২৪ জানুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৫৬





শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ৫৬)
শামীমা আহমেদ 

উত্তরা থেকে একঘন্টার মধ্যেই উবার জিগাতলায় পৌছে গেলো।শিহাব উবারের ভাড়া চুকিয়ে শায়লাকে নিয়ে তাদের বাড়ির গেটে নামল। দুজনেই গাড়ি থেকে নামলো।শিহাব দেখলো সবুজ শাড়িতে শায়লাকে খুব সুন্দর লাগছে। শায়লা তাকিয়ে দেখলো বাড়ির গেটটি বেশ বড় আর খুব সুন্দর!  শায়লার প্রথমেই ভালো লেগে গেলো। উপরে তাকাতেই  দেখলো  দক্ষিনমুখী চারতলা বাড়ির সামনের বারান্দা।শিহাব তাকে এগিয়ে নিলো।
শিহাব দরজায় নক করতেই বাড়ির কেয়ার টেকার রুহুল আমিন দরজা খুলে দিলো। শিহাব শায়লাকে রুহুল আমিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আজ অনেক বছর যাবৎ রুহুল আমিন চাচা আমাদের বাড়িতে।সেই আমাদের ছোটবেলা থেকে।আমাদের বিল্ডিং এর পিছনের যায়গায়  তার ফ্যামিলি  নিয়ে থাকে।মা ওদের ঘর তুলে দিয়েছে। শায়লা খুব মনযোগ দিয়ে শিহাবের কথা শুনছিল। শায়লাকে দেখে রুহুল আমিনের চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে! কিন্তু তেমন একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ নেই একেবারে! 
রুহুল আমিনকে উদ্দেশ্য করে  শিহাব বললো, চাচা ও শায়লা।আজ আমাদের সাথে সারাদিন বেড়াবে। চাচা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।  শিহাব শায়লার হাত ধরে বাড়ির ভিতরে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেলো।জানালো,আমাদের বাড়িটি অনেক বছরের। সেই  আমাদের স্কুলে পড়বার সময় বাবা এই বাড়িটি বানিয়েছেন।বাবা তখন আমেরিকায় থাকতেন।  বাড়িতে লিফটের ব্যবস্থা করা হয়নি। তোমাকে কষ্ট করে পায়ে হেঁটে উঠতে হবে। শায়লা চোখের ভাষায় জানালো,কোন অসুবিধা নেই।শিহাব জানালো, নিচতলা আর দোতালায় ভাড়াটিয়া আছে।তিনতলায় বড় ভাইয়া ও ভাবির ফ্ল্যাট আর চারতলায় আমার জন্য।মা বাবা আরাফ সেখানেই থাকে। আর ছাদে ভাবীর করা চমৎকার বাগান আছে।বিকেলে সেখানে বসে আমরা চা খাবো। শায়লা তোমার কি ভালো লাগছে এখানে এসে?আমার কিন্তু অনেক ভালো লাগছে।আজ সকাল থেকেই জীবনটা অন্য রকম হয়ে গেছে।বহুদিন পর এই বাড়িতে আমি, দুজন মিলে একসাথে এলাম। আর হ্যাঁ, শায়লা তোমাকে জানিয়ে রাখি,চারতলায় আমার রুমটা কিন্তু তেমনি আছে।বাবা মা অন্য রুমে থাকছে। যদিও বাড়ির ফিটিংসগুলো বেশ আগের তবুও সিঁড়ির স্পেস অনেক চওড়া ।বাইরে থেকে সূর্যের আলো সিঁড়িতে পড়েছে।দিনের বেলা লাইট লাগছে না একেবারেই। নীচতলা দোতালা পেরিয়ে ওরা তিনতলায় পৌছুতেই দেখলো দরজায় সুমাইয়া ভাবী দাঁড়িয়ে। শায়লা যেন শিহাবের আড়ালে লুকাতে চাইছে। শিহাব শায়লাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে ভাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ভাবী ও শায়লা। শায়লার কথা তোমাকে তেমন করে বলা হয়নি।কেমন করে যেন খুব দ্রুতই  সব কিছু ঘটে গেলো।তুমি কিন্তু মনে কিছু রেখোনা৷ শায়লা খুব ভালো মেয়ে।কথা বললে তোমার ওকে খুব ভালো লাগবে।শিহাব একা একা বকেই যাচ্ছে। ভাবী একেবারেই নিরুত্তর। কেমন যেন চোখে মুখে থমথমে ভাব"। শিহাব ভাবলো প্রথম দিন একটু এমনি হবে।সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।অনেকক্ষন কি যেন ভেবে সুমাইয়া এবার কথা বলে উঠলো। কেমন আছো শায়লা? দেখো কতক্ষন হলো, তোমাদের দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি।প্লিজ তোমরা ভেতরে আসো।
শিহাব মৃদু আপত্তি জানালো। এখন না ভাবী।আগে মায়ের সাথে শায়লার দেখা করিয়ে আনি। শায়লা
আরাফকেও দেখার জন্য খুব আগ্রহ করে আছে। সুনায়রা আর আরুশ ওরা কোথায়? ওদের ডাকো।ওদের জন্য খেলনা আর চকলেট এনেছি।বলেই শিহাব ভাবীকে ব্যাগ এগিয়ে দিলো। ভাবী বেশ জোর দিয়েই বললো, না, শায়লা প্রথম এসেছে আমাদের বাসায়। এভাবে উপরে যাবে না।তোমরা আমার এখান থেকে সকালের নাস্তা করে তারপর উপরে যাবে। ভাবী এত করে বলছে। শিহাব তাই মেনে নিল। আর তাছাড়া শায়লাই তো আজ অতিথি। ভাবী তাকে আপ্যায়ন করতে চাইছে সেটাতো গ্রহন করতেই হয়।আরাফের জন্য ভাবী এতদিন পর্যন্ত  মায়ের সব ভুমিকাই পালন করেছে।আজ শায়লাকে দেখে হয়তো আরাফের জন্য মায়াটা কষ্ট  দিচ্ছে। শিহাব শায়লাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলো।ভাবী, ভাইয়া উঠেনি? উঠেছে।বাইরে গেছে।তোমাদের ভাইয়ারা কয়েকজন মিলে একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে ইনভেস্ট করছে। তারই একটা মিটিং হচ্ছে আজ গুলশানে একজনের বাসায়।শিহাব ভাবলো, ভাইয়া চিরকালই তার ব্যাপারে উদাসীন। এটা কি শিহাবের প্রাইভেসি মেইন্টেন করা নাকি নিজেকে দুরত্বে রাখা শিহাব বুঝে উঠতে পারে না। ভাবী  শায়লা শিহাবকে ডাইনিং টেবিলে ডাকলো।অনেক নাস্তার আয়োজন! ভাবী বেশ যত্ন করে ওদের নাস্তা করালো।শিহাবের মনের ভেতর আরাফকে দেখার জন্য অস্থির লাগছে। এখনো কি ঘুম থেকে উঠেনি আরাফ? শিহাবের প্রশ্ন সুমাইয়াকে। হ্যাঁ,উঠেছে তো।একবার আমার এখানে ঘুরে গেছে ওর দাদীর সাথে।এখন বোধহয় খেলছে।শিহাব বুঝতে পারছে না অন্যদিন আরাফ তার জন্য অস্থির হয়ে থাকে। কখন আসবো কল করতে থাকে অথচ আজ চুপচাপ হয়ে আছে। সুমাইয়া ওদের চা দিলো।দুজনে চায়ে চুমুক দিতেই শিহাব  শায়লাকে জানালো,
শায়লা, ভাবী আমাদের পরিবারের জন্য একজন নিবেদিত প্রান মানুষ।ভাইয়াকে দেখে, নিজের সন্তান সংসার দেখেও বাবা মা আরাফেরও সমান যত্ন নেয়।তারপর বাড়ির যাবতীয় ঝুট ঝামেলা সবই ভাবী সামলায়। আমাদের জীবনে ভাবী একটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন।সুমাইয়া শিহাবকে থামিয়ে বললো, এভাবে বলছো কেন? এটাতো আমারও সংসার। সবাইকে নিয়ে থাকতে আমার  ভালো লাগে। 
ভাবী আরাফকে নিয়ে তোমার অনেক ঝামেলা আর ব্যস্ততায় দিন গেছে। এখন থেকে শায়লা আরাফের সব দায়িত্ব বুঝে নিবে।শায়লা আরাফকে না দেখেই অনেক আপন করেছে।আজ তাই দেখাতে নিয়ে এলাম।শিহাব বুঝতে পারছে না,ভাবী কথার মাঝে বেশ অন্যমনস্ক কখনো বিষন্ন আবার কখনো কেমন যেন ভীত চোখে মেইন দরজার দিকে তাকাচ্ছে। শায়লা নাস্তা পর্ব সেরে ভাবীর হাত ধরে বললো,ভাবী
আজ থেকে আরাফকে আমি মায়ের আদরে আপন করে নিবো।আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। এবার সুমাইয়া বলে উঠলো, শুধু আরাফ? আরাফকেই আপন করবে? আরাফের বাবাকে, আমাকে আপন করবে না? 
ভাবীর দুষ্টুমিতে শায়লা লাজ রাঙা হয়ে উঠলো। ওরা বিদায় নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলো।
শিহাব আরাফকে দেখার জন্য বেচায়েন হয়ে উঠলো!
ভাবীকে এড়িয়ে দ্রুতই বেরিয়ে এলো। শায়লা ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিহাবের পিছু নিলো। পেছনে  দরজায় সুমাইয়া বেশ উৎকন্ঠিত চোখে শায়লা আর শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল।
শিহাব বেশ দ্রুতই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলো।আরাফকে দেখার জন্য আর তার দেরি সইছে না। শায়লা শিহাবকে ফলো করে  একরকম দৌড়েই  পিছু পিছু গেলো।চারতলার দরজা খোলাই ছিল।শিহাব বাসায় ঢুকে পড়লো। ড্রইং ডাইনিং এ কেউ নেই।শিহাব শায়লাকে সরাসরি  মায়ের ঘরে নিয়ে গেলো।মা বিছানায় শুয়েছিলেন। শিহাব মায়ের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখতেই মা জেগে উঠলেন। শিহাব মাকে উঠে বসালো। শায়লাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলো।বললো মা দেখ ও শায়লা।দেখো কি মায়া ভরা মুখটা। মা তুমি আরাফের জন্য মা চেয়েছিলে,আমাকে সংসারী  হতে বলেছিলে। মা দেখো তোমাদের সবার চাওয়া ইচ্ছে আজ পূরণ হবে। শায়লা আমাদের সবার খুব আপন হয়ে থাকবে।আরাফ তার মায়ের আদর পাবে যেটা তুমি সবসময় চাইতে। শায়লা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো।মা শায়লার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলো।
ভালো থাকো মা।বসো, বলেই শায়লাকে কাছে টেনে নিয়ে বিছানায় তার পাশে বসালেন। শায়লার হাত ধরলেন।কিন্তু পরক্ষনেই মা কেঁদে উঠলেন।শিহাবের জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমার দুইটি সন্তান তাও খোদার হিসেবে কেমন দুজনের ভাগ্য। আজ শায়লাকে পেয়ে হয়তো মা আনন্দে  কেঁদে ফেলছে। 
শিহাব বারবার ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,মাকে প্রশ্ন করলো,মা আব্বাকে দেখছিনা,আব্বা  কোথায়? তাছাড়া আরাফ কোথায়? আজ যে আরাফ আমার কাছে দৌড়ে এলোনা? মা প্রসঙ্গ পাল্টে 
খুব হালকা স্বরে বললেন, তোর বাবা একটু বাজারের দিকে গেছে।
শিহাব এ কথা শুনে বেশ রাগান্বিতই হলো।
বেশ শাসনের সুরেই বললো,
মা বাবাকে কেন একা বাজারে যেতে দাও?এখন বয়স হয়েছে।রাস্তাঘাটে কখন কোন বিপদ হয়।রুহল আমিনকেতো বাসায়ই দেখলাম। ওতো বাবার সাথে যেতে পারে।
শিহাবের কথার জবাবে  মা বললেন,
ও গেলে গেটের খেয়াল কে রাখবে? পানি ছাড়তে হয়।ভাড়াটিয়াদের কত রকম চাওয়া থাকে। রুহুল আমিনের ছেলে রফিককে নিয়ে গেছে।
শিহাবের উৎসুক চোখ ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
মা, আরাফকে দেখছিনা।আজ আমার কাছে আসছে না কেন? ও কোথায়? ওর জন্য খেলনা এনেছি,চকলেট এনেছি,নতুন ড্রেস এনেছি। শায়লা আরাফকে দেখতে এসেছে । শায়লা আরাফকে মায়ের আদরে আমাদের কাছেই রাখবে। শায়লাকে তোমাদেরও খুব ভালো লাগবে মা। ও খুব ভালো মেয়ে।
শিহাবের এমন কথায় শায়লা সলজ্জ হয়ে মাথা নিচু করে মায়ের পাশে বসে রইল।
শিহাব আরাফ আরাফ করে ডাকতেই মা বললেন আরাফ তোর ঘরে আছে।
আমার ঘরে? একা একা কি করছে? তোমরা ওকে একা ছেড়ে দিয়েছো কেন? বলেই শি্হাব হনহন করে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।শিহাব না থাকলেও ওর ঘরটা আগের মতই সাজানো আছে। জিগাতলায় এলে শিহাব পারতপক্ষে নিজের রুমে যায় না। শিহাব মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় মা বেশ অস্থির হয়ে উঠলেন।শায়লা লক্ষ্য করলেন মা খুব শক্ত করে শায়লার হাতটি ধরে রাখলেন।চোখে মুখে একটা আতংক ভাব! 
মায়ের রুমের পাশের রুমটাই শিহাবের। শিহাব  দরজায় যেতেই দেখে আরাফ তার বিছানায় বসে একা একা খেলছে।বিছানায় অনেক খেলনা ছড়ানো।জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়া।বিছানায় রোদ এসে পড়েছে।শিহাব বুঝতে পারছে না,বাচ্চাটিকে একা একা কিভাবে মা ভাবী এভাবে বিছানায় রেখে চলে গেছে?  শিহাব আরাফ বলে ডাকতেই বলে উঠলো,আব্বু মা এসেছে।
শিহাব বুঝতে পারছে না, আরাফতো এখনো শায়লাকে দেখেনি,কিভাবে বলছে মা এসেছে।
শিহাব কথাটা ভালোভাবে বুঝতে আবার বলে উঠলো,কোথায় তোমার মা? 
আরাফ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল্য, ঐ যে!
শিহাব সেদিকে তাকাতেই একেবারে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়লো।
রিশতিনা!  কখন এলো?
রিশতিনা চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে।
আরাফ বলেই চলেছে ঐ যে মা,ঐ যে মা!
শিহাব কতকটা সময় যেন স্থির হয়ে রইল।নির্বাক নিরুত্তর।
রিশতিনার দিকে তাকাতেই রিশতিনা বলে উঠলো,  হ্যাঁ আমি,ভুল দেখছো না।আমি আজ সকালে এসেছি। আমি আমার স্বামী সংসার আর সন্তানের কাছে ফিরে এসেছি।আরাফ আমার সন্তান।আমিই আরাফের মা।
আরাফ ক্রমাগত বাবা বাবা ডেকেই চলেছে। রিশতিনা আর আরাফের মাঝে  শিহাব কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much