দংশন
সারা রাত রেখা দু 'চোখের পাতা এক করতে পারে নি। এরইমধ্যে ফোনটা বেজে চলেছে। রেখা ক্লান্ত শরীর ,তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ফোনটা কোনরকমে ধরল এবং বলল'হ্যালো'।
ওপার থেকে সোমদত্তার কন্ঠে ভেসে এলো'দিদি, পার্থকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি । কেন কি হয়েছে ওর? হ্যালো হ্যালো। ফোনটা কেটে দিলো ?'
এবার রেখা কি করবে? এ দিকে মনোজও বাড়িতে নেই ।সঙ্গে সঙ্গে মনস্থ করলো , মনোজকে ফোন করবে। ভেবে রিং করল।ফোনটা ওপার থেকে রিসিভ করে বলল ' হ্যালো কি হয়েছে বল?'
রেখা বলল 'কি করে জানলে কি হয়েছে?
মনোজ বলল 'এত সকালে তো তুমি ফোন করবে না তোমার তো কাজে থাকার কথা।'
রেখা বলল ' ঠিকই ধরেছো পার্থকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ।এখন আমার কি করা উচিত ।এখন এই মুহূর্তে আমি ট্রেন তো পাবো না।
মনোজ বলল 'পার্থ! কোন পার্থর কথা বলছো?
রেখা এবার একটু রাগ আর বিরক্তির স্বরে বলল পার্থ ।পার্থকে চেনো না ।আমার ভগ্নিপতি।
মনোজ বলে ' যা কিছু মনে করো না। আসলে আমি ভেবেছি পাশের বাড়ির ওই পার্থ। কেন কি হয়েছে ওর?'
রেখা বলল ' কি হয়েছে সেটা তো জানি না ।গতরাত্রে সোমদত্তা ফোন করেছিল ।তাতে ও যা বলেছিল ,ওর নাকি পার্থর সাথে থাকা সম্ভব হচ্ছে না ।আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আজকের মধ্যেই এই ঘটনা ভাবতে পারো?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ যাও ।তবে কাকু কাকিমাকে এই মুহূর্তে কিছু বলার দরকার নেই। বয়স হয়েছে তো ?একে তো ছেলেটা অমানুষ ।সে তো মা বাবার খোঁজ খবরই রাখে না ।আবার এইদিকে মেয়েটারও এই অবস্থা ।ঠিক আছে ।আমি দেখছি। আমি পাশের বাড়ির পার্থকে বলে দিচ্ছি ।ও গাড়ি করে দিচ্ছে। তুমি বেরিয়ে যাও।'
রেখা বলল 'বাবান কেমন আছে?'
মনোজ বলল 'আগের থেকে ভালো আছে। বিপদের ঝুঁকি নেই ।এ যাত্রায় বেঁচে গেল।'
রেখা বলল 'যাক, তবু একটু আশার কথা শোনালে।'
মনোজ বলল 'ঠিক আছে তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও ।পুটু এসেছে?'
রেখা বলল 'না, কত জ্বালা হয়েছে বলো দিকি নি?'
মনোজ বলল 'ঠিক আছে। আমি বাড়ি যাই । তারপরে ওর বাড়িতে যাবো । খোঁজ খবর নেব ।না হলে অন্য লোকের ব্যবস্থা করতে হবে ।এখন তুমি মাথা ঠান্ডা করে ,যেখানে যাচ্ছ ,সেখানে যাও ।আমি এদিক দিয়ে বেরিয়ে যাব।'
রেখা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল 'কি হবে? ঠিক আছে আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।'
এরই মধ্যে গাড়ি এসে হাজির।বাইরে থেকে কয়েকবার বৌদি বৌদি করে ডাকার আওয়াজ।
রেখা জানলার পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করল কে?ও পার্থ।
পার্থ বলল 'নুতন ড্রাইভার কিছু সমস্যা হলে ব'লো।'
রেখা বলল 'কেন হাদুর কি হলো? এমনিতেই অসুবিধার মধ্যে আছি, আবার যদি কিছু গন্ডগোল হয়।'
পার্থ বলল 'না ,বৌদি চিন্তা ক'রো না ।এমনিতে ও পাকা ড্রাইভার। সেরকম হলে আমাকে একটু ফোন করে নিও।ঠিক আছে। গড়িয়া স্টেশনের কাছে সোমদত্তাদের বাড়ি যাবে তো ?অনেকদিন আগে একবার গিয়েছিলাম ।আমিই নিয়ে গেছিলাম। ওর হাজব্যান্ড খুব ভালো মানুষ ।তাই না বৌদি? '
রেখা শুধু এক কথায় ' হ্যাঁ ,বলে সম্মতি জানালো।'
গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় চৈতির মা বলল 'দিদি কোথাও বেরোচ্ছ? কারো কি কিছু হলো? রেখা শুধু বলল 'হ্যাঁ একটু বেরোচ্ছি ।'
চৈতির মা বলল 'ঠিক আছে সাবধানে।'
রেখা ভাবছে চৈতির মার একটু বেশি বেশি সব ব্যাপারে ।কোথায় যাবো ?কি করবো? সর্বক্ষণ যেন একটা নজর । বাবা রে কি বেয়াক্কেল মেয়ে । সোমদত্তা কে ফোন করে যাচ্ছি ।ফোনই ধরছে না ।কি মেয়ে জানে না ,যে চিন্তা হয়। ভাবতে-ভাবতে যাচ্ছে এমন সময় মনোজ ফোন করল 'কত দূরে আছে ।'
রেখা বলল 'এইতো প্রায় ঢুকবো ঢুকবো।'
মনেজ বলল 'সে পৌঁছে গেছে।'
রেখা বলল 'বাবা ,তুমি পৌঁছে গেছো ।ওদিকে কি ব্যাপার বুঝছ?পার্থ ঠিক আছে ?'
মনোজ বলল ,'আরে পার্থ অব্দি পৌঁছাতে পেরেছি ?কোথায় বাড়িতে আসলাম -দেখি কেউ নেই । সমুকে ফোন করলাম ও ঠিকানা দিলে, সেখানে যাচ্ছি ।আমি তোমাকে টেক্সট করে দিচ্ছি। তুমি সেই ঠিকানায় পৌঁছে যেয়ো কেমন,?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে। নির্দিষ্ট হসপিটালে গিয়ে পৌঁছালো ।সোমদত্তা আর ঐ ছেলেটাকে দেখতে পেল ।মাথা গরম হয়ে গেল কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা রাখে।
রেখা বলে 'পার্থ কেমন আছে রে? '
সোমদত্তা বলল 'যাও না দেখে এসো।
রেখা বলল 'আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি ,একটা কথা সোজা করে উত্তর দিতে পারিস না?'
সোমদত্তা বলল ' কি ভুল বলেছি ।তুমি যাও না নিজেই দেখতে পাবে ।আমার বলার চেয়ে নিজের চোখে দেখা টা অনেক বেশি বাস্তব বলে মনে হবে না? '
রেখা কথা না বাড়িয়ে সোজা ঢুকে গেল নির্দিষ্ট কেবিনে । দেখে মনোজ বসে আছে।
রেখা বলল 'কেন এমন করেছিলে?'
পার্থর চোখে জল ।একটু হেসে কথা বলার চেষ্টা করছিল ,।
তখন মনোজ বলল 'এখন এসব কথা থাক।'
রেখা শুধু বললো 'সব ঠিক হয়ে যাবে।'
পার্থ ভরসার চোখে রেখার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
রেখার ও চোখ ফেটে জল আসছিল।
মনোজ বলল ' তোমরা একটু কথা বল আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।'
ফিরে এসে মনোজ ইশারায় রেখাকে যা বলল তাতে মোটেই প্রীতিকর ঘটনা কিছু ঘটছে না।যেভাবে সমু
ছেলেটার সঙ্গে ঢলে আছে, তাতে আমার ভীষণ বিরক্তি লাগলো ।ও পুরো নির্লজ্জ হয়ে গেছে, ওর স্বামী যেখানে ভর্তি।'রেখার কথাগুলো শুনে কান গরম হয়ে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসলো।
এসে যা দেখল ,তাতে রেখা মাথা ঠান্ডা রেখে বলল'
'যা না তুই পার্থর কাছে। কাছে গিয়ে একটু বোস।'
সোমদত্তা বলল 'যা বলার তো তোমাকে গতকালকে দিদি বলেই দিয়েছি ।ওর সঙ্গে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়।'
রেখা বলল 'তোর কোথায় সমস্যা? তোদের ক্রাইসিস টা কি? কেন? সেগুলো আমাদেরকে বল। আমরা চেষ্টা করে দেখি। তাছাড়া পাবলো ছোট ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। নিজের সুবিধার জন্য তুই এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারিস?'কথা বলতে বলতেই দেখতে পেল ছেলেটা হাঁ করে সমস্ত কথাগুলো যেন গিলছে।
রেখা তার দৃষ্টি দিয়ে যেন ছেলেটিকে ভস্ম করতে চাইল ।বুঝিয়ে দিতে চাইল ।এখানে থাকাটা তার অনুচিত।
ছেলেটি বুঝতে পেরে সোমদত্তাকে বলল'তোমরা কথা বলো ।তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বাররা আছে। এখানে থাকাটা আমার ঠিক নয়।'
সোমদত্তা রেখার দিকে' বিরক্তি ও জিজ্ঞাসা চোখে তাকিয়ে ছেলেটাকে বলল 'এখানে কেউ ফ্যামিলি মেম্বার নেই ।আমার যা বলার আমি শাশুড়ি মাকে বলে দিয়েছি।'
ছেলেটি একটু মুচকি হেসে পাশেই বসে রইল।
এত অসহ্য লাগছিল। রেখা শুধু বলেছিল তুই এতটা নির্লজ্জ, বেহায়া ।আমি কখনো কল্পনা করতে পারি নি যে আমাদের ফ্যামিলিতে এইরকম একটা কালচারের মেয়ে আছে? কাকু কাকিমা কতটা কষ্ট পাবে একবারও ভাবলি না ।ছোট্ট পাবলো নিষ্পাপ ওর কথা ও একবার ভাবছিস না।'
সোমদত্তা বলল 'দেখো দিদি আমি বাবা তোমার মত অত ভ্যালুজ ,মরালিটি বুঝি না। যা করতে মন চায় না আমার কাছে সেটাই অন্যায় ।কারণ মন ই আমার কাছে গড ।আমার কাছে নীতি-টিতির কোন মূল্য নেই।'
কথাগুলোতে যেন রেখার মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগল ।তার বুকে সজোরে এসে যেন ধাক্কা মারলো ।সে ধাক্কা তার কলেজ জীবনে সিদ্ধার্থ র প্রপোজ করার ধাক্কার চেয়ে অনেক বেশি। রেখাকে টানতে টানতে মনোজ নিয়ে আসলো আবার ভেতরে। আর মনোজ বলতে লাগলো 'পৃথিবী মনে হচ্ছে অনেক নিচে নেমে গেছে, নাকি পৃথিবীর মানুষগুলো অনেক নিচে নেমে গেছে ,।সবকিছু যেন ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। মনোজ বলল 'পার্থর সঙ্গে দেখা করে ,চলো বাড়ি ফিরতে হবে। তোমার অনেক ধকল গেছে। পার্থকে বিদায় জানিয়ে যখন রেখা ও মনোজ বেরিয়ে গাড়িতে বসলো ।তখন রেখার মনে হল সে যে পার্থকে কথাগুলো বলল সবকিছুই মেকি। আদৌ সেগুলো বাস্তবায়িত হবে না। গাড়িতে বসার পর ফোন বেজেই যাচ্ছে। মনোজ ফোনটা দেখে বলল রিম্পাদি ফোন করছে ,রিসিভ করো। রেখা ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালো। সে শুধু ভাবতে লাগলো কাকু কাকিমা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা,? তাছাড়া ওইটুকু বাচ্চার কি রকম রিয়াকশন হতে পারে ?একবারও ভাবার চেষ্টা করল না ।রেখার ভেতরে যেন এই দংশন ক্ষতের আকার নিল। ছেলেটার বউ বাচ্চা আছে। ও কি সুখের সাগরে ভাসতে চলেছে কে জানে?