একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (১৫)
সুখের মাঝে চোরা দুঃখ
সারা রাস্তা রেখা শুধুমাত্র সোমদত্তার কার্যকলাপ নিয়ে ভেবে আসছিল, আরো ভেবে একসার হচ্ছিল পার্থ এমন কি করেছে ,যার জন্য তাদের সাত বছরের সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, তাসের ঘরের মতো। মেয়েরা তো সবকিছু মানিয়ে নেয়। সোমদত্তা অন্তত ছেলেটির কথা চিন্তা করে তো পারতো ,সংসার টিকিয়ে রাখতে। পার্থর চোখের জল দেখে তো মনে হচ্ছে না ,যে পার্থর ভেতরে এমন কিছু অপরাধবোধ আছে; যার জন্য সোমদত্তা ওকে ছেড়ে দিচ্ছে। ওর চোখের অভিব্যক্তি দেখে তো বোঝা যাচ্ছে সোমদত্তাকে কতটা ভালবাসে। চোখ বুজে এই ভাবনাগুলোই রেখাকে কুকুর তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। মনোজ রেখাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল 'রেখা নাও নেমে পড়ো ।বাড়ি এসে গেছ।'
রেখা বলল 'ও এসে গেছি ।চলো।'
মনোজ বলল ''তুমি যাও। তোমাকে আজ খাবার করতে হবে না ।আমি হোম ডেলিভারি অর্ডার দিচ্ছি ।এসে দিয়ে যাবে। কি খাবে বল? বিরিয়ানি অর্ডার দেব?
রেখা বলল 'আমি কিছু জানি না। যা ভালো বোঝো তাই করো। '
মনোজ বলল তুমি বিরিয়ানি খেতে ভালোবাসো তো। তাই দুটো মটন বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে দিলাম সোনা। আর শোনো কোন ঘরের কাজ এখন তোমায় করতে হবে না। কালকে আমি ছুটি নিয়ে পুটুর বাড়িতে যাব । ও যদি কাজে না আসে তাহলে, অন্য ব্যবস্থা করে আসব ।ঠিক আছে। তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে পারলে একবার রিম্পাদিকে ফোন করে নাও ।এতবার করে ফোন করেছে তো ,খারাপ দেখায়।'
রেখা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।'সত্যি মনোজ খুব কেয়ারি।এজন্যই তো কখনো রেখা অন্য কোন কিছু ভাবতে পারে নি ।জীবনে তো তার কম প্রপোজাল আসে নি ।কি বিয়ের আগে, কি পরে। হ্যাঁ মনোজের ভেতরেও কিছু নেগেটিভ গুন আছে কিন্তু ওর যা পজিটিভ গুন আছে তাতে সব ঢাকা পড়ে যায়। আর তাছাড়া এটাই তো জীবনে বড় জিনিস যে মানিয়ে নেওয়া।'এত অবসাদ এত ক্লান্তি তার পরেও মনোজের দিকে হেসে তাকিয়ে রেখা ঘরে ঢুকে গেল।
মনোজ পার্থকে ডেকে বলল ' কত দিতে হবে?'
পার্থ বলল ' আপনি তো জানেন দাদা। দিন না ।আপনাদের সঙ্গে কোন অসুবিধা হয়েছে কোন ব্যাপারে।'
মনোজ হেসে বলল 'আচ্ছা ,ঠিক আছে। রাখ । বলে ভাড়া মিটিয়ে দেয় ।
পার্থ হেসে বলে ' দাদা ,বৌদির কোন অসুবিধা হয় নি তো রাস্তায় ?আসলে নতুন ড্রাইভার ছিল তো আর বৌদি বরাবর হাদুর গাড়িতে যাতায়াত করেছে ।ফলে বৌদি একটু ভয় পাচ্ছিল ।'
মনোজ ব্যাঘ্র ভাবে বলল 'না, না ।কোন অসুবিধা হয় নি ।খুব ভালো ড্রাইভার।ঠিক আছে অনেক উপকার করেছ পার্থ ভাই।'
পার্থ বলল 'না ঠিক আছে দাদা ।এটা তো আমাদের ডিউটি।'
মনোজ পার্থর হাতে হাত রেখে বলল 'ঠিক আছে পার্থ ।অন্য সময় এসো। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই কেমন।তোমার কিন্তু চা পাওনা রইল।'
পার্থ হেসে বলল 'ঠিক আছে দাদা ।আসুন।'
মনোজ ঘরে ঢুকেই রেখা ,রেখা ..খা.আ..আ ডাকতে লাগল।
বাথরুম থেকে রেখা সাড়া দিলো 'কি বলছ..? '
মনোজ বলল 'ও আচ্ছা ,ঠিক আছে ।আজকে স্পেশাল কফিটা আমি বানাবো তোমাকে করতে হবে না।'
রেখা বলল ' কেন তুমিও তো টায়ার্ড না? '
মনোজ বলল 'ঠিক আছে। আজকে আমি করি না ? আজ কফি খেতে খেতে গল্প করবো ।মনে হচ্ছে যেন তোমার সঙ্গে বসে গল্প করি।'
রেখা বাথরুম থেকেই সাড়া দিলো ' ঠিক আছে।'ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রেখা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এসে বলল 'তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও ।আমি সন্ধ্যেটা দিয়ে দিই।'
মনোজ বললো 'ওকে ম্যাম। জো হুকুম (চিবুক ধরে)।
রেখা হেসে ফেলল আর বলল 'যাও যাও যাও।'
মনোজ বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল ' একটা কথা বলবো রেখা ?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ।বলো না ,কি বলবে?
মনোজ'বলল 'তুমি কখনও সমুর মতো বলবে না তো ,আমাকে ছেড়ে দেবে? '
রেখা অবাক ও জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল 'এমনি মন মেজাজ ভালো নেই ।তার মধ্যে তুমি অলক্ষুনে কথা কেন বলছ? '
মনোজ বলল 'না চিন্তা হয়।'
রেখা বললো 'যদি তাই হয়। তুমি নতুন করে নিজের জীবনটাকে সাজাবে ।তুমি অন্যের জন্য কেন নিজের জীবনটাকে স্যাক্রিফাইস করবে?'
মনোজ কেমন অবাক হয়ে যায়। সে ভাবতে পারে নি এ ধরনের কোনো কথা শুনবে। বলে-' না ,না ,রেখা ।আমার জীবনে একজন ই রেখাপাত করেছে ।সেটা তুমি ভালোই জানো। আমার মাথায় হাত রেখে বলো কখনো এসব কথা বলবে না । একদম কাছে গিয়ে মনোজ রেখার হাত দুটি ধরে হাঁটুগেড়ে মিনতি জানায়।'
রেখা বলল 'বাহ রে ,আমি কোথায় বলতে গেলাম। তুমি বললে, তাই বললাম। আর আমাকে কি পাগলা কুকুরে কামড়েছে? '
মনোজ বলে 'আসলে সমাজ ,পরিস্থিতি, সময়,মন, মানুষকে কোথায় কখন নিয়ে যায় কে বলতে পারে বল রেখা ? আরও বলল যে সমুর কথা কখনো ভাবতে পেরেছ?'
রেখা একটু রেগে গিয়ে বলল 'ওর মতো বাজে মেয়ের কথা ছাড়ো।নিজের বোন বলে নয় ,সত্যিই চিরকাল এমন কি আমার সঙ্গে হিংসে করে এসেছে। কাকু কাকিমা আমাকে একটু ভালবাসত বলে। যাও আমার সন্ধ্যে দিতে দেরি হয়ে যাবে। তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।' সদ্য স্নান করে রেখার চুলে তখনো জলটা লেগে রয়েছে ।একটা অসাধারণ তৃপ্তি, স্নিগ্ধ ভাব ওর মুখে মুখে চলে যাওয়ার সময় জলের ছিটে মনোজের চোখে মুখে ছড়িয়ে গেল । এখনো যেন আগের মতো পাগল হয়ে যায়।আর যতবার দেখে ততবার রেখাকে মনে হয় যেন , ওকে নতুন করে আবিষ্কার করে।এই দুটো দিন বাড়িতে না থাকার জন্য যেন মনে হচ্ছে কত যুগ রেখাকে দেখে নি ।কেন হয় যে ওর এরকম তার সে জানে না ,ভাবতে ভাবতে মনোজ বাথরুমে চলে যায়। ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে ব্ল্যাক কফি করে নিয়ে আসে ।তখন রেখা ঠাকুর ঘর থেকে সদ্য পুজো করে বেরিয়েছে ।ওকে হাত দুটো ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে কাপটা সামনে ধরে।'
রেখা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্য ।এই কফির গন্ধে যেন মাথা ধরা ছেড়ে গেল সে thanks জানাল।
মনোজ বলল ' এত ফরমালিটি কেন?'তখন হেসে বলে না না না সরি লটস অফ লাভ। ক্ষণিকের জন্য যেন কেমন হয়ে গেল রেখাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিল বলল এই ভালোবাসা থাকুক নিরন্তর তোমার আমার জন্য ,বলে গাল দুটো টিপে দিল আর নাকে নাক ঘষে দিল। রেখাও যেন কেমন হয়ে গেল ও যে অবসাদ, ক্লান্তি ,অনুভব করছিল এক নিমিষে মনোজ সবকিছু যেন দূরে সরিয়ে দিল। মনোজ রেখাকে আদর করে বারবার ডাকতে লাগলো আর চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল। মনোজ যেন অনুভব করে রেখার পা গরম হয়ে উঠছে ,হাত উষ্ণ।মনোজের ভেতরে যেন আরো ব্যাকুলতা বেড়ে যায়। তার শুধু মনে হয় সে রেখাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় সুখের সাগরে। যেখানে তারা দুজন সাঁতার কাটবে। এমনি সময়ে আবার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই ভেসে আসে রিম্পাদির গলা'রেখা তুই ঠিক আছিস?
'হ্যাঁ রিম্পাদি 'রেখা বলে।
রিম্পাদি বলে ' যাক তাও ভাল। কি করছিলি ?তার আগে কতবার তোকে ফোন করেছি। তুই তো জানিস তোর গলা শুনতে না পারলে আমার ভালো লাগে না।
সত্যিই যে বিষাদ যে দুশ্চিন্তা তার মনকে গ্রাস করেছিল ।সেজন্যেই সে রিম্পাদির ফোনটা রিসিভ করে নি।।এখন যেন সে একটা আলাদা সুখ অনুভব করছে সেই মানুষটির জন্য। তার স্বামী মনোজ সেই পারে রেখাকে আদরে যত্নে সোহাগে তাকে ভরিয়ে দিতে।
রিম্পা দি আবার বলে কিরে তুই বেশি কথা বলছিস না?
রেখা অনুভব করে আর জন্মে রিম্পাদি যেন রেখার দিদি ছিল। তা না হলে এই আত্মিক সম্পর্ক কখনো গড়ে উঠত না। তাই রিম্পা দি চলে যাওয়ার ঘটনাটা তাকে সুখের মাঝেও বড্ড পীড়া দেয়। রেখার জীবনের সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সর্বদাই তার ভয় যাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে উঠতে থাকতে চেয়েছে, তারা সবাই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। এখন চলে যাবে রিম্পা দি। ভাবতেই রেখার চোখে জল চলে আসলো সে চোখ মুছে নিল তারপর বলল 'তোমাকে পরে সব বলব।
রিম্পাদি ।ঠিক আছে ভালো থাকিস ফোন রাখছি।
বুক জোড়ায় অশান্ত অন্ধ সংগ্রাম যেন রেখাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। রেখা ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো এতক্ষণ ধরে তার যে কান্নার বাদ চেপে রেখেছিল সেই বাঁধ ভেঙে যেন কান্না ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে টেবিলে মাথা রেখে সে প্রায় কেঁদে উঠলো। ওদিকে মনোজ এসে রেখাকে বলল ' কি হয়েছে রেখা? তুমি আমার সঙ্গে শেয়ার করো।রেখা উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে যতটুকু আকাশ দেখা যায় সেটুকু দেখার চেষ্টা করছিল তার মনে হয়েছিল আজকের আকাশে যেন দীপ্তিময়ী নয়। রেখার চোখ ভিজে ।হঠাৎ মনোজ এসে তাকে কাছে টেনে নিল ।রেখা ঝাঁপিয়ে পড়ে মনোজের বুকের উপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।সোমদত্তাকে নিয়ে যে ঝড় উঠেছে সেই ঝড়ে এক পশলা বৃষ্টি কি পার্থর জীবনটাকে ভিজিয়ে দেবে? রুক্ষ শুষ্ক প্রাণ কি আবার সজীব হয়ে উঠবে? আশেপাশের যারা আছে. তারা কি সেই আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে পারবে?তার সুখের মাঝে চোরা দুঃখ কি এভাবেই থেকে যাবে?
অলঙ্করণ : সানি সরকার
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৫ ক্রমশ