একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (৪৪)
প্রস্তুতি
আজ রবিবার সুমিতা কাজে আসবে না ,তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরেছে ।গতরাত্রে মনোজের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিয়েছে।একবার দেশের বাড়ি কাকা কাকিমার কাছে যেতে হবে। কাকু অসুস্থ ।কাকিমা ফোন করেছিল না গেলে খুব খারাপ দেখায় ।যদিও তার আগেই যাওয়ার দরকার ছিল কিন্তু সময় করে উঠতে পারে নি নানাকারণে । তাই আজকে কোনোভাবেই মিস না হয় সেজন্য রেখা সব প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।তাছাড়া জন্মভিটের প্রতি টানটাই যেন রেখাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই সবুজে ঘেরা বাড়ি। সামনে মস্ত বড় উঠোন। যখন ছোট ছিল দেখেছে,সেই উঠোন গোবর দিয়ে মা,কাকিমা ,জেঠিমা কে ভালো করে লেপে দিতে। কাজের জন্য চন্দনা কাকিমা ছিল কিন্তু অতো বড় উঠোন কখনোই তাকে নিকাতে দেখা যায় নি। দুপুরবেলায় দোতলার ঘরগুলো মোছার নাম করে দেখা যেত ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কাকিমা সেখানে ঘুমোচ্ছে। আজ কত স্মৃতি মনে পড়ছে। আজ কবি অরুণ মিত্রের কবিতার লাইন মনে পড়ছে-
'আমার শ্রবণ একক স্বরের স্থিতি পায়।'
অথবা মনে পড়ে
'তবু তার আঁচলের হাওয়া আজও আমার নিভৃতে।'
রেখা আর সেইসব নিশানা ধরেই ফিরে যেতে চায় তার গ্রামের বাড়িতে। ভেতরে সারারাতের সেই উত্তেজনা কাজ করেছে,তাই ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েছে। প্রাতঃক্রিয়া সেরে রাধা গোবিন্দর পূজো করেছে।মিলির বাচ্চাদের দুধ গরম করেছে। কিন্তু সমস্যা তার পিছু ছাড়ে না।চা করে মনোজকে ডাকবে বলে যেই ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
ঠিক তখনই রেখার জা চিৎকার শুরু করে দেয়' 'এখানে সেখানে নোংরা করে রাখবে, একটু যে সকাল বেলায় পুজোর থালা নিয়ে উপরে যাবো ,সেই উপায় নেই।'
রেখা কথাগুলো শুনতে পায়। আর মনে মনে ভাবে সকালবেলায় সিঁড়ির দরজা যখন খুলেছে ,সেখানে রেখা বাচ্চাদের মলমূত্র যা ছিল তা পরিষ্কার করে দিয়েছে ।
তা সত্ত্বেও একবার রেখা ছুটে গিয়ে দেখে আসে।
সেখানে গিয়ে রেখা দেখে 'না মিলির বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে আছে। কোথাও নোংরা কিচ্ছু নেই।'
তখন রেখা বাধ্য হয়ে ওর জায়ের কাছে গিয়ে বলে' 'দিদিভাই, দিদিভাই কোথায় নোংরা গো?'
রেখার জা দেখল হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে ।তাই তখন কথাটা ঘুরিয়ে বলে' না ,না ।নোংরা নয়। আমি বললাম সিঁড়ির কাছে কে জুতো রেখেছে এলোমেলো করে ।পুজোর থানা নিয়ে যাব তো তাই?'
রেখা বলল ' কে রেখেছে জুতোগুলো? কাদের ই বা জুতো?'
রেখার জা বলল 'কে জানে?'
রেখা জানে কাদের জুতো। ওরা নিজেরাই নিজেদের জুতো রেখে দেয়, অথচ এমনভাবে কথা বলবে যেন মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।শুধু শুধু পায়ে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার মতলব।
রেখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে কতটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। মিলির বাচ্চাদের দুধ ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার গরম করতে হবে। মনোজের চাও ঠান্ডা হয়ে গেল। কে জান তো এরকম একটা ঝামেলায় পড়তে হবে। প্রতিদিন ফ্লাক্সে চা টা রাখা হয়। আজ ভাবলো সঙ্গে সঙ্গে চা টা দিয়ে দেবে কিন্তু হবার উপায় নেই।
রেখা ভাবে 'আজকে কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিল কে জানে?'
এসব না ভেবে তাড়াতাড়ি গিয়ে কাজগুলো সেরে নিতে হবে।
ওদিকে মিলি এবং ওর বাচ্চারা চেঁচাচ্ছে ।রেখা কোন দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না ।
শুধু একবার হাঁক দিয়ে বলে 'যাচ্ছি চুপ কর।'
কিছুক্ষনের জন্যে চুপ করে।
এর মধ্যেই মনোজ চেঁচাচ্ছে 'রেখা রেখা রেখা...।
রেখা রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দিল' 'কি হলো?'
মনোজ বলল 'ঘড়িতে কটা বাজে খেয়াল আছে?'
রেখা বলল 'আমার তো আছে কিন্তু তোমার কি আছে?'
আর কোন কথা না বাড়িয়ে রেখা মিলির বাচ্চাদের দিকে ছুটল।
মনোজ চুপ করে যায় আর মনে মনে ভাবে 'তাই তো ?'
রেখা বাচ্চাদের কাছে বলল 'কই রে আমার পাইলট ,ক্যাপ্টেন ,কর্নেল ,মিলি সোনারা কই?'
মনোজ গিয়ে সেই দৃশ্যটা দেখছে রেখার ডাক শুনতে পেয়ে বাচ্চা গুলো কেমন সুন্দর ছুটে ছুটে আসছে। মানোজ থাকতে না পেরে ভিডিও করে ফেলল।
হঠাৎ পেছন ফিরে রেখা দেখে মনোজ দাঁড়িয়ে।
রেখা বলে 'কত কিছু কান্ড হয়ে গেল।'
মনোজ বলল 'আমাকে তোমার ডাকার কথা ছিল না? '
রেখা বলল 'হ্যাঁ তোমাকেই তো ডাকতে যাচ্ছিলুম ।কিন্তু এদিকে মহাভারত রচনা কৌশল তৈরি হয়েছিল। আমার অবস্থাটা কেমন হয়েছিল জানো,'পাগল মরে হেঁটে আর বোকা মরে খেটে'।'
মনোজ বলল ' কেন কি হয়েছিল?'
রেখা বলল 'কি আবার হবে।
সেই সমস্যা মিলি আর মিলির বাচ্চারা, ওরা যেন ওদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে।
মনোজ বলল 'আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার কিছু বলতেই হবে।'
রেখা বলল 'দেখো আজকে যে চক্রবুহ্য তারা রচনা করতে চাইছিল, তাতে নিজেদের জালে নিজেরাই জড়িয়ে গেছে।'
মনোজ বলল' এরকমভাবে আর কতদিন সহ্য করব বল?'
রেখা বললো 'এসব কথা আর মাথায় নিও না তো ।এবার তাড়াতাড়ি তুমি চা টা খেয়ে ফ্রেস হয়ে নাও ।বেরোতে হবে তো?'
মনোজ বলল 'তোমার সব রেডি?'
রেখা বলল 'আমি তো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছি।
মনোজ বলল 'আজকে ওই ট্রেনটা পাবো না জানো তো ?তার থেকে চলো পার্থ কে বলি।'
রেখা বলল 'পার্থকে এখন পাবে তুমি ?পুজোর সিজিন ওর গাড়ী কত বুকিং থাকে।'
মনোজ বলল 'অত টেনশন নিও না তো ।পার্থকে ফোন করে দেখি না। ওর কাছে যদি গাড়ি না থাকে। ও কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবে।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ', পার্থ খুব ভালো ছেলে ।আমাদের সুবিধা -অসুবিধাগুলো ভালো বোঝে।'
মিলির বাচ্চাদের থালাটা নিয়ে এবার ও ছুটতে শুরু করল আর বলল 'তাহলে সেই ব্যবস্থাই করো আর তাড়াতাড়ি যেন বেরোতে পারি , তুমিও তার প্রস্তুতি নাও।'
(ক্রমশ )