বিষাদ
(উৎসর্গ—আজাদ সেখ কে)
মামুদ পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। “পরনে ছিল নোংরা ও ছেঁড়া জামা -প্যান্ট, চুলগুলো বড়ো বড়ো উসকোখুসকো, দাড়ি ও গোঁফ গুলো বড়ো হয়ে কিছুটা মুখে ঢুকে পড়ে।“ কখনো কখনো মদের বোতলে জল খায়,পরে থাকা সিগারেট গুলো নিয়ে খেলা করে। মামুদের মা মামুদকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাস্তার পাশে মোড়ের দিকে বসে আনমনে খেলা করছে। এমনকি মনে মনে গান করে-
“ পিয়া তোমাকে এখনও ভালোবাসি ,
তুমি আসবে ফিরে আমার এই বুকে।
ভালোবাসি শুধু তোমাকেই। “
মামুদ বাবা তুই এখানে আছিস চল বাড়ি চল।
হঠাৎ পিয়ার সাথে মামুদের দেখা হয়,মামুদের কাছাকাছি গিয়ে পুরোনো প্রেমিককে চিনতে পেরে তার চোখ দিয়ে অশ্রু সজল নয়নে ঝরতে থাকে।
আপনি মামুদের কে, এই অসহায় পাগল ছেলেটার “মা”।
(৩ বছর আগের ঘটনা)
কীভাবে এই অবস্থা হল, “ওই জঙ্গিপুর কলেজে বেটাকে কত স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি করলাম ফিজিক্সে অনার্স কোর্সে। তাঁর সাথে পিয়া নামে একটি মেয়েকে সে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু সেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় সরকারি চাকুরী করে এক ছেলের সাথে।“
তারপর থেকে সে মানসিক চাপের, নেশা করতে করতে মদ, গাঁজা, বিড়ি, সিগারেট খেতে শুরু করে আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যায়।
পিয়া কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে চড়ে ঘরে চলে যায়। নিজের প্রতি অনুশোচনা করতে থাকে।
মামুদ ক্লাস একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় বিড়লা হাইস্কুলে। সে মেধাবী ছাত্র, এমনকি স্কুলে ক্লাসের টপার। পিতা-রশিদ সেখ ,মাতা- ফিরদৌসী বিবি। তাদের একমাত্র সন্তান ছিলো মামুদ। তারা গ্ৰাম থেকে শহরে এসেছে। রশিদ সেখ একজন চাকুরীজীবি। সে কোম্পানিতে চাকরি করেন।
ক্লাস করতে করতে পরিচয় হয় পিয়ার সাথে। পিয়া একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে পরে। কেননা সে পরে চান্স পেয়েছে। পিয়া পড়াশোনা ভালো, সে মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। মধুমিতা ম্যাম বৈষ্ণব পদাবলী ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাসে পিয়া আর মামুদ পাশাপাশি বসে মন দিয়ে ক্লাস করছে। ম্যামের বৈষ্ণব পদাবলীর ক্লাস করার কিছু দিনের পর দুজনের মধ্যে পূর্বরাগ থেকে অনুরাগে পরিনত হয়।
মামুদ তোমাকে কতদিন বলবো সময়ে এসো, আমি কতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, প্রায় তিন ঘণ্টা থেকে অপেক্ষা করছি। রাস্তার ধারে কিছু বকেটা ছেলের টিটকারি শুনতে হয়।
আচ্ছা বাবা রাগ করে না, “আমার বাবু-সোনা রাগ করে না, এইতো আমি চলে এসেছি “।
দাও আমার জন্য কি নিয়ে এসছো,অবশ্যই এনেছি তোমার স্পেশাল খাবার “বাদাম”। তাইতো বাবু তোমাকে আরও বেশি বেশি করে ভালোবাসাটা বেড়ে যায়।
পিয়া কালকে রেজাল্ট দিবে, তুমি জানো?
হ্যাঁ। “আমার খুব ভয় করছে মামুদ, কেন”?
যদি রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায়, তুমি ভালো রেজাল্ট করবে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
( পরের দিন)
ভালো রেজাল্ট করে দুজনেই ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হলো, একসাথে কলেজ-টিউশন যাতায়াত করে।
মামুদ কালকে কোনো জায়গা ঘুরতে চলো, কালকে যাবে,
“ হ্যাঁ চলো”, কয়েকদিন পর গেলে ভালো হতো, না আমি কালকেই ঘুরতে যাবো, এমনকি তোমাকে সাথে যেতে হবে।
“সেখানে গিয়ে কিছু শপিং করবো” । “আমার যাওয়া হবে না পিয়া”।
“আমি বুঝতে পারছি কেন যাবে না”। তোমার কাছে টাকা নাই তারতার জন্যজন্য।
“আমি থাকতে তোমার কোনো সমস্যা হবে না মামুদ, চলো কালকে তাহলে “।
অনেক ঘুরাঘুরি করার পর সপিং করে, আসার মূহুর্তে, পিয়ার বাবা দুজনকেই দেখে ফেলে।
পিয়া তোমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসি, চলো। যেতে যেতে মামুদ পিয়া কে বলে, “পিয়া তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলি, আমি কিন্তু পাগল হয়ে যাবো”।
“পিয়া তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না “।
“ I love you পিয়া,” মামুদ বাড়িতে বিয়ের কথা বলছে, আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না,
অনেক ম্যানেজ করছি, এটা মনে হয় পারবো না। পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হবে, আমি যতটা পারি ম্যানেজ করবো মামুদ।
তুমি কাঁদছো মামুদ, এটা মনে হচ্ছে শেষ বাড়ি করে ছেড়ে গেলাম, আর দেখা হবে না পিয়া, আমার মনে হচ্ছে।
“পাগল কোথাকার কাঁদতে নেই “, মামুদ আমি কিন্তু থামতে পারছি না, আমার কান্না বেরিয়ে আসছে “, প্লিজ মামুদ এখন কান্না করো না, আমার বাড়ির কেউ দেখে নিবে।
পিয়া আমি কিন্তু কালকে আমার বাবা – মাকে দুজনের সম্পর্কের কথা বলবো।
“দেখো মামুদ তোমার পরিবার মেনে নিলেও”, “আমার বাবা কিন্তু মানবে না “।
ঠিক আছে কাল তাহলে দেখা হচ্ছে পিয়া।
মামুদ বাড়ি গিয়ে একটা ফোন দিবে, তুমি সাবধানে বাড়ি যাও।
(একমাস পর পিয়া সাথে দেখা)
পিয়া তোমাকে আমি পাগলের মত খুঁজেছি, তোমার বাড়ির সামনে এসে কতদিন ঘুরে গেছি, তোমাকে একটি বারের দেখার জন্য, তোমার ফোনের অপেক্ষায় সবসময় বসে আছি। কবে তুমি একবার ফোন করবে।
“তোমার কি একবারও দেখার ইচ্ছে করনি”!
“আর তুমি শাড়ি পড়ে আছো, হাতে নতুন চুড়ি, বা হাতে তোমার কি এটা, আংটি মনে হচ্ছে”।
“তুমি কি বিয়ে করে নিয়েছো “।
একটি বারের জন্য আমার কথা শোনো মামুদ, তুমি পাগলের মত করো না, প্লিজ শোনো মামুদ।
“সেদিন রাতে আমাকে মা বেধড়ক মার মেরেছে, এমনকি ফোনটাও ভেঙে দিয়েছে, তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার পরের দিন কলকাতায় চলে জোর করে আমাকে নিয়ে চলে যায় এবং মামার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়”।
আমি আর কি করবো ভেবে পাচ্ছি না, আর তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ, না হলে আমি পালিয়ে আসতাম শুধু তোমার জন্য, তোমাকে একটিবার দেখার জন্য, আমার মামুদ কি অবস্থায় আছে, শুধু পরিবারের জন্য তোমাকে হারাতে হলো।
এমনকি বাবা বলছে “ তুই যদি ওই ছেলেটার সাথে মেলামেশা ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস , তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি “ ।
তখন আমার কিছুই করার ছিল না মামুদ।
“পরিবারের পছন্দ মতো ছেলেকে বিয়ে করে আমি সুখী আছি, সুখী নাই মামুদ বয়সের চাইতে দ্বিগুণ বয়সের ছেলেকে বিয়ে করে মানসিক প্রশান্তি নেই মামুদ” ।
বাবা- মা শুধু “ সরকারী চাকরিরত “ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে, আমার মেয়ে সুখে শান্তিতে থাকবে এই ভেবে।
“মামুদ তুমি আমাকে ভুলে যাও, আমার থেকে ভালো মেয়ে পাবে, সে তোমাকে আমার থেকে বেশি কেয়ার করবে”।
“ভুলে যাও তুমি আমাকে, ভু- লে যাও”।
পিয়া তুমি জানো,” তোমাকে ভুলে যাওয়া তো দূরের কথা “।
“তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না”।“আমি বেকার তাই, তোমার পরিবার আমার ভালোবাসার মূল্য দিলো না, এমনকি তুমিও “
এরপর থেকে মামুদ সমস্ত নেশা করতে থাকে, মানসিক চাপে পাগল হয়ে যেতে শুরু করে।
প্রতিটা বাবা – মায়ের এই সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে হবে, সন্তান কোথায় ভালো থাকবে, কার সাথে ভালো থাকবে এটা কোনো মেয়ের বাবা ভাবে না। ভাবে শুধু সরকারি চাকরি করে, মানে ছেলে ভালো। বেশিরভাগ মেয়ে বলে সুখে আছি, কিন্তু তার অন্তরে শুধু কোথায় যেন অশান্তি, অসুখী থেকেও তার সাথে সংসার করে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়।
এই ভাবে পিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে দিন যায়, মাস যায়, বছরের পর বছর যায় পিয়ার স্মৃতি নিয়ে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে থাকে মামুদ।
শত শত মামুদ তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে না পেয়ে পাগল হয়ে যায়, কেউ এই পরিস্থিতিতে কোনো মেয়েকে কাছে পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আর কেউ কাউকে না পেয়ে একাকিত্বের মধ্য দিয়ে নদী ভাঙনের মতো, এক মূহুর্তে সমস্ত কিছু যেন ভেঙে চুরমার করে দেয়, সেরকমই মামুদের জীবনে হয়েছিল।
০৪/১০/২০২০