উপন্যাস
টানাপোড়েন ১০১
বুনোঝড়
মমতা রায় চৌধুরী
রেখার বেখেয়ালী মনে উঠেছে অতীতের ঢেউ সেসব ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে কখন যে ভোর হয়ে গেল বুঝতেই পারে নি। জানলার ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ তেরচাভাবে ভাবে এসে পড়েছে। চমক ভাঙ্গে।
অন্যদিকে তুলি ,পাইলট এত জোরে চেঁচাচ্ছ যে আর বিছানায় শরীরটাকে রাখতে পারল না। কান খাড়া করে শুনল। ওদের আওয়াজটা কি ধরনের আওয়াজ অনুধাবন করার চেষ্টা করলো ।এই আওয়াজ এর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় ওরা কি চাইছে, কি করছে? এখনকার আওয়াজ এর মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি একটা আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ পেল ।
রেখা ভাবে 'এরা তো খুব সুন্দর মিলেমিশে থাকে। তবে মাঝে মাঝে এতটা রেগে যায় কেন, কে জানে? '
রেখা উঠে পরল দরজাটা খুলেই দেখতে পেল মনোজের ঘরে আলো জ্বলছে ।
ওদিকে যেতে গিয়েও মিলি ,তুলি ,পাইলটদের চিৎকারে ,আগে সেদিকটায় গিয়ে ধমক দেয়' তুলি ,পাইলট এত গলার আওয়াজ কেনো?
একটু চুপ করে গেল। তারপর প্রত্যেকে যেন কিছু বলতে চাইল ।পরস্পর পরস্পরের অভিযোগ জানাতে শুরু করলো । রেখা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত দিয়ে প্রত্যেকের মাথায় আদর করে
দিল ।তারপর চলে আসলো ।
রেখা দ্রুত ছুটল বাথরুমের দিকে। এত জোরে বাথরুম পেয়েছে বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাথরুম থেকে একেবারে প্রাতঃক্রিয়া ও অর্ধস্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে গোপালকে তুলল ,গোপালের ভোগ নিবেদন করলো।
গোপালের কাছে প্রণাম করে প্রার্থনা করল' 'হে ঈশ্বর সকলকে ভাল রেখো। সারাদিনটা যেন ভালো যায়।'
আজ কাজের অত তাড়া নেই। নূতন কাজের মাসি লেগেছে। অবশেষে সুমিতাকে বিদায় করা গেছে। মাসি বয়স্ক হলেও গুছিয়ে কাজ করে।
সুমিতার মতো ফাঁকিবাজ নয়। অথচ প্রথম দিন যখন এই মাসিকে কাজে নিয়ে আসে মনোজ, রেখা তখন একটু বিরক্ত হয়েছিলো। মাসির সামনে কিছু বলে নি ঠিকই।
কিন্তু পরে বলেছিল বাজখেকো গলায় 'সুমিতাকে নিয়ে এত ভুগলাম আবার নিয়ে এসেছ এই বয়স্ক মাসিকে।ভালো লাগে না ছাই।'
মুখ গম্ভীর করে রেখা চলে এসেছিলো নিজের ঘরে।
পরে মনোজ এসে নিজেকে দেখিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেছিল' আমার উপর বিশ্বাস রাখ ,আমার
উপর । এ মাসি সুমিতার মত হবে না।'তারপর রেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।'
মাঝে মাঝে মনোজের রোমান্টিক আবেগে রেখা ভেসে যেতে চায় কিন্তু আবার মাঝে মাঝে ওর মাথায় কি যে ঘুনপোকা ধরে কে জানে?
রেখা আজ বুঝতে পারে ' মনোজ ঠিক কথাই বলেছিল । এ মাসি সত্যিই ভালো।'
সুমিতা থাকলে এতক্ষণ বসে বসে ভাবার কোন স্কোপ ছিল? বাপরে বাপ সারাক্ষণ টেনশন আর টেনশন ।সকাল থেকে উঠে নাকানি-চোবানি খেতে হতো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে আপন মনে বলে উঠল' এ বাবা এত বেলা হয়ে গেছে মাসি আসার সময় হয়ে গেছে ।'
রান্নাঘরের দিকে গেল মাসির জন্য চা করতে হবে, নিজেদের জন্যও করতে হবে। জলটা কাপ মেপে মেপে প্যানে দিল ফোটাতে , সঙ্গে আদা গোলমরিচ, লবঙ্গ ,তুলসী পাতা দিয়ে দিল একটু থেঁতো করে। গ্যাসের অন্য চুলায় দুধ গরম করতে বসিয়ে দিল , আটার লেচি কেটে রুটি বানিয়ে বাচ্চাগুলোকে খাওয়াতে গেল। যাওয়ার সময় মনোজের ঘরে একবার উঁকি দিল। আর মনে মনে বলল' একি রে বাবা টেবিলের কা'ছে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে, কি ব্যাপার ?কি হল? তারপর ভাবলো "না যাই একবার বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে এসে ঘরে ঢুকে দেখি তিনি কি করছেন?'
বাচ্চাগুলো খাবার খাইয়ে এসে ওদের থালাগুলো বেসিনে রেখে, চা নিয়ে ঢুকলো মনোজের ঘরে।
কাছে গিয়ে মনোজকে ধাক্কা দিয়ে বলল ' কি ব্যাপার এভাবে ঘুমাচ্ছ কেন ?সারারাত কি এভাবে ঘুমিয়েছো?'
মনোজ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল 'কেন আমি তো ঘরে কাজ করতে এসেছি ,ঘুমাবো কেন সারারাত এখানে বসে?'
মনোজের কথা শুনে রেখা হতভম্ব হয়ে গেল কি বলতে চাইলও আর কি মানে হয়ে গেল।
মনে হল যেন চোর ধরা পড়ে গেছে তাই সাফাই গাইছে।
রেখা শুধু বলল 'আমি এভাবে বলতে চাই নি, তুমি যেভাবে বলছো?
মনোজ বললো' সকাল সকাল এত জ্ঞান দিওনা।'
রেখা ও কেমন যেন একটু রেগে গেল বলল' এই তুমি এভাবে কথা বলছ কেন ?আমি কি এমন বলেছি তোমায়?'
মনোজ হঠাৎই বলে উঠলো 'অসভ্য মেয়ে মানুষ।'
রেখার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কথাটি শুনে গা ঘিনঘিন করে উঠলো। আর বলল "তোমার মাথা ঠিক নেই ।কাকে, কি কথা বলতে হয়, সেটা তুমি শেখো নি।'
মনোজ বলল'' না না এখন তোমার কাছ থেকে শিখব ,এটা তোমার ক্লাস রুম নয়।'
রেখা বলল 'তুমি আমাকে কি ভাবো বলতো?'
মনোজ বলল' কি ভাবি সেটা তো বলেই দিলাম।'
রেখা আর নিতে পারল না।
বলল 'আমি এভাবে কথা শুনতে অভ্যস্ত নই আমাকে এভাবে বলবে না।'
মনোজ বলল" সেটা তুমি যা ভালো বোঝো তাই করবে।"
আর কোন কথা বাড়ালো না শুধু বলল 'ছি: তুমি আমার স্বামী হয়ে এসব কথা বলছো ছি: ছি:
ছি :।
রেখা ভাবছে' কি এমন সে করেছে যার জন্য মনোজ এ ভাবে বলল।'
তাছাড়া কাজের মাসি এসে যাবে । এসময় ওর কাছে না থাকাই ভালো ।আরো কি ছাইপাশ বলে দেবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আজকাল এরকমই ব্যবহার করছে। কালকেই তো শাশুড়ি মার ওখান থেকে ঘুরে আসল। ওখান থেকে কিছু কি হয়েছে?
আজও সেই পৌষ সংক্রান্তি। আজই ঘটেছিল রেখার জীবনে আর এক দাগী অধ্যায়।
আজ আবার পৌষ সংক্রান্তি আগের দিন অনেক নিয়ম-কানুন ছিল ,সেগুলো করেছে আজও রয়েছে কিছু নিয়ম। তবুও মনে থেকে যায় সে কলঙ্কিত জীবনের কাহিনী।
মনে পড়ে মকর সংক্রান্তির আগের দিন সকাল থেকেই" রেখার শাশুড়ি মা নানা কারণে ঝগড়া করার ইস্যু খুঁজছিলেন। হঠাৎই দোতলা থেকে এসে যখন নিজের রুমে তিন তলায় ঢুকে যাবেন তখন রাঁধুনিকে শুনিয়ে বলছেন 'আমার দুয়ারের সামনে কেন এত নোংরা ,এত জল। পরেরদিন মাসি আসুক
কাজে ,জিজ্ঞেস করবো 'ঘর সামনে মুছেনি আদবে কথাগুলো যে রেখাকে শুনিয়ে বলা রেখা সেটা বুঝতে পারে কিন্তু রেখা মানতে পারে না যে ,একটা কাজের মেয়ে সে গরীব হতে পারে কিন্তু তারও একটা মূল্যবোধ তার আত্মসম্মান আছে ।কারণ সে তো কাজে ফাঁকি দেয় নি ।সে ভালোমতোই করে গেছে কিন্তু যেহেতু ওটা ফ্রন্ট প্যাসেজ তাই যাতায়াতের সময় পায়ে পায়ে জলময় হয়েছে হয়তো সে দোষটা কিন্তু কাজের মাসির নয় ।তাই যখন শাশুড়ি মা ওইসব কথা বললেন, তখন রেখা চুপ করে থাকতে পারে নি।
' রেখা তখন রাঁধুনিকে লক্ষ্য করে বলেছে 'কোথায় কি নোংরা আছে দেখি।l আমি মুছে দিচ্ছি '
রাধুনি বলল '' হয়তো ভুলে গেছে.
তখন রেখা বলল না মাসি কিন্তু কাজে ফাঁকি দেয় না। মাসি ঠিকঠাকই মুছে গেছে, পায়ে পাই হয়তো জল জল হয়েছে ।যাই হোক সেই অবস্থায় তুই ব্যাপারটা থেমে গেল কিন্তু তুষের আগুন জ্বলে উঠল ঠিক সন্ধ্যেবেলায়। ঠিক সন্ধে বলা যায় না ।রাত আটটা নাগাদ রেখার শরীরটা ভাল ছিল না । মেয়েলি প্রবলেম থাকার জন্য শুভ কোন জিনিসে করতে পারবে না ।কিন্তু নিয়মকানুনগুলো করতে হবে ।ওদিকে শাশুড়ি মা কিন্তু কোন নিয়ম-কানুন এর ধার ধারে না অথচ লোকের কাছে তিনি বলেন এ বাড়িতে যে বউ এসেছে কোন নিয়ম কানুন সে করে না ।ফলে আগে যে মেয়েটি কাজ করত হঠাৎ সে দেখা করতে আসে। বিয়ে হয়ে গেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে বাপের বাড়িতে ।রেখার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো ,সে তো ভেবেছিল যে পাড়াতুতো ভাইপো এসেছিল চালের গুড়ি দিতে আর নতুন পিঠার সাজ দিতে ,যাতে পিঠে করা হয় ।সে পিঠের সাজ পোড়াতেই হবে ,না হলে সারা বছর পিঠে করা যাব না ।পিঠে খাওয়া যাবে না ,এটা নিয়ম। তাছাড়া অনেক কিছু নিয়ম আছে পিঠে করে সেগুলো করতে হয়। আলপনা দিতে হয় লক্ষ্মী মায়ের আরাধনা করতে হয়। কাজের মেয়ে কৃষ্ণা যখন আসে তখন রেখা বলে কৃষ্ণা একটা কাজ করে দেবে গো? কৃষ্ণা বলল কি কাজ বৌদি?
রেখা বলল ' আজকে তুমি আমাকে একটু আলপনা দিয়ে যাবে আমিতো ছুতে পারব না মোমবাতি জ্বালাতে হবে ধান ,দূর্বা ,সিঁদুর দিতে হবে। ছাদে গিয়ে আলপনা দিয়ে সাজিয়ে পিঠে, খড়, দূর্বা সিঁদুর দিয়ে মা লক্ষ্মীর আরধনা করতে হবে।
আর ঘরে ঘরে একটু আলপনা দিয়ে দিতে হবে।
কৃষ্ণা বলল ' এ আবার কি কঠিন কাজ নিশ্চয়ই করে দেবো। বৌদি আমাকে একটু দেখিয়ে দিও ।'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,সে তো দেখিয়ে দেব আমি শুধু ছুঁতে পারব না ।সেইজন্য বলা। আর তাছাড়া ভাইপো আছে তোমাকে সাহায্য করবে।
যেমনি বলা তেমনি কাজ। ওরা ঠিক যথারীতি আলপনা দিয়ে সব নিয়ম রীতি সব করে দিয়ে গেল শাখ বাজিয়ে দিয়ে গেল। ওরা যেতে না যেতেই মনোজ যখন ঘরে আসলো ,একটা কি কাজে মনোজকে ডেকে আমার শাশুড়ি মা বললেন 'দেখো আমার দুয়োরের সামনে দেখো কি অবস্থা ?দরজার থেকে বেশ খানিকটা দূরেই একটা চালের জায়গা সেটা কে ওরা সরিয়ে রেখেছিল ।দেখে যা কি সব কাণ্ড। তখন মনোজ বলেছিল ' তোমার দরজার কাছে তো নেই। বেশ খানিকটা তো দূরেই
আছে ।তাতে কি অসুবিধা হচ্ছে তোমার? যদি অসুবিধা হয় এটা যে রেখেছে তাকে বল সরিয়ে দিতে।
শাশুড়ি মা বলেন 'বাবা ব'লে মরবো নাকি ?এতে আগুন জ্বলে যাবে।'
মনোজ বলে 'তুমি এসব কি কথা বলছো মা ,আগুন জ্বলবে কেন?'
মা বললেন _তুই জানিস না বাড়িতে কি সব কাণ্ড করে বেড়ায় তোর বউ?'
রেখা ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না।
যখন আবার ঐ একই কথা রিপিট করে যাচ্ছে এ বাড়িতে টেকা দায় হয়ে দাঁড়াবে ।
ঠিক তখনই রেখা গিয়ে বলে ' 'কি সমস্যা হয়েছে আপনার। এটা তো আপনার কোন সমস্যা করছে না, আর এইখানে জায়গা কোথায় বলুন ?কোথায়
রাখবো ?সেই নিয়ে কি ভাষl শব্দ ব্যবহার করল ভাবতে অবাক লাগছে । বলল 'অসভ্য ঘরের মেয়ে বাড়িতে এসে হার মাস জালিয়ে ,পুড়িয়ে, খাক করে দিল। অলক্ষীও
বলল । লক্ষ্মীর আরাধনা হচ্ছে ঠিক, ঐদিনই রেখাকে কিভাবে নানা কটু কথায় হেনস্থা করতে লাগল ।
তখন রেখা বলেছিল একটা কথা আপনি এভাবে অসভ্য মহিলা অসভ্য মহিলা বলবেন না খারাপ লাগে শুনতে ।এটা ঘুরিয়ে যদি আপনাকে বলা হয়।
এই কথা নিয়ে শুরু হয়ে গেল অশান্তি ।ননদকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে এত চিৎকার করে বলছেন। পাড়ার লোকও শুনতে পাচ্ছে আর তারপর শুরু হয়েছে রেখার নামে নানা ধরনের আজেবাজে কথা ।ভেবেই পেল না যে, সে কি কাজটা
করেছে ?সে তো বাড়ির মঙ্গলের জন্য এসব করেছে।
সে তখন বলল 'ঠিক আছে আমি মুছে দিচ্ছি সব ।তাতে তো আপনার শান্তি হবে ।আপনার বয়স হয়েছে এভাবে উত্তেজিত হবেন না। দরজা দিয়ে আসতে যাচ্ছে এমন সময়জোরে দরজা ধাক্কা মারলো শাশুড়িমা। ভাগ্যিস রেখা হাত সরিয়ে নিয়েছিল। সরিয়ে না নিলে রেখার হাত কেটে বাদ হয়ে যেত।
মনোজ প্রচন্ড অশান্তি শুরু করল রেখার সাথে ।
রেখাভেবে পায় না যে তার দোষটা কোথায়? সে কি
করেছে ?আসলে রেখার জীবনের প্রাপ্তি এটা নয় ।রেখা ভাবে সে চূড়ান্ত ভুল করেছে এই পরিবারে বিয়ে করে এসে। তার মনের প্রশান্তির সে কখনো খোঁজ পায় নি ।যখন স্বামীর কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পেতে শুরু করেছে ।ঠিক তখনই দেখা গেছে কোন না কোন কারনে মনোজের বুনোরাগ হঠাৎ করে এসে হাজির হয়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ।রেখার জীবনে আজও ঠিক তাই
হলো ।রেখার দু-চোখে শুধু জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।