আত্মজীবনীর পরাবাস্তব
থেকে থেকে করাত ও হাতুড়ির শব্দ আসে; আর
শুনতে পাই চলন্ত র্যা দার মুখর গান
গজালের বাক্সে মাথা রেখে শুয়ে আছে ভাই
নধর দুপুর নিয়ে সে খেলছে
আর রোদে রোদে পোড়ে ছুতোরের ছেলে সে-ছুতোর
একজন জিশু খ্ৰিস্ট
তখন আমি চলেছি তোমার পিছনে ঘাস পার হয়ে
আরও কত মহাজাগতিক ঘাসে
বন পার হয়ে অন্য বনে, এক ত্ৰাস থেকে
অরণ্যনিবিড় অন্য কোনও ত্ৰাসে
পার হয়ে যাই মধুবনি নদী, পার হয়ে যাই
পাতাগুল্মলতাঘাসফুল
তোমার সাথেই ছুটছি, তোমার পিছুই বিকাশ
এক ভুল থেকে আর ভুল
এরপর কী হচ্ছে জানো? উড়ে যাচ্ছে জামা
কলার সাদা হয়ে আসা, দিনমজুরের এক মেরুন জামা
তার সেলাইছেঁড়া পকেট থেকে খসে পড়ছে কাগজ
সে-কাগজ শূন্য পাতা
সে-কাগজ না-লেখা সব বিরল প্ৰেমপত্ৰ
সে-কাগজ কালু ডাক্তারের লেখা প্ৰেসক্ৰিপশন
তখন আমি ছুটছি আর ছুটছি তোমার সাথে
আংরাভাসা-ঠাকুরপাট
দেওমালি থেকে ইনডং হয়ে লুকসান ছুঁয়ে
ময়নাগুড়ি-বানারহাট
আকাশে উড়ছে আজব পাখিরা, পাখাহীন তারা
তবু তীক্ষ্ণ যত চঞ্চুময়
জলা পার হয়ে অন্য জলা, তোমার সাথেই,
ভয়ের পর আরেক ভয়
আমি উড়ন্ত জামাকে বলি ফিরে এসো
আমি উড়ন্ত পাখিদের বলছি ফিরে এসো
উড়ন্ত প্ৰেসক্ৰিপশন তুমিও ফিরে এসো
এখনও বাবার জন্য দুচারটে ওষুধ কেনা বাকি
ফিরে এসো শূন্য পাতা সব ক্লোরোফিল
ফিরে এসো প্ৰেমপত্ৰ বিষাদআবিল
ফিরে এসো চোর মুন্ডা মাতাল হাবিল
হারি মুন্ডা কী চুরি করেছিল? আদৌ চুরি করেছিল কিছু? মনে পড়ে?
হাবিল লাকরা খেয়েছিল কোন মদ? পচা মারুয়ার? মনে পড়ে?
যখন তোমার পিছু-পিছু এদিক-ওদিক ছুটি সব মনে পড়ে যায়
মনে পড়ে কুজি ডায়নার জলে সাহাবাড়ির মেয়েটি কী চিঠি ভাসায়
নদীর ওপাড়ে, ভুটানের দিকে, কেমন ফাঁসি-ফাঁসি ভাব জেগে ওঠে
ঘুমের বড়িগুলি সেগুনের ফুল হয়ে সারারাত খুলিগাছে ফোটে
শুধু ফাঁসি-ফাঁসি ভাব, ফাঁসিঘ্ৰাণ, শুধু চারদিকে ফাঁসিফিসফিস
ফাঁসি বলে, ‘সাহামেয়ে, আয়, চাঁদ সাক্ষী রেখে তুই ফাঁসিতে ঝুলিস'
পাথরে চশমা খুলে রেখে মেয়ে তাই ঝুলে পড়ে চাঁদ থেকে চাঁদে
সেই থেকে সেগুনবনের কুকুরেরা ঘুমচাঁদ দেখে দেখে সারারাত কাঁদে
সেই ঘুম পানপাত্ৰে ঢেলে খায় মাতাল হাবিল
তার যত কারখানাখেতবনঝিলকাঠমিল
সৰ্বত্ৰ চুয়ে পড়ে কুয়াশা ফোটার মতো ফাঁসির নিঝুম
সেই ফাঁসি গোপনে বেহাত করে হারি মুন্ডা চোর
সেও এক ছমছমে হরর সিনেমা, অপঘুমঘোর
চুরি করে, কাটে, তারপর আগুনে পোড়ায়
পিটিয়ে পিটিয়ে দেখে ফাঁসিমাখা লোহা আজ কত ঝলসায়
বিকাশ, তোমার সাথেই ছুটছি; না-ছোটার
সাধ্য নেই আর
তারপর ফুটছি, টগবগ করে, যেন আমি ভাদইয়ের ভাত
ফুটে উঠি ম্লান করে টগরের সমস্ত অভিশম্পাত
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে দেখো সে-ভাতের ঘ্ৰাণ
গজালের মতো ঋজু, দৃঢ় হয়ে আসে আজ আমাদের প্ৰাণ
তখন হারানো করাতকে বলি ফিরে আয়
শাণিত বাটালকে চুপিসারে বলি ফিরে আয়
মৰ্গের স্টিলের হাতুড়িকে বলি ফিরে আয়
আমার দিকে ফিরে আসতে থাকে এক আত্মজীবনী...
২.
ঘুম ভাঙাতে এসেছেন মাদমোয়াজেল উরশুলা
আর ঘুমন্ত কবির মুখে খেলছে বারবানটাইন ঘাসের আভা
শিলিগুড়ির বিছানায় খেলছে আৰ্লসের সূৰ্য
সূৰ্যমুখীর খেতে দুলে যাচ্ছে তকতকে আকাশ
যেন বাতাসের গাউন পরে উরশুলা যায় হলুদের দিকে
আমি কি তবে হলুদেই যাব? চাঁদনিরাতের নুয়েনেনে?
কোত্থাও না, আমি শুধু যেতে চাই গয়েরকাটায়
মাদমোয়াজেল সেই গাঁয়ে শোকেতাপে একলা কাটায়
সেখানে এক চাঁদনিরাতে বসে থাকব মধুর শ্মশানে
আর সাধুবাবা পাঠ করবেন মৃদু পাৰ্ল বাক
লেলিহ চিতা জ্বলছে নদীটির পাড়ে
কে এক বেতাল যেন বসে আছে আমাদের ঘাড়ে
আৰ্লসহলুদ থেকে আমি চলি তাহিতিসুনীলে
এখানেও সেই নিগ্ৰোবস্তি, আর হাৰ্লেমের রাজা
সাপ, জেব্ৰা, খচ্চরের মধ্যে যেন বারাক ওবামার পূৰ্বপুরুষ
ওয়াল স্ট্রিটের এক চৈনিক ভিখিরি, ইহুদি বেশ্যার দল
পোপের মুখোশ পরা যত পৰ্তুগিজ উচ্ছন্ন নাবিক
শেয়ারবাজার হয়ে উঠছে শেওলার পিরামিড
মনোবিকলনের ফাঁকে কত বিষ
দুই হাত আকাশে তুলে লোরকা তাই আমাকে বলেন
বলো, কে আমার দুঃখ বুঝতে পারবে?
বলো, কে আমার দুঃখ বুঝতে পারবে?'
আমি বুঝি
আমি বুঝি
বুঝতে পেরেছি এই এক স্বেচ্ছানিৰ্বাসনে
বিষাদের বিষ কীভাবে নীল হয়ে হয়ে আসে শরীরে
পল্টনবাজারের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছে
ষোঢ়শী গণিকা
তাকে বুঝি
খিস্তি ঝাড়ছে বুড়ো ফলওয়ালা
তাকে বুঝি
লাখটকিয়ায় ঝলমল করছে বাজনামুখর মলগুলি
ব্ৰা ও প্যান্টি পরা পুতুল দেখে রগড় করছে পুলিশ
বিধানসভার সামনে আদিবাসী মেয়েকে নাঙা করে পিটছে শহর
আমাকে সকল মল পার হয়ে ঘেটোর দিকে যেতে হবে
পলিথিন প্যাকেটের পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে
যেখানে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা ভাত খায়
যতসব বাংলাদেশি, ডি ভোটার
নগরের সব উড়াল সেতু মিশেছে এইখানে এসে
এই মনোবিকলনে, দিশি ভাঙ আর মদের আড্ডায়
এরাও আমার চেয়ে কম ক্ৰীতদাস নয়, কম দুখি নয়
নিয়মিত ছেঁড়া বুট পালিশ করা হয়, সব যেন আস্ত হাবসি
আর বিষ পড়ে, চুয়ে- মদে, ভাতে, ঘিলু ও জীবনে
লেক ইডেনের মতো পড়ে থাকে দিঘলিপুখুরি
অফিসপাড়ার তাম্বুলখেকো বাবুরা সেখানে প্ৰস্ৰাব করে
ব্যানার খাটিয়ে বসে সব ঝানু রাজনীতিবিদ
আমি বলিঃ
‘বলো, কে আমার দুঃখ বুঝতে পারবে?
বলো, কে আমার দুঃখ বুঝতে পারবে?'
গয়েরকাটা; গয়েরকাটাই আমার সব শোক বোঝে
সব তাপ বোঝে
সব শৈত্য বোঝে
আমি মরবার আগে তাই গয়েরকাটায় যেতে চাই
রক্তাক্ত সব উড়ালসেতুর বদলে মধুবনি সাঁকোয় কত প্ৰাণ
অন্ধবাউল সেখানে গাইছে বসে অন্তহীন ভাটিয়ালি গান
বোধিকথা বলছেন সন্ত কেরুয়াক, সেখানে বসত
পিট সিগার গাইছেন গুয়ান্তেনামারা, সেখানে বসত
হরকরা আসে রোজ, থিওর লেফাফা দিয়ে যায়
বোধিকথাময় গীত, আর আত্মজীবনীর যত চিঠি
বস্তুত আমি এক ভাতশিকারি
হারপুন পাশে রেখে লেফাফা খুলে অক্ষর টিপে টিপে দেখি
কতটা ফুলেছে চালগুলি, কতটা গরম ও নরম হয়েছে
ঠিকঠাক সেদ্ধ হল কি না
কতটা ভাতের মতো হল অক্ষরের প্ৰাণ
তারপর ফের বোধিকথা হবে
তারপর ফের বাজবে গিটার
থিওর চিঠি নিয়ে বিকেলবেলায় আসবে বোবা হরকরা
আর আর্তুরের রক্ষিতা সেই হাবসি মেয়েটি
আমার পায়ের ক্ষত মুছে দেয়
আমার হৃদয়ক্ষত ধুয়ে দেয় স্তন থেকে চুয়ে পড়া দুধে
প্ৰকৃতি পরিব্যাপ্ত হয়েছে আজ এক অচুক ওষুধে
হাবসি মেয়েটি রে, তোকে তো বৃথা খুঁজে মরি
আসাম ট্ৰাংক রোডের ধারে তোর উড়োউড়ো তাঁবু
নোংরা মশারির ভিতর শুয়ে আছিস তুই
এবার তোরও না জানি কত হয়েছে গ্যাংগ্ৰিন
তোর কাছে তোর কাছে তোর কাছে
আমার সকল কবিতার যাবতীয় ঋণ
৩.
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৮৮ সাল
আমার আত্মহননের তারিখ
আমার কোনও সোয়েটার ছিল না
গুয়াহাটির তীব্ৰ শৈত্যে ঠকঠক করে কাঁপছে
আমার চাদর-পরা-মৃতদেহখানা
রাইগর মরটিসের পর কেমন যেন ফ্যাকাশে সব আঙুল
ঝুলে পড়েছে জিভ, চোখদুটো নিথর, চুলে কাচপোকা
মরবার পর কাছারিবস্তি থেকে এল
ঝলসানো শুয়োরের মাথা
আর ভাতের পচাই
তখন নরকাসুর পাহাড়ের মাথায় এক দিব্য আলো
আমি ঝুলতে ঝুলতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম
নেমে আসছেন বেথলেহেমের সেই কাঠমিস্ত্ৰি
এবার জিশুজন্ম হবে, তারই সব জাঁক
তারই যত দিব্য আলোক
শীতের রাতে আকাশে কতশত তারা
কত জোনাকি উড়ছে তখন পাহাড়ের বেতবনে
গুয়াহাটির তীব্ৰ শীতে আমার
মৃতদেহ তখন ঠকঠক করে কাঁপছে
প্ৰথম বেতন পাবার পর সোয়েটার কেনা জরুরি
এটা বোঝা গেল
আমি শবদেহমাত্ৰ
আমি আমার শরীর বয়ে নিয়ে যাই দিনহাজিরায়
বয়ে নিয়ে আসি ঘেটোর ভিতর
জাদুকুয়াশা পড়েছে চারদিকে, আমি তবু সোয়েটারহীন
কাছারিবস্তির উত্তাপ সম্বল করে বাঁচি
আর উপরের আস্তাবল কী অবাক প্ৰভাময় হয়
ফাঁসিবাজারে গেলে আমার গা ছমছম করে
সুরম্য বিপণিগুলিতে কত যে ঝুলে আছে শব
ফাঁসির মড়া সেসব
ফ্যাকাশে আঙুল, ঝুলে পড়া জিহ্বা, চোখ অপলক
শুধু নরকাসুর পাহাড়ে কার যেন প্ৰসববেদনা শুনি
একটি উজ্জ্বল তারা ঝুলে আছে চূড়ার নিকটে
সেই তারা দেখে দেখে হাঁটি, দিক ঠিক করি
তখন পাদদেশে কোন-এক সত্ৰে ভাওনা শুরু হয়
ওই যে করতাল বাজে, ওই যে বাজে মহাখোল
তখন মড়াগুলি নড়েচড়ে উঠেছে চারদিকে
দিব্য আলো খুব নড়েচড়ে, নড়েচড়ে একখানি শিশুহাত
আমি এক একা
বন্ধু নেই, প্ৰেম নেই, গ্ৰাম নেই, প্ৰাণ নেই
কাছারিবস্তি ছাড়া আর কোনও উত্তাপ নেই
সেঁকা শুয়োর, টকে ওঠা পচাইয়ের গন্ধে মাখা দিন
হাজিরাশ্ৰমিকের এক রাত্ৰি জাগরণ
আমি আমার মৃতদেহ পাহারা দিতে থাকি
যদি প্ৰাণ আসে ফের...
আশা তবে আজও আছে কণ্ঠে লেগে থাকা ফাঁসে
যদি প্ৰাণ আসে, যদি প্ৰাণ আসে...
ডিফু থেকে আসা কুষ্ঠরোগী গাইছে
আজান ফকির
বারাবাঁকি থেকে আসা বুড়ো ঠেলাওলার সাথে
গল্প করি
ভুরাগাঁও থেকে আসা প্ৰৌঢ় কামলার সাথে
কথা বলি
ভাওনা ফুরোলে আগুন পোহায় হাজিরাশিল্পীরা
তাদের সঙ্গী হয়ে সেঁকি মৃতশরীর
ওষুধ বেচতে এসেছে বেদে ও বেদেনিরা
তাদের তাঁবুর কাছে কাছে প্ৰাণভিক্ষা করি
কিশোর শাকওলার কাছে প্ৰাণভিক্ষা করি
ঠকঠক ঠকঠক চাদর বুনছে যে কাৰ্বিকুমারী
সকলেই আমার মতন, ঝুলে থাকা শব
যারা বেঁচে আছে তারা আমাদের দেখেও দেখে না
ছায়া ছায়া
কাছারিবস্তির এই কজন যেন ছায়া ছায়া
নগরের রাজপথে আমাদের ছায়াটি পড়ে না
যখন বোমা ফাটে
যখন গুলি চলে
যখন লাঠিচাৰ্জ হয়
আমাদের ফের মৃত্যু হয়
গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মজীবনী তখন ছটফট করে
৪.
বিকাশের সাথে রোজ দেখা হয়
সে কিছু বলে, সে কিছু শোনে
সে বলে শোকের কথা, আনন্দের কথা আমি বলি
আমার পকেটে ছিল রোদ, আমি তাকে দিতে চাই
সে আমাকে ঠোঙা ঝেড়ে দেয়
কিছুটা পাহাড় আর কিছুটা সাগর
আমরা দুজনে বানাতে থাকি এক প্ৰবালের ঘর
তারপর ঝড়বৃষ্টিবজ্ৰপাত আমাদের ঘর ভাসে বানে
ঘিলু থেকে কত ঢেউ সংগোপনে ঢুকে যায়
আমাদের প্ৰাণে
আমি কি বিকাশ? নাকি তার ছায়া?
এইসব ভাবি
মায়াবি এইসব রূপকথাগুলি ব্ৰাত্য যত
জাদুহাবিজাবি
কেন শুধু ঝুলে থাকে নক্ষত্ৰপুঞ্জ থেকে
থুতুমাখা দড়ি
কেন আজ খুলে যায় যাকে আমি অন্ধরাতে
ছানাছানি করি
আমারই ছায়াকে আমি ছানি শুধু, চুষে খাই
ছায়াটির জিভ
আমি কি বিকাশ, নাকি ভিনগ্ৰহী কোনো
নক্ষত্ৰের জীব¯
সবে তো কামরাঙারং হয়েছে আজকের আলো
শিউলিও আজ যেন গন্ধ ছড়াল
হিম পড়েছিল; পড়ে ছিল তারা কলমিপাতায়
সেখানে হাওয়া এসে মিতালি পাতায়
ঝোরাটির সাথে
বিকাশ নিবিড় হবে ঢলে পড়া বিকাশের রাতে
এখন আলোটি আসে মরে
মোষের গাড়িখানা ভরা হল সোনারঙ খড়ে
ভেসে আসে গেঁয়োগুৰ্বো পাখিদের ভাওয়াইয়া গান
ফাঁসির মড়ার ভিতর যেন জেগে ওঠে প্ৰাণ
ওরে ও পাখির দল তোদের কাছে ঋণী
ওরে ও বৃক্ষকাতার তোদের কাছে ঋণী
ওরে ও অমল ঝোরা তোদের কাছে ঋণী
ওরে ও মুখর গান তোদের কাছে ঋণী
তোদের কাছেই প্ৰাণভিক্ষা করে যায় আমার জীবনী