উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭৮
যন্ত্রণার আঁচড়
মমতা রায় চৌধুরী
স্কুলে ঢুকতে ই এক অভিভাবক এসে জিজ্ঞেস করলেন'আপনি কি রেখা ম্যাম?'
রেখা বলল' হ্যাঁ ।কেন বলুন তো?'
অভিভাবক বললেন 'নমস্কার,আপনি ফোন করেছিলেন?'
রেখা বলল ' আমি?
অভিভাবক বললেন ' প্রজেক্ট এর ব্যাপারে।'
রেখা বলল'হ্যাঁ ,ফোন করেছিলাম আপনার মেয়ের নাম কি?'
অভিভাবক বললেন' রিয়া মল্লিক।'
রেখা হাত বাড়িয়ে বললেন ', হ্যাঁ হ্যাঁ, দিন।'
বড়দি লক্ষ্য করে একবার মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে পড়লেন।
গার্জেনের কাছ থেকে খাতাটা নিয়ে বড়দিকে গিয়ে রেখা বলল'দেখলেন দিদি তাও একজন গার্জেন এসে দিলেন ।বাকিদের মধ্যে কেউ তো সুইচড অফ করে দিচ্ছেন, আবার কেউ ফোন ই তুলছেন না।'
বড়দি বললেন 'খুবই সমস্যার কথা।'
রেখা বলল' তাহলে কি করবো এখন?'
বড়দি বললেন'আর দুটো দিন দেখো, যদি না দেয়, তখন নয় বিষ্ণুকে পাঠাবো'।
রেখা বলল ' ঠিক আছে বড়দি, যেমন বলছেন তেমনই হবে। আসছি তাহলে বড়দি।'
বড়দি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
রেখা চলে আসছে ঠিক তখনই পেছন থেকে বড়দি ডাকলেন। 'রেখা শোন।'
রেখা গিয়ে বলল'কিছু বলবেন বড়দি?'
বড়দি বললেন'সামনের সপ্তাহে রিম্পার ফেয়ারওয়েল দেয়া হবে। তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখছি, কারণ তুমি তো মাঝে মাঝেই ছুটি নিচ্ছো এজন্য।'
বড়দির কথাটা শুনে রেখার বুকের ভেতরে যেন একটা কেমন যন্ত্রনার আঁচড় কেটে গেল। রেখার চোখে মুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট ধরা পরলে ,বড়দি বললেন 'দেখ রেখা ,পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদ প্রচেষ্টায় বহু শিক্ষক-শিক্ষিকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাড়ির কাছে যাবার স্বপ্ন 'উৎশ্রী'সোনায় সোহাগা করে দিয়েছে। সেজন্য মন খারাপ না করে এটাকে মেনে নাও।'
রেখা বলল' হ্যাঁ দিদি, সে তো মানতেই হবে।'
এরইমধ্যে রিম্পাদির গলা শোনা গেল 'রেখা কোথায় গেল বলতে বলতেই বড়দির ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে ঢুকে বলল 'তুই এখানে ।আমি কত জায়গায় তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি ।একবার ক্লাসের দিকে গেলাম ভাবলাম বোধহয় টুয়েলভের ক্লাসে আছিস ,গিয়ে দেখলাম নেই।'
রিম্পাদি রেখার কাছে এসে হাত দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল' কিরে কথা বলছিস না?'
রেখার চোখের জল দেখে রিম্পা একটু অবাক হয়ে গেল। রিম্পা বলল 'কি হয়েছে?'
বড়দি হেসে বললেন 'রিম্পা তোমার সামনের সপ্তাহে ফেয়ারওয়েল টা আছে ওকে জানালাম তার থেকে মুখটা কেমন ভার হয়ে আছে দেখো।'
রিম্পা বলল' আমি জেনেও ওকে সাহস করে বলতে পারছিলাম না ।বড়দি ,যাইহোক আপনি বলে দিয়েছেন, ভালোই হলো। না হলে হঠাৎ করে আগের দিন জানতে পারলে আরো বেশি কষ্ট পেত।'
রেখা বলল 'না ,না কষ্ট পাবার কি আছে ?ধরে তো আর কাউকে রাখা যাবে না।'
রিম্পা বললেন 'দেখলেন বড়দি?'
বড়দি বললেন 'অভিমানবশত কথাগুলো বলছে। ওর ভেতরটা তো যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে।'
রিম্পা পরিস্থিতি হালকা করার জন্য রেখার গাল দুটো ধরে বলল' 'বড়দি, দেখুন ফর্সা গাল দুটো কেমন অভিমান এ লাল হয়ে গেছে।'
বড়দি বললেন'হ্যাঁ তাই তো?'
রেখা বলল ' বড়দি আসছি।''
রিম্পা বলল 'বড়দি আসছি।'
বড়দি বললেন "হ্যাঁ এসো।'
আরো বললেন আচ্ছা আজকে টিচার্স নন টিচিং স্টাফ সকলের সঙ্গে দুটো থেকে একটা মিটিং আছে ।ওটা পঞ্চমী নোটিশ টা সার্ভ করল কিনা দেখ তো?'
রিম্পা বলল 'ঠিক আছে বড়দি।'
রিম্পা আর রেখা যখন স্টাফ রুমে ঢুকলো অনিন্দিতার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
কে কি শাড়ি পরবে? কে কি অর্নামেন্টস পড়বে বেশ জমিয়ে আলোচনা চলছে। টিফিন আওয়ার্স ক্লাসের চাপ নেই।
অনুরাধা বলল 'হ্যাঁ রে রেখা। তুই কি শাড়ি পরবি?'
রেখা কোন উত্তর দিল না।
অনুরাধা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিশেষ ভঙ্গি করলো।
শিবানী বলল'রিম্পাদি যাচ্ছ তো?'
রিম্পা বলল'( যাবার ইচ্ছে তো আছ?'
অনুরাধা বলল 'রে'খার কিছু হয়েছে রিম্পা? '
রিম্পা বলল'⁹ না তো?'<
শিবানী বলল "ওর মুখটা ভারী, তাই বলছিলাম।
রিম্পা শিবানীর কথায় কান না দিয়ে বলল' সবাই শোনো একটু মিটিং আছে । বড়দি আমাকে বলতে বললেন ,তাই বললাম।'
এরইমধ্যে ঘন্টা পড়ল।
এরমধ্যে বড়দি ঝড়ের গতিতে স্টাফ রুমে ঢুকে বললেন 'আজকে মিটিং ডাকা হয়েছে মূলত পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য।
আগামী সপ্তাহে স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।
আপনারা সবাই চেষ্টা করবেন এই সময় গুলোতে ছুটি না নেবার । পরীক্ষার দিনগুলোতে কোন সি এল গ্রান্ট হবে না।'
শিবানী বলল 'কিন্তু দিদি, কারুর তো কোনো আর্জেন্ট প্রয়োজন হতে পারে?'
অনুরাধা বলল' হ্যাঁ দিদি ঠিকই তো।'
বড়দি সে কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে বললেন' নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করবেন না আর নম্বরগুলো এবং খাতাগুলো খুব যত্ন করে রেখে দেবেন সংসদ চেয়ে পাঠালে পাঠানো হতে পারে।'
অনুরাধা বলল 'দিদি পরীক্ষাসংক্রান্ত বাইরে একটা কথা বলতে চাই?'
বড়দি বললেন 'হ্যাঁ বলুন।'
অনুরাধা বলল 'অনিন্দিতা জানতে চাইছে কতজন মোটামুটি ওর বিয়েতে অ্যাটেন্ড করছে। '
বড়দি বললেন 'সেটা আলোচনা করে তোমরা ঠিক করো।'ঠিক আছে মিটিং এখানেই শেষ হলো।'
শিবানী বলল "রেখা কিছু বল বিয়েতে যাবার ব্যাপারে?"
অনুরাধা বলল'সব ব্যাপারে ওর উৎসাহ বেশি থাকে। মনমরা হয়ে থাকলে ভালো লাগে না।স্কুল থেকে গাড়ি করা হচ্ছে ।কে কে যাবে আমাকে জানিও।'
শিবানী বলল' হ্যাঁ কজন যাচ্ছে সেই বুঝে সেরকম গাড়ি করতে হবে।'
রিম্পা বলল 'আমি আর রেখা যাচ্ছি।"
শিবানী বললো 'তাহলে আমরা মোট 10 জন হচ্ছি'। 'অনুরাধা বললো তাহলে দুটো গাড়ি করতে হবে।
ইতিমধ্যে টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ে গেছে পাঁচ মিনিট হয়ে গেল।
বড়দি এসে বললেন" আপনাদের আলোচনা এখনো হচ্ছে? দেখুন দেখুন কার কি ক্লাস আছে?'
আলোচনায় যেন একটা ছন্দ পতন ঘটল। প্রত্যেকে তড়িঘড়ি করে ক্লাসে যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেল।'
রেখার কানে আজকে এই সমস্ত কথা কোনো রেখাপাত করল না।ক্লাস ছিল না বলে স্টাফ রুমে ই ছিল রেখা।তখন ফোন বেজে উঠলো। রিংটোন বাজতে শুরু করলো-
'সবাই তো সুখী হতে চায়..?
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল' হ্যালো'।
মনোজ বলল' কখন ফিরছো?'
রেখা বলল 'স্কুল ছুটি হলে?'
মনোজ বলল আজকে বড়দিকে বলে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারলে না পার্থদের বাড়ি কাজ ছিল।'
রেখা বলল' বলার স্কোপ পাই নি।'
মনোজ বললো' তোমার কি কিছু হয়েছে?'
রেখা বলে কই না তো?
মনোজ বলল' মনে হচ্ছে যেন ভেতরে কত কষ্ট, কিছু লুকিয়ে যাচ্ছ?'
রেখা বলল' না সেরকম কিছু নয়।'
মনোজ বলল' আজকে একবারও ফোনও করলে না?'
রেখা বললো' সময় পাই নি।'
মনোজ বলল 'ঠিক আছে ফোন রাখছি।'
ফোনটা কেটে দিয়ে শুধু ভাবতে লাগলো যাকে ভালোবাসা যায় তাকে চিরদিন আটকে রাখা যায় না ।ভালোবাসা তো ক্ষনিকের সুখ দিয়ে চিরস্থায়ী করে যায় ।শীতে শিশির স্নাত দূর্বা ঘাসে সূর্যের কিরণে উজ্জ্বল আলোর সৃষ্টি করে তাও তো ক্ষণস্থায়ী অথচ তা মনমুগ্ধকর ।সেই সুখস্মৃতি নিয়েই পরের দিনের অপেক্ষা। রিম্পাদি রেখার জীবনে সেই সুখস্মৃতি ।কল্পনার সমুদ্রে সুখটাকে নেড়েচেড়ে আগামী দিনগুলোতে পথ চলা। গোধূলি বেলায় সেই ম্লান সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেখা শুধু বলে ওঠে এই তো জীবন।এই তো জীবন।এই তো জীবন।