উপন্যাস
টানাপোড়েন১১৮
স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচল
মমতা রায়চৌধুরী
স্কুল থেকে ফিরে হঠাৎ একটা বাজে খবর মনটাকে ভারাক্রান্ত করে দিল। তার সাথে পরিচয় বেশিদিনের নয় ,লেখালিখি নিয়ে মনামীর মাধ্যমেই পরিচয়। মনামীদের অফিসে আসেন বিভিন্ন টেন্ডার নেবার জন্য এবং বিভিন্ন তথ্য সংবাদপত্রে পরিবেশনের জন্য। আসলে উনি একজন সাংবাদিক এবং লেখালেখিও করেন। বেশ কিছু কাব্যও নাকি প্রকাশিত হয়েছে।
মনামী ভদ্রলোককে বলেছিলেন 'আমাদের এক বন্ধু ভালো লেখালেখি করেন ।'
দেখতে পারেন' ওর লেখা নিয়ে ।'
ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু?
মনামী অবাক হয়ে নাকি বলেছিল' কি যে বলেন না আপনি মাঝে মাঝে ।মেয়ে বন্ধু। কোন বন্ধু হলে বেশি আপনার সুবিধা ? ছেলে না মেয়ে বন্ধু?'
একটু ব্যাকা চোখে তাকিয়ে মেয়ে বন্ধুর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন।
মনামীদের অফিসে উনি একজন রসিক মানুষ বলেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাই কেউ উনার কথায় কিছু মনে করেন না।
" ভদ্রমহিলা দেখতে কেমন?'
মনামীর কাছে ছবি ছিল সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে বলল এই দেখুন।'
"বাহ ,দারুন তো। জমে যাবে।'
আপনি পারেনও বটে।
মনামী নাকি হো হো করে হেসে ওঠে ছিল।
সেই সূত্রে কন্টাক্ট নাম্বারটা দেয়া
হয়েছিল ।রেখাকেও পরে মনামী কন্টাক্ট নম্বর দিয়েছিল ।
" এই নে কন্টাক্ট নম্বর।'
রেখা তো পুরো অবাক।
'বিস্ময়ে মনামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।'
আরে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখবি ।না ,এখন নম্বরটা নিবি?'
'না দেখছি তোর দ্বারা কোনো কাজ হবে
না । রিম্পাদির ফোন নম্বরটা দে ,রিম্পাদিকে পাঠিয়ে দিই।'
এরপর নিজেই ব্যাগ হাতড়ে রেখার ফোনটা বের করে সেভ করা নম্বরটি নিয়ে নিল।
রিম্পা দিকেও পাঠিয়েছিলো।
'তুই তো এসব নিয়ে বেশি কিছু ভাবিস
না ।কতদিন বলেছি পত্রিকায় লেখাগুলো দে ।
না, নিজের কাছে চেপে রেখে দিয়েছে।'
আপন-মনে বকবক করে গেল কিছুক্ষণ ।তারপর রেখার ফোনেও নম্বরটি সেভ করে দিল।
'যাক বাবা, আমার শান্তি।
দেখিস বাবা, পরে আবার আমাকেই ভুলে যাস না।'
রেখা তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলল 'কি যা তা বলিস না।'
মনামী আরো বললো 'শোন
'একটা টাইম দিয়েছেন। এই টাইমের মধ্যে দেখবি তোর কাছে ফোন যাবে ।'
কথাগুলো বলে মনামী স্কুটিতে স্টার্ট দিল আর কোন দিকে তাকালো না। যেন মনে হলো একরাশ ঝড়ো বাতাস কিছুক্ষণের জন্য ঝটকা মেরে এসে সব কিছু ওলট পালট করে যেমন দিয়ে যায়,ঠিক সেই গতিতে ও স্কুটি চালিয়ে চলে গেল।
রেখাও স্কুলে যাবে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে।
রেখা বরাবর এসবে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। লেখাটা তার নেশা ।ভালোবেসে সে লেখে।তবে মাঝে মাঝে লেখার গতি থেমে যায় ।সেরকম তো চাপ থাকে না যে অমুক পত্রিকায় লেখা দিতেই হবে ,নির্দিষ্টভাবে কয়েকটা দিনের জন্য বা ধারাবাহিকভাবে। তাই চাপ নিয়ে লেখে না, মনের খুশিতে, কখনো আনন্দ ,কখনো বা একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে সে বেছে নেয় লেখাকে।'
তাই আজও কোনো গুরুত্ব দিলো না কথাটার।
ট্রেনের খবর হয়ে গেল ট্রেন ঢুকছে ।রেখা দুই নম্বর প্লাটফর্মে যাবার জন্য ওভার ব্রিজ অতিক্রম করার জন্য দ্রুত উঠলো সিঁড়ি দিয়ে।
সেদিনের কথাটা তাই আজও তার মনে আছে। এই দিনেই তার প্রথম বোধহয় লেখালেখির জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিত স্থাপিত হয়েছিল।
ট্রেনে উঠে রিম্পাদিকে খোঁজ করতে থাকে। সাধারণত রিম্পা দি প্রথম দিকের লেডিসেই থাকে কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপর কোন রকম ভাবে জায়গা নিয়ে রিম্পাদিকে ফোন করলো।
রিম্পাদির ফোন রিং হতে হতেই রিম্পাদি ফোনটা রিসিভ করল বললো'আমাকে খুঁজছিস তো?'
'সত্যি ,তুমি কি করে বোঝা গো মনের কথাগুলো হ্যাঁ । তুমি কোথায় আছো বলো
তো ?
রিম্পদি তখন ও হো হো করে হাসছে।
' তুমি কোথায় উঠেছে বলো
আগে। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠেছ? কি ব্যাপার ?কিছু রহস্যের গন্ধ আসছে মনে হয়।
কিছু কেমিস্ট্রি তৈরি করছে নাকি?'
'হ্যাঁ ,হ্যাঁ গেস কর সেজন্যই তো অন্য কম্পার্টমেন্ট উঠেছি। কি কি আমার কপালে তোরা কম্প্লিমেন্টস লিখে রেখেছিস।'
'তা বলো আর হেঁয়ালি কোরো না, কোন দিকে আছো?'
" আজকে পেছনে লেডিসে উঠেছি।'
'ওমা কেন কি কারনে উঠলে?'
'ওমা জানিস না স্মৃতিদি।স্মৃতিদির জন্য উঠলাম'।
_এর ভিতর স্মৃতিদিকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?'
আরে স্মৃতিদির নাগাল কোথায় পাচ্ছি। টাকা পাবে না ?কোন হুশ নেই। যতবারই ফোনে বলা হয় ,ওটা ঠিক পেয়ে যাবো। তাহলে বোঝো এভাবেও ব্যবসা চালায় সে। টাকা পড়ে রয়েছে সেদিকে হুশ নেই।'
'হ্যাঁ ,বুঝলাম।'
এই জানিস তো একটা কি ভালো স্কিভি
এনেছিল ।ভাবলাম আমাকে মানাবে 'কি মানাবে না ?'
'ওমা মানাবে না কেন?
অত সুন্দর তুমি দেখতে। তোমার ফিগার টা কত সুন্দর বলতো?'
' আর ঢপের চপ ভাজিস না তো ।যত উল্টোপাল্টা কথা তোর। হ্যাঁ তোর নজরে তো সবসময় আমি সুন্দর। আমার নজরে তুই।,'
'হ্যাঁ সুন্দরীর পাশে শাকচুন্নি ,বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো রেখা।
ঠিক আছে ।রাখ রাখ ।'
'কিছু নিলে কি ,সেটা বল?'
'হ্যাঁ ,নিলাম তো?
বেশ কিছুটা কৌতুহলী নিয়ে
'কি কি নিলে বল তো?
'আরে একটা হ্যান্ড বাটিক সিল্ক শাড়ি।'
'কত সিল্কের শাড়ি কিনবে ?না ,এবার তোমার ওয়ারড্রব খালি করো তো ,কিছু আমাদের দাও।
'বাবা কে কাকে বলে রেখা?
' তবে হ্যাঁ ,হিংসে হচ্ছে ,যদি কালারটা সুন্দর হয় আমি কিন্তু নিয়ে নেব।'
'নে ,না কে বারণ করেছে। তোকেই মানাবে ।
'তাই বুঝি ?ঠিক আছে ।বাকি কথাগুলো আর এখন বললাম না ,পরেই বলবো।'
ফোনটা রাখতে যাচ্ছি ঠিক তখন রিম্পাদি বলে শোন শোন আমাকে একটা না কন্টাক্ট নম্বর পাঠিয়েছে জানিস?'
'আরে সেই ব্যাপারেই তো তোমার সঙ্গে কথা বলবো। '
' ঠিক আছে। স্কুলে গিয়ে কথা হবে।'
Ok
সত্যি সত্যিই ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন এবং বলেছিলেন"আপনি লেখালেখি করেন,,।
যদি রাজি থাকেন তাহলে আমাদের পত্রিকাতে আমরা ধারাবাহিকভাবে আপনার লেখা প্রকাশ করব।
কথাটা শুনে মনে মনে রেখা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। একটা কিরকম একটা অদ্ভুত অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেও বোধহয় তার লেখাগুলো ডানায় ভর দিয়ে এভাবে পাড়ি দেবে মানুষের মনের জগতে। লেখক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে ।উত্তেজনায় তার রক্তের ভিতরে একটা আলাদা স্রোত বয়ে গেছিল।কথাটা শোনার পর কল্পনায় যেন ভেসে গিয়েছিল রেখা দূর বহুদূর।
তারপর ভদ্রলোক যে কথাটা বলেছিলেন তাতে খুব আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিল রেখা এবং কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে গেছিল।
'এমনি এমনি তো আর প্রকাশ পাবে না ।এর জন্য কিছু খরচ তো করতেই হবে ।ঠিক আছে ।'
ভদ্রলোক এমনভাবে কথাগুলো বলেছিলেন তাতে রেখা বুঝতে পেরেছিল লোকটা পুরো
প্রফেশনাল ।
তারপর যখন বললেন 'কী ম্যাডাম ,আপনি কিছু বলছেন না।'
'রেখা তখন বলেছিল 'না ,আমি আপনাকে পরে জানাবো।'
তাহলে একটু তাড়াতাড়ি জানাবেন কারণ আমাদের সামনে তো পুজো সংখ্যা বের হবে। একটু আগে বললে ভাল হয়।
ঠিক আছে আপনি ভাবুন।'
বাড়িতে এসে রেখা মনোজকে কথাটা বলেছিল আর রিম্পদিকে ও ফোনে জানিয়েছে।
মনোজ বলেছিল' লেখালিখি তুমি করো। তুমি দেখো কি চাইছো? এব্যাপারে তো আমার কখনো তো তোমার ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিই নি তবে তুমি দিতেই পারো লেখাটা যদি বের হয় অনেকে পড়তে পারবে ।খারাপ কিছু নেই এতে।
তারপর রিম্পাদিকে ফোন করতে যাবে কি?
রিম্পাদিই ফোন করে রেখাকে বলে ' ভদ্রলোক তো আমাকে ফোন করেছিলেন খুবই উৎসাহী মনে হল ।প্রথমে তো আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম উৎসাহ দেখে যে বাবা এত উৎসাহ দেখাচ্ছেন নিশ্চয়ই লোকটা বেশ ভালো তো। লেখাগুলো প্রকাশ করবেন। তুই তো কোথাও দিস
না ।এতবার করে বলার পরও ।
পরক্ষনেই লেখালেখির ব্যাপারটা যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম তাহলে ' কি হবে ? জানো লোকটা প্রফেশনাল পুরো।
রেখা বলল' সেই জন্যই তো ,আমি একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গেছি। আদপেও আমার লেখা ভালো কি মন্দ ,সেটা আমি বুঝব কি করে বল তো
রিম্পা দি ?আমি যদি টাকা দিয়েই আমার লেখাটা কে প্রকাশ করাই , তাহলে সেখানে লেখার মান কি আছে ?আমি বুঝবো কী করে? ' 'কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস । ছাড় না ,আমরা তো জানি তুই ভালো লিখিস। প্রকাশ হতে চাইছে যখন করে দে না আর তুই না পারিস আমি করে দিচ্ছি।
মনামী এই জন্যেই আমাকে কিন্তু নম্বরটা দিয়েছে। মনামী ও আমাকে ফোন করেছিল। ঠিক আছে। ছাড় ,তোকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।'
একটা রফা হয়ে গেছিল তারপর দেখা গেল সত্যি কটা লেখা প্রকাশিত হল।
চারিদিকে একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে গেল কিন্তু আমার আমি তো জানি, আমার মনের ভেতরে সে খচখচানি টা রয়েই গেল ।কত জনা কতভাবে উইশ করতে লাগলো কিন্তু মন থেকে সেই দ্বিধা, সেই টানাপোড়েন কিন্তু কিছুতেই সরাতে পারলাম না ।ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা বিশ্রী রকমের অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল।'
ওই পত্রিকায় লেখাটা দেখলেই তখন কেমন বিরক্তি লাগতো। টাকা দিয়ে আমার লেখা প্রকাশ করলাম। সত্যি করে বিশ্বাস করো আমি না কিছুতেই ঘুমাতে পারতাম না রাত্রে।'
মনামীকে যখন ব্যাপারটা খুলে বললাম।
মনামী বলল' ম্যাক্সিমাম তো এরকম ই হয় ।তুই জানিস না, তাই তুই এই নিয়ে বেশি মুষরে
আছিস। মন থেকে ওটা সরিয়ে ফ্যাল তো।'
রেখাও নিজেকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করল। ঠিক আছে বোধহয় এরকমই এই জগতটা।
কিন্তু খটকা লাগতে লাগল লেখা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে। লেখা প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল পুরোটা কিন্তু পুরো লেখা প্রকাশ হচ্ছিল না।
অবাক হয়েই রেখা ভদ্রলোককে ফোন করল
"কি ব্যাপার পুরো লেখা প্রকাশ করলেন না।
" হ্যাঁ ,করব ম্যাডাম। ধীরে ধীরে। চিন্তার কোন কারণ নেই। আসলে একটু ব্যস্ত আছি।
সে কথাই বিশ্বাস করল ও নিশ্চিন্তে বেশকিছু দিন দিন কাটাতে লাগলো কিন্তু রেখার ভেতরেও একটা কাঁটা যে রয়ে গেছে ,টাকার ব্যাপারটা। টাকা নিলেন প্রফেশনাল লোকের মত।অথচ লেখা প্রকাশ হলো না ।এই ব্যাপারটা আর সঙ্গে মনের ভেতরে ছিল একটা ভীষণ রকমের যন্ত্রণা টাকা দিয়ে লেখা প্রকাশ ভাবা যায়?'
রেখা তো কিছুতেই রাজি ছিল না। সবার কথাতেই সে রাজী হল।
যদিও ভদ্রলোক এরপর রেখার বিভিন্ন
কবিতা ,গল্প চেয়েছেন ।
ম্যাডাম আরো কিছু গল্প, কবিতা, আপনি আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠান। অন্য কোন পত্রিকাতেও পাঠানোর চেষ্টা করব।
রেখা মনে মনে ভাবল সে কোন মানুষ সম্পর্কে এরকম বাজে ধারণা করাটাই উচিত না ।ভালো করে বোঝাও বুঝে ওঠার আগেই কারো সম্পর্কে রকম মন্তব্য করা উচিত নয়। নিজেই আত্মগ্লানিতে ভাবতে লাগলো।
যেরকম হামাল দিস্তা আদার টুকরো দিলে তাতে যদি ছ্যাচা হয় ,দেখা যায় প্রথম অসাবধানতাবশত আদা কুচি চলে গেলে চোখে জ্বালা যন্ত্রণা হয় কিছুক্ষণ চোখ টাকে বন্ধ করে রাখতে হয়।
রেখার ভেতর ঠিক সেরকমই জ্বালাটা ছিল।
কোন মানুষ সম্পর্কে এরকম ধারনা করাটা উচিত নয় ।যদি প্রফেশনালি হবেন তাহলে আর কোন লেখা চাইতেন অন্য কোন পত্রিকায় পাঠানোর জন্য ?
ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ এটা মোটেই ভাবাটা ঠিক হয়নি।
রেখার ভাবনার ভীত আর একটু মজবুত হয়েছে যখন দেখা গেল সত্যিই বেশ কিছু কবিতা ,গল্প অন্য পত্রিকাতেও প্রকাশ পেয়েছে।
এরপর কিন্তু রেখা ভুলে যেতে বসলো যে উনার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে রেখার লেখাগুলো প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল ,পুরোটা হয়নি। কেমন যেন একটা কৃতজ্ঞতাবোধে বাধো-বাধো
ঠেকল ।
তার কাছে আর বলতে পারল না।
এরপর ভদ্রলোক নানাভাবে হোয়াটসঅ্যাপে নানারকম মেসেজ পাঠাতে থাকলেন। প্রথমে সুপ্রভাত দিয়ে শুরু হলো তারপর একান্তে কিছু নিজের কথাগুলো, কষ্টের কথাগুলো ,শেয়ার করতে লাগলেন ।রেখাও ভাবলেন কি জানি হয়তো ভেতরে ভেতরে লোকটা এতটাই ভেঙে গেছেন। এইজন্য রেখা ও সহানুভূতির সঙ্গে সমস্ত কথাগুলো শুনতে থাকে।
কিন্তু ভুলটা ভাঙ্গে রেখার একদিন ভদ্রলোক হঠাৎই রেখাকে প্রেমপ্রস্তাব এবং কিছু অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে । রেখা ও ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে এবং রেখা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে তিনি যে ব্যাপারটা করতে চাইছেন মোটেই ওনার বয়সের সঙ্গে শোভনীয় নয় এবং যাকে ব্যাপারটা তিনি বোঝাতে চাইছেন তিনি ওই ধরনের কাজের মেয়ে নন।
তারপরেও ভদ্রলোক পাগলের মত কিন্তু নানাভাবে নানা রকম মেসেজ পাঠাতে থাকে । ভেতরে রিপু গুলোকে যেন মহুয়া ফলের রস খাইয়ে মাতাল করে দিতে চাইতো । কিন্তু কখনো ভেবে দেখতেন না আদপেও অপর পক্ষে কতটা অভ্যস্ত হবেন।
মনে মনে ভাবতো লোকটা কি কোন সাইকো পেশেন্ট। এরকম কথাও বলা যায় বা লেখা যায়?
সাহিত্যিকরা তো শব্দ গুলোকে খুব সুন্দর ভাবে পরিবেশন করেন। কিন্তু উনি ছি: ছি :ছি : টলারেট করতে পারছিলো না রেখা অথচ নিরুপায়।
রেখাও এর থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলো কিন্তু জানে না কিভাবে যে একটা অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে ।না পারছে বেরিয়ে আসতে, না পারছে এন্টারটেইন করতে। কেমন যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। বোঝা এরকমই হয় অক্টোপাসের মতো বন্ধন ছাড়াতে চাইলে ও ছাড়ানো যায় না। রেখার শাঁখের করাতের অবস্থা হয়েছিল।
যখন রেখাকে কোন কিছুতেই কাবু করতে পারলেন না।
তখন একদিন ফোন করে বললেন যে তাদের একটা কবি সাহিত্যিকদের সম্মাননা অনুষ্ঠান আছে, সেখানে আপনাকে সংবর্ধিত করা হবে একটা কার্ড আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে অবশ্যই আসবেন।'
রেখা প্রথম ভাবল মনে মনে, যা হয়েছে হয়েছে ঠিক আছে ।কার্ড আসলে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই l যাবে।
তারই মাঝে একদিন ফোন করলেন, বললেন আপনাকে বলা হয়নি । আপনাদের যে কবি স্বীকৃতির বা সম্মাননা দেয়া হবে আপনাদের মেডেল সার্টিফিকেট , এর জন্য পে করতে হবে।
কথাটা শোনার পর রেখার মাথাটা ঘুরে গেল। বন বন করে ঘুরছে ।চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
তখনো রেখা চুপ করে শুনে যাচ্ছে পাগলের প্রলাপ।
'কারণ যারাই এই সম্মাননা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, প্রত্যেকেই কিন্তু তারা এই পে করেই তাদের এই সার্টিফিকেট বা মেডেল নেবেন।
রেখা কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
তারপর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল ।ভেতরে একটা তো বারুদের ঘর তৈরি হয়েছিল অপেক্ষা ছিল শুধু একটা স্ফুলিঙ্গের। দিনের খুব বিরক্তি অগ্ন্যুৎপাতের অপেক্ষায় ছিল।এত দিনের এই অসভ্যতামি গুলো সহ্য করে গেছে রেখা। এখন কিছুতেই সেটা টলারেট করতে পারল না। বলল 'শুনুন কবিতা গল্প ,উপন্যাস, লেখাটা আমার নেশা। পেশা নয় ।যদি সার্টিফিকেট আমাকে পে করে নিতে হয় ,ওরকম সার্টিফিকেটের আমার কোন দরকার নেই ,আর ওই ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে আমি যেতে চাই না।'
ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে বললেন'সে কি সবাই এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য আগে থেকে আমাদের সঙ্গে কন্টাক্ট করেন আর আপনি এইধরনের একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করবেন? আপনি চান না আপনার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক।
রেখা মাথাটা তখন একটু ঠাণ্ডা করে বললেন 'নিশ্চয়ই চাই কিন্তু সেই চাওয়া আমি টাকা দিয়ে নিজের কীর্তির তাজমহল বানাতে চাই না।'
'শুনুন এই আজকের দুনিয়াতে নিজের কীর্তির কথা আর নিজেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হয় ।এটা জেনে রাখুন। আপনি বোধহয় জানেন না ।আপনি তো এই লাইনে নতুন সেজন্য।'
কথাটায় একেবারে রেখার মাথাটা হঠাত করে কেমন ঝটকা মেরে উঠল। এতটাই তেতে আছে রেখা তবু নিজেকে বলছে মনে মনে রেখা থাম কুল, কুল ডাউন ।
তারপর বলল 'আপনাকে তো আমি বললাম যে আমি ওই ধরনের লেখক ,কবি ,সাহিত্যিকদের দলে নেই। কবি সাহিত্যিক স্বীকৃতি বা সম্মাননা যদি নিতেই হয় নিজের কৃতিত্বেই নেব। আমার লেখা যদি সকলের ভাল লাগে । এমনিই আমার কৃতিত্ব ফুটে বের হবে ।তার জন্য আমার টাকা দিয়ে কেনার কোন মানেই হয় না।'
'শুনুন কোনদিনও আপনার লেখা প্রকাশ পাবে না।'
' আমি চাই না আমার লেখা প্রকাশ পাক। আমি বললাম তো আপনাকে এটা আমার নেশা ।আমি ভালোবেসে লিখে যাব।'
'এ ভালোবাসার কেউ মর্যাদা দেবে না আপনাকে।'
রেখার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছিলো শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিল। ফোনটা কাটার আগে একবার জোরালো কন্ঠে বলল
'আর শুনুন একটা কথা বলি আপনাকে ,যে টাকাটা পে করা হয়েছিল আপনি তো পুরো লেখাটা আমার প্রকাশ করেন নি, সেটার কি হলো বলুন তো?
' আপনি চাইলে আপনাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতে পারি।'
রেখা চুপ করেছিল।
যদিও সে টাকা আর ফেরত দেননি ভদ্রলোক।
রেখাও যেচে ফোন করতে যায়নি।
উল্টে ভদ্রলোকই অনেকবার মেসেজ পাঠিয়েছেন তার পরেও বলেছেন যে
'আপনি লেখা পাঠান এর জন্য আর কোনো আপনাকে টাকা পে করতে হবে না কিন্তু রেখার কোনো কর্ণপাত করেনি ।
রেখা কোন রেসপন্স করেনি। হ্যাঁ ,হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা রেখে দিয়েছিল। তারপর থেকে ভদ্রলোক আর কোন বাজে মেসেজ পাঠানোর সাহস
পাননি।
শুধু কোথায় কি কবি ,সাহিত্যিক, সম্মেলনে হচ্ছে সেগুলোকে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিতেন এবং উত্তর পাবার চেষ্টা করতেন। শেষে একবার বললে মেসেজ পাঠিয়ে ছিলেন 'ম্যাডামের এখনো রাগ কমেনি।'
' ওই দিন থেকেই ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে এতদিনের টানাপোড়েন চলছিল বেরিয়ে আসার জন্য , সুযোগ এসে গেছিল। রেখা বন্ধন ছিন্ন করে ,যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।'
রেখা যেন মুক্ত বিহঙ্গ নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় আর মুক্ত বায়ু মনেপ্রাণে ভরে নিতে চায়।
মনামীকে এই ঘটনাটা রেখা বলে নি। রেখা চায় নি মনামী এই ব্যাপারটা জানুক এবং ওদের ভেতরে যে সম্পর্কটা আছে ভালো সম্পর্কটা জিইয়ে থাকুক । আর খারাপ দিকটা
নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল।
শুধু রেখার মনের ভিতর তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল।
এই ভদ্রলোক এমন ছিলেন কোন সম্পাদকের নম্বর পর্যন্ত দিতেন না ,চাইলেও বলতেন আমরা বলে না দিলে প্রকাশ পাবে না। তবুও
ভুলবশত একটা লিংক পাঠিয়ে ফেলেছিলেন
তাতেই ওই পত্রিকার সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ছিল। রিম্পা দি সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল।
আজ রেখার লেখা প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।' সিঁড়ি' পত্রিকার ঠিকানা টা রিম্পা দি ওই ভদ্রলোকের দৌলতেই সেটাকে জোগাড় করে রেখেছিলেন, যার জন্য নিজের থেকে সেই 'সিঁড়ি' পত্রিকায় লেখাগুলো আবার দিতে থাকে এবং দেখা যায় যে ওই সম্পাদক তিনি উৎসাহিত করতে থাকেন এবং এখন ধারাবাহিকভাবে তার লেখাটা প্রকাশিত হচ্ছে ।এজন্য সত্যিই যতই লোকটাকে ঘৃনা করুক না কেন একটা যেন কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই গেল অন্তরে।
কিন্তু হঠাৎই ভদ্রলোকের হার্ট অ্যাটাকের খবরটা শোনার পর রেখার মনের ভেতরে একটা রেখাপাত ঘটল ।রেখা কোনদিনও মনেপ্রাণে চায় নি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটুক। মানুষ তার আপন কর্মের দ্বারাই নিজের নিজের বৃত্তে আবর্তিত হোক এটাই চেয়েছে। কথাটা শোনার পর রেখা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেছিল । মনামী যখন ফোন করে বলেছিল 'হ্যালো তুই
কোথায় ?'
'কেন বলতো ?একটু ব্যস্ত আছি।
' কবি ,সাহিত্যিক, সাংবাদিক সৌমেন রায় মারা গেছেন ।'
কে?'
'আরে ভুলে গেলি এর মধ্যে? তোর লেখালেখি প্রকাশ হয়েছে।
' ও আচ্ছা ,আচ্ছা । কিভাবে?
' আর বলিস না গতরাত্রে হার্ট অ্যাটাক।
' সত্যি ভীষণ খারাপ খবর ।
'আরে সকালে ঘটনাটা ঘটেছে কিন্তু আমি অফিসে যাবার পথে তোকে আর ফোন করে উঠতে পারিনি ।আমি তাই তোকে জানানোর দরকার ছিল বলে তাই জানালাম।
' কি ভাল ছিল জানিস এই ভদ্রলোক।'
রেখা কিছু বলতে পারলো না প্রথমদিকে ।যে ব্যক্তি বেঁচে নেই ,তাকে নিয়ে সমালোচনা করার কোন মানেই হয় না ।হ্যাঁ নিশ্চয়ই কারো না কারো কাছে নিশ্চয়ই ভালো ব্যক্তি, ভালোই হয়েই
থাকুন না নয় ,সকলের কাছে উজ্জ্বল হয়েই
থাকুন । কালো আঁধার হয়ে থাকুক রেখার অন্তরে।
রেখা শুধু বলল' উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।'
মনামী বলল' আমার ভীষন খারাপ লাগছে জানিস।'
রেখা বলল 'কেন কালকে হঠাৎ এরকম হলো? উনার কি কোন হার্ট ডিজিজ ছিল?
আরে না শুনেছি ছেলে নাকি চলে যাবেন ভীষণরকম নাকি খাবার দাবার খাওয়া হয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা যায় ।
' ও আচ্ছা ,আচ্ছা,।
ঠিক আছে রাখছি।'
রেখা ভাবল এরকমও হয়। মানুষ যে পৃথিবীতে নেই অথচ কিছু বিরক্তি, কিছু ক্ষোভ ,কিছু ঘৃণা মানুষের ভেতরে কিছু ভালোবাসা ,সেগুলো থেকেই যায় ।এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ওপর নির্ভর করে ,সেই ব্যক্তি তার কি প্রতিক্রিয়া রেখে গেছেন ।
রেখার কাছে আজ কোন কিছুরই প্রতিক্রিয়া নেই শুধু একটাই কামনা যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। কৃতজ্ঞতাবোধ রেখার ভেতরে রয়েই
গেছে।কারণ আজ উনার দৌলতেই রিম্পা দি অন্য পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন সে জন্য অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো। চোখ থেকে যেন গড়িয়ে পরল নোনা চোখের
জল ।সেই জলে কি ছিল বিরক্তি, ক্ষোভ ,ঘৃণা ,না ভালোবাসা? শুধু স্মৃতিতে রয়ে যাবে। নাকি বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে?'