি নীচে নয় অন্তরীক্ষে বিচারন করো ।আমি তোমাকে মাটিতে পা ফেলে জলকাদায় নেমে তোমার দিকে দৃষ্টি রেখে পথ চলতে পারি।'
"তুমি কেন এত আমাকে ভালোবাসো?'
"আমরা তো অসমবয়সী তারপরেও?"
স্বপ্নীল বলল" বারবার কেন তুমি বয়সের কথা টানো বল তো? আমি তোমাকে বলেছি বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। যারা শুধুমাত্র শরীরটাকে পেতে চায় তারা বয়সের হিসাব করবে আমি তো তোমার শরীরটাকে পেতে চাই কিন্তু আমি তোমার মনটা আগে চাই তোমার মন আমার কাছে থাকলে শরীরটাকেও আমার পাওয়া হয়ে যায় । যার আকর্ষণে দুটো নরনারী একত্রিত হয় ,সে তো ক্ষনিকের মোহ সেটা পূরণ হয়ে গেলে পড়ে থাকে মন ।মন ভেঙে গেলে আর কিছুই পাওয়া যায় না ।
রেখার এসব কথা ভাবছে আর দু চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে
একটা দীর্ঘশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আর বলছে *আজ তুমি কেমন আছো এটুকু জানার অধিকারও আমার নেই তোমার কন্টাক্ট নম্বর টাও তুমি চেঞ্জ করে ফেলেছ । এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছো। আজ কি শুধু তোমার কাছে মনে হয় চোখে ধুলো ছুড়ে দিলে যে রকম কাউকে দেখা যায় না ,ধুলো যেমন আপনি উড়তে থাকে তার গতিবেগের হাওয়ায়, ঠিক তেমনি করেই কি আমাকে অন্ধকারে রাখছো?'
আজ তোমার কাব্যগ্রন্থ সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাবে, আগের মত হলে হয়তো খুশিতে আমাকে নিয়ে নাচতে।"
"তবুও আমি চাই তুমি জীবনে আরো অনেক বড় হও ।তোমার কীর্তি রয়ে যাক তোমার কর্মে,,তোমার সৃজনশীলতায়।"
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভাবনায় ছন্দপতন ঘটে মনোজের ডাকে । যেন মনে হল সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঢাকা পড়তে শুরু করল মনোজ হাঁক দিল রেখা ,রেখা ,রেখা আ.আ.আ।
"তুমি কি আজকে ছাদেই থাকবে, বাচ্চাগুলোকে খেতে দেবে না?'
এ কথাটা শুনতে পেয়ে খুব লজ্জিত হল ছি ছি ছি ছোট বাচ্চাগুলোর খিদে পেয়ে গেছে ওদেরকে খেতে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে আসলো। এসে ওদের খাবার রেডি করল তারপর খেতে দিল। যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তুতু কিউ কিউ আওয়াজে অনেক কিছু বোঝাতে চাইল।
রেখা মনে মনে ভাবল তোমার এই নিষ্ঠুর বাস্তব আজ আমার দৃষ্টি হরণ করে না শুধু দৃষ্টিকে পীড়া দেয় মাত্র । তুমি আমার কাছে শেষ কথা নও। এটা আমাকে মানতে হবে।
রেখা বাচ্চাগুলোকে খেতে দিয়ে যখন খাবারের থালা টা নিয়ে ঢুকছে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে রেখা ।আরএকটু লজ্জিত হয় রেখা বসন নামিয়ে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে বেশ ভালো করে চোখেমুখে জল দিতে থাকুন তারপর বেরিয়ে আসলো।, তখন মনোজ জিজ্ঞেস করে' তোমার মনটা কি আজকে খারাপ ,?
তোমার কি কিছু হয়েছে?"
রেখা বলে' কেন?"
"না তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তাই জিজ্ঞাসা করলাম।"
রেখা বললো" তোমাকে ডিনার সার্ভ করব?'
"দেবে? দাও।"
রেখা কোন কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে রুটি আর চানা মশলা তরকারি দিয়ে মনোজকে খেতে দিল।
"তুমি খাবে না?"
"আমার খেতে ভালো লাগছেনা।"
"সেকি?" মনোজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
"খিদে পাইনি তো ।"
"তাহলেও অল্প করে খাও এতটা রাত খালি পেটে থাকবে?"
রেখা একটু জোরের সঙ্গে বলল" খিদে পেলে কি বলতে হতো? কেনো এক কথা বারবার
বলছ । তোমাকে কি রুটি দেবো?'
"না আর কিছু লাগবে না তবে একটু তরকারি দিতে পারো।'
রেখা আরেকটু তরকারী এনে মনোজ কে দিল।
মনোজ খেতে খেতে ভাবছে মাঝে মাঝে চিলেখার কি হয় ওকে বুঝে উঠতে পারিনা নানা কোলাহলকে ছাপিয়ে যেন ওর ভেতরে একটা যন্ত্রনা একটা না পাওয়ার বেদনা কাজ করে আমি ঠিক বুঝতে পারি কি এমন কষ্ট যেটা আমাকে বলতে পারেনা কি এমন যা কেউ ছুঁতে পারে না।
রেখা সবকিছু গুছিয়ে গেছে রেখায় নিজের রুমে চলে যায় শুতে মনোজ তখনও টিভিতে নিয়োগ শুনে যাচ্ছে চোখ দিয়ে দেখছে বটে কিন্তু মনটা পরে রয়েছে লেখার দিকে শুধু মনে হচ্ছে স্রেফ যেন ফাঁকি দিচ্ছে রেখা নিজেকেই নিজের প্রতি একটা নিশ্চয় ওর জীবনে কোন প্রচ্ছন্ন করুন বেদনা রয়েছে কি সেটা?
টিভি সুইচ অফ করে দিয়ে মনোজ যায় শোবার ঘরে। বেড সুইচ জ্বেলে দেখে রেখা একদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। মনোজ সুইচড অফ করে দিয়ে রেখার পাশে শুয়ে পড়লো। রেখা কে আর জাগালো না শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল ঈশ্বর ওর মনের দুঃখ কষ্ট গুলো দূর ক'রো। মনের টানাপোড়েন শেষ করে দাও।
চলবে ...