শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৪১)
শামীমা আহমেদ
মায়ের ডাকে নিজের ঘর থেকে শায়লা বেরিয়ে এলো। ডাইনিংএ এসে মায়ের সাথে নাস্তা সারলো। সব কিছু মা'ই এগিয়ে দিলো। শায়লা কেমন যেন একটা জড়তা নিয়ে অতিথির মত বসে রইল।মা যা এগিয়ে দিচ্ছে শুধু সেটাই নিচ্ছে। শায়লা শুধু নিজের গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। এক গভীর ভাবনায় সে ডুবে আছে।অন্য সময় নিজেই সকালে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে মাকে ডাকতো।একসাথে নাস্তা করতো।মায়ের সবকিছুর খোঁজ নিতো কিন্তু আজ অন্য রকমের পরিবর্তন তার মাঝে। মা শুধু বিস্মিত হচ্ছিল! শায়লা যে কল্পনায় শিহাবের ভাবনায় ডুবে আছে মায়ের কাছে তো তা অজানা।আজ সকালের শিহাবের মেসেজটি দেখার পর আরো যেন সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে সে। অবশ্য শায়লার মনের এই পরিবর্তন এ বাড়িতে একমাত্র রাহাতই বুঝতে পারে। শায়লা নাস্তা সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে এলো।মা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। শায়লার সেদিকে একেবারেই খেয়াল নেই।মা এগিয়ে এসে দরজা খুললেন।কাজের বুয়া বাসায় ঢুকলো। শায়লা তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো।অন্য সময় এই কাজের বুয়ার সাথে আজ রান্নায় কী আয়োজন , আর সেজন্য কী কী করণীয় তার নির্দেশনা দিয়ে রান্নার খুন্তিটা নিজের হাতে নিয়ে নিতো। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আর রান্নাঘরে যাওয়া হয়নি।আর শায়লার এ ব্যাপারে কোন আগ্রহও যেন নেই।সারাক্ষণ অচেনা একটি মানুষের জন্য কোন সুদূরের ভাবনায় একেবারে নির্লিপ্ত হয়ে থাকা।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শায়লা নিজের ঘরে এলো ।ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। বিছানায় বসতেই মেসেঞ্জারে শিহাবের কল। শায়লা বেশ কিছুক্ষন মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে শিহাবকে দেখে নিলো কেমন যেন একটা অনুভুতি হতে লাগলো। চায়ের চুমুক দেয়া ভুলে গেলো।চোখ মোবাইলে আটকে গেলো। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ধরতে শায়লার হাত কাঁপছিল।
সাইড টেবিলে চায়ের কাপ রেখে শায়লা কল রিসিভ করলো।এমনিতেই সকালের কলটা ধরা হয়নি। কল ধরতে দেরী হলে শিহাব ভীষণ অস্থির হয়ে উঠে। শায়লা তাই দ্রুতই কলটা রিসিভ করলো। আজ প্রায় দশদিন পর শিহাবের কন্ঠস্বর শুনছে। শায়লা একদম অনুভুতিহীন নিঃসাড় হয়ে গেলো।
ওপ্রান্তে শিহাব বলেই চলেছে, শায়লা তুমি কেমন আছো,শায়লা তুমি কেমন আছো?
অস্ফুট স্বরে শায়লা ছোট্ট করে উত্তর দিলো
ভালো।সে নিজেই তা শুনেছে কিনা সন্দেহ।
হ্যাঁ শায়লা আমি চাই তুমি দ্রুতই ভালো হয়ে উঠো, তোমাকে নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলাম।কেন তুমি আমার কথা ভুল বুঝে এতটা অসুস্থ হয়ে গেলে?
শিহাবের কথায় শায়লার সেদিনের রেস্টুরেন্টের সব স্মৃতি ভেসে এলো।রিকশায় করে সেই যে তার একা একা বাসায় ফিরে আসা।পথটা সেদিন খুব দীর্ঘ লাগছিল।আশেপাশের মানুষগুলোকে অদৃশ্য লাগছিল।শায়লা ভেবে নিয়েছিল তার জীবনটা আজ এখানেই যেন শেষ হয়ে যায়। জীবনটাকে আর টেনে নেয়ার ইচ্ছে তার নেই। শিহাবকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক একজন মানুষ।
ওপ্রান্তে শিহাব অপেক্ষায়। শায়লার বুকের ভেতর অনেক জমাটবাধা উত্তর। কিন্তু অভিমানে অনুযোগে তা আর বেরিয়ে আসতে চাইছে না। শায়লার চোখ জলে ভরে উঠলো।
শিহাব ঠিকই বুঝতে পেরেছে শায়লার এই নীরবতার মানে।
শিহাব বলেই চলেছে, শায়লা রাহাতের সাথে আমার কথা হয়েছে।তুমি কি সবকিছু জেনেছো? রাহাত কী সবকিছু তোমাকে জানিয়েছে।শায়লা একেবারেই নিরুত্তর।
শায়লার মনে অবস্থা শিহাব বুঝতে পারলো।
সেদিনের কথাগুলোর জন্য সে নিজেও বেশ অনুতপ্ত।কিন্তু সেদিনের সেই কথাগুলো না হলে আজ এত কাছে আসার, মনস্থির করা যেতো না।সবকিছুতে সৃষ্টিকর্তার একটা কার্যকারণ থাকে,আর তা অবধারিতভাবে ঘটবেই। শিহাব এই কথাটি ভীষণভাবে বিশ্বাস করে।শায়লার এমন পিনপতন নীরবতায় শিহাব বুঝে নিলো শায়লার ভেতরের ক্ষতটা এখনো শুকায়নি। শিহাব ভেবে নিলো ঠিক আছে ও আরেকটু সময় নিক। শিহাব বলে চললো, শায়লা আমি অফিসে যাচ্ছি। যাবার আগে তোমার কন্ঠস্বরটা শোনার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। ঠিক আছে। তোমার মন ভালো হলে আমাকে কল করো।আজ সকালের মেসেজট দেখেছো কি? শিহাব তাই ইচ্ছে করেই মেসেঞ্জারে কল দিয়েছে।
এবার শায়লা শুধু বললো,দেখেছি।
আচ্ছা তাহলে পরে কথা হবে।অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।শায়লা আমরা দুজনে একদিন ঐ অনেকদূরে আমার সেই প্রিয় জায়গাটিতে বেড়াতে যাবো।
শায়লার 'আচ্ছা' শব্দটি খুব নিচুস্বরে শোনা গেলো।
শিহাব বাই বলে কলটা এন্ড করে দিলো। অভিমানী মন নিয়ে নীরব থাকলেও এখন যেন শিহাবের শূন্যতাটা ধক করে এসে বুকে লাগলো। শায়লা শিহাবের ছবিটি দেখছিল মন দিয়ে।সানগ্লাস দিয়ে চোখটা ঢেকে আছে কিন্তু শায়লার শিহাবের চোখ দুটো দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।এরপর শিহাবকে বলবে সানগ্লাস ছাড়া একটা ছবি পাঠাতে।দেখা যাক আর এভাবে কথা বলা হয় কিনা যে এতটা আবদার করবে। বিষয়টি হয়তো শিহাব সহজভাবে নিবে নয়তো একেবারেই
এড়িয়ে যাবে।শায়লা নিজের মনের সাথে নিজেই কথা বলে চলেছে।
রাহাত অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে বের হয়ে অফিসের গাড়ির সাহায্য নিয়ে গুলশান আড়ং এ চলে এলো।শায়লা আর মায়ের জন্য দুটো শাড়ি কিনবার উদ্দেশ্যে। নায়লার জন্য আগেই কেনা হয়েছিল।সেগুলো নিয়ে তো আর যাওয়াই হলোনা। একদিন যেতে হবে মাকে নিয়ে। শিহাব চট করে দুটো শাড়ি চয়েস করে নিলো। শায়লার জন্য খুব সুন্দর একটা সাগর নীলের সিল্ক শাড়ি আর মায়ের জন্য নরম কটন শাড়ি।মা এতেই বেশ আরামবোধ করে।
শিহাব অফিসে পৌঁছে লাঞ্চ বিরতিতে শায়লার খোঁজ খবর নিলো।সে শাওয়ার নিয়েছে কিনা,খেয়েছে কিনা,এখন কি করছে? শায়লা এবেলায় যেন একটু ফ্রি হয়েছে। একে একে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলো।শিহাবেরও মন সারাদিন শায়লাকেই ভেবে চলে আর এই ভেবে অবাক
হয়ে যায় সে কতভাবেই না শায়লাকে সতর্ক করেছিল যেন দুজনের মধ্যে কোন ভালবাসার সম্পর্ক না দাঁড়ায়।কিন্তু সব শর্তই আজ আর মনের দাবীর কাছে হার মানলো।শিহাব আবার সেই কথাটিই ভেবে নিলো, সব কিছুই বিধাতার ছকে ফেলা এক অকাট্য নিয়তি। হয়তো তার বাকি জীবনটা শায়লার
সাথেই বাঁধা।নাহ! শায়লাকে নিয়ে আর কোন ছেলেখেলা হয়।কারো মন নিয়ে এভাবে অন্যায় আচরণ মোটেও গ্রহণ যোগ্য নয়।শুধু একটি আবদারই শায়লার কাছে থাকবে, সে যেন মায়ের আদর বঞ্চিত তার শিশু সন্তান আরাফকে মায়ের ভালবাসা দিয়ে বড় করে তোলে। এ ব্যাপারটা আগেই শায়লাকে জানিয়ে তার সম্মতি নিয়ে রাখতে হবে।
শায়লার কাছ থেকে ফোনে বিদায় নিয়ে শিহাব কাজে মন দিল।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much