উপন্যাস
টানাপোড়েন৯৮
দুঃসহ আঠারো বছর
মমতা রায়চৌধুরী
নদী অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে মায়ের কেবিনের দিকে তাকিয়েছিল, কখন ডাক্তারবাবু বেরোবেন একটা মনের ভেতরে অশান্ত উদগ্রীব কাজ করছিল । তবে যাই করে থাকুন না কেন মায়ের এই কন্ডিশনে উনি তো পাশে আছেন ।আজকে আর কোনো বিরক্তি, ঘৃণা কিছুই নেই ,লোকটার প্রতি ।আজকে শুধু মনের ভেতরে একটাই প্রতিক্রিয়া তার মায়ের সুস্থ হওয়া।
হঠাৎই ডাক্তারবাবুর কথা কানে আসলো মিস্টার মালহোত্রা জিজ্ঞেস করলেন 'কী বুঝছেন ডাক্তারবাবু?'
ডাক্তারবাবু বললেন 'আপনাদের তো আগেও বলেছিলাম যে ঠিক আছে, উনাকে এখন টেনশন মুক্ত রাখুন ।কোন অবস্থাতেই যেন কোনো টেনশন না কাজ করে ,হাসি খুশিতে রাখুন আর আমরা তো নার্সিংহোমে রয়েছি..।'
মিস্টার মালহোত্রা বললেন ' এবার কী আমরা ভেতরে ঢুকতে পারি?'
ডাক্তারবাবু বললেন 'অবশ্যই পারেন তবে এক সঙ্গে কেউ জটলা করবেন না?'
মালহোত্রা বলেন' থ্যাংক ইউ ডাক্তারবাবু।'
মিস্টার মালহোত্রা ডাক্তার বাবুর সঙ্গে কথা বলার পর প্রথমে তিনিই এগোতে লাগলেন মায়ের কেবিনের দিকে।
নদী সব দেখতে লাগল। কিন্তু আজ যেন নদী প্রতিবাদ করতে পারলো না ।নদীর প্রতিবাদী হওয়া উচিত ছিল ,সেই প্রথম মায়ের কাছে যাবে বলে ।কিন্তু আজকে সমস্ত বিরক্তি, রাগ , দ্বেষ, ঘৃণা, আক্রোশ, কোথায় ধুলিস্যাৎ হলো ?শুধু মনের ভেতরে রয়ে গেল মায়ের জন্য শুভকামনা।'
মিস্টার মালহোত্রা কেবিনে একা ঢুকেছেন ।মায়ের সঙ্গে কি কথা হচ্ছে ,নদী সেসব ভাবতেই চাইল না।
তারপর নদীর বন্ধুরা বলল' হ্যাঁ রে, নদী ,আমরা তাহলে চলি । আন্টি তো আগের থেকে ঠিক আছেন। কালকে খোঁজ নেব কেমন থাকেন না থাকেন।
বন্ধুরা সবাই বলল' 'প্রয়োজন হলে ডাকিস কেমন, কোন দ্বিধা করিস না?'
এরমধ্যে বন্ধুরা ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো, যেটা নদীর কানে আসলো ।
রথীন বলল ' হ্যাঁ রে মালটা কে রে আন্টির কেবিনে ঢুকলো?'
তীর্থ বলল 'আরে বাবা, আন্টি যে অফিসে কাজ করেন ,সেই অফিসের বস।'
প্রত্যেকে কেমন যেন একটা আলাদা ইঙ্গিতে হেসে উঠলো। সমুদ্র অবশ্য ওদের কথায় কোন রেসপন্স করে নি।
নদীর কানটা যেন গরম হয়ে উঠলো কথাগুলো শুনে কিন্তু তারপরও নদী যেন কেমন নিষ্প্রাণ,নির্বাক হয়ে রইল। তার ভেতর থেকে যেন কোন কথা বের হয়ে আসলো না।
রথীন তীর্থ সবাই সমুদ্রকে বলল 'কিরে তুই কি এখনো তীর্থের কাকের মত বসে থাকবি?'
সমুদ্র কি বলতে যাবে তার আগেই রথীন বলে উঠলো 'না না তুই একটু থাক। আমরা এগোতে থাকি ।একটা অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো।'
নদীর এ কথাগুলো হজম করতে বেশ সময় লাগলো।
সমুদ্র রথীনদের উদ্দেশ্যে বলল 'আমিও তো যাবো ,ওয়েট কর না একটু।'
সমুদ্র নদীকে বলল 'আমি চলে যাব নদী ,নাকি থাকবো ?
তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব?'
নদীর মনে মনে তার বন্ধুদের কথা ভাবছিল এরা তার প্রকৃত বন্ধু না। এরা প্রকৃত বন্ধু হতে পারে
না ।সাময়িক হতে পারে। যদিও সমুদ্র ওদের থেকে অনেকটাই আলাদা। সমুদ্রর খামখেয়ালিপনা রয়েছে ভেতরে। মাঝে মাঝে বড্ড
ছেলে মানুষি কাজ করে ফেলে সমুদ্র।
নদী শুধু একটুখানি হাসল সমুদ্রের প্রতি আর মনে মনে ভাবল,তবু সমুদ্রের ভেতরে একটা সরলতা আছে।
নদী শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ।
এর মধ্যেই ঝরনা মাসি বলে ওঠে' মামনি ,মামনি , আমরা কিসে ফিরব?
নদী কেমন অবাক হয়ে যায় ।কিসে ফিরবে মানে, অ্যাম্বুলেন্সে এসেছিলে তো?
ঝর্ণা বললো' হ্যাঁ?
নদী বলল 'হয় কোন ট্যাক্সি ধরব, না হলে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে যেতে হবে।'
এরমধ্যে মিস্টার মালহোত্রা বেড়িয়ে আসলেন।
মিস্টার মালহোত্রা বললেন 'নদী তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে?'
নদী শুধু ঘাড় নেড়ে তার মতামত জানাল।
মিস্টার মালহোত্রা বলল ' ঠিক আছে যাও। তুমি গিয়ে তোমার মাকে দেখে এস আর তোমাদের বাড়ি ফেরার জন্য একটা গাড়ি বলে দিচ্ছি কেমন?'
নদী শুধু ঘাড় নাড়লো আরেকটু ম্লান হাসলো।
মিস্টার মালহোত্রা বেরিয়ে গেলেন যাওয়ার সময় ঝর্নাকে বলে গেলেন আপনাদের জন্য গাড়ি ওয়েট
করবে। আপনারা বাড়িতে চলে যাবেন।'
ঝরনাও ঘাড় নাড়লো
মিটার মালহোত্রা চলে যাওয়ার দিকে ঝরনা আর নদী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
ঝর্না এবার নদীকে কাঁধ ধরে ঝাঁকালো ', চলো, চলো মামনি, তোমার মায়ের কাছে।
নদীর যেন চমক ভাঙ্গলো তারপর বলল 'হ্যাঁ, মাসি চলো।'
ঝরনা আর নদী পর্দা সরিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকলো।
নার্স বললেন' বেশি কথা বলবেন না আর আপনারা একসঙ্গে দুজন ঢুকলেন কেন?'
ঝরনা আর নদী রুপসার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
কেবিনে ঢুকতেই নাকে একটা মৃদু ওষুধের গন্ধ কেমন যেন একটা নীল চাদরে ঢাকা রূপসার লম্বা গোলাপি ফর্সা শরীর বিছানায় যেন অসহায় নিষ্প্রাণ। জানলার দিকে মুখ করে আছে।
কেবিনে ঢুকে ঝর্ণা বললো' বৌদি, ও বৌদি?'
রুপসা মুখ ফেরাল ঝরনা আর নদীর দিকে।
ঝরনা আর নদীকে দেখে রুপসা হাসার চেষ্টা করলো
ঝর্ণা বললো 'এখন কেমন?'
রুপসা ঘাড় নেড়ে জানাল একটু ভালো।
রূপসা নদীর দিকে তাকিয়ে। নদী মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না। কেন যে সেদিন মাকে এতগুলো কথা বলতে গেল নদী এটাই বারবার ভাবছে।
রুপসা ঝর্ণার দিকে ইঙ্গিত করল মেয়েকে কাছে আসার জন্য।
ঝর্ণা বললো' মামনি, মায়ের কাছে
যাও । একটু বসো মায়ের কাছে।'
ঝর্ণা নদীকে হাত ধরে টেনে মায়ের কাছে বসালো।
নদী মায়ের কাছে বসলে রুপসা নদীর হাত দুটোকে চেপে ধরল।
নদীর দুচোখ বেয়ে তখন জল পরছে। নদী শুধু বলল _ব্যাথাটা এখন কম?'
রুপসা একটু অন্যমনস্ক ভাবে ঘাড় নাড়ল।
রুপসা তখনও নদীর হাতদুটো বুকের কাছে নিয়ে আছে। রুপসা কেমন অসহায় ভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। নদী মাকে দেখার পর কেমন যেন একটা অনুভুতি হল।
নদীর চোখে জল দেখে রুপসা হাত দিয়ে জল মোছার চেষ্টা করল।
নদী মায়ের হাত দুটো চেপে ধরল। এই দুটো হাত পরস্পর পরস্পরের কাছে এতটাই চেপে বসে আছে যে অসহায় দুটো জীব যেন পরস্পর পরস্পরের কত কাছে একে অপরের ভরসার পাত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
নদী মায়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল ' একটু বেটার?'
রুপসার যেন মনে হলো তার গোটা আকাশটা তার ওইটুকু মেয়ের
ভেতরে ,সেটাই হাতের মুঠোয় ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। তার ওইটুকুই আকাশের ফালি নিয়ে সে সারাটা জীবন বাঁচতে চায়।
রূপসার ভেতরে যে মেয়েকে নিয়ে ভয়ের একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, একটা যন্ত্রণা সেটা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল।
আর নদী ও তার চোখের সামনে দেখতে পেল তার সামনে রাখা ক্যানভাসে মায়ের অভিব্যক্তি যেন একটা দুটো রঙের
আচড়কাটছে, তুলিতে ধরা দিতে
চাইছে। সে আছে তার মায়ের ,মা আছে তারই সঙ্গে ।দুটো চোখ একে অপরের দিকে পলকহীন । কোন নেশা তার বুকের ভেতরে চেপে বসেছিল মাকে না মানার।
মনে পড়ে যায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা লাইন
'' আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ,
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি।
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ,
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয়উঁকি।
আঠারোবছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়।
হয়তো এই বয়সের জন্য এসে করেছি ভুল মায়ের প্রতি বিশ্বাস আস্থা সব এক নিমেষে হয়েছিল বিলীন।
তাই আজ মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতি পদে পদে শুধু মাকে হারানোর ভয়। দুচোখ তাই জলে ভরে ওঠে। চোখের ভাষাতে সেকথাই সে বোঝাতে থাকে।
রুপসা মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারে তাই মেয়েকে তার বুকের কাছে টেনে নিতে চায়। তাই আচমকাই নদীর বুক যেন হুহু করে ওঠে ।নিজের খেয়ালে 18 বছরের নদী একটা খেলা খেলতে চেয়েছিল ।আজ তাই তার বুকে বুমেরাং হয়ে গেছে ।তাই নির্ভয়ে চোখ শুধু বিশ্ব ঘুরে এসে দেখছে তার কাছের , ভরসার শৈশবের সেই মাকে খুঁজে পেতে চাইছে।