উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮৮
বিদায়
মমতা রায়চৌধুরী
বাড়িতে যতই মেজ পিসিমা খোঁচা দিয়ে কথা বলুন না কেন ?শিখা কিন্তু গায়ে মাখছে না,মাখার চেষ্টা ও করছে না।'
বৌদিভাই তো বলেই দিয়েছে 'পিসিমা ক'দিনের জন্য এসেছেন কিছু বললে , কিছু মনে করিস না।'
তখন শিখা বলেছিল 'কিন্তু বৌদি ভাই..?'
তখন মাধুরী মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলেছিল' কোন কথা নয় এবং বলেছিল বৌদি ভাইয়ের কথাটা মেনে নিতে।'
তাই আজ অনেক কথা শোনানোর পরও কোনো কথা বলে নি, avoid করে গেছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিখা এসবই ভাবছিল।
তারপর বেলঘড়িয়া থেকে ট্যাক্সি ধরে দক্ষিণেশ্বরে নেমে পড়ে । কোথাও যেতে ভালো লাগছে
না ।তাই মায়ের কাছে, মাকে দর্শন করতে, তার আশীর্বাদ নিতে একাকী বেরিয়ে পড়া।মাকে পুজো দিতে গিয়ে সেখানে লম্বা লাইন দেখে ভাবে অনেকটা সময় লেগে যাবে। কিন্তু পুজো দেবে বলে ভেবেছে যখন ,দেবেই।'
বৌদিভাইকে একটা মেসেজ করল' আমার ফিরতে দেরী হবে। চিন্তা ক'রো না।'
মেসেজ করতে করতে একটা ফোন ঢুকলো
ফোনটা করেছে কল্যান ।
শিখা ফোনটা রিসিভ করল'হ্যালো',।
কল্যান বলল'কিছু জানালে না তো?'
শিখা' নিরুত্তর।'
কল্যান বলল 'আজকে আমি কলকাতায় এসেছি। দেখা করবে আমার সঙ্গে?'
শিখা বললো 'আমি তো পুজো দিতে এসেছি।'
কল্যাণ বলল 'কোথায় ? দক্ষিণেশ্বর?'
শিখা বলল' হ্যাঁ।'
কল্যান বলল 'f ফ্যামিলির সাথে এসেছো?'
শিখা বলল' না ,আমি একা।'
কল্যাণ বলল: আমি দমদমে আছি তাহলে আমি পৌঁছে যাব দক্ষিণেশ্বরে।'
শিখা মনে মনে ভাবল এটা আবার কি সংযোগ রে বাবা। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কল্যাণ বলল' কিছু বলছো না যে?'
শিখা বলল ' কি বলবো ?আপনার যদি ইচ্ছে হয় পুজো দিতে আসবেন? মায়ের কাছে সবার দরজা খোলা।'
কল্যান হেসে বলল 'হম খুব কায়দা করে উত্তর দিলে। Good
শিখা বলল' পুজোর লাইন দিতে যাব। ব্যাগ জমা রেখে দিতে হবে।'
কল্যান বলল 'একটু ওয়েট করো একসঙ্গে পুজো দেবো ।আমি দক্ষিণেশ্বর স্টেশনে পৌঁছে গেছি।
শিখা চুপ করে থাকলো
কল্যান বলল'তাহলে মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিচ্ছি।'
শিখা বলল 'আসলে পুজো দিতে দেরি হয়ে
যাবে ।বাড়ী পৌছাতে দেরি হয়ে যাবে।'
কল্যাণ বলল 'সেরকম হলে বাড়ি পৌঁছে দেবো?'
শিখা সঙ্গে সঙ্গে বললো' না না বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে না। মনে মনে ভাবল বাব্বা বাড়িতে মেজ পিসি আছে ।আরো কত কথা যে শোনাবে তার ঠিক ঠিকানা নেই । সুঁচ ফোটানো কথা বড্ড ভয় লাগে।'
কল্যানের মনে একটা টানটান উত্তেজনা, মনে লেগেছে খুশির হাওয়া। কি এক অনাবিল আকর্ষণে ছুটে চলেছে। পরনে নীল শার্ট, ক্রিম প্যান্ট। হাতে ছিল একগুচ্ছ গোলাপ ফুল।
কল্যান ভাবছে' কি করে ফুলগুলো শিখাকে দেবে? ভেবে নিয়েছে আজকে দেবেই।'
শিখা পায়চেরি করছে আর বারবার ঘড়ি দেখছে।
এরমধ্যে মধ্যেই কল্যান ঢুকে গেল ।
কল্যাণ শিখাকে ফোন করলো ।শিখার ফোন রিং হতেই শিখা ফোন রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
কল্যান বললো' কোথায় আছো?'
শিখা বলল' গেট থেকে ডানদিকে।'
কল্যান খেয়াল করল শিখা ফোনে কথা বলছে ,দেখতে পেয়ে বলল ' দেখতে পেয়েছি।'
কল্যান বলল' বাহ কি সুন্দর লাগছে নীল শাড়িতে। 'নিঙ্গারিয়া নীল শাড়িতে শ্রীমতি চলে...।'গুন গুন করে গান ধরল ।
শিখাও লক্ষ্য করলো 'বাহ খুব সুন্দর লাগছে।'
একি কাকতালীয়ভাবে দুজনের ড্রেস ই নীল।
হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।
কল্যান হাতটা চোখের সামনে নেড়ে বলল ' কি দেখছ?'
শিখার যেন হঠাৎ করেই ধ্যান ভঙ্গ হলো। হেসে বলল ' না কিছু না এমনি।'
কল্যাণ ভনিতা না করে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল দিয়ে' বলল 'এটা তোমার জন্য'।
শিখা তো হতবাক হয়ে গেছে ।কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না । শেষে শিখা দুহাত ভরে ফুলগুলো নিলো। আর জোরে জোরে গোলাপের সুগন্ধ মনে প্রানে নিয়ে নিল। তারপর বলল 'থ্যাঙ্ক ইউ।'
কল্যান বললো 'চলো তাড়াতাড়ি পুজোটা দিই।'
শিখা বললো 'হ্যাঁ চলুন।'
কল্যান বললো' এখনো কি আপনিতেই ঠেকে থাকবো।'
শিখা শুধু হাসল।
কল্যান যেন সেই হাসিতে একমুঠো ভালোবাসার স্ফুরণ দেখতে পেল।
তারপর আস্তে আস্তে দুজনেই পুজোর ডালা সাজিয়ে লাইনে দাঁড়ালো। আগের থেকে লাইনটা অনেকটাই হালকা আছে। প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেল।
অবশেষে মায়ের কাছে গিয়ে পুজো দিল। দুজনেই আশীর্বাদ নিল। তারপর পুজো দিয়ে বেরিয়ে ভেবেছিলো গঙ্গার ধারে গিয়ে বসবে,একটু গল্প করবে। সামনে কল্পতরু উৎসব ।সেজন্য এমনিতেই একটু ভিড়। দুজন আবার আনমনে হাঁটছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। হাঁটতে হাঁটতে বালি ব্রিজের উপর এসে দাঁড়ালো ।একমনে তাকিয়ে গঙ্গার দিকে। শান্ত ধীর গতিতে বয়ে চলেছে জাহ্নবী। একদিকে বেলুড় মঠ ,অন্য দিকে দক্ষিণেশ্বর। কল্যাণ শিখার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান ধরল'তোমারে লেগেছে এত যে ভাল,
চাঁদ বুঝি তা জানে...।'
শিখা কল্যাণের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
কল্যাণ শিখার দিকে তাকিয়ে যেন চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।
এরমধ্যে শিখার ফোন বেজে উঠলো। 'আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল...।'রিসিভ করে বলল হ্যালো'।
শিখার বৌদি ফোন করেছে। মাধুরী বলল কোথায়? ঠিক আছিস তো?
শিখা বলল হ্যাঁ ঠিক আছি।ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।
মাধুরী বলল 'ঠিক আছে। সাবধানে আসিস।'
শিখা বলল 'ঠিক আছে।'
শিখা ফোনটা কেটে কল্যাণের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল 'এবার যেতে হবে।'
কল্যান বলল 'চলো কোথাও গিয়ে একটু খেয়ে নিই।'
শিখা বলল 'এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।'
কল্যাণ বলল 'তাহলে চলো।'
শিখা বলল কলকাতায় কিছু কাজ ছিল?
কল্যান বললা' না তো।'
শিখা হেসে বলল 'ও।'
কল্যান বললো 'কিসে যাবে?'
শিখা বলল 'ট্যাক্সিতে।'
কল্যাণ বলল 'ঠিক আছে। এরমধ্যে একটি ট্যাক্সিকে 'এই ট্যাক্সি, ট্যাক্সি বলে হাত দেখাল।'
ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো ।গেট খুলে দিল শিখা বসল এবার কল্যান ও এসে পাশে বসলো।
শিখা বলল 'আপনি?'
কল্যাণ বলল 'আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।'
শিখা বলল 'না আমি যেতে পারবো।'
কল্যান বলল'ঠিক আছে ।আমি জানি তুমি যেতে পারবে। আমি বাড়ির ভেতরে যাবো না। সামনেটায় আমি নামিয়ে দেবো।'
শিখা প্রসন্নতার হাসি হাসলো।
এরপর দুজনেই চুপচাপ ।কেউ কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে কল্যাণ আবার গান ধরে' -
'রোদে জ্বলা দুপুরে,
সুর তুলে নুপুরে বাস থেকে তুমি যবে নাবতে।
একটা কিশোর ছেলে একা কেনো দাঁড়িয়ে?
সে কথা কি কোনোদিন ভাবতে?'
….
দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায়।
দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায় হৃদয়ের জানালায় কান্নার খাঁচা শুধু রেখেছি…
স্বপ্নের জাল বৃথা বুনেছি।'
কল্যান অত্যন্ত আবেগ তাড়িত হয়ে শিখার হাতে হাত রাখলো।
শিখা হাতটা সরিয়ে নিল না। কেমন যেন বিদ্যুত খেলে গেল সারা শরীরে।
কল্যান শুধু বলল'চলো হারিয়ে যাই দূর নীল সমুদ্রে।'