০৩ ডিসেম্বর ২০২০

অমলেন্দু বিশ্বাস



নীল সরস্বতী

পাতিরাম থেকে ধ্যানবিন্দু যেতে যেতে 

পথে পড়ে মধ্যিখানে এ‍্যালবার্ট হল।

তুমিতো জেনেছ যাকে কফিহাউস

অথচ কুহকপথে জানি আমি

নীল সরস্বতী! সমস্ত গরল গলে

কফির ইনফিউশানে মৃদু ধোয়া ওড়ে


আঙুলে অক্ষর ঠিক মদির সেতারে

ছঁয়ে দিলে ফুটে থাকে শব্দের দো‍‍‍‍‍্যতনা

লিটিল ম্যাগাজিনের দ্রোহ মুখবন্ধ

নতুন পাতার গন্ধে লেগে থাকে 

ঐশী নূরমাখা আকাংখিত  স্বপ্ন।

সৈয়দা আইরিন পারভীন এর প্রবন্ধ



এর মানে কিন্তু জীবনে হেরে যাওয়া নয়, শিক্ষা নেয়া।

ডিপ্রেসন এক অদ্ভুত রোগ এই রোগের কারন আছে, কিন্তু প্রতিকার নাই। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যথর্তা, হতাশা, ধাক্কা আর দূভার্গ্য এই সব কিছু এক চিমটি করে মিশিয়ে যে মিক্সচার বানানো হয় সেই মিক্সচারের নাম ডিপ্রেসন "নিষ্টুর পৃথিবী হুট করে একটা মানুষকে এই মিক্সচার গিলিয়ে দিতে পারে। ডিপ্রেসন নামের মিক্সচার গিলে ফেলা মানুষটা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়, পৃথিবীর লাল নীল হলুদ সব রং তার কাছে সাদাকালো লাগে, সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তার দ্বারা আর কিছু হবে না। হয়তো আর  "যদি "নামের শব্দ গুলো তার জীবনের ডিকশনারি থেকে মুছে যায়।

              

একটা মানুষ যখন শুধু কষ্ট পায় সে মন খারাপ করতে ইচ্ছে হয় কিংবা কাদঁতে ইচ্ছে হয়

সে যখন রাগ হয় তখন চিৎকার করে রাগের প্রকাশ ঘটাতে ইচ্ছে হয়। ডিপ্রেসন নামের এই অনুভুতিটা কষ্ট আর রাগ মিশালে এক বিচ্ছিরি অনুভুতি। ডিপ্রেসড মানুষের কান্না পায় না, চিৎকার করতে ও ইচ্ছে হয় না, তার নীরবে চিৎকার করে কাদঁতে ইচ্ছা হয় শুধু, কিন্তু সে কাদঁতে পারে না-একদম না।


       একজন ডিপ্রেসড মানুষের মাঝে মাঝে শুধু দুই হাতে মুখ চেপে একা একা চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।

      

        দিন শেষে সে হারিয়ে যেতে পারে না, ডিপ্রেসন উল্টো তাকে হারিয়ে দেয়, মাথার উপর একটা হাত, পিঠে একটা আলতো চড় আর এক মুঠো ভাগ্য দরকার তার ভীষণ দরকার।

শ্যামল রায়



আমি ঘর হতে চেয়েছি

আমি ঘর হতে চেয়েছি

খুঁজে নিতে চাইছি

 একদিকে সূর্য অন্যদিকে জোসনা রাত।

কিন্তু যৌবনে স্বপ্ন দেখাটা, একটু বাড়তি 

 ইছামতি নদীর মতো

কখনো বহতা

কখনো বালির চরা।

কোলাহলের কাছে উড়ে বেড়ায়

এক ঝাঁক প্রজাপতি

প্রিয় সন্ধ্যা নামলে সিঁদুর পরা নারী

নির্ভেজাল ভালোবাসাটা ভুলে যায়

পেরিয়ে যায় সকাল থেকে রাত

পালটায় হাত, ঠোঁট ,গোটা শরীর

আমি তোমার ঘর হতে চেয়েছি

আমি মেঘ হতে চাইনি

আমি প্রজাপতির ডানা হতে চাইনি

যৌবনের স্বপ্ন দেখায়

নির্ভেজাল কবিতা হয়ে ঘর খুঁজছি। 

প্রেমাংশু শ্রাবণ কবির,রের দীর্ঘ কবিতা



সই বিকেলের কথা মনে পড়ে

সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে?

এক দীর্ঘতম আশ্চর্য বিকেল!

লোকালয় থেকে দূরে

 আমাদের সেই স্বপ্রেম সাঁতার,মনে পড়ে?

তোমার সমস্ত তুমি আমার সমস্ত আমি মিলেমিশে কি রকম একাকার

একটা বিকেলের আর অনন্ত অতীতে ডুবে গিয়েছিলো--মনে পড়ে?


সূর্যের জিহ্বায় লাল সে সময়ে ছুঁয়ে ছিলো প্রকৃতির শেষ দিনটুকু

তুমি তার রক্তিম কুঙ্কুমরেণু গ্রীবা ও চিবুকে

খুব মেখে ছিলে বলে

উজ্জ্বল  সিংহের মত বাতাসেরা অপূর্ব কেশর দুলাতে দুলাতে এসে

তোমার চিবুকে ঘাড়ে--শুরু করে দিয়ে ছিলো সুন্দর তান্ডব।


আমরা সেদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের সবকটি ইটের মমতা ছুঁয়েছি

মাতাল বাতাস নিয়ে অপরুপ খেলতে খেলতে আমরা কেমন অতীতের খুব বর্ণময় অভ্যন্তরে ডুবে যাচ্ছিলাম,মনে পড়ে?


একটা সরু কুঠুরির মুখোমুখি এসে থমকে দাঁড়ালে তুমি।

প্রশস্ত দীঘল সিঁড়ি দেখিয়ে বললে,এসো--এই সিঁড়ি ভেঙে আরও নিচে নামি

কিছুটা সময় আজ কাটুক এখানে,


এই ভাবে এরপর তিনটি বিদীর্ণ ঘরে

দীর্ঘক্ষণ কেটেছে কেমন!

ওই ঘরে কোনোদিন বোধিসত্ত্ব বুদ্ধের মূর্তির তলে সমর্পিত হতো

অনার্য বিক্ষোভে জ্বলা অবিনাশী বাঙালীর বিষাক্ত বল্লম

বিনয়ী বীরের মতো করতল পেতে আত্নার গভীরে তারা তুলে নিতো

অহিংসার প্রেমের আর নির্বাণের অনন্ত কামনা!

সেরকম প্রণামের অতীত মুদ্রায় তুমি দুই বাহু আন্দোলিত করে

আমাকে জড়িয়ে নিলে বাতাসের সাথে,

আমি কি বাতাস।


দ্বিতীয় কুঠুরি জুড়ে তোমার গভীর গাঢ় চুম্বনের ছায়া বেঁচে আছে

একটা বেদির মূলে আমরা বসেছিলা বুদ্ধ আলিঙ্গনে।


শতাব্দীর ক্লান্তি মোড়া তোমার নিঃসীম ঘাড় উজ্জ্বল মন্ত্রের মত জ্বলছিলো পবিত্র আলোয়

তোমার অচিন ঠোঁট কানে কানে বলেছিলো শুধু,

অনার্য কুমারী আমি,

তুমি কোন বীরনাথ দুর্ধর্ষ প্রমিক

আমাকে উদ্ধার করো,ধরো--

সীমাহীন উচ্চারণে মন্ত্রপূত করো!মনে পগে?


তৃতীয় দুয়ারে ঢুকে তুমি আরও আর্যর্পুব রমণীর নিজস্ব কলায় 

আমার কন্ঠার হাড়ে মুখ গুজে কী সব বলেছো....

আমি তার কিছুই শুনতে পারিনি!


আমি শুধু তোমাকে দেখছিলাম।

কী রকম বদলাতে বদলাতে তুমি মুখর অতীতে ডুবে গেলে--

মনে হলো,

আমরা কোথাও নেই,

বাতাসের শব্দ জুড়ে শুধু আছে ইতিহাস মন্থনের পরে জমে থাকা এক পূতঃ স্মৃতির উত্থান!


তোমার চিবুকে খুব ঝরঝরে স্মৃতিময় পাতাদের মর্মরিত ধুলো।

তোমার কন্ঠা ও গ্রীভায় বোদ্ধ যুগীয় লিপি উঠেছিলো ফুটে

তোমার গভীর চোখে বুদ্ধের অবিনাশী মন্ত্রের ক্রন্দন

তোমার বাহুর ছন্দে নেচে ওঠে আর্যতীত রমণীর আত্নার উৎসব

তোমার ওষ্ঠে শুধুই

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি....


তোমার শরীর যেনো শূন্য থেকে শূন্যতর

অতীতে দিকে ধাবমান

আমি শুধু ওষ্ঠ পেতে আকন্ঠ করেছি পান নির্জন অতীত

এইভাবে আমাদের কয়যুগ কেটেছে সেখানেঃমনে পড়ে?


যখন ফিরছিরাম,পূনরায় লোকালয়ের দিকেই

এগিয়ে আসছিলাম

তখন সন্ধ্যা নেমেছে,

নিয়নের আলোময়

যত তুমি উঠছিলে ভেসে

তোমার শরীর থেকে একে একে অবসিত হয়ে গেলো সব অতীতের ধুলো!


আমি তবু তোমাকে দেখছিলাম,

কী ঘোর লজ্জায় ডুবে

এবার বললে তুমি--

কী দেখছো অমন করে?

লোকেরা কি ভাববে বলো তো!

কি ভেবে বললে ফের,

কোন কিছু ফেলে আসোনি তো?

আমি তখন সমস্ত চেতনায় শুকে দেখছিলাম

তোমার এই পরিবর্তনের ঘ্রাণ।


আমরা এসেছি ফেলে

আমাদের বিহ্বলতা চুম্বনের গন্ধমাখা বিভোর বিকেল

লোকালয় থেকে দূরে অন্য এক জীবনের নর্ম সমর্পন!

তখন ফিরছো তুমি ফের বর্তমানে।

মনে পড়ে? 

মনে পড়ে?

শ্রীমতি মমতা রায় চৌধুরী'র গল্প



রিপূর্ণা


দূর হয়ে যা। অন্য লোক দেখে নেব। মিনাদেবীর চিৎকার শুনে পূর্ণা ছুটে এসেছে দোতলায়। ফুলি বলছে আগে আমার কথাটা তো শুনবা গিন্নি মা। কোলে ছোট বাচ্চা মেয়েটি ওই ধমকে কান্না জুড়ে দিয়েছে। পূর্ণাকে দেখে একগাল হেসে কোলে যাবার জন্য ঝুঁকে পড়েছে। ফুলি তো মেয়েটাকে রাগের বশে দিয়েছে এক চড় বসিয়ে। কোলে যাইবো,কাজই চইলা যাইবো আর কোল খুঁজতেছে। পূর্ণা বলল -আহা ফুলি বাচ্চা মেয়েকে কেউ এভাবে..... দাও আমার কাছে দাও। মিনাদেবী তো আরো রেগে আগুন। ওই যে আর একজন হয়েছে কাজের মেয়ে সোহাগী। বাজা মেয়েমানুষ, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে। কটুক্তি করে ফুলিকে আরেকবার শাসিয়ে বললেন- এরপর থেকে কাজে দেরি হলে একেবারে বিদেয় করে দেব। ফুলি তো কাঁদতে লাগলো। পূর্ণা সান্ত্বনা দিয়ে বলল -তুই তো জানিস মা ওরকম, তাহলে এত দেরি করে আসিস কেন? না গো বৌদি ,আজকে আমার বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটছে, এর লায়গাই তো, বলে চুপ করে যায়। পূর্ণা বলে -কী হয়েছে রে? বরের সাথে আবার ঝগড়া করেছিস? হ,কেন? তুমি তো জানো বৌদি ওই যে পাশের বস্তিতে পুটি আমার বরের মাথাটা খাইলো। আচ্ছা কও তো আমার কিসে কমতি আছে? চারডা পোলাপানের জন্ম দিছি। আর কি চাই? পুরুষ মানুষগুলার আসলে এক খাবারে ওগো পোষায় না। পূর্ণা আর কথা বাড়ায় না। ঠিক আছে তুই কাজ কর। লক্ষী আমার কাছে থাকুক। ও বৌদি,একটা কথা কমু। আমার মাইয়াডারে লইবা তুমি। তোমারে তো কত ভালোবাসে। দেখো, তোমার কাছে গেইলে আমার কাছে আসতেই চায় না। আর বাড়িতে গিয়া তো সারাক্ষণ বড়মা বড়মা। তুই যে কী বলিস না ফুলি, নিজের বাচ্চাকে  কেউ অন্যের কাছে দেয়। আমি সত্যি কইতাছি, তোমার কাছে থাকলে আমার লক্ষ্মী মানুষ হইয়া যাইবো। আমার তো আরো তিনডে বাচ্চা আছে? তোমার তো, বলেই থেমে যায়। পূর্ণার চোখে জল এসে যায়। সত্যি ,ভগবানের কী বিচার।যারা খেতে দিতে পারে না তাদের ঘরে এতগুলো বাচ্চা। আর যাদের সব আছে ,তাদের ঘরে শূন্যতা। এত বছরের বিবাহিত জীবনে এই শূন্যতা নিয়ে পূর্ণার জীবন কাটছে। সে ভাবতে থাকে ভবিষ্যৎটা কী তার এইভাবে অবলম্বনহীন শূন্যতায় ভেসে যাবে?এজন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কম কটুক্তি তো তাকে শুনতে হয় না?কিন্তু তার স্বামী শংকর, পূর্ণাকে বোঝে । বলে,- এই নিয়ে  দুঃখ করো না। সংসারে সবাই সবকিছু পায় না। ভগবান যা চাইছেন ,তা ভালোর জন্যই করছেন। বরং যতবার পূর্ণা তার স্বামীকে বলেছে, তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে। তাতে অন্তত তার সংসারে পরিপূর্ণতা আসবে। কিন্তু শংকর বলেছে আমি তোমাতেই পরিপূর্ণ, আমার কিচ্ছু চাই না। ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছিল। পূর্ণার বাবা-মা মেনে নেয়নি এত বছরেও। বাবার বাড়ি বড়লোক ছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল মেয়েকে কোন সরকারি ভালো চাকরি দেখে বিয়ে দেবেন। তাই ব্যবসায়ী ছেলেকে মেনে নিতে পারেন নি। আর শঙ্করের মা চেয়েছিলেন ছেলেকে মোটা টাকার বিনিময় বিয়ে দেবেন। তারা আরও দুটি ছেলের মোটা অংকের টাকা নিয়ে বউ ঘরে এনেছেন। তাই তাদের কুটোটি নাড়তে হয় না। অথচ পূর্ণাকে প্রায় সবকিছুই করতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও জয়েন্ট ফ্যামিলিতে শংকর কিছু করতে পারে না। অনেক সময় শংকর বলেছে-চলো তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকি। কিন্তু পূর্ণা রাজি হয়নি। সে বলেছে একদিন তার মা ঠিকই তাকে মেনে নেবেন।এইসব ভাবতে ভাবতেই ফুলিকে চা আর জলখাবার দিয়ে দেয় আর লক্ষ্মীর জন্য দুধ গরম করে দেয়। যদিও শাশুড়ি মা এর জন্য প্রচুর কথা শোনান। কিন্তু সে নীরবে এ কাজ করে যায়। শাশুড়ি মা এত কিছু করার পরেও লক্ষ্মীকে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত করতে পারেন নি। হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ফুলির কাজ হয়ে গেলে লক্ষীকে নিয়ে চলে যায়। এরপর সে রান্না-বান্না সেরে সকলকে খাবার দিয়ে নিজের ঘরে নিজেকে একাকী পাবার জন্য ভাবতে থাকে।আজ দুদিন হল শংকর বাড়ির বাইরে ব্যবসার কাজে গেছে।আজকে তার ফেরার কথা।তাই সে ভাবতে থাকে আজকে সে নীল রঙের শাড়িতে ভালো করে সেজেগুজে থাকবে কারণ শংকর যতবার বাইরে থেকে আসে ততবার  পূর্ণাকে তাদের প্রথম দিনের শারদীয় সোনালী রোদ্দুরে নীল শাড়িতে প্রথম দেখেছিল। সেইরূপে এসে বারবার তাকে দেখতে চায়। বিয়ের এত বছর পরেও তাই এইটুকু চাওয়া বদলে যায়নি। আর শংকর গোলাপ ফুল আর জুঁই ফুলের মালা নিয়ে এসে পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে।এতকিছুর মধ্যেও এই উষ্ণতাটুকুই যেন তাদের বারবার আরো রোমান্টিক আরো কাছাকাছি এনে দেয়। পূর্ণা শংকরের জন্য সেই ভাবেই ধরা দেয়। আজ তার একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ফুলির কথাতে। সে ভাবছে একবার বলবে শংকরকে লক্ষীকে দত্তক নেয়ার কথাটা। কিন্তু কী ভাবে বলবে? আদপে কি মেনে নেবে? তারপর তার বাড়ির লোকজন ?এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে দিতে থাকে আর শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে থাকে সকলকে ভাল রাখার জন্য। এমন সময় শংকর আসে কিন্তু শঙ্করের মধ্যে সেই উৎফুল্লতা নেই,কেমন যেন একটা চিন্তার পাহাড় নিয়ে বাড়িতে এসেছে। তার সামনে সহাস্যে নীলাভ শাড়িতে পূর্ণা। সে শুধু  হেসেছে কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণবন্ততার অভাব। পূর্ণা ভাবে তার সেই প্রিয় জুঁই আর গোলাপ ফুল কোথায়? কিন্তু মুখে কিছু বলে না। বরাবরই পূর্ণা একটু মুখচোরা। সে শংকর এর জন্য কফি নিয়ে আসে। শংকর কফি খেয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে যায়। পূর্ণার মনের বালুচরে হাজারো মেঘ এসে জড়ো হয়। মন ভালো করার জন্য কবিতার বই বের করে পড়তে থাকে। রাত্রিতে সকলের খাবার দাবার শেষ হলে শংকর বাড়িতে আসে। পূর্ণা তাকে খাওয়ার কথা বললে, সে বলে খেয়ে এসেছে। এই প্রথম ব্যতিক্রম পূর্ণাকে ছাড়া শংকর বাইরে থেকে খেয়ে আসে। পূর্ণা ভীষন কষ্ট পায়।মনে পড়ে  কলেজ লাইফের কথা।শংকর ওদের কলেজের সিনিয়র ছিল। প্রথম প্রপোজ করেছিল শংকর কলেজের সোশাল এর দিন। তখন হয়ত তাদের ভেতরে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে নি কিন্তু আস্তে আস্তে ছোট ছোট সহযোগিতা অনার্স ক্লাস শেষে গাড়ি না পেলে শংকর দায়িত্ব নিয়ে, নানা প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে পূর্ণাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া এসব করেছে।এরপর আস্তে আস্তে দুজনে কাছাকাছি আসে। গড়ে ওঠে ভালোবাসা। তারপর শংকর পারিবারিক ব্যবসার কাজে ঢুকে যায় আর পূর্না ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। কিন্তু শংকর মাঝেমাঝে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সঙ্গে দেখা করে এসেছে। এরপরই পূর্ণার উচ্চশিক্ষা শেষ হলে দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু আজকে পূর্ণার মনে হচ্ছে তার এই পৃথিবীতে শুধু সে একা সেখানে শংকর কোথায়? অভিমানের ঘন মেঘ তার মন আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সকাল হলে সে উঠে দেখে তার বিছানার পাশে রাখা জুঁই ফুলের মালা আর গোলাপ ফুল। কিন্তু শংকর কোথায়? তাকে না বলে সে তো কোথাও বেরোয় না? পরে একটা চিরকুট লেখা দেখে তাতে লেখা আছে- চিন্তা করো না ,তুমি ঘুমাচ্ছিলে। তাই তোমাকে ডাকি নি। একটা বিশেষ কাজে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। পূর্ণা খুশিতে মন আকাশে ভেলা সাজিয়ে পাড়ি দিতে চাইছে অনেক অনেক দূর। এমন সময় বৌদি বলে ফুলি ডাকতে শুরু করে। ফুলির ডাকে সাড়া পেয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ফুলিকে বলে- কীরে আজ এত সকালে? ফুলি বলে- দুদিন ছুটি নেব।লক্ষীকে একটু রাখবে তোমার কাছে? সে রেখে যা কিন্তু ও কী রাত্রিতে থাকতে পারবে? হ্যাঁ পারবে। এরপর তো একা একাই থাকবে? কী বললি? কই কিছু না তো। শোন আজকের কাজ করবি তো? ফুলি বলে হ্যাঁ। তবে যাবার আগে ছুটি নেওয়ার কথা মাকে জানিয়ে যাস। ওরে বাবা, শুনেই তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে? ঠিক আছে। লক্ষ্মীকে দুপুরের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে পূর্ণা । পূর্ণা লক্ষ্য করেছে লক্ষ্মী কি সুন্দর নিশ্চিন্তে আঁচল ধরে ঘুমোচ্ছে। পূর্ণা লক্ষীকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ আদর করল আর ভাবতে লাগলো এরকম লক্ষ্মী তো তারও হতে পারত? এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে শংকর ফিরে আসে এবং বলে একটা খারাপ খবর আছে। পূর্ণা বলে কী খবর। ফুলির অবস্থা ভালো নয়। ফুলিকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। কেন? ফুলি সুইসাইড এটেম করেছে। সে কী কথা? কেন? কী জানি ওদের মধ্যে কি হয়েছে? ওর বর নাকি আজকে প্রচন্ড মেরেছে। আমি হসপিটালে যাচ্ছি। শংকর বেরিয়ে গেলে পূর্ণা ভাবতে থাকে সত্যিই ফুলির যদি এদিক সেদিক হয়ে যায়, তাহলে কী হবে লক্ষ্মী আর অন্য বাচ্চাদের? ভাবতেই যেন চোখের সামনে বাচ্চাগুলোর দুর্দশার চিত্র জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে কিছুতেই স্থির হতে পারছে না।এদিকে শংকরকে ফোন করছে,ফোন ও ধরছে না। পাঁচতলা ফ্লাটের উজ্জ্বল সোনালী রোদ এসে পড়েছে ।এখনো অন্ধকার হতে বাকি আছে । পূর্ণার অজানা আতঙ্ক ও  ক্লান্তিতে শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল। ঠিক এই সময় শংকর পূর্ণাকে সেই খারাপ খবরটি জানায়। লক্ষ্মীকে পূর্ণা জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নেয়। চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। লক্ষী কচি দুহাতে তার চোখের জল মুছে দেয় আর বলে বড়মা কাঁদছো কেন? আমি আছি তো। কেঁদো না। রাত নটায় শংকর বাড়ি আসে এবং ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেয়।তারপর নিজের ঘরে চলে আসে। পূর্ণা সব কাজ শেষ করে যখন রুমে আসে।তখন দেখে শংকর লক্ষীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর পূর্ণাকে কাছে টেনে নেয় আর বলে এরপর কী হবে এই বাচ্চাটার? পরের দিন লক্ষীর বাবাকে খবর দিলেও সে আসে না।এভাবে পাঁচ দিন কেটে গেলে, শংকর লক্ষ্মীদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে লক্ষ্মীর কথা বললে ,সে জানায়- লক্ষ্মীকে কোন হোমেটোমে দিয়ে দেওয়া হবে। অন্য বাচ্চাগুলোর করুণ অবস্থা দেখে শংকর বলে, ঠিক আছে ।হোমে দিতে হবে না ।লক্ষ্মীকে আমরা দত্তক নেব। লক্ষ্মীর বাবা বলে- তাহলে তো বেঁচে যাই। লক্ষ্মীর বাবার অদ্ভুত হাসিতে শঙ্করের মনে হল এই লোকটি বাবা হবার যোগ্য নয় সেই মুহূর্তে তার কাছে মনে হয়েছিল একজন পৈশাচিক ব্যক্তি। শংকর দ্রুতপদে বাড়িতে আসে আর পূর্ণাকে বলে লক্ষ্মী আজ থেকে তাদের মেয়ে হিসেবেই এ বাড়িতে থাকবে। কিন্তু পূর্ণা বলে তার বাড়ির লোকজন কেউ কী মেনে নেবে ? শংকর বলে -বাড়ির জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছ ।এবার নিজেদের কথা ভাবো। তোমাকে আমি পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে চাই। খুশিতে পূর্ণা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে এবং বলে সত্যিই সে আজকে পরিপূর্ণা।পূর্ণা বলে সে মা হতে পেরেছে। অন্যদিকে শঙ্করের ফোন বেজে ওঠে। ফোনে কথা শেষে শংকর পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে আর বলে মিস্টার বোস তাদের বিজনেস অফারটাকে ডিনাই করেছিল কিন্তু আজই সেটা আবার একসেপ্ট করেছে। শংকর আরো বলে লক্ষ্মী তাদের জীবনে সত্যি সত্যিই লক্ষ্মী হয়েই এসেছে। আজ আমাদের শুধু খুশি আর খুশি।  পূর্ণা বলে আর কেউ তাকে বাজা মেয়েমানুষ বলতে পারবে না। তবে ফুলির জন্য তার কষ্ট হয় ।এই অকালে চলে যাবার জন্য। তবে যাবার আগে ফুলি লক্ষ্মীকে তার কাছে দিয়ে, তাকে পরিপূর্ণা করে দিয়ে যায়। আর এজন্যেই তার মনের বালুচরে আজকে শুধুই খুশির হাওয়া, শরতের সোনালী রোদ্দুর শিউলি পদ্মের সমারোহ।

অলোক দাস


পৃথিবী দাও বিদায়

হাওড়া  বন্দি মোন জটিলতায় বদ্ধ জীবন, স্রোতের ধারার মতো বইছে দিনরাত - কিছু স্মৃতি আছে, যা ভোলার নয়, কবিতার দেশে এঁকে যাই, এই চলে আসা পথের ঠিকানা, হ্যাঁ মোন কথা বলে কখনো, যখন আমরা গভীর ঘুমে আছন্ন ।যেখানে গান নেই, ভালোবাসার অভাব, প্রাণ নেই, আশ্রয় ও নেই, তখনি 'mon' বলে বিদায় দাও । নীল আকাশ যা স্থির চিরদিন, তার নিচে শুধু কান্না, শুনছি বারবার । জানি দেহের বাঁদিকে যে  ঘড়িটা চলছে, সেটা অমূল্য । দামি বাড়ি, গাড়ি ও অর্থ যতই হোক, এর কোনো মূল্য নেই, কিন্তু বাঁদিকের ঘড়িটা বড়োই অমূল্য ।

ফাতেমা ইসরাত রেখা



বিভ্রান্ত সম্পর্ক 

তুমি দূরেই থাকো , দূরত্বেই তোমাকে মানায় 

কাছে এলেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, 

চেনা পৃথিবীর ওম কি রকম অচেনা লাগে।

মনে হয় যেন আমার অস্তিত্ব ক্ষয়ে মিশে গেছে 

তোমার বুকের গভীরে মোড়ানো যান্ত্রিক দর্শনে,

কুয়াশার ছাপ ফেলে যায় তোমার গমন পথের দু’দিকে।


তুমি দূরেই থাকো, যেমন আছো

কাছে এলেই জমানো অভিমান দু'চোখে উপচে পড়ে 

শান্ত নদীর শীতল জলস্রোত ফুলে ফেঁপে ওঠে।

প্রতিটি তরঙ্গ যেন ভরসার প্রতীক হয়ে যায় তোমার স্পর্শে 

তোমার লগ্ন মাধুরী জলে ভিজে যায় অপেক্ষার আঁচে সময়ের,

নেশা ভরা দৃষ্টির তরঙ্গে কামনার ঊর্মি দোলে ঘোর লাগা বিষাদে 

আবছা আলোয় ভিজে যায় মন মহুয়ার বন। 


তুমি দূরেই থাকো, যতোটা পারা যায় 

আমারও মন ভুলে যাক সম্পর্ক, ভুলে যাক সব সংশয় 

দ্বিধা দ্বন্দ্বের মায়া ছেড়ে কষ্টে থাকা সহজ।

মিথ্যা প্রবোধ মেনে নিয়ে সমঝোতা কঠিন বরং আরো 

মুখোশের আড়ালে মুখ, সত্যের আদলে মিথ্যা অভিনয়ে 

তোমাকে ভীষণ মানিয়ে গেছে আজকাল 

তুমি বরং দূরেই থাকো, দূরত্বেই তোমাকে মানায়।

জি এম কাউসার আলী, (অষ্ট্রেলিয়া)



শূন্যতায় পূর্ণ

পৃথিবী নিস্তব্ধ নিরিবিলি

শূন্যতায় আছন্ন চতুর্দিক,

শূন্যতায় পরিপূর্ণ অপূর্ণ হৃদয়

না পাবাদের ভীড়ে,

কূয়াশায় নিমগ্ন ধরার

এই বেলা ভূমিতে।

অতৃপ্ত অন্তর শুধু খুঁজে ফেরে 

একরাশ ফুরসাত ,

কখনও চেয়েছি নিজের মতন করে,

পূর্ণতার দলে ভিড়তে সুখের নোঙরে।

তৃপ্ততা যে লেখেনি বিধাতা 

এই অধমের ভালে!

শুধু এঁকে দিয়েছে দুঃখের বলিরেখা 

অধমের কপালে। 

নয়ন মেলে চেয়ে থাকি, 

চাতকের ন্যায় তোমার পানে,

কখনও সুখ বৃষ্টি বর্ষন করো 

আমার খরাচিত হৃদয়ে।

ওয়াসিম খান



সে আসবে বলে 

সেই কবে থেকে, সে আসবে বলে ,

প্রতিটা দুপুর বসে বট তলে থাকি একা একা । 

কোন শুভ দিনে, শুভ মুহূর্তে , 

শত যুগ পর তার সাথে হবে ক্ষণিকের দেখা । 


মন ভাঙে তবু আসলনা তো সে 

এ অপেক্ষার হয় নাকো কভু চির অবসান । 

পৃথিবীর বুকে আঁধার নামলে

জলে ভরে আখি, করি শুধু মিছে মিছে অভিমান। 


নীরবে পাথর কষ্টে কাতর 

বলি নাকো কথা কভু কারো সাথে একা একা হাসি ।

পাগল বলেই লোকে গালি দেয়

দেখ যত পারে, আমি চুপ থাকতেই ভালোবাসি ।

তাহসান কামরুজ্জামান

তুমি আসলে 


তুমি যখন আমার হৃদয়ের চারণভূমিতে পাড়ি জমাও"তখন পুরো পৃথিবী জুড়েই যেন আমার সুখের উল্লাস ছড়িয়ে যায় ! 

চারিদিকে সব ফেকাসে রংগুলো রঙিন হয়ে উঠে। 

যেন নতুন কোনো আকাশের দেখা মেলে"যেখানে শুধুই জমা হয়েছে  ব্যক্তিগত কিছু মনকাড়া বৃষ্টি। 


কতোদিন ধরেই তো তোমার হৃদয়ের আকাশে আমার নীল ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে রেখেছি! 

যদি তুমি একটু তাকিয়ে দেখো,আমার হৃদয়ের আকাশটা কে,


তোমার প্রতিটা পদচারণে দলিত হয়ে উঠে আমার হৃদয়ের মন্দিরে! পুনরাবৃত্তি করতে থাকে তুমি এসেছিলে বলে। 

কি এক অদ্ভুত শক্তি দেখেছো? 

অদৃশ্য হয়েও ডাকাতে থাকো চুপটি করে হৃদয়ের ইশারা দিয়ে

রঙিয়ে দিতে পারো মনের অনুভূতিগুলো।