০৭ জানুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ/৫০ পর্ব






শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৫০)
শামীমা আহমেদ 

দরজায় কলিংবেল শুনে শায়লা  নিজের ঘর থেকে এগিয়ে এলো। দরজা খুলতে গেলে ডাইনিং এর দেয়াল ঘড়িটাতে তাকিয়ে নেয়া শায়লার বহুদিনের অভ্যাস।কে কোন সময়টাতে  এলো এটা দেখা শায়লার একধরনের ভাবনার খোরাকও বটে! 
ঘড়ির কাঁটায় রাত নয়টা।শায়লা দরজা খুললো।রাহাত অফিস থেকে ফিরলো।আজ বেশ দেরি হলো।রাহাত অবশ্য আগেই অফিস থেকে তা জানিয়েছিল।সামনে ওদের অফিসে বোর্ড মিটিং।অনেক পেপারস রেডি করতে হচ্ছে।তাই দেরি হবে।না জানালে মা বেশ অস্থির হয়ে উঠে। রাহাত আর কোন দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো, 
আপু, খুব ক্ষুধা পেয়েছে, খাবার দাও।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
শায়লা তড়িঘড়ি করে কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।
দিচ্ছি, হাতমুখ ধুয়ে এসো।
রাহাত নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে আবার ফিরে এলো।
ওহ! আপু, আজ অনেক ব্যস্ত ছিলাম।তাই শিহাব ভাইয়াকে কল করতে পারিনি।আজ সারাক্ষনই সবাই গ্রুপে কাজ করেছি।একেবারেই ফুসরত মেলেনি।তবে ইনশাআল্লাহ  অবশ্যই  কাল কথা বলবো।
শায়লা বেশ আড়ষ্ট হয়ে কথাগুলো শুনছিল।রাহাত যতটা সহজভাবে বলছে মনে হচ্ছে শিহাব ইতিমধ্যে  এই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছে।আসলে  শিহাবের সাথে কথা বলে রাহাতেরও খুব ভালো লেগেছে!তাইতো তাকে পরিবারের সদস্য করে নিতে আর যেন ত্বর সইছে না।
---তোমাদের কী কথা হয়েছে আপু?
শায়লা রাহাতের দিকে চোখ না তুলেই জানালো,হ্যাঁ,হয়েছে।
ঠিক আছে আপু,কাল অবশ্যই কথা বলে নিবো।একটু ব্যস্ততা কমবে কাল।আমি আসছি,বলে রাহাত ঘরে ঢুকে গেলো।
শায়লা কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো।মাঝখানে  দাঁড়িয়ে মা দুই ভাইবোনের কথার কিছুই বুঝলা না।সে অবাক হয়ে শুধু এদিক ওদিক করলো। তবে একটা নাম নিয়ে আলোচনা যে হলো সেটা সে শুনেছে,তা হলো শিহাব।শিহাব কে!মা ঠিক বুঝতে পারছে না।  শায়লার দিকে দৃষ্টি দিতেই শায়লা দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেলো।শায়লা মায়ের এমন বিব্রতকর অবস্থা  দেখে নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছে।

প্রায় পৌনে দশটার দিকে শিহাব ঘরে ফিরলো।পথিমধ্যে বাইক থামিয়ে  একটা  ক্যাটারিং হাউজে চাওমিন অর্ডার করলো।তাকে সেখানে বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো।যেহেতু টেক এওয়ে খাবার তাই ওরা বেশ যত্ন নিয়ে খাবারটি তৈরি  করে।আর তাই একটু সময় বেশি নেয়।আর শিহাবকে তো সার্ভিসম্যানগুলো খুবই পছন্দ করে।ওদের খুব ইচ্ছা,স্যার একদিন আমাদের এখানে বসে ডিনারটা করেন,ম্যাডামকেও একদিন আনেন। ওদের ধারনা শিহাবের উপস্থিতি ওদের কাস্টমার বাড়াবে।বিশেষ করে নারী কাস্টমার!শিহাব এসব কথার একেবারেই পাত্তা দেয়না। সে নিজেকে এতটা সস্তা করে দিতে রাজী নয়। পুরুষের  সৌন্দর্য  তার ব্যক্তিত্বে আর নারীর  সৌন্দর্য  শালীনতায়।শিহাব বাইরে বাইকে বসেই অপেক্ষা করে। আজ বাইকে বসেই শিহাব ভেবে নিলো,ঘরে খাবার ফুরিয়েছে।মা,ভাবীকে জানাতে হবে আবার কিছু খাবার তার জন্য পাঠাতে। পরক্ষণেই ভাবলো।না পাঠাবে কেন? খুব শীঘ্রই সে নিজেইতো জিগাতলায় যাবে, শায়লাকে নিয়ে। শায়লার কথা জানিয়ে মা আর ভাবীকে আগে থেকেই ব্রিফ করে রাখতে হবে।মা খুশি হলেও ভাবী কিভাবে নিবে শিহাব তা বুঝতে পারছে না।ভাবীর খুব ইচ্ছা ছিল তার খালাতো বোনের সাথে শিহাবের বিয়ে দিতে।ভাবীর খালাতো বোন জেরিন,মেয়েটি নিঃসন্দেহে খুবই ভালো কিন্তু শিহাব ঠিক মেয়েটির সাথে নিজেকে মিলাতে পারেনি।বেশ ধনীর ঘরের মেয়ে। বিয়ের তিনদিনের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায়।ছেলেটি ড্রাগ এডিক্ট ছিল। বিয়ের সময় বুঝা যায়নি একেবারে।আর বিয়ের পর তা বুঝতে পেরেই জেরিন আর তার সাথে সংসার করতে চায়নি। শিহাব ভেবে নিলো, আসলে পৃথিবীতে কেউই সুখী বয়।অর্থ বিত্তও সুখ এনে দিতে পারেনা।টাকার অভাবে দরিদ্ররা মেয়ে বিয়ে দিতে পারে না, অর্থাভাবে স্ত্রীর প্রতি নির্যাতন চালায় আবার ধনীদের প্রচুর অর্থ থাকলেও,তাদের কাছে  অর্থের চেয়ে এডজাস্টমেন্ট বড়! 
চাওমিন তৈরি হয়ে এলো।শিহাব বক্সটি নিয়ে বাইকে বাসার উদ্দেশ্যে দে ছুট! বাসার গ্যারেজে বাইক পার্কিং করার সময় কেয়ারটেকার বেলাল এগিয়ে এলো।কিছু একটা বলার জন্য কাছে এসে হাত ঘষাঘষি করছিল।
কিছু বলবে বেলাল?
জ্বী স্যার,একটা কথা।
বলো।
বেলাল বেশ ভীত মুখেই বললো, স্যার নিচতলা অপুর আম্মু ম্যাডামে আমার কাছে আপনার মোবাইল নম্বরটা চাইছিল।আপনার অনুমতি ছাড়া তো আমি দিতাম পারিনা।
শিহাব আবার জানতে চাইল,,,,, কে?
ঐ যে স্যার, আপনারে যে জ্বরের সময় নাস্তা পাঠাইছিলো।অপুর আম্মু ম্যাডামে।
ওহ! বুঝেছি।নিশ্চয়ই কোন বিয়ের প্রস্তাব আসবে।হয় ছোট বোন,নয়তো ননদ নয়তো কোন বান্ধবীর ছোট বোন নয়তো কোন ভাবীর অবিবাহতা খালাকে নিয়ে।শিহাব এসব ভালোই বুঝে।এইসব সে এত ফেইস করেছে যে শিহাব এ সবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।তাকে নিয়ে কে কি বলতে চায় শিহাব খুব ভালো করেই বুঝে।তাইতো শিহাব নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলে।পারতপক্ষে কোন ধরণের পারিবারিক আয়োজনেও এজন্য সে যায় না।
শিহাব বেলালকে বেশ কড়া করেই নিষেধ করে দিলো নম্বর না দিতে। শিহাব ভেবে নিলো খুব শীঘ্রই এইসব যন্ত্রনার দিন শেষ  হচ্ছে।শায়লাকে দ্রুতই সে ঘরে নিয়ে আসবে। আমাদের দেশে এইসব ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের অতি উৎসাহ একেবারেই ভদ্রতার বাইরে।
শিহাব ঘরে ঢুকে খাবারটি টেবিলে রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
শায়লার মেসেজ এলো।আজ রাতে কি মেনু?
শিহাব উত্তর লিখে জানালো,চাওমিন এনেছি।
হু, গরম থাকতেই খেয়ে নিও।
শিহাব বুঝে না মেয়েরা যত্ন আত্তির ব্যাপারে কিভাবে যে এত পারফেক্ট?
শিহাব লিখলো, শায়লা, তোমার সাথে শেয়ার করে চাওমিনটা খেতে ইচ্ছে করছে।
আচ্ছা, সে হবে কোনদিন।তুমি চাওমিন অর্ডার করে আমায় কল দিলেই  আমি চলে আসবো।
ওকে,,জাস্ট মাইন্ড ইট!
শায়লা নীরব হলো।শিহাব মনের ভাবনায় শায়লাকে নিয়ে চাওমিন বক্স এক নিমেষে খালি করে ফেললো! শিহাবের খুব প্রিয় এই আইটেমটা।ভাবীর হাতেরটা চমৎকার হয়।একদিন ভাবীই খাইয়েছিলো। শিহাব ভাবলো শায়লাকে বলবে ভাবীর কাছে থেকে  রান্নাটা শিখে নিতে।শিহাব কি যে সব এলোমেলো ভাবছে! নিজেই মনে মনে হাসছে।
শিহাব এক কাপ গরম কফি বানিয়ে বিছানায় নিয়ে বসলো। মাকে কল দিতে হবে।আজ জীবনের বিরাট একটি সিদ্ধান্ত মাকে জানাতে যাচ্ছে।শিহাব খুব করে জানে,মা কতটা খুশি হবে! মায়ের চাওয়াটা শিহাব ঠিকই বুঝতো কিন্তু তা পূরণ করতে পারছিল না। 
মাকে কল করে শিহাব বাবা মায়ের শারিরীক খোঁজ খবর নিয়ে জানালো, মা আমি দুদিন পর শুক্রবার দিন জিগাতলায় আসছি।মা আমার সাথে একজন অতিথি  থাকবে সে সারাদিন তোমাদের সাথে থাকবে।আরাফের সাথে সময় কাটাবে।
মা এবার বুঝতে পারলো কেমন অতিথি!
মা, আমি যাকে নিয়ে আসছি সেই হবে আরাফের মা।আমি চাই, তুমি ও বাসার সবাই আরাফকে এটাই বুঝাবে, যে ইনিই তোমার মা।
শিহাবের কথায় মা একেবারেই নিরুত্তর হয়ে রইল।এ ব্যাপারটিতে তার কোনই আপত্তি নেই বরং আরাফ মায়ের আদর পাবে শিহাবের মা এতেই খুশি।
মা,তুমি বাবা আর ভাবীকে জানিয়ে রেখো।আর ভাবি যেন ভাইয়াকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখে।যদিও এ ব্যাপারে 
শাহেদ কোন আগ্রহই দেখাবে না।কোন কালেই সে শিহাবকে নিয়ে অতিরিক্ত কোন কৌতুহল দেখায়নি।একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তিনি।শিহাব জানালো,
মা,আমি তোমাদের ওর ব্যাপারে সব জানাবো। দয়া করে তোমরা ওকে কোন কিছু নিয়ে প্রশ্ন করবে না। শুধু দেখবে সে আরাফকে আপন করতে পারছে কিনা আর আরাফও তার কাছে স্বেচ্ছায় যাচ্ছে কিনা। তোমরা ওদের কে আপন হতে সাহায্য করো।
আচ্ছা মা,রাত হয়েছে,ঘুমিয়ে পড়ো।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শিহাব কল শেষ  করলো। একটা সিগারেট  ধরিয়ে  দীর্ঘ এক টান দিয়ে সাথে কফি কাপে দারুণ এক সিপ টেনে নিলো।মূহুর্তেই দেহের ভেতরে একটা রক্তের ছলাৎ চলনে দেহটা কেঁপে উঠলো। শায়লার মুখটা যেন চোখের সামনে এসে থামলো! যেন শায়লার স্পর্শ টের পেলো।শিহাব মনের অজান্তেই হেসে উঠলো। হাতে টিভি রিমোট নিয়ে স্পোর্টস চ্যানেলে স্টিক হলো।ফুটবল খেলা চলছে।ম্যানচেস্টার আর রিয়েল মাদ্রিদের খেলা।দুই পক্ষেই গোল হয়ে হয়েও হচ্ছে না! একপক্ষ কর্ণার কিক মিস করছে তো আরেকপক্ষের লং শট বারবার গোল পোস্টে লেগে ফিরে আসছে! ভীষণ উত্তেজনাকর খেলা চলছে। শিহাব খেলার মাঝে বারবারই আফসোস করে উঠছে।
গ্যালারিতে  সমর্থক দর্শকদের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।কোন ভাবেই যেন নিজ দলের গোল দেয়া দেখাটা মিস না হয়ে যায়!
শিহাবের মোবাইলে 
একটা রিং এলো। শিহাবের মনযোগ কিছুটা হলেও সেদিকে গেলো।কোন নাম ছাড়া অচেনা একটা নম্বর থেকে।শিহাব কৌণিক চোখে একবার দেখে নিলো। নাহ! নাম্বারটা একেবারেই চেনা নয়। ফ্যাক্টরির ম্যানেজার কিনা? কোন ঝামেলা হলো কিনা আবার?
ভাবতে ভাবতে এক রাউন্ড রিং শেষ হলো।শিহাবের মনে খেলার আগ্রহের চেয়ে এখন মোবাইল স্ক্রিনে চোখ আটকে গেলো।
আবার কল।শিহাব এবার এক রিংয়েই ধরলো।
হ্যালো, কে বলছেন।
ওপাশের নীরবতা শিহাবকে উৎকন্ঠিত করে তুললো।বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে শিহাব।
কে বলছেন? কে বলছেন? 
এবার উত্তর ভেসে এলো।যা শুনে শিহাব একবারে যেন  ভাবনার কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। টিভি স্ক্রিনে ম্যানচেস্টার  এক গোল দিয়েছে,গ্যালারিতে দর্শক আনন্দে ফেটে পড়ছে কিন্তু  শিহাবের সবকিছু যেন পানসে হয়ে থমকে গেলো।ওপ্রান্তে কে? শিহাব ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলেও এমন রহস্যজনক আচরণে বেশ রাগও হচ্ছিল।
কিছুক্ষন পর উত্তরটা ভেসে এলে, শিহাব যেন হঠাৎ থমকে গেলো! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এত উত্তেজনাকর খেলাও আগ্রহে ভাটা পড়লো। মনে হলো সুদূর অতীতের 
ভুলে যাওয়া একটা খুবই চেনা কন্ঠস্বর থেকে উত্তরটি ভেসে এলো,,,,,আমি রিশতিনা। গত পরশু দেশে এসেছি।তুমি কেমন আছো শিহাব?
চকিতেই যেন শিহাবের ভেতরে বিশাল এক ভূমিধ্বস হলো।চলার গতির হঠাৎই থেমে গেলো। সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রিশতিনার মায়াবী মুখটা বুকে এসে আঘাত করলো।
ওপ্রান্ত থেকে আবার একই প্রশ্ন,,,কেমন আছো শিহাব ?


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much