উপন্যাস
টানাপোড়েন ৯৫
অপ্রত্যাশিত
মমতা রায় চৌধুরী
নদীর মনের ভেতরের তারগুলি ক্রমশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা বেসুরোভাব । হৃদয়তন্ত্রীতে যেন আর কোনো সুরেলা সুর বেরোবে না। তার সঙ্গেই কেন এরকম হচ্ছে। নদীর স্বচ্ছন্দ গতিপথ কেন বারবার আটকে যাচ্ছে?তার ভেতরের সাজানো বাগান টা কেন এমনি করে তছনছ হয়ে যাচ্ছে?'
অনেক রাত অব্দি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে ।ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে চারিদিকটা। তার জীবনটা তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না।
প্রথমে তার জীবন থেকে তার সব থেকে কাছের মানুষ তার বাপি চলে গেল। বাপিকে তো আর সেখান থেকে ফেরানো যাবে না। ইচ্ছে করলো বাপি কে স্পর্শ করা যাবে না।
এরপর মা ও তার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
হঠাৎই নিচে ঝর্ণা মাসির কথার আওয়াজ পাওয়া গেল। 'বৌদি এখন কেমন বোধ করছ?'
নদী কথাগুলো না শোনার চেষ্টা করছিল। তবুও কথাগুলো কানে শোনা যাচ্ছিল ভাসা ভাসা।
রুপসা অনেক ক্লান্ত স্বরে বলল' ভাল ।'
তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে কাঁচের জলের ক্লাসটা নিতে যাচ্ছে ।
তখনই ঝর্ণা ছুটে এসে বলল' একি আমি রয়েছি তো ?তুমি কেন নিতে যাচ্ছো আবার কিছু একটা অঘটন ঘটাবে নাকি?'
রুপসা একটু মলিন হেসে বলল' তুমি আর কত করবে ঝর্ণা?'
ঝর্ণা বললো 'আমি তো কাজ করতেই এসেছি।'
রুপসা বলল 'তা হলেও তুমি না থাকলে আজকে আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম না।'
তারপর উৎসুকভাবে এদিক-ওদিক দেখতে
লাগল ।কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছে যেন।
ঝর্ণা বললো 'তুমি কি মামনিকে খোঁজ করছ?'
রুপসা বলল 'আজকের জন্মদিনটা মাটি হয়ে গেল ।জন্মদিনটা মাটি হয়ে গেল ঝরনা।'
ঝর্ণা বললো 'সব ঠিক হয়ে যাবে বৌদি?'
রুপসা বলল 'আমি জানি আমার মেয়েটা আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।'
ঝরনা একটু চুপ করে রইলো।
রুপসা জানলার দিকে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশটা যেন মনে হচ্ছে শুধু ফাঁকা, শুধুই অন্ধকার, শুধুই অস্তিত্বহীন টিকে থাকা।
ঝর্ণা বললো' বৌদি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
রুপসা বলল 'কি করে হবে ঝরনা? আমার মেয়ের একটা স্পেশাল দিন। আমি মা হয়ে তার কাছে থাকতে পারলাম না ।এর থেকে কষ্ট আর কি আছে বলতে পারো তুমি?'
ঝর্ণা বললো 'আজকে তুমি অফিস থেকে বের হতে পারলে না কেন বৌদি?'
রূপসার চোখে জল। 'তোমার দাদা মরে গিয়ে আমাকে মেরে গেছে। কেন যে আমি এই অফিসে চাকরি নিলাম?'
ঝর্ণা বললো 'কিছু খারাপ কিছু ঘটেছে?'
রুপসা তখনও শূন্য দৃষ্টিতে বিহ্বলভাবে তাকিয়ে আছে ঝর্ণার দিকে।
ঝর্না এবার বৌদির কাছে এসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল' কি করবে বলো ?আমরা তো নারী। আমরা জানি আমাদের শত প্রতিবন্ধকতা জীবনে আসে ।এই প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। সমাজ আমাদেরকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে।
রুপসা বলে' আমি এভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাবো জানো?'
ঝরনা বৌদির মুখে হাত দিয়ে বলে' খবরদার বৌদি এভাবে কথা বলবে না তুমি?'
রুপসা বলে 'ঝরনা আজকে তুমি আমার কাছে আছো বলে ,তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলে আমি শান্তি পাই।'
ঝরনা বলে' তুমিও তো আমাকে কোন পাঁক থেকে তুলে এনেছ বৌদি ।আমার নতুন জীবন দিয়েছ।'
রূপসা বলে 'কিন্তু আমার জীবন যে পাঁকে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।'
ঝরনা বলছে 'বৌদি তুমি এভাবে কেঁদো না ।আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।'
রূপসা বলছে' আমার হৃদয়খানা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ঝরনা। আমার একমাত্র মেয়ে সে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় । আমি বাঁচতে পারব না।'
ঝরনা বলছে 'না না আমাদের মামনি সে রকম মেয়েই না। ঠিক তোমাকে বুঝতে পারবে। একদিন দেখো বৌদি।'
রুপসা কেমন হাপুস নয়নে কাঁদছে ঝরনার বুকে মাথা রেখে।
' আমি আজকে যা কিছু করছি সব আমার মেয়ের জন্য করছি। আমার জীবনের কি আছে তুমি বল তো?'
ঝরনা বলছে' কেঁদো না বৌদি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্রমশ সান্তনা দিচ্ছে। আর বলছে চুপ চুপ।'
নদীর হঠাৎ করেই কথাটা কানে আসে। নদী ভাবতে থাকে তাহলে কি সে মামনিকে কী ভুল বুঝছে?'
ভাসা-ভাসা কথাগুলো কানে আসছে। একটু কৌতুহলী হয়ে উঠছে নদী।
সবকিছু যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে
যাচ্ছে ।নদীর হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে
গেল ।আর ইচ্ছে করলো না তুলে আর একবার সুখটান দিতে। আজকাল তো এই সুখটানেই বেঁচে আছে নদী।
এমন সময় সমুদ্র ফোন করে। রিং হয়ে যাচ্ছে নদীর ফোনে। নদী তাকিয়ে দেখে সমুদ্রর ফোন।
আর মনে মনে বলে'এই শালা, আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না এক দন্ড।
কারণে-অকারণে ফোন করতেই হবে।'
নদী ভাবছে সত্যিই আজকাল ও যেন কি সব শব্দ উচ্চারণ করে ফেলে ,এটা তো তার ডায়রিতে কখনো ছিল না। দ্রুত কি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে নদী। তবে কি এখনো তার ভেতরে একটু-আধটু সংস্কার বা নীতিবোধ কাজ করছে? যার জন্য এই শব্দ উচ্চারণ করার পরও কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।'
আবার পরক্ষনেই নদী ভাবছে 'একটু বেশিই রিয়াক্ট করে ফেলছে সমুদ্রের প্রতি। ওই তো আপদে-বিপদে অনেক থেকেছে। তাই বলে নদীর জীবনে কোন প্রাইভেসি থাকতে পারে না?'
দু'তিনবার রিং হয়ে কেটে গেল। আবার ফোন বাজছে।
এবার নদী বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল বলল 'কেন রে তুই ,সবসময় আমাকে এত জ্বালাস ?কি দরকার তোর?'
সমুদ্র একটু হকচকিয়ে যায় তারপর কিছুক্ষন নিরুত্তর থেকে বলে 'একটা খারাপ খবর আছে নদী?'
নদী বলল 'কোনো সুখবর থাকে না আমার জন্য।
তবুও বল শুনি?'
সমুদ্র বলল' এক্সিডেন্ট'।
নদী যেন আকাশ থেকে পড়ে ছিঃ ছিঃ ছিঃ।না জেনেবুঝে কেন সমুদ্রকে এতগুলো কথা শোনালো ।
তারপর একটু নরম সুরে বলল 'কার এক্সিডেন্ট?'
সমুদ্র বলল'আজ অরুনাভদার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?'
নদী বলল 'কি বলছিস তুই?
নদীর কাছে এটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত তাই হতভম্ব ভাবে প্রশ্ন করল
'কখন ,কিভাবে?'
সমুদ্র বলল 'মেডিকেল কলেজের সামনেই। মারাত্মক চোট পেয়েছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।'
নদী বলল 'এ বাবা, কি কথা শোনাচ্ছিস?'
সমুদ্র বলল 'আমরা প্রায় সবাই যাচ্ছি। তুই কি আসবি?'
নদী বলল' আলবত যাব।'
সমুদ্র বলল 'অরুনাভদা কতটা প্রগ্রেসিভ জানিস তো সমস্ত ব্যাপারে ?পড়াশোনা বল ,কালচারাল বল...।'
নদী বলল' ঠিক আছে। তুই আমার বাড়ির সামনে চলে আয় ।আমি তোর সঙ্গে বাইকে চলে যাব।'
সমুদ্র বলল' ওকে।'
নদী ভাবছে 'এই তো কদিন আগে অরুনাভদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো ,কত মজার কথাই জানে। মন খারাপের দিনগুলোতে অরুনাভদা যেন মুশকিল আসান।
ওয়ারড্রব থেকে জিন্সের প্যান্ট টা বের করে পরতে গিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে ভাবছিল এসব কথা।
সঙ্গে একটা কুর্তি পরে নিল আর একটা উইন চিটার পরে নিল।, ঠান্ডা আছে, বাইকে গেলে লাগবে ঠান্ডাটা।
এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নিল প্যান্টের
পকেটে । সমুদ্র আর তীর্থ যা হ্যাংলা ।ওদের কাছে চাইলেও সহজে পাওয়া যাবে না ।যদিও চটাতে চাইবে না ।দেবে। তবুও লক্ষীর ভান্ডার পূর্ণ করে নিয়ে যাওয়া ভালো।
দরজাটা লক করে ফোনটা বুকপকেটে নিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামছে, জুতোর আওয়াজ শুনে রুপসা ঝরনাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার জন্য বাইরে যেতে বলল ইশারায়।
এরমধ্যে গেটের কাছে এসে হর্ণ বাজাচ্ছে সমুদ্র।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নদী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল
ঝরনা মাসিকে দেখে।
ঝর্ণা বললো 'কোথায় যাচ্ছো মামনি?'
নদী বলল' একটু দরকার আছে মাসি ,বেরোচ্ছি।'
ঝর্ণা বললো' রাত হয়ে যাচ্ছে এখন বেরোলে?'
নদী একটু বিরক্ত হয়ে বলল 'ঝরনা মাসি কলকাতা শহরে এই সময়টা রাত নয়। বলো সন্ধ্যে। তারপর ঝর্নাকে বলল 'সরো ,সরো ,
সরো ।আমার তাড়া আছে।'
সমুদ্র তখনও হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে।
নদী বলল চেঁচিয়ে 'এই দাঁড়া নেমে গেছি।'তারপর মুখ ফিরিয়ে ঝরনা মাসিকে বলল'আমার ফিরতে দেরী হতে পারে?'