অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন ।
টানাপোড়েন (পর্ব ১০)
দুশ্চিন্তা
রেখা ভেবেই রেখেছিল আজ অলস ছুটির দুপুর, মনোজ ব্যারাকপুরে ছোট পিসি শাশুড়ির বাড়ি যাবে।সারা দুপর শুধু ঘুম আর ঘুম। সকাল সকাল কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। পুটু রবিবার আসবে না ।সারা নির্জন দুপুরে রেখার শুধু ঘুম আর ঘুম।একটা ম্যাগাজিন ওল্টাতে ওল্টাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কাকিমা কাকিমা বলে চিৎকার,ঘুম জড়ানো চোখে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, রেখাকেই তো ডাকছে। বৃষ্টি পড়ছে ছাদে জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখে পাশের বাড়ির চৈতালি। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই বলল 'কখন থেকে ডাকছি কাকিমা।'
আরে তুই কবে এসেছিস?
জানতেই পারি নি তুই এসেছিস।
চৈতালি বলল 'পাঁচ ছয় দিন হবে। আসলে তুমি স্কুল নিয়ে এত ব্যস্ত। বেরিয়ে যাও সেই সকাল সকাল। এ দিকে ঢোকো অনেক দেরীতে। ভেবেছিলাম আজ দুপুর বেলায় আসব। তারপর তোমার কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। ভাবলাম ছুটির দিন হয়তো তোমার কাজ আছে ।পরে সন্ধ্যের দিকে আসবো।
রেখা বলল 'দাঁড়া চৈতি ।-বলেইছুটে গিয়ে জামাকাপড় নামিয়ে নিয়ে আসল। কিন্তু একটু ভিজে গেল। চৈতালি তখনো দেখে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
রেখা জিজ্ঞেস করল 'তুই কি একবারে চলে আসলি। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি মা সাধ খাইয়ে দিয়েছে?
চৈতালি চুপ করে আছে ।তোর ক মাস হল। ১0 এ পা দিলি না? আসলে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ।ওকে বোঝাই যাচ্ছিল না। শেষে কাঁদতে শুরু করল।
কান্নার আওয়াজে ওর মা ছুটে আসলো। ওর মা বলল 'আর ব'ল না দিদি বাচ্চাটা তো নষ্ট হয়ে গেছে।'
রেখা অবাক ব্যাগ্রভাবে বলল "কি করে?
চৈতির মা বলল "আমাদের পোড়া কপাল। মাসে মাসে যে ডাক্তার দেখানোর কথা ,ইনজেকশন নেওয়ার কথা সেগুলো শ্বশুরবাড়িতে কোন ব্যবস্থাই করে নি।'
রেখা অবাক হয়ে বলল,'সে কি? ওর শাশুড়ি মা তো ভালো। তাহলে এরকম কাজ করলেন কেন?
চৈতির মা বলল 'আমরাও তো ভালোই জানতাম । এখন দেখুন তার মুখোশটা বেরিয়ে এসেছে। ওরা চায় না ওর সন্তান হোক।'
রেখা বলল 'এ আবার কি কথা?'
চৈতির মা বলল ' কি আর বলব দুঃখের কথা দিদি। ওর ননদের বাচ্চা আছে ,তাই বলছে আর বাচ্চা নিয়ে কি হবে?বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে ,ওর শাশুড়িমার কোনো হেলদোল নেই। বরং ওকে বলেছে তুমি বাবার বাড়িতে যেতে চাইলে চলে যাও ।এরপরে আর যেতে পারবে না। যেতে হলে আজই যেতে হবে। তখনো ওর ঐ রকম ব্লিডিং হচ্ছে ।মনের অবস্থাটা ভাবো দিদি।মেয়ে ফোন করাতে আমরা গিয়ে নিয়ে আসলাম।'
রেখা চিন্তিতভাবে বলল ' আর ওর বর। সেও চায় না?'
চৈতির মা বলল 'একটা ছেলে ,মায়ের কথায় ওঠে বসে...বলেই চুপ করে গেল।'
রেখা বলল 'তাই বলে নিজের সন্তানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ?
চৈতির মা বলল "মেয়েকে তখনই বলেছিলাম নিয়ে আসি। ও রাজি হয়নি। ভেবেছিলো বাবা-মায়ের সংসারে টানাটানি। নুন আনতে পান্তা ফুরায়।আবার গিয়ে খরচ বাড়াবো? এই ভাবনাটা ওর কাল হলো।'
চৈতি তো কেঁদেই চলেছে।
রেখা মনের কষ্টটা অনুভব করে বলল ' কাঁদিস না ?গাছ থাকলে ফল ধরবে। তুই আগে সুস্থ হ।
চৈতির মা বলল 'আমরা শোনামাত্রই দিদি নিয়ে চলে এসেছি। ভালো করে ডাক্তার দেখিয়ে ,তারপরে ছাড়বো।
এতক্ষণ পর চৈতালি বলল 'মা বাবা ।মা বাবাই হয় ,কাকিমা।
রেখা বলল তুই তো বলেছিলি তোর শাশুড়ি মা খুব ভালো।
চৈতির মা বলল 'বিয়ের পর কটা মাস ভালই ছিল। কিন্তু এখন পুরো অন্য রকম। ওকে এই অবস্থাতেও সব কাজ করিয়েছে ।ছেলের সামনে কিন্তু করায় নি ।ছেলে অফিসে চলে গেলেই সব কাজ ওকে দিয়ে করানো হতো। অথচ ডাক্তার ওকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছিলেন।একথাগুলো মেয়ে আমাদেরকে জানায় নি। জানলে তো তখনই নিয়ে আসতাম। এত বড় ক্ষতি তো আর হতে পারত না।'বলেই কাঁদতে লাগল।
রেখা বলল 'যা হবার তো হয়েই গেছে। এবার থেকে সাবধানে। ডাক্তারের কথামত চলবি।'
চৈতির মা বলল 'আমিও বলেছি ডাক্তার ক'মাস পর বাচ্চা নেওয়ার কথা বলেছেন। তখন বাচ্চা পেটে আসলে আমাদেরকে জানাতে, আমরা তোকে গিয়ে নিয়ে আসবো। আমাদের সাংসারিক অনটনের কথা তোকে ভাবতে হবে না।'
রেখা বলল 'একদমই ঠিক কথা দিদি। এই চৈতি মন খারাপ করিস না আসিস হ্যাঁ বাড়িতে।'
চৈতির মা বলল 'সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে। ওই দেখো বকবক করেই যাচ্ছি।এদিকে তোমার সব জামাকাপড় ভিজে গেছে না গো। অনেকক্ষণ থেকেই ডাকছি আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো।
রেখা বলল 'হ্যাঁ কি করে যে এত ঘুমিয়ে পড়লাম।'
চৈতির মা বলল 'পুটু কাজে আসে নি তো আজকে?'
রেখা বলল 'সে তো আজ কদিন থেকেই আসছে না।'
চৈতির মা বলল ্'আজকে দেখলাম অটো করে যেতে'
একটু অন্যমনস্ক ভাবে যাচ্ছিল ।চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ ছিল। আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না ।তখন আমি চৈতিকে নিয়ে আসছি ডাক্তারের কাছ থেকে।'
এ বাবা তাহলে কি হবে ?রেখা বলল ।ও কি কালকেও কাজে আসবে না? কালকে তো আমাকে স্কুলে যেতেই হবে ।আমার স্কুলের এক দিদিমনির ফেয়ারওয়েল আছে। না গেলে কি হবে বলো তো দিদি ।এতদিনের কলিগ ওরা আমার বাড়ির সমস্যার কথা বুঝবে না। ভারী চিন্তায় পড়ে গেলাম।
'ক'দিন হলো আসছে না 'চৈতির মা বলল।
রেখা বলল 'এই তো আজ ৫ দিন হল।কি জানি ভাইরাল ফিভার হলো কিনা? যাইহোক একটা তো খবর পাঠাবে দিদি। জানে তো আমাকে বেরোতে হয়।
চৈতির মা বলল ' কাজের লোকগুলোই এ রকম জানো তো।'
রেখা বলল 'আমরা ওদের ছাড়া চলতে পারব না। সে দুর্বল জায়গাটুকু ওরা বুঝে গেছে। কিন্তু ও যদি খবর না পাঠায় আমাকে তো অন্য লোক দেখতেই হবে।'
চৈতির মা বলল 'হ্যাঁ তা তো ঠিকই। এখন ওদের আবার ইউনিয়ন হয়েছে। ওদের এত বাড়বাড়ন্ত।একটা ফোন করে দেখতে পারো।
রেখার চোখে মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ, কাহা তক সম্ভব। রাত ৮ টায় বাড়ি ফিরে...? বাবা ,এদিকে বৃষ্টির ধোঁয়া ছুটছে। ক দিনের নিম্নচাপ..?
কাকিমা কাকু কোথায়? চৈতি বলল।
হ্যাঁ ,তাই তো একটা খবর তো নেওয়া হয় নি ।কি মরণ ঘুম আমার এসেছিল। আর বলিস না ছোট পিসি শাশুড়ির বাড়িতে গেছে। ওখানে কি হয়েছে কে জানে? দেখি একটা ফোন করি। তুই কোন দুশ্চিন্তা করবি না চৈতি। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। '
চৈতি বলে 'সেই আশাতেই তো আছি কাকিমা।
রেখা আশ্বাস দিয়ে বলে 'ঠিক আছে রে ।ঐদিকের জানলাগুলো দিই নি। জানলাগুলো লাগিয়ে দিই বুঝেছিস? পরে সময় করে আমার ছুটির দিন দেখে আসবি -বলেই হাতের জামা কাপড়গুলো নিয়ে টেবিলে রাখল ।আর হন্তদন্ত হয়ে জানলা লাগাতে লাগলো। ওদিকে ঝড়ো হাওয়ায় দরাম দরাম করে জানলাগুলো আওয়াজ হচ্ছে। পাশের বাড়ি ছেলেটার রোমান্টিক গান লাগিয়েছে দেখো ।'এই মেঘলা দিনে একলা ।ঘরে থাকে না তো মন'। বাপরে বাপ ঘরে থাকার কি দরকার, বেরিয়ে গেলেই হয়। নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে। যাক গে বাবা ,যে পড়েছে পড়ুক ।আমি বরং
মনোজকে একটা ফোন করি। রিং করলো কিন্তু ফোনের লাইনের কি অবস্থা?পুক পুক্ করে আওয়াজ নেটের এত সমস্যা..? ধুত্তেরি ফোন ছেড়ে দিয়ে সন্ধ্যাবাতি দেবার জোগাড় করতে লাগলো। যা বৃষ্টির হাল ট্রেন বন্ধ না হয়ে যায়। দুশ্চিন্তায় পড়ল রেখা।
এবার কি করবে রেখা? টিভিটা খুল্লো অন্যমনস্ক ভাবে। খবরে দেখাচ্ছ আপাতত ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে ।স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে ট্রেন আবার চালু হবে। যা বৃষ্টির অবস্থা, মনে হচ্ছে সমুদ্র এসে গ্রাস করবে। এখন রেখা কী করবে ,ভেবে ভেবে গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১০ ক্রমশ