উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮৯
বিদায়
মমতা রায়চৌধুরী।
৩১.১২.২১
রাত্রি১.৩৫
আজ একটা দিন গেল বটে রেখার ,কতটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।একদিকে গত রাত্রে সাড়ে বারোটায় বাড়ি ফেরা হঠাৎই কাকিমার শরীর খারাপ কথাটা শুনেই ছুটতে হলো ।মনোজকে নিয়ে দেশের বাড়ি কাকিমার কাছে । ফলে স্কুলে যেতে পারে নি । হঠাৎ কোন বাজলো'কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো, কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো'। গাড়িতে যেতে যেতেই ভাবছিল এসমস্ত কথা। ফোনটা বের করে দেখে বড়দির ফোন।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলে' হ্যাঁ দিদি বলুন।'
বড়দি বললেন' রেখা আজকে তুমি স্কুলে আসলে না?'
রেখা বলল' আসলে দিদি একটা প্রবলেম হয়ে গেছে।'
বড়দি বললেন'তুমি না আসলে তো এদিকে প্রবলেম হয়ে যাবে।'
রেখা বলল' হ্যাঁ আমি সেটা জানি।'
বড়দি বললেন" কি হয়েছে?'
রেখা বলল'আসলে আমার কাকিমা হঠাৎ অসুস্থ। তাই সেখানে যাচ্ছি।'
বড়দি বললেন' ও তাই বুঝি?'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,দিদি।'
বড়দি বললেন'হ্যাঁ সেখানে তো যেতে হবেই। ঈশ্বর কাছে প্রার্থনা করি যেন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়।"
রেখা বলল' হ্যাঁ দিদি এটুকুই প্রার্থনা।'
বড়দি বললেন' কিন্তু স্কুলের প্রোগ্রামের ব্যাপারটা..।'
রেখা বলল' চিন্তা করবেন না দিদি প্রোগ্রামের যা-কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট সব আমি করেই
রেখেছি ।শুধু দোকান থেকে যে জিনিসগুলো আনার দরকার ,সেগুলো নিয়ে নিতে হবে। আমি টিচারদের বলে দিচ্ছি।'
বড়দি বললেন 'সে তো ঠিক আছে কিন্তু পুরো প্রোগ্রামটা সঞ্চালনার ব্যাপার রয়েছে।'
রেখা বলল 'যদি কাকিমা স্টেবল থাকেন, তাহলে আমি আজকে রাত্রে ফিরবো ।কালকে স্কুলে জয়েন করব দিদি.'।
বড়দি বললেন' আমি জানি তোমার কাজের ব্যাপারে কতটা তুমি সিরিয়াস ,।সে ব্যাপারে আমার কোন অভিযোগ নেই ।কিন্তু তা হলেও এ ব্যাপারটা তো আর তোমার হাতে নয় ।সেই জন্যই চিন্তা হচ্ছে।'
রেখা বলল' হ্যাঁ দিদি সেটাই তো?'
বড়দি বললেন 'ঠিক আছে। তুমি দেখো ফোনে যোগাযোগ করে ,কি করতে পারো ?আমাকে একটু জানিও কেমন?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ দিদি সে তো জানাবো ই। আমি ঐদিন থে প্রেসেন্ট না থাকতে পারলে আমারও প্রচন্ড খারাপ লাগবে?'
বড়দি বললেন'হ্যাঁ সে তো ঠিকই। রিম্পার ও খারাপ লাগবে। তোমাদের মধ্যে এত সুন্দর বন্ডিং ভাবতেই অবাক লাগে ।বেশিরভাগ টিচারদের মধ্যে তো শুধু দলাদলি আর মনোমালিন্য।'
অপল্লো বিদায় সম্বর্ধনা ।'বিদায় 'শব্দটা আমার কাছে প্রচন্ড যন্ত্রণা দায়ক।'
বড়দি বললেন 'সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারি।'
রেখা বলল তবু তো মেনে নিতেই হবে।
ঠাকুরের কথায়
যেতে নাহি দিব হায়
তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যেতে হয়।'
বড়দি বললেন' একদম হক কথা।'
রেখা বলল ' কি করে যে প্রোগ্রামটা আমি সঞ্চালনা করব সেটাই বুঝতে পারছি না ।তবু চেষ্টা করব?'
বড়দি বললেন'সে আস্থা আমার আছে তোমার প্রতি। তোমরাও সাবধানে যেও।'
রেখা বলল' হ্যাঁ, দিদি।'
তারপর রেখা এটাই ভাবছিল যে পরের দিন যেহেতু রিম্পাদির বিদায় সম্বর্ধনা ফলে সমস্ত কিছুর প্রোগ্রাম এরেঞ্জ এর দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিয়েছেন বড়দি। এমন কি,একটা মেমেন্টো এতদিনের স্কুলের স্মৃতি, সেখানে ভেতরের লেখাটা পর্যন্ত রেখাকে লিখে দিতে হয়েছে ।কিন্তু সেগুলো যে দোকানে ছিল, সেখান থেকে আনার দায়িত্ব ওই মুহূর্তে ঠিক করে নিতে হয়েছে ।কেননা যদি কাকিমার বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে তাহলে তো ফিরতেই পারবে না । বাড়ি পৌঁছে রেখা দেখল কাকিমা একটু স্টেবল।এদিকে মনেপ্রাণে চেয়েছিল অনুষ্ঠানে থাকতে। তাদের এতদিনের
সম্পর্ক। এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটানো। শুধু স্কুল জীবন নয় , তারা সাংসারিক জীবনের সুখ-দুঃখ-কষ্ট সময়ের প্রতিটি পল শেয়ার করেছে। ।রিম্পাদি না থাকলে রেখার স্কুলের অস্তিত্ব কি রকম হবে সেটা ভেবে যেমন সে কষ্ট পেয়েছে , তেমনি আঁতকে উঠেছে ।তার বিদায় যাত্রাটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেবার দায়িত্ব তার কাঁধে ছিল । সমস্ত প্রোগ্রাম এরেঞ্জ করা। ফোনে ফোনে অন্যান্য টিচারদের দায়িত্ব দিয়ে,বড়দিকে জানিয়ে দেওয়া। রেখার স্কুলে না আসলেও যাতে কোন অসুবিধা না হয় । ঈশ্বর তো মনের কথা শোনেন ,সত্যি করেই যদি ঈশ্বরকে ডাকা যায়। রেখার কথাও শুনেছেন ।
মনোজকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে গেছে কাকিমার কাছে। সেখানে গিয়ে যেন ভূত দেখছে । সমু মানে সোমদত্তা বসে আছে ।
গাড়ি থেকে নামতেই ভোলা কাকা এসে বলল ', তুমি এসেছ চলো চলো চলো। '
রেখা বললো 'এখন কেমন আছে কাকিমা?'
ভোলা কাকা বলল 'এই ডাক্তার দেখে গেলেন ।আগের থেকে একটু ভালো।'
রেখা হাফ ছেড়ে বলল 'বাঁচলাম টেনশনে ছিলাম। থ্যাংকস গড।'
ভোলা কাকা বলল 'ছোটবৌদি তো সারাক্ষণ শুধু তোমার নাম করেই যাচ্ছে।"
রেখা বললো 'চলো ,চলো, চলো ।আগে কাকিমাকে গিয়ে দেখি।'
রেখা আর মনোজ ভেতর ঢুকলো।
কাকিমার ঘরে যেতেই ভোলা কাকা তার আগে বলল'ছোটবৌদি ,দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।'
সমু বললো 'এখন মাকে ডেকো না তো? একটু আগে ঘুমালো।'
রেখা বললো' থাক ডাকতে হবে না।'
ভোলা কাকা বলল'ছোট বৌদি ডাকতে বলেছে।'
ভোলা কাকা আর সমুর কথা কাটাকাটিতে কাকা পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন কে এসেছে রে?'
ভোলা কাকা বলল 'দিদিমণি এসেছে?'
কাকা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন' কে ননী এসেছে।"
রেখা আর মনোজ কাকার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়।
রেখা কাকাকে প্রণাম করে বলে 'এখন কেমন আছো?'
কাকা বললেন 'তোকে দেখতে পেয়েছি এখন ঠিক আছি।'
রেখা বলল" সমু কবে এসেছে?'
কাকা বললেন 'গত রাত্রে।'
রেখা বলল 'পাবলো কোথায়?'
কাকা বললেন 'ওকে রেখে এসেছে।'
রেখা বলল 'আচ্ছা।'
রেখা আরো বলল 'দেখি কাকিমার কাছে যাই।'
কাকু বললেন 'ঠিক আছে',।
আবার কাকিমার ঘরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ঘরে তখন সমু নেই। রেখা সরাসরি কাকিমার ঘরে ঢুকে দেখল কাকিমা জেগে।
রেখা কাকিমাকে গিয়ে বলল ' কাকিমা এখন কেমন বোধ করছ?'
কাকিমা বললেন 'আগের থেকে ভালো।'
ঠিক তখনই আবার সমু ঘরে ঢুকে বলল এ'খন মাকে ডিস্টার্ব না করাই ভালো।'
রেখা বলল 'আমি তো চলে যাব কাকিমার সঙ্গে একটু দেখা না করলে হয়?'
কাকিমা বললেন'আয় আমার কাছে আয় বস।
আমি ভীষণ খুশি যে তুই এসেছিস?'
অবশেষে ইতিমধ্যে মনোজ ঘরে ঢুকে পড়ে।
সমু যেন মনোজকে চিনতে ই পারে না।
বেশ কিছুক্ষন ধরে কাকিমার কাছে থেকে বলে 'আমাদের ফিরতে হবে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন "থাকতে পারবে না।'
রেখা বললো "না কাকিমা স্কুলে কালকে যেতেই হবে।'
কাকিমা কাকে যেন খুঁজে বেড়াতে লাগল তারপর বললো "ভোলা।'
ভোলা কাকা পাশেই ছিল বলল 'এই তো বৌদি।'
কাকিমা বললেন 'জামাই মেয়ে যেন না খেয়ে যায় দেখো।'
ভোলা মাথা নেড়ে বলল 'এই নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়।"
হল এখন কোন খাওয়ার ঝামেলায় যাব না কাকিমা।
মনোজ এবার তাড়া দিয়ে বলল'তাড়াতাড়ি চলো রাত হয়ে গেলে কিন্তু কুয়াশা পাবে, গাড়ী চালাতে অসুবিধা হবে।'
রেখা বলল "ঠিক আছে কাকিমা ,তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। আমরা এখন উঠি।'
কাকিমা বললেন 'কিছু খাওয়া দাওয়া করলে না।'
রেখা বলল "ওসব অন্যদিন হবে কাকিমা।ঠিক আছে ,আসছি তাহলে।' যাও বা একটু বসতো সমুর ভাব ভঙ্গি দেখে কিছুতেই ভালো লাগছিলো না।
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেল
পরেরদিন স্কুলে রিম্পাদির ফেয়ারওয়েল।
অবশেষে রিম্পাদিকে বিদায় জানাতেই হচ্ছে।
সকাল থেকে মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ ছিল। অবশেষে যাব যাব করে আজকের দিন বেদনায় ভারাক্রান্ত করে দিয়ে রিম্পাদি চলে যাবে নতুন কর্ম জীবনে। গাড়িতে আসতে আসতেএসবই ভাবছিল
স্কুলে পৌঁছে রিম্পাদিকে খোঁজ করছিল।
বড়দি বললেন 'কাকে খুঁজছো? রিম্পাকে?
সে রাস্তায় আছে।'
রেখা বলল 'ও আচ্ছা।'
বড়দি বললেন 'তুমি এদিকে সব প্রোগ্রাম সেট করে ফেলো।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ দিদি।'
প্রোগ্রাম সেট করতে করতেই রিম্পাদি এসে হাজির হলো।
রেখার তো চোখে জল ছল ছল করছে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল।
প্রথমে স্নিগ্ধার গান দিয়ে উদ্বোধনী সংগীত।
'তোমারেই মেনেছি জীবনের ধ্রুবতারা..।'
পাদের জন্য আনা কিছু স্কুলের তরফ থেকে উপহার সামগ্রী যেটা সারা জীবন ভালোবাসার স্মৃতিসুধা হিসেবে থেকে যাবে।
এরপর বিষাদ ঘন পরিবেশে রিম্পাদিকে নিয়ে দু চার কথা বলা।
এরপর পুরানো সেই দিনের কথা দিয়ে মেয়েদের স্মৃতিচারণ।
এরপর সৌমীয়ার কবিতা আবৃত্তি।
এরপর বড়দি দু চার কথা বললেন।
তারপর রেখাকে স্মৃতিচারণ মেয়ের কথা বললে রেখা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
রিম্পাদি রেখাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায়ll ভেঙে পড়ে। রিম্পাদির ও একই অবস্থা।'
কান্না ঝরা মুহূর্ত। কাল থেকে আর রিম্পাদি স্কুলে আসবে না। রেখার পাশে জায়গাটি শুধু ফাঁকা ফাঁকা আর ফাঁকা। অন্তরাত্মা হু হু করে উঠলো। এরমধ্যে বড়দি রিম্পাদি সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন। সমাপ্তি সংগীত'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
এবার রিম্পাদি আর রেখা দুজনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এ যেন বাঁধ ভাঙ্গা বাদল ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস।
বাড়ি ফেরার পথে রিম্পাদি আজকে গাড়ি নিয়েএসেছিল ।রেখাকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিল। 'বিদায় ' ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে বিচ্ছেদ বেদনায় ভরা এক আবেগঘন মুহূর্ত। 'বিদায় 'জানানোটা কতটা কষ্টের। তবুও "বিদায়' জানাতেই হয়
রেখার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লাইনটা বারবার মনের ভেতরে অনুরণিত হতে থাকে।
"যেতে নাহি দিব হায়
তবু যেতে দিতে হয়
তবু চলে যেতে হয়।'