উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭২
মায়ের ভাঙ্গা হৃদয়
মমতা রায়চৌধুরী
কালকের কি দিনটা গেল সকলের মনের ওপর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাসিমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না ।মাসিমার দুই ছেলে অন্তপ্রাণ। সন্তানরা তার কাছে হৃদপিণ্ড স্বরূপ। মেসোমশাই মারা যাবার পর থেকে মনের দিক থেকে এমনি ভেঙ্গে পড়েছিলেন ।তবুও দুই সন্তান মাকে যেভাবে আগলে রেখেছে তাতে আস্তে আস্তে মেসোমশাইয়ের শোকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন ।ঠিক সেইসময় একটা বড় ধাক্কা ।কিভাবে মেনে নেবেন ভাবতেই পারা যাচ্ছে না ।সারাটা রাত আমার কাছেই ছিলেন। পাশে থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি মায়ের যন্ত্রণা। শুভায়নের অ্যাডভেঞ্চার এর প্রতি এতটাই ঝোঁক ছিল যে, সে ,যে কোন ঝুঁকি নিতে পিছপা হতো না ।তার বন্ধু অনীকের কথাটা
একদম সত্যি।
ভোর চারটের সময় ফিরে এসে চোখের পাতা এক করতে পারে নি রেখা।চোখ দুটো জ্বলছে।সারাক্ষণ শুভায়ন এর সুখ স্মৃতি চোখের কাছে ঘুরে বেরিয়েছে। আজকেও সূর্য উঠেছে ।তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে ।তবুও বিষন্ন মন আলোর প্রথম কিরণ তার মেখে নিতে ইচ্ছে করছে না। মানুষের মনের ভিতরে কত দ্বন্দ্ব , কত টানাপোড়েন, কে কার খবর রাখে ?চেনা মানুষগুলোকে এরকম কষ্ট পেতে দেখতে কারই বা ভালো লাগে ।এসব ভাবতে ভাবতে এক কাপ গরম কফি করে নিয়ে এসে খাবার টেবিলে বসল।
মনোজ জিজ্ঞেস করল 'কফি কি শুধু তুমি একাই খাবে?'
রেখা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল 'কখন তুমি এসেছ বুঝতেই পারি নি তো।
মনোজ বলল 'তুমি কার কথা অত মন দিয়ে ভাবছিলে ?তুমি আমার আসাটাও টের পাওনি?'
রেখা বলল 'কার কথা ভাববো? কাল থেকে যা হচ্ছে শুধু খারাপ খবর। মাসিমা পুরো ভেঙে পড়েছেন।'
মনোজ বলল' সে তো স্বাভাবিক।'
রেখা বলল 'পার্থর জ্বরটা কমেছে ।এত কাজ কম্ম, ওই তো দেখাশোনা করতো। মাকে সামলানো, সব দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
মনোজ বললো' বড় ছেলে, দায়িত্বটা একটু বেশি।'
রেখা বলল 'মাসিমাকে সামলানোটাই সব থেকে এখন বড় ব্যাপার।"
মনোজ বলল" শোক দিয়েছেন যিনি ।লাঘব ও করবেন তিনি।"
হঠাৎ রেখা বলল ''ওই দেখো কে উঁকি মারছে?'
মনোজ বলল "কে গো?'
রেখা বলল' পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখো।'
মনোজ বললো 'তুলি, লিলি, পাইলট।'
রেখা বলল 'ও মা গেট কে খুলে দিল গো?'
ওরা সবাই ভোঊ..উ করে উঠলো।
রেখা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে দুটোকে কোলে তুলে নিল।আর মনোজকে বললো' দেখো গেটটা খুলে দিয়ে কেউ ঝগড়া করার ফন্দি আঁটছে কিনা?"
মনোজ বল 'যা করে করুকগে ছাড়ো তো?'
মনোজ নিমিষের মধ্যে রেখার চোখমুখে দেখতে পেল একরাশ ক্লান্তির ভেতরে একমুঠো সোনালী ভালোবাসা ,আদর ,স্নেহ সবকিছু জড়িয়ে যেন মাতৃত্ব টাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কে বলবে সারারাতে ক্লান্তি দুশ্চিন্তা আর টেনশান গেছে ওর উপর দিয়ে।
রেখা কোলে তুলে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ওদের দুধ গরম করে আনল তারপর বেশ কয়েকটা বিস্কিট ওর ভেতরে দিয়ে ভালো করে চটকে ওদেরকে খেতে দিল।'
মনোজ বলল 'আজকে রুটি দিলে না ওদের?'
রেখা বলল 'রুটি করার সময় পাই নি গো?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ ,তাই তো আমারই প্রশ্নটা করা ভুল হয়েছে। ঠিক আছে। খাক ওরা।'
রেখা বলল' কি খিদে পেয়েছে দেখো?'
মনোজ বললো 'তাই তো দেখছি।'
রেখা বললো তোমার জন্য কি খাবার করব বল তো ?কি খাবে তুমি?'
মনোজ বলল 'কি বলি বলো তো ?
'ক্লান্তি একরাশ
তোমায় করেছে গ্রাস'
এরমধ্যে কি বলি তোমায়?'
রেখা তো মনোজ এর কন্ঠে কাব্য শুনে
রীতিমতো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
মনোজ হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝাতে চাইলো'কি হলো একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছ?'
রেখা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলল 'আ্যাই জানো তুমি না ভালো কবিতা লিখতে পারবে?'
মনোজ বললো 'ও তুমি নিজে লেখিকা তাই কেবল আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছো?'
রেখা বলল ' না গো । ঠাট্টা করছি না ।বি সিরিয়াস।'
এবার মনোজের মুখ থেকে কোন কথা বের হল না।
রেখা বলল' কি হল তুমি এখন হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে।।?'
মনোজ বলল' দেখছি আমি এই পৃথিবীর মানুষ না অন্য গ্রহের?'
রেখা গায়ে চিমটি কেটে বললো 'দেখো তো?'
মনোজ বলল উঃ লাগছে?
রেখা বলল 'চোখের ইশারায় এবার কি মনে হচ্ছে তুমি এই পৃথিবীতে আছো, না অন্য গ্রহে?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ এখন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমার মিষ্টি বউ ,লেখিকা বউ, রেখার কাছে।'
রেখা মনোজকে ধাক্কা দিয়ে বলল' যাও সব সময় মশকরা না? আমার অনেক কাজ আছে।''
রেখা রান্না ঘর থেকেই বলল ডিম সেদ্ধ করছি কিন্তু তোমাকে হেলদি খাবার খেতে হবে?
মনোজ আমতা আমতা করে বলল 'অ্যাই রেখা, মেথি মালাই হবে গো?
রেখা বললো 'আজকে মেথি মালাই আবার কখন বানালাম? কাল থেকে যা দেখছ এই অবস্থা?'
মনোজ বলল 'না ,তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে ,আমি তোমাকে পরে মেথি মালাই করে খাওয়াবো ।তাহলে এখন তুমি ওটস খেয়ে নাও। ঠিক আছে। ফ্রুটস ওটস দিয়ে দিই।
মনোজ "মাথা নাড়লো।'
একটা প্যানে দুধ ফুটতে দিলো ।অন্যদিকে আপেল কলা, কিসমিস ,কাজু খেজুর কুচি কুচি করে কাটল। কেটে একটা বোলে ওটস দিয়ে গরম দুধ দিয়ে করে মিশিয়ে, চামচ দিয়ে খেতে দিল।'
সবেমাত্র মনোজ এক চামচ মুখে তুলেছে ,এমন সময় ফোন'বেজে উঠলো'আকাশ ভরা সূর্য তারা..।'
রেখা রান্না ঘরে থেকে গ্যাস মুছতে মুছতে ন্যাতার জলটা নিংড়ালো ,বেসিনে ন্যাতার জল টপটপ করে পড়তে লাগল।
ওই অবস্থাতেই রেখা বলল 'বাবা তোমার ফোনে আবার এই রিংটোন ?বাহ খুব সুন্দর।'
মনোজ 'তখনও কথা বলছে ফোনে।'
রেখা কানটা খাড়া করে শুনছে? কখন হয়েছে?
রেখা ন্যাতাটা বেসিনে রেখে এসে বলল 'কি হয়েছে গো?'
কি হয়েছে ?এসব কথা শুনলেই যেন আজকাল রেখার বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে ওঠে।
মনোজ হাতের ইশারায় কথা বলতে বারণ করল।'
মনোজ বলল' ডাক্তার ডেকেছ?'
রেখা কথাগুলোর কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
মনোজ যখন বল ' পার্থ আমার মনে হয় মাসিমার এখন রেস্ট এর প্রয়োজন, তাছাড়া ডাক্তারের মতামত নিয়ে কাজ করা উচিত।'
রেখা বুঝলো যে মাসিমার শরীর খারাপ।
রেখা মনে মনে ভাবল সত্যিই ভদ্রমহিলা অমায়িক স্বভাবের।কিন্তু তার জীবনে একের পর এক ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা।'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে?'
দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।
ফোন কেটে মনোজ বললো 'রেখা একবার তুমি পার্থদের বাড়ি যাও তো?'
রেখা বলল 'মাসিমার কিছু হয়েছে?'
মনোজ বলল-হ্যাঁ বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছেন।'
রেখা বললো 'কালকে রাত্রেও ওরকম হয়েছে।
ডাক্তার ঘোষ দেখছেন তো?'
মনোজ বলল-'হ্যাঁ ,ডাক্তার তো এসেছেন।এবার ওদের তো একটা মেন্টাল সাপোর্টের প্রয়োজন। তুমি একটু ওদের কাছে যাও।'
রেখা বলল 'সে তো আমি যেতাম ই । আমি ঘরের কাজগুলোও গুছিয়ে নিয়ে ভেবেছিলাম যাব।'
রেখা বলল' আর পারা যাচ্ছে না সুমিতাকে নিয়ে ।এবার তুমি ছাড়িয়ে দাও ।আমি আর পারছি না ওকে নিয়ে।'
মনোজ বলল 'কালকে এসেছিল তো?'
রেখা বলল 'কালকে এসেছিল, তাহলে ও কি কাজটা করে গেল বলো?আজকে আবার আসলো না। এভাবে পারা যায়?'
মনোজ বললো 'ঠিকআছে এ কটা দিন তুমি সহ্য করো ।এখন আমিও তো বেরোতে পারছি না বলো? লোক দেখাবো কি করে?'
রেখা বলল ' ওরা ঠিক সুযোগ বুঝে দাও মারে।'
মনোজ বলল' ঠিক আছে এখন ঐসব নিয়ে ভাবলে চলবে না ।তোমার হাতের কাজগুলো করে যত তাড়াতাড়ি পারো ,তুমি পার্থদের বাড়ি যাও।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,এই তো এখন স্নান করবো, পুজো করবো, কিছু খেয়ে যাচ্ছি।'
মনোজ বলল' ঠিক আছে।'
লেখা তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল গিয়েই শাওয়ারটা ছেড়ে দিল শো শো করে জলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।অন্যদিকে আরেকটি বাথরুমের কল ও খুলে দিয়েছে।'
রেখা বাথরুমে স্নান করতে করতে ভাবতে লাগলো সব যেন ঠিক হয়ে যায় ঈশ্বর।