ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯২)
শামীমা আহমেদ
এক অনিশ্চয়তার বাতাবরনে মোড়ানো শিহাব, শায়লাকে পাওয়া না পাওয়ার দোলাচলে বাইক নিয়ে এগিয়ে চলছে।
কেবলমাত্র রাস্তার দুপাশের নিয়ন বাতিকে লক্ষ্য করে বাইক ছুটে চলছে। তার কাছে চারপাশের আর সব কিছু অদৃশ্যমান হয়ে আছে। ট্রাফিক সিগন্যালের বাতিগুলো মাঝে মাঝে চলার গতিতে ছেদ ঘটাচ্ছে। রাত বাড়ছে।পথে যানজট তীব্র হচ্ছে।সবারই গন্তব্যে ফেরার তাড়া। কারো জন্য ঘর,ঘরের মানুষজন উন্মুক্ত হয়ে অপেক্ষায় কেউবা নিদির্ষট সময়ের মধ্যে মালামাল পৌঁছে দেয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধে যানবাহনে গতি বাড়িয়ে দেয়া। শিহাব জানেনা কার উদ্দেশ্যে তার ছুটে চলা,সে জানেনা তার ভবিতব্য। এই রাতের শহরে কেবল শায়লার জন্য হৃদয়ে ভালবাসা সম্বল করে একটা স্বপ্নের বাস্তবায়নে উর্ধ্বশ্বাসে এগিয়ে যাওয়া। শিহাব বুঝতে পারছে শায়লাকে তার পরিবারের সন্মান রাখতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব করতে হচ্ছে। তবুও শিহাবের কোথায় যেন শায়লার প্রতি একটা ভরসা। তার বিশ্বাস, শায়লা তাকে ছাড়া আর কাউকে গ্রহন করবে না। কিন্তু কিভাবে শায়লা নিজেকে এর থেকে বের করে আনবে। আজ সকালে শায়লার চোখের ভাষায় বিনা প্রশ্নে সে শিহাবের কাছে চলে আসার জন্য তৈরি ছিল। কিন্তু কি করে যে কি হয়ে গেলো ! সবই বিধাতার বেঁধে দেয়া বিধিলিপিতে এগিয়ে চলছে।শিহাব মনকে শান্ত করে বাইকের চলায় মনযোগী হলো। সে আজমপুর দিয়ে উত্তরায় ঢুকলো। শায়লাদের বাসা সেক্টর সাতের রোড ক্রস করতে গিয়ে তার মনটা ভেতরে ভেঙে চুড়ে যাচ্ছিল।নিজেকে সামাল নিয়ে সে সোজা একটানে নিজের বাসার দিকে এগিয়ে গেলো।
এদিকে রাহাত বিয়ে বাড়ির সব আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছে। শায়লার ঘর কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিয়ের বাসরঘর যেমন করে সাজানো হয়। বাড়ির ভেতরের মানুষ যেমনি বিয়ে বাড়ির আমেজ ধরে রেখেছে তেমনি বাইরে থেকে দেখে লোকজন বুঝবে এই বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান চলমান। তবে বুবলীর মাধ্যমে কোন সমাধান করতে না পেরে রাহাত নিজেই এবার শায়লার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলো।রাহাত ভেবে নিলো, আপু যতই অনীহা দেখাক না কেনো রাহাত তা উপেক্ষা করে আপুর কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে নিবে। শিহাব ভাইয়াকে কল করে আপু যেন তাকে বাসায় থাকতে বলে।রাহাত নিজে গিয়ে শিহাব ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে নিয়ে আসবে।রাহাত শায়লার ঘরের বদ্ধ দরজায় নক করতে বুবলী দরজা খুলে দিলো। রাহাত শায়লার ঘরটিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। কিন্তু সেখানে আপুর এমন মলিন মুখ দেখে রাহাতের মনটা ব্যথায় ভরে উঠলো। সে সরাসরি শায়লার হাত ধরে তার ভুলের জন্য, আপু যেন ক্ষমা করে দেয়,তার অনুরোধ করে গেলো। ছোট ভাইয়ের এমন অনুনয়ে শায়লা প্রথমে কঠোর থাকলেও কিছু সময় পর বোনের মন গলে একেবারে কাদা হয়ে গেলো।কতইনা আদরের এই ভাইটা! তার জন্য শায়লা আর আবেগ ধরে রাখতে পারলো না। শায়লার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। বারংবার শিহাবের কাছে ক্ষমা চাওয়ার উত্তরে এবার শায়লা ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। বুবলী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক ! ভাইবোনের মান অভিমান ঘুচলো। কিন্তু শায়লার একটাই কথা আমি শিহাবকে আসতে বলতে পারবো না সেটা তোমাদের দ্বায়িত্ব। আজ কানাডার অতিথি আসেনি বলে তোমরা তার খোঁজ করছো। তোমাদের ভুলের মাশুল তোমাদেরই দিতে হবে। শায়লার সম্মতিতে শিহাব এক লাফে রাজী হয়ে গেলো। রাহাত তক্ষু্ণি শিহাবকে ফোন করতে উদ্যত হলো। রাহাত তার মোবাইল আনতে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।
রাত সাড়ে দশটার দিকে শিহাব নিজের বাসার গেটে এসে গেট খোলার জন্য প্রতিদিনের অভ্যাসমত জোরে হর্ণ বাজাতেই দেখলো,পুরো দরজাটাই খোলা। বাসায় গাড়ির যাতায়াত। অচেনা মানুষজনের আসা যাওয়া।চকচকে উজ্জল পোষাকের অতিথি, নারী পুরুষ শিশু বাসায় প্রবেশ করছে। শিহাব সাবধানতায় বেশ জোরে হর্ণ বাজিয়ে বাসায় তার বাইক ঢোকালো। স্টার্ট বন্ধ করে হেলমেট খুলতেই কেয়ারটেকার বিল্লাল শিহাবের দিকে এগিয়ে এলো। শিহাবের ফ্ল্যাটের চাবি হাতে নিয়ে কাছে এলো। শিহাবের মনেও একটা জিজ্ঞাসা, আজ বাড়িতে এত লোকজন ! কোন উৎসব আয়োজন নাকি ?
বিল্লাল শিহাবকে জানালো, স্যার, আজ দোতালার অপুর আম্মু ম্যাডাম আর হাসান স্যারের বিয়া বার্ষিকী। অনেক মেহমান আসতাছে। বাসায় অনেক আয়োজন হইছে।
অনেক খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হইছে। আমারেও দাওয়াত দিছে। ডিউটি শেষ কইরা যামু।
শিহাব মনে মনে ভাবলো, মানুষ তার প্রিয় মানুষকে বিয়ে করে আবার কত ধুমধামে বিয়ে বার্ষিকীও করে। আর তার জীবনে সবটাই ধোয়াশা হয়ে থাকে। ধরা দিয়েও নিষ্ঠুরের মত তাকে একা করে যায়। শিহাবের মনে শায়লার মুখটা ভেসে উঠলো। সে অভিমানে অনুযোগে নিজের কাছে নিজেই জানতে চাইলো, কই সন্ধ্যা থেকে শায়লা তো তাকে একটা কলও করলো না ? সারাদিন আরাফের একটা খোঁজও নিলো না।বিদেশি অতিথিকে পেয়ে তাকে ভুলেই গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো, এ আমি কি ভাবছি? শায়লা কখনোই তাকে ছাড়া কাউকে গ্রহন করবে না। শিহাবের নীরবতায় বিল্লাল বললো, স্যার কিছু ভাবতাছেন ? উনারা আপনারেও দাওয়াত করতে চাইছে। কিন্তু যতবারই আপনার বাসায় গেছে ততবারই তালা দেওয়া পাইছে। তাইতো আমারে বইলা রাখছে, আপনি আইলেই য্যান তাদের খবর দেই। স্যার আমি তাদের জানাইয়া আসি।বিল্লাল এগিয়ে যেতে উদ্যত হতেই শিহাব তাকে থামিয়ে দিলো। শিহাব বললো,না বিল্লাল, তাদের এখন আর জানিও না। আমি খুবই ক্লান্ত।আমি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিবো। ওদের জানিও না। বিল্লাল দেখলো, সত্যিই স্যাররে খুব ক্লান্ত লাগতাছে। কিন্তু সেতো শুধু বাইরেটা দেখছে। শিহাবের ভেতরটা যে ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে সেতো সেটার টের পাচ্ছে না। শিহাব হাতে হেলমেট,বাইক আর ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে এগিয়ে গেলো। লিফটে অতিথিদের যাতায়াত চলছে। শিহাব তাই লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
দোতালায় অপুদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল। শিহাব দোতালার সিঁড়িতে উঠতেই দেখলো,দরজায় অপুর বাবা হাসান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ সুটেড বুটেড পোশাকে উৎসব আমেজে যেন শিহাবের জন্যই অপেক্ষা। ভেতর থেকে অতিথিদের আলাপচারিতার শব্দ, সাথে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। শিহাব ভদ্রতাবশতঃ হাসান সাহেবের প্রতি সালাম জানাতেই হাসান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শিহাব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে নিলো। হাসান সাহেব শিহাবকে বাসায় ঢুকতে অনুরোধ করলো। শিহাব বিনীতভাবে বললো, আজ নয়,অন্য দিন, আরেকদিন, বলেই সে ছুটে যেতে চাইলো। কিন্তু হাসান সাহেবের অনুরোধ, আজ আমাদের একটি বিশেষ দিন, এমনতো সবদিন হবে না। আপনার ভাবী আপনাকে দাওয়াত করতে বেশ কয়েকবার গিয়ে দরজায় তালা পেয়ে ফিরে এসেছে।চাইলে ফোনে বলতে পারতাম সেটা ঠিক সুন্দর দেখাতো না৷ তাইতো আপনার বাসায় ফেরার বাইকের শব্দ পেয়েই দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি।প্লিজ,কিছু মনে করবেন না, আজ আমাদের সাথেই ডিনার করুন। হাসান সাহেব শিহাবকে অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। শিহাব দেখলো,হাসান সাহেব কথা বলতে থাকলে তার ঠিক পাশে হলেও হাসান সাহেবের পিছনে নিজেকে একটু আড়াল করে গাঢ় বেগুনি রঙের ঝলমলে শাড়িতে একটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো। তার বড় বড় চোখ দিয়ে আড়াল থেকে শিহাবের দিকে দৃষ্টি রাখলো। হাসান সাহেব তখনো শিহাবের হাত ধরেই রেখেছেন। মেয়েটি আসার টের পেয়েই হাসান সাহেব বললেন, ও আমার শ্যালিকা, নাম চৈতী। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ছে।প্রায় শেষের দিকে । বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছে । ওরা দুই বোন।শিহাব বুঝতে পারছে না,হাসান সাহেব মেয়েটি সম্পর্কে কেন এতকিছু বলছেন। শিহাব সৌজন্যতা দেখিয়ে, ও আচ্ছা,ও আচ্ছা, বলে ছুটতে চাইলো। এবার শিহাব সারাদিন তার উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুটা বলে হাসান সাহেবের কাছ থেকে ছুটতে চাইলো।
দেখুন, আমি সারাদিন হাসপাতালে ছিলাম। আমার পরিবারের খুব কাছের একজন অসুস্থ। আমি সেই সকালে বেরিয়েছি। আমি খুবই ক্লান্ত এবং মানসিকভাবে আপসেট আছি।আমার বাসায় ফিরে রেস্ট নিতে হবে।
এবার হাসান সাহেব শিহাবের মনের অবস্থা বুঝলেন। যদিও শিহাব শায়লার প্রসংগে কিছুই বলেনি।
ঠিক আছে, আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন। আমি অতিথি বিদায় করে আপনার সাথে দেখা করে আসবো।শিহাব আচ্ছা,ধন্যবাদ, জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। সিঁড়ির বাঁক ঘুরে উপরের সিঁড়িতে উঠতেই শিহাব দেখলো, বেগুনি রঙের শাড়ি পরা মেয়েটি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। এবং স্থির দৃষ্টিতে শিহাবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শিহাব তার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেলো।
রাহাত বেশ আগ্রহ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে মোবাইল আনতে গেলেও বারবার কল করেও শিহাবের কোন সাড়া পাচ্ছে না। বারবার একই উত্তর আসছে।মোবাইলটি বন্ধ আছে । রাহাতের ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। তবে কি অভিমান করে শিহাব ভাইয়া মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে ? আপুর কাছে নিশ্চয়ই কানাডা থেকে নোমান ভাইয়া আসবার খবর জেনেছে । রাহাত বুঝতে পারছে না এখন সে কি করবে ? কিভাবে শিহাব ভাইয়ার ভুল ভাঙাবে। শিহাব ভাইয়ার বাসাওতো সে চেনে না। রাহাত নিজের ভুলে আজ নিজেই এমন বিপদে পড়েছে। নিজের উপর তার রাগ হচ্ছে।নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বুবলী উৎকন্ঠিত হয়ে রাহাতের কাছে শিহাবের রেস্পন্স জানতে চাইছে। কোন সাড়া না মেলাতে সে হতাশ হয়ে যাচ্ছে। বারবার এ ঘর ও ঘর করছে । বাড়ির অতিথিরা বহাল তবিয়তে চলাচল করছে। তারা বুঝতেও পারছে না ভেতরে কি ঘটে যাচ্ছে।
শিহাব চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই ঘরের ভেতরের অন্ধকার এক বিশালতা তাকে গ্রাস করলো।একটি ব্যথিত ভাঙা মন নিয়ে শিহাব ঘরে প্রবেশ করলো।শায়লার কথা মনে পড়তেই শিহাবের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। অজান্তেই তার চোখ দুটো জলে ভরে গেলো।ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে সারারাত একাকীত্বের দুঃসহ অনুভবে কাটাতে হবে, এমনি ভাবনায় মনটা ভারী হয়ে উঠলো। ড্রইং রুমের বাতি জ্বালিয়ে সে বেড রুমে ঢুকলো। খাটের সাইড টেবিলে হাত থেকে বাইকের চাবি হেলমেট আর মোবাইল নামিয়ে রাখলো। তার ঘরটি শুন্য। আজ শিহাবের ঘরে শায়লাকে নিয়ে আসবে এমনটি আশা নিয়েই সকালে বেরিয়েছিল। নিয়তি সেটা হতে দেয়নি। যদি শায়লার স্বামী তার জোর দাবী খাটিয়ে শায়লাকে তার করে নেয় তবেতো তার আর কোন আশাই থাকবে না সবরকম দুরাশায় তার
মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।
শিহাবের কাপড় বদলাতেও ইচ্ছে করছে না।কিন্তু সারাটাদিন এক কাপড়ে।নিজের দিকে তাকিয়ে শিহাব ভাবলো তার চেঞ্জ দরকার।সে অনিচ্ছাতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজেকে ফ্রেশ করে শিহাব বেডরুমে দাঁড়াতেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। শিহাব দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাত সাড়ে এগারোটা। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো বিশাল এক ট্রে নিয়ে বিল্লাল দাঁড়িয়ে। নানান খাবারে ভরপুর করে ট্রে সাজিয়ে হাসান সাহেব মুখে একরাশ হাসির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে আসতে পারি ? বলেই হাসান সাহেব তার এক পা শিহাবের ঘরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। শিহাব বুঝতে পারলো, আজ মনে হয় আর এর হাত থেকে তার নিস্তার নেই।
চলবে....