উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮৭
উথাল পাথাল মন
মমতা রায়চৌধুরী
শিখার গতরাতে উত্তেজনায় ঘুম আসে নি হঠাৎ করে মনটা যেন কেমন উথাল-পাতাল করছে।কেন এমন হলো ?তবে কি মেসেজগুলো তার ভেতরে কোন রেখাপাত করল ।নাকি অন্যকিছু? উদাসী বাউল মনটাকে আবার কি ঘরের দিকেই আবদ্ধ করার জন্য কোনো মন তাকে ডাকছে, সোনার আলোয় ভরিয়ে দেবার জন্য ।
খুব ভোরবেলায় উঠে পরেছে শিখা। ভোরে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঠাকুরঘরে গেছে। ঠাকুর ঘরে প্রেমের ঠাকুর 'রাধামাধব 'এর সামনে 'তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে ,মলিন মর্ম মুছায়ে..।'গান গাইছে একাগ্রচিত্তে।
গান শুনে মাধু ,সুরঞ্জন ,বৃষ্টি সকলের ঘুম ভেঙে গেছে ।সকলে হা করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তিন তলার ঠাকুর ঘর থেকে আওয়াজ আসছে।
মাধু সুরঞ্জনকে ধাক্কা দিয়ে বলল 'এই শোনো ,শোনো ।দেখো, শিখা গান গাইছে আবার ।আজ কতদিন পরে ঠাকুর ঘরে ঢুকলো বলো তো।'
সুরঞ্জন বলল 'একটা গুড সাইন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।'
মাধু বললো 'অপূর্ব গাইছে গো। '
সুরঞ্জন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো আর বলল 'বোনটা কার দেখতে হবে তো,?'
মাধু হেসে বলল 'ননদটা কার দেখতে হবে তো?'
বৃষ্টিটা আবার বলল" পি মনিটা কার দেখতে হবে তো?'
মাধু আর সুরঞ্জন তো বৃষ্টির কথায় অবাক হয়ে গেল। তারপর মাধু বৃষ্টিকে গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল 'একটা পাকা বুড়ি।'
এরপর বৃষ্টির হাতটা ধরে বলল 'চলো চলো চলো ঠাকুরঘরে চলো সবাই ।শিখা গান করছে।'
মেজ পিসি ঘর থেকেই বললেন 'কে গান করছে মাধু? শিখা?'
মাধুরী বলল'-হ্যাঁ মেজ পিসিমা।'
মেজ পিসি বললেন' গানের গলা তো ভালো। ওকে তো আমি এসে অবধি গান করতে শুনি নি।'
সবাই গিয়ে ঠাকুরঘরে বসলো। মাধু আর সুরঞ্জন দেখছে' কি ভক্তিভরে একান্তমনে ,একনিষ্ঠভাবে ঠাকুরের পুজো করছে গানের মধ্যে দিয়ে। অন্য কোন দিকে ধ্যান নেই। গান শেষে শিখা দু' হাত জোড় করে ঠাকুরের কাছে প্রণাম করলো ।প্রণাম করার সময় মাধুরী লক্ষ্য করল শিখার চোখে জল।'
মাধুরী মনে মনে ভাবল 'শিখার আত্মা শুদ্ধিকরণ হলো আঘাতে -আঘাতে , দগ্ধে -দগ্ধে পুড়ে পুড়ে ।
শিখা পুজোর শেষে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে পরিবারের সবাই উপস্থিত। শুধুমাত্র মেজ পিসি ছাড়া। এমনিতেও মেজো পিসির তিনতলা ওঠার ক্ষমতাও নেই, হাঁটুতে ব্যথা।
শিখা সবাইকে প্রদীপের শিখার তাপ, রাধা মাধবের আশীর্বাদ দিল ।তারপর প্রসাদ দিল।
মাধু দেখছে শিখাকে কি স্নিগ্ধ লাগছে। কি সুন্দর একটা লাল পেড়ে শাড়ি পরেছে।
বৃষ্টির পি মনি বলেই শিখাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছে ।ঠিক তখনই মাধু বৃষ্টিকে ধরে বলল ' একদম
নয় ।পি .মনি কে এখন ছোঁবে না ।বিছানা থেকে উঠে এসেছ।'
শিখা বলল' ছেড়ে দাও না বৌদিভাই। ও তো শিশু কিচ্ছু হবে না।সবকিছুর মধ্যেই ভগবান বিরাজ করেন ।এ'খানে কোন আচার-বিচার, রীতিনীতি খাটে না।'
মাধুরী তো শিখার কথায় হা হয়ে গেল। কি শুনছে শিখার কাজ থেকে।
মাধুরী বলল' ঠিক আছে । আমি নিচে যাচ্ছি প্রত্যেকে নাও ফ্রেশ হয়ে নাও। বৃষ্টির হাত দুটো ধরে নিয়ে বলল'বৃষ্টি চলো, চলো, চলো তোমাকে ব্রাশ করিয়ে দিই তারপর তুমি দুধ খেয়ে হোমওয়ার্ক করবে।'
শিখা আর সুরঞ্জনকে বলল 'তোমরাও তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি নাস্তা রেডি করছি। '
মাধু সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নিচে নেমে গেল।
সুরঞ্জনও নিচে নেমে গেল। শিখা কিছুক্ষণ ঠাকুরঘরে রাধামাধবের দিকে তাকিয়ে থেকে আপন মনে কি যেন বলল তারপর দরজা বন্ধ করে শিখাও নিচে নেমে আসলো।
ইতিমধ্যে শিখার ফোন বেজেই চলেছে।'
মেজ পিসি বললেন 'কার ফোন এতবার করে বেজে যাচ্ছে গো মাধু ,ফোনটা কেউ ধরছে না?'
মাধু বলল 'আমরা তো কেউ এখানে ছিলাম না পিসিমা।'
শিখা নিচে নেমে আসলে মাধু কানের কাছে গিয়ে বলল' তোর ফোনটা বেজে গেছে ।যা দেখ কে ফোন করল?'
শিখা হেসে নিজের ঘরে চলে গেল।
ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা ছিলই। সে তাড়াতাড়ি ফোনটা দেখল। দেখছে 'কল্যান ফোন করেছিল?'
তারপর হোয়াটসঅ্যাপটা খোলে। দেখল বেশ কয়েকটা মেসেজ ঢুকেছে।
প্রথম মেসেজটা'তখন ফোনটা ধরতে পারি নি।
এর জন্য দুঃখিত।'
পরের মেসেজটা আছে'অভিমান হয়েছে?'
তারপরে মেসেজে আছে 'বললাম তো একটা কাজে ছিলাম।'
এবার শিখা মেসেজ দিল'মনে করব কেন?'
সঙ্গে সঙ্গে কল্যান রেসপন্স করলো'
'অভিমান পাই খুঁজে কিছু,
পাই খুঁজে কিছু ব্যথাময়।
তাই আমি করে মাথা নিচু,
দুরু দুরু মনে সংশয়।'
শিখা টেক্সট করল
'অভিমানে নেই কোনো মূল্য
শীতের ঝরে যাওয়া
পাতার মতই শুধু শূন্য।'
মনের সংশয় ছেড়ে
এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর।
তাই পিছনে ফিরে তাকানো
শুধু ভুল আর ভুল।'
কল্যান মেসেজ করল
'অভিমান মূল্যহীন হলে
কি করে যে যায় দিনকাল?
কালোমেঘ মনে ভেসে এলে
বদলাবে কিছু হালচাল।'
শিখা লিখল'
'কিছুই বদলাবে না
হয়তো বা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর।'
কল্যান লিখলো '
শীতে শুধু পাতা নয় মনে,
ঝরে পড়ে বসন্তের পাতা।
চেয়ে থেকো প্রেমী আনমনে,
আমি হই হেরে যাক ব্যথা।
শিখা লিখল
'মনের জীর্ণতা যখন এসে বাসা বাঁধে,
কোন বসন্ত এসে তাকে নিয়ে যাবে উড়িয়ে।'
কল্যান লিখলো'
' এর চেয়ে বেশি কিছু তুমি,
ভালোবাসা মেখে মনময়।
প্রেম ছুঁয়ে লিখে যাই আমি
ভাষা নিয়ে করে নির্ণয়।'
শিখা লিখল
'তবুও তো ফুলের সুবাস
প্রত্যেকে চায়।
ঝরে যাওয়া পাঁপড়ির
সে রূপ গন্ধ কোথায়?'
কল্যান লিখল
' কোথায় ঝরেছে পাতা বলো,
সুগন্ধি ছেয়েছে হৃদি মন।
ঘুরে আসি মনে মনে চলো
পাহাড় সমুদ্র আর বন।'
এবার শিখা একটা হাসির চিহ্ন পাঠায়।
কল্যান আবার লিখলো
'শীতের গায়ে তুমি যদি একে দাও
পলাশের গান।
আমি তো অনন্ত যতি ছিল যত বোধে
আঁকা অপমান।
সবই তো ধুয়ে মুছে যাবে খুশির ফিরে পাবে
হৃদয়ের টানে।'
শিখা লিখল '
সব সময় শুধু চাওয়া ভালো থাকা
এই প্রত্যাশাটুকুই বেঁচে থাক।'
কল্যাণ লিখেলো 'সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে কে?'
শিখা কোন জবাব দেয় না।
এরমধ্যে মাধু বৌদি ', শিখা ,শিখা আ..আ . আ বলে ডাকতে শুরু করেছে।'
কল্যান আবার লিখল উত্তর কোথায়?
মাধু আবার ডাকছে শিখার নাম ধরে।
মেজ পিসি নিচ থেকে চিৎকার করছেন।
বলছেন'এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে। তাকে সব সময় খাবার জন্য ডাকতে হবে?'
শিখার কানে কথাটা আসলো। লিখল এখন আমি নিচে যাচ্ছি বৌদি ডাকছে?'
কল্যান বলল 'ok কিন্তু জবাব চাই। মনে থাকে যেন।
শিখা হাসির চিহ্ন দিয়ে পাঠায়।
এবার শিখা শাড়িটা চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে। মাধুরী লক্ষ্য করে শিখার ভেতর আজকে রাগ নেই ।মেজপিসিমা যেভাবে কথাগুলো শোনালেন তাতে মাধুরী ভেবেছিল শিখা এসে আবার কোনো কাণ্ড করে না বসে।'
শিখা নিচে এসে বৌদিকে বলল'বৌদিভাই, আমার খাবার দাও।'
মাধুরী বলল' এই দিচ্ছি।'
শিখা বললো 'বৌদিভাই আজকে আমি একটু বেরোবো।'
কথাটা শুনতে পেয়ে মেজ পিসি বললেন 'কেনো রে ,যখন- তখন, যেখানে -সেখানে বেরোস কেন এত?'
শিখা কোন কথার উত্তরই দিলো না এভয়েট করে গেল।
মাধু বলল 'পিসিমা প্রয়োজন থাকলে তো বেরোতেই হবে না?'
পিসিমা বললেন 'আর এত ঢাকো কেন মাধু তুমি?'
শিখা বলল 'বৌদি ভাই আমি বেরোচ্ছি।'
মাধু শুধু হেসে ঘাড় নাড়লো।
শিখা ঘরে গিয়ে ড্রেস পরতে পরতে গান গাইতে লাগল 'ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে...।
তারপর একটা কি উত্তেজনা মাদকতা সারাক্ষণ মনটাকে উথাল পাথাল করে দিতে লাগলো । এই উত্তেজনাতেও কি আনন্দ ? ভালো লাগছে শিখার।'আজকে কি সারাটা দিন ধরেই চলবে মনের ভেতর অস্থিরতা? সারারাত ঘুম হয় নি কিন্তু তাতে টায়ার্ড লাগছে না। শিখার মনে কি হলো সেটাই খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে। আজকে বাইরে বেরোবে ফুটপাতে রাস্তা ধরে হাঁটবে অনেকটা দূর পর্যন্ত নিজেকে জানার জন্য।