শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৫৭)
শামীমা আহমেদ
আরাফের ক্রমাগত বাবা বাবা ডাকেও শিহাবএকেবারেই নিরুত্তর ও নির্জীব হয়ে রইল।রিশতিনা একদৃষ্টে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল।শিহাব দেখতে আগেরমত তেমনি সুন্দর আছে। আজ প্রায় চার বছর পর সে শিহাবকে দেখছে।এর মাঝে কোনদিনও আর এক মূহুর্তের জন্য তাদের দেখা বা কথা হয়নি।রিশতিনার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না নেমে আসছে।
বাবা বাবা ডেকে ডেকে আরাফ একটু একটু করে বিছানার কিনারায় চলে এলো। যে কোন মুহুর্তে সে একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।এই দৃশ্যে শিহাব যেন হুশে ফিরে এলো।শিহাব দৌড়ে গিয়ে আরাফকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
প্রচন্ড ভয় পেয়েছে সে! আরাফ বাবার বুকে একেবারে খাঁমচে ধরে মিশে রইল। শিহাব যেন প্রাণ ফিরে পেলো।সারাটা সপ্তাহ সে ছেলেটাকে না দেখে থাকে। এমনকি ফোনেও কথা কম বলে। আরাফের মুখে বাবা ডাক শুনলে সে নিযেকে স্থির রাখতে পারেনা। আর মা হয়ে চার চারটি বছর পর আজ সন্তানকে দেখতে আসা? মায়ের অধিকার নিয়ে কথা বলা। যেখানে আবার আরেকজনের সাথে নতুন সংসার করছে
সেখানে আরাফকে ছেলের দাবী নিয়ে কেন আসা? আর স্বামীর প্রতি কি এমন দ্বায়িত্ব সে দেখিয়েছে। সে লন্ডনে যেতে না চাইলে কেউ কি তাকে জোর করে নিতে পারতো ? শিহাবের ভেতরে এতদিনের যত ক্ষোভ রাগ আর অভিমান একসাথে হয়ে রিশতিনার প্রতি তা ঘৃণা হয়ে বেরিয়ে এলো।
রিশতিনা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শিহাবের
খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। শিহাব তা বুঝতে পেরে এক ঝটকায় দূরে সরে গেলো। আর বেশ স্পষ্ট করে বলতে থাকলো,না আরাফ আমার সন্তান।শুধু আমার সন্তান। তুমি ওর কেউ না।আমি আরাফের বাবা।
রিশতিনা বলে চললো, শিহাব তুমি আমার সম্পর্কে ভুল জেনেছো।আমি কাউকে বিয়ে করিনি।বাবা শত চেষ্টা করেও আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করাতে পারেনি। আমি বাবাকে শুধু পড়াশুনার দোহাই দিয়ে বিয়ে ঠেকিয়েছি।
তাদের নজরদারীর ভিতরেও আমি শুধুই তোমার কথাই ভেবেছি।
রিশতিনার কোন কথাই শিহাব যেন শুনছে না।বিশ্বাস করতে চাইছে না। রিশতিনা অবিরল ধারায় কেঁদেই চলেছে।
বলেই চলেছে, শিহাব তোমাকে আমি একদিনের জন্যও ভুলিনি। তোমার আমার জীবনে যা ঘটেছে তা আমার বাবার জন্যই হয়েছে।আজতো সে আর বেঁচে নেই। তাইতো আমার সংসারে আমি ফিরে এসেছি।
রিশতিনার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা শিহাবকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছে। কত কত রাত সে একা একা কেঁদেছে। ছোট্ট শিশুটি মেয়ের দুধ বঞ্চিত হয়েছে।বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের কাছে তাদের পরিবারকে ছোট হতে হয়েছে।তবুও সেইসব দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই সে একরকম মৃতপ্রায় জীবন কাটিয়েছে।সে আর সেইসব দুঃসহ স্মৃতিতে ফিরে যেতে চায় না। রিশতিনার পারিবারিক মর্যাদা তাদের চেয়ে অনেক উচ্চে।তার বাবা ব্যারিস্টার ছিল।ভীষণ অহংকারী এবং ক্ষমতার দাপুটে ব্যক্তি বারংবার শিহাবদের পরিবারকে অপমান করেছে। শিহাব ভেবে নিলো,রিশতিনাকেও তাদের সেই পারিবারিক অবস্থানেই থাকতে হবে।শিহাব আর পিছনে ফিরে তাকাতে চায় না। বাবা মাকে এই শেষ বয়সে সে আর আহত করতে চায়না।
শিহাবের জীবন আজ অন্য ধারায় বয়ে গেছে।তার জীবনে শায়লা এসেছে। শায়লাই হবে আরাফের মা।শিহাব রিশতিনাকে ফিরে যেতে বললো।
রিশতিনা তুমি তোমার মৃত বাবার ইচ্ছে পূরণ করে তার আত্মার শান্তি দাও। তোমাদের পরিবারে ফিরে যাও।
---আর আমার জীবনের শান্তি?রিশতিনার পালটা প্রশ্ন।
সে তুমি তোমার মত করে খুঁজে নাও।বারবার তুমি আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিও না। আমি জীবনে খুব গোছানো মানুষ ।তুমি বারবার তা তছনছ করোনা।
রিশতিনাকে হারিয়ে শিহাব যতটা কাতর ছিল শায়লাকে পেয়ে আজ যেন ততটাই দৃঢ় হয়েছে।কিছুতেই সে আর পিছু ফিরবে না। রিশতিনাকেও সে আর কোন বাঁধনে বাঁধবে না।
রিশতিনা শিহাবের হাত ধরতে চাইলে শিহাব তা হতে দিলো না। রিশতিনা ভীষণ অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকালো।
টেবিলের উপর রাখা রিশতিনার হ্যান্ডব্যাগে মোবাইল বেজেই যাচ্ছে। রিশতিনা তা রিসিভ করছে না। শিহাবের কাছে তার কোন আকুতিই যেন খাটছে না।
রিশতিনা এই ভেবে ভীষণ অবাক হচ্ছে এমন করে শিহাব তাকে ভুলে গেছে!সরিয়ে দিতে চাইছে! অনেক আশা নিয়ে সে আজ এসেছিল।
শিহাব তার অবস্থানে স্থির রইল। সে এখন বেশ বুঝতে পারছে কেন বাড়িতে প্রতিটা মানুষ এমন থমথমে ভাব নিয়ে ছিল।ভাবী এত আতংকিত ছিল।
রিশতিনা ফোনের দিকে এগিয়ে গেলো।
হ্যান্ডব্যাগটির পাশে আজো শিহাব আর রিশতিনার বিয়ের দিনের ছবিটির ফটোফ্রেম রাখা। রিশতিনা ফ্রেমটি হাতে তুলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সেই দিনের সেই আবেগের মূহুর্তের ছবিটি আজ কতটাইনা মিথ্যা হয়ে গেলো।শিহাব অনেক বদলে গেছে।আর ভাবলো,যাবেই তো আমি তো তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
রিশতিনা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো।রিশতিনার মায়ের ফোন।মেয়েকে বাসায় না পেয়ে ফোনে খোঁজ করছেন।রিশতিনার অভিব্যক্তিতে বুঝা গেলো ওপাশ থেকে মায়ের বেশ বকাঝকাই হচ্ছে। রিশতিনা চুপ করে সবটা শুনে নিলো। শুধু বললো, আচ্ছা।
রিশতিনা এখন ভেবে নিলো , রোমেল ভাইয়ার কাছে তাহলে যা শুনেছে সেটাই ঠিক। শিহাব এখন অন্য একজনকে ভালোবাসে। রোমেল ভাইয়ার এমন খবরের সত্যতা পেতেই রিশতিনার ছুটে আসা।তবে সে কোনদিনই ভাবেনি শিহাব তাকে ফিরিয়ে দিবে। সন্তান রেখে কত মায়েরাইতো আজকাল চাকরীর জন্য,উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যায়, তাতে কি সন্তানের অধিকার হারায়? তবে রিশতিনার যাওয়াটাতো সেরকম সহজ কিছু ছিল না। অমন দুধের শিশুকে সে ছেড়ে গেছে এটাতো তার বিরাট অন্যায় হয়েছে। রিশতিনার সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তার বাবার উপর।এখন মাও তাকে রেহাই দিচ্ছে না। রিশতিনা এটাও ভাবে শিহাব যদি তাকে সেদিন জোর করে ছিনিয়ে আনতো, তবে তো আজ তাদের জীবন অন্যরকম হতো।
আরাফ ভীষণ ভয় পেয়েছে।! যদিও অনেক খেলনা পেয়ে আর রিশতিনেকে মা জেনে সে খুব খুশি হয়েছিলো কিন্তু হঠাৎ করে অজানা একজন মানুষ এসেছে যাকে মা ডাকতে হয়েছে আবার তার সাথে বাবার ঝগড়াও হচ্ছে! এসব ভেবে আরাফ ভয়ে একেবারে শক্ত হয়ে বাবার পিঠে পড়ে আছে। সে এখন তার চাচী আর দাদীর কাছে যেতে চাইছে।সে ভাবছে, এতদিনতো তাদের কাছে আমি ভালোই ছিলাম।শিশুমন কখনোই বাবামায়ের কলহ মেনে নিতে পারে না।বাবা মায়ের মাঝে বৈরীভাবে সন্তানেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
শিহাবের ভাবী সুমাইয়া উপরে চলে এলো। আজ সকালে হঠাৎই রিশতিনার আগমনে সেও ভীষণ চমকে গেছে! ওদিকে শিহাব আসতে চাইছে শায়লাকে নিয়ে, সে আগেই বুঝেছিল এমন একটা পরিস্থিতি হতে পারে।সুমাইয়া দরজায় আসতেই আরাফ বাবার কোল থেকে তার দিকে হাত বাড়িয়ে যেতে চাইছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে আরাফ যাকে মা বলে জেনে এসেছে সে তো সুমাইয়াই।সুমাইয়ারও আরাফের জন্য বুকটা খাঁ খাঁ করছে। সে দ্রুত গিয়ে শিহাবের কাছ থেকে আরাফকে রীতিমতো ছিনিয়ে নিলো। আরাফ সুমাইয়ার কোলে গিয়ে শুধু দাদীর ঘর দেখাচ্ছে। সে দাদু দাদু বলছে।সুমাইয়া শিহাবের কাছে জানতে চাইলো, শিহাব তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? সন্তান তোমাদের। আমিতো নিয়ে যেতে পারি না।
এবার, রিশতিনা এগিয়ে এলো, বেশ অপরাধীর মত বললো, ভাবী,মা হয়েও আমি নিজ সন্তানকে ফেলে গেছি।কেন কোন কার্যকারণে, কার চাপে সবই আপনাদের জানা। আর আজ যখন সব পিছে ফেলে আবার আমি তোমাদের কাছে ছুটে এলাম, তোমরা আমাকে ফিরিয়ে দিলে।ভালোই হলো।আমার নিজের দোষ আমি কাটিয়ে গেলাম। আমার সন্তানের নাম আরাফ,,সেটাও আমার অজানা ছিল,আজ জানলাম। তুমিই ওকে মায়ের আদরে বড় করেছো।আমার স্বামীর প্রতিও আমি দায়িত্ব পালন করিনি,কোন অধিকারেই আমি তোমাদের কাছে গ্রহনযোগ্য নই।আর যার কাছে অধিকার ছিল সেও বদলে গেছে। সে আজ অন্য কারো হয়ে গেছে। আমার যা হারাবার তা হারিয়ে গেছে। আমার বাবা
আর মায়ের ইচ্ছা পূরনেই আমার জীবনকে উৎসর্গ করে যাবো। তবে মনে এতদিন এটাই শান্তি ছিল যে, ভাবী, তুমি আরাফকে মায়ের আদরে বড় করছো। তবে আজ অন্য কেউ আরাফের মা হতে চাইছে তাই খুবউ উৎকন্ঠা নিয়ে যাচ্ছি। অন্য একজন কেউ কি আরাফের সত্যিকারের মা হয়ে উঠতে পারবে? তবে মনে হচ্ছে তার মনে অনেক শক্তি নয়তো কেমন করে সে শিহাবের মন থেকে আমাকে একেবারে মুছে দিয়েছে।
ভাবী তোমরা ভালো থেকো।আমার ছেলে বড় হয়ে নিশ্চয়ই কোন একদিন তার জন্মদাত্রী মায়ের খোঁজ করবে আর নাড়ীর টানে তার কাছে পৌঁছে যাবে। কথাগুলো বলেই, রিশতিনা হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে আরাফকে ছুয়ে দেখতে চাইলেও তা যেন ভবিষ্যতের জন্যই জমা রাখলো। চোখে মুখে একটা সোনালী দিনের স্বপ্ন নিয়ে রিশতিনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আরাফ ছোট্ট ভীত পাখির ছানার মত চাচীর বুকে একেবারে যেন মিশে রইল।
সুমাইয়া শিহাবের পিঠে হাত রাখল।শিহাব ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। শিহাব এতক্ষন যা করেছে সবই এতদিনের জমানো রাগ অভিমানেরই বহিঃপ্রকাশ! রিশতিনাকে শিহাব কতটা ভালোবাসতো সেতো ভাবীর চেয়ে বেশি কেউ জানতো না। সুমাইয়ারও চোখ ভিজে উঠলো।শিহাব তার দেবর হলেও সে তাকে একেবারে নিজের ভাইয়ের মতই দেখে। রিশতিনাকে নিয়ে শিহাবের এমন কোন কথা সুমাইয়াকে বলেনি তা হয়নি।
সুমাইয়া বেশ বুঝতে পারলো শিহাব কতটা কষ্টে দিনে দিনে এমন পাথর হয়েছে। যেভাবেই হউক শিহাব নিজে থেকে একটা সিদ্ধান্তে এসেছে এটাতেই সুমাইয়ার স্বস্তি! সে শিহাব আর আরাফকে তার শ্বাশুড়ির ঘরে এগিয়ে নিলো। শিহাব বুঝতে পারছে না, সে কি কাজটি ঠিক করলো কিনা? রিশতিনার জন্য তার ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। শিহাব ধীর পায়ে সুমাইয়াকে অনুসরণ করে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
যদিও শিহাবের মা বেশ শক্ত করে শায়লার হাতটি ধরে ছিলো তবুও অনেকক্ষন শিহাবের দেখা না পেয়ে শায়লা বারবার ভীত হরিণীর মত দরজার দিকে চোখ ফেলছিল।
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much