অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন ।
টানাপোড়েন (১১)
অস্পষ্ট ধ্বনি
রেখার বৃষ্টি ভেজা রাতে একটা দুশ্চিন্তা তো মনকে গ্রাস করেইছিল। কিন্তু হঠাৎই পাশের বাড়ির ছেলেটার আবার গলা পেল 'রিমঝিম গিরে শাওন।সুলাগ সুলাগ যা এ মন।.. মরসুম মে ...।'গানটা কেমন মাদকতা এনে দিল রেখার শরীরে ও মনে। রেখা আস্তে করে জানলাটা খুলে বাইরের পরিবেশটা দেখার চেষ্টা করল। বৃষ্টির ছাট এসে চোখে মুখে পড়ছে।রেখা হাতটা জানলা দিয়ে বার করলো কি অসাধারণ একটা অনুভূতি রেখাকে নিয়ে গেল ছয় বছর আগের জীবনে। অনেক পুরুষ তার জীবনে এসেছে। সেভাবে কারো ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। কি বিয়ের আগে ,কি বিয়ের পরে। ঘটনাটা বিয়ের পরে ঘটেছে। সবেমাত্র স্বামীকে ছেড়ে স্কুল-কলিগদের সঙ্গে কাটিয়ে এসেছে বিষ্ণুপুর ।বিষ্ণুপুর এর ঐতিহাসিক ঘরানায় আর সঙ্গে মুকুটমণিপুরে গিয়ে বসন্ত মরসুমে লাল পলাশের সমারোহ ,আদিবাসীদের আনাগোনা। নির্জন বনানীতে কয়েকবার তো বসেই পড়ল রেখা । লাল পলাশ ফুলগুলোকে হাতে তুলে চোখেমুখে মাখছে , রিম্পা দি ও পায়েল বলল ' কিরে তোর কি নতুন করে প্রেম এসেছে? দাঁড়া মনোজদাকে বলছি
ফোন করে।
অলঙ্করণ: সোমাশ্রী সাহা
রেখা বলল 'আমার বয়েই গেছে, আমরা সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে, বলেই নাচতে শুরু করলো। ব্ল্যাক জিন্স আর গোলাপি গেঞ্জিতে কি অসাধারণই নাকি লাগছিল? এটা অন্যান্যরা বলেছিল। তিন-চারদিন হইহুল্লোড় করে ওখানে কাটিয়েছিল ।জীবনে এই প্রথম একাকী কোথাও যাওয়া পরিবারের সদস্য ছাড়া। কিন্তু সেখানে গিয়ে একটা গলায় কাঁটা বিঁধে ছিল সেটা হল বোর্ডের খাতা । এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাইছে না রেখা ,মনেও করতে চাইছে না। তবুও মনে পড়ে। ওখান থেকে ফিরে আসার পর সেই খাতার জন্যই ঘটেছিল তার জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনা। ফেরার একদিন পরে হেড এক্সামিনারের বাড়িতে খাতা জমা দিতে যেতে হবে ।এমনিতেই বাড়ি থেকে বেরোতে লেট হয়ে গেছে। ট্রেন পায়নি ।শেষ পর্যন্ত ভাবল ব্রেক করে করে বাসে যাবে। নির্দিষ্ট টাইম এ বাসস্টপে এসে বাস না পেয়ে সে ভাবল বাইপাস থেকে বাস ধরবে। কিন্তু সেখানে যেতে হলেও একটা অবলম্বন দরকার ওই সময় সে দিশেহারা হয়ে গেছিল।এমন সময় একটি ছেলে বাইক করে যাচ্ছে ,অনেকক্ষণ ধরেই রেখাকে ফলো করছিল। প্রথম দিকে একটু বিরক্তি লেগেছিল। তারপর দাঁড়িয়ে রেখা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিসে যাবে?
তখনই কাছে এসে ছেলেটি বলল ' আপনি কি লিফট চাইছেন?
রেখা কোন কথার উত্তর দিল না। এমন সময় ফোন আসলো 'হ্যালো'
ফোনের ওপার থেকে প্রশ্ন এলো'আপনি কখন খাতাগুলো নিয়ে আসবেন?'
হাঁ স্যার, একটু দেরী হবে আমি ঠিক পৌঁছে যাব।
সে তো আসবেন আমাদের তো একটা সময় আছে কোথাও না কোথাও সিডিউল করা থাকে।
রেখা বলল 'স্যার এ বারটা ক্ষমা করে দিন।
ছেলেটি তখন নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আর মিটমিট করে হাসছে।
আবার কাছে আসলো এবং হেসে এসে বলল 'ম্যাডাম আপনি স্কুল টিচার? দেখুন আমি কিন্তু আপনার উপকারই করতে চেয়েছি। ফোনে বলছিলেন খাতার ব্যাপারে আপনার লেট হয়ে যাচ্ছে, তাই..?
তখন রেখা মনে মনে ভাবল তাই তো লিফট নিলে কি অসুবিধা আছে? এবার একটু হেসেই রেখা বলল ' হ্যাঁ। আসলে আমার হেড এক্সামিনারের বাড়িতে যেতে হবে।'
ছেলেটি আবার হেসে বলল 'সে জন্যই তো বলছি চলুন ,আপনাকে লিফট দিচ্ছি।'
রেখার একটু কিন্তু কিন্তু ছিল কিন্তু অপারগ হয়েই শেষ পর্যন্ত চেপে পড়ল বাইকে। এই বাইকে চাপা যে পরবর্তীকালে তার কাল হবে কে জানত?
ছেলেটি জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল ' কোথায় যাবেন?
রেখা বলল 'আপনি আমাকে বাইপাসে নামিয়ে দিলেই হবে। '
তারপর ছেলেটি নিজেই যেচে নিজের পরিচয় দিতে লাগলো। আমি একটি ব্যাংকে চাকরি করি। আমার নাম সমীরন।
বয়স খুব বেশি নয়।কথাবার্তা বেশ ভালই লাগলো রেখার।
শেষে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল ' ম্যাম আপনার নাম?'
রেখা কিছুতেই নামটা বলতে চাইছিল না কিন্তু পরবর্তীকালে ভাবল এতটা উপকার করল নামটুকু বললে কি এমন হয়ে যাবে?
তখন সে বলল 'আমি রেখা ।
এবার ছেলেটি হঠাৎ করেই গাড়িটা এমন ব্রেক কষলো রেখা ছিটকে ওর গায়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল।
ছেলেটি বলল ' আমাকে ধরে বসুন না। হাতে লাগেজ আছে?'
রেখা বলল 'না না আমি ঠিক আছি।'
এরপর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল 'আপনার কি নতুন বিয়ে হয়েছে?'
রেখা এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলে না।
আবার ছেলেটি প্রশ্ন করল 'আপনার বাচ্চাকাচ্চা আছে?'
রেখা ভাবছিল কি অদ্ভুত ব্যাপার লিফট দিয়েছে বলে তাকে এত কিছু বলতে হবে নাকি ?
আবারো রেখা চুপ।
এবার ছেলেটি বলল 'কেন আমাকে বললে কি আপনার কোন অসুবিধা আছে?'
এবার রেখা বলল 'হ্যাঁ ।সে তো আছেই। হঠাৎ আপনি গায়েপড়ে এতগুলো কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ছেলেটি বলল 'ম্যাম রেগে যাচ্ছেন? ঠিক আছে আপনাকে বলতে হবে না।'কথা বলতে বলতেই বাইপাসে এসে গেল।
রেখা বলল 'ঠিক আছে আপনি এখানে নামিয়ে দিন। নেমে একটা থ্যাংকস জানাল।
ছেলেটি কিন্তু বাইকটা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো। রেখা এবার বারবার ঘড়ি দেখছে ।বাসের টাইম? বাইপাসের ধারে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞেস করল দূরপাল্লার গাড়ি কি বেরিয়ে গেছে, বহরমপুর যাওয়ার?
অচেনা ব্যক্তি বললেন এই তো একটু আগেই গেল আপনার আসার মিনিট দুয়েক আগে। এবার রেখা ভারি চাপে পড়ে গেল। ছেলেটি কিন্তু তখনও মিটিমিটি হাসছে। পাশে অনেক যুবক-যুবতী এমন গায়ে পড়ে সাথে গায়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে কেমন অসহ্য লাগছিল। পাশে এক পেঁপে বিক্রেতা পেঁপে নেবে নেবেন বলে হাঁকছে। পাশে এক আখের রস বিক্রেতাকে ছেলেটি বলল 'দু গ্লাস আখের রস দিন।'একটি গ্লাস নিজের হাতে অপরটি রেখার কাছে এগিয়ে ধরল। বলল 'এই নিন আখের রস খান। চিন্তায় আছেন তো? রিল্যাক্স করুন।'
রেখা খাবে কি খাবে না দোটানায় পড়ল। ছেলেটি এমন ভাবে হাতের কাছে এনে দাঁড়িয়েছে ,না করতে পারছে না ।শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে নিতে হলো গ্লাসটি। তারপর টাকা মেটানোর সময় রেখা নিজের থেকেই দেখল এটা তার ভদ্রতায় লাগে ।তাই বলল দামটা রেখাই দেবে।
ছেলেটি বলল 'কেন আমি তো আপনাকে অফার করেছি ।দামটা আমি দেব। '
রেখা বলল 'না আমি দেবো।'
শেষে ছেলেটি বলল 'ঠিক আছে ।আবার যদি কখনো দেখা হয় ,তখন আপনি আমাকে খাওয়াবেন ওটা due থাক। রেখাকে হার মানতে হলো।
ছেলেটি বলল _ম্যাডাম এখন কি করবেন?
রেখা একটু চিন্তিত মুখে বলল ' হ্যাঁ, তাই তো ভাবছি।'
ছেলেটি ভরসার সঙ্গে বলল 'নিজেকে দেখিয়ে আমি আছি। '
এবার রেখা সত্যি সত্যি হেসে ফেললো। ভাবলে ঠিকই তো ,তার জীবনে যেন উদ্ধারি দূত হয়ে এসেছে। ছেলেটি বলল 'চলুন আপনাকে পৌঁছে দেবো আপনার হেড এক্সামিনারের বাড়িতে।'
রেখা বলল 'আপনি কেন যাবেন আমার জন্য।'
ছেলেটি বলল 'সেটা তো বলতে পারি না। তবে কেমন যেন মনে হলো আপনার উপকারটা করি।'
এবারে রেখা হেসে বলল ' ঠিক আছে চলুন। থ্যাঙ্ক ইউ।'
ছেলেটি বলল 'থ্যাঙ্কস কিসের জন্য? আগে আপনাকে পৌঁছে দিই ।তারপরে না হয় থ্যাংকস জানাবেন।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে আমি কথায় পেরে উঠব না ।চলুন।'
যেতে যেতে হঠাৎ বৃষ্টি ।রেখা!তো ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ছেলেটি বলল আপনার তো খাতা আছে। কি হবে ।এদিকে তো ভিজে গেছেন। কিছু মনে করবেন না ম্যাম একটা কথা বলব?
রেখা বলল 'হ্যাঁ বলুন না?
বলছি আমার কাছে রেনকোট আছে কিন্তু আমি তো গায়ে দিলাম না ।কারন আপনি ভিজে যাচ্ছেন।আমি কি করে গায়ে দিই বলুন? তারচেয়ে রেনকোটটা দিয়ে আপনার ওই খাতাগুলোকে গার্ড করুন। বলেই নিজের থেকে খাতাগুলো আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রেনকোট দিয়ে মুড়িয়ে দিলে। আর বললে এবার ও কি আমাকে ভয় করছে?'
রেখা একদম ঝাঁসির রানীর মত উত্তর দিল। ভয় ,ভয় পাবো কেন ?আপনি বাঘ, না ভাল্লুক?
ছেলেটি উত্তর দিলো হেসে 'আমিও তো সেটাই জানি আমি বাঘ না ,ভাল্লুক নয়। তবে আপনার সঙ্গে আজকের এই দীর্ঘ সময়ের রাস্তাটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে ।'
রেখা বলল 'কেন আপনি কখনো এরকম কাউকে নিয়ে বাইকে চাপান নি?'
ছেলেটি বলল্য' হ্যাঁ মিথ্যে বলব না ।চাপিয়েছি কিন্তু আপনার সঙ্গে একটা আমার অন্যরকম অনুভুতি হলো ।জানি না কেন হল, এ প্রশ্নের কোন ব্যাখ্যা নেই। বলতে বলতেই গন্তব্য স্থানে এসে গেল।
রেখা বলল 'এখানেই নামিয়ে দিন।'
ছেলেটি বলল 'একটা সত্যি কথা বলবো?'
রেখা জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালো।
আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
রেখা তো অবাক হয়ে গেল ,একটু হেসে চলে গেল।
ছেলেটি পিছু ডাকলো শুনুন? বলেই একটা ভিজিটিং কার্ড রেখার হাতে ধরিয়ে দিল। রেখা আবার উৎসুক ভরে তাকিয়ে ।
ছেলেটি বলল 'রাখুন কখনো যদি প্রয়োজন লাগে।'
রেখা মনে মনে ভাবল, আর কি প্রয়োজনে লাগবে আর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে না চাঁদ।'
রেখা একটা থ্যাঙ্কস জানিয়ে চলে গেল।
কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে তার জীবনে ছেলেটি কিভাবে জায়গা করে নিয়েছিল ।সেটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে ফোনের আওয়াজে রেখা ফিরে আসলো তার আসল জায়গায়।
ফোনটা রিসিভ করল '
হ্যালো'।
মনোজ বলল 'এই রেখা আজকে আমি ফিরতে পারবো না ।তোমাকে কিছুতেই ফোনে পাচ্ছিলাম না।'
এদিকে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। রাত হয়ে গেছে কালকে অফিস করে একেবারে বাড়ি ফিরব। তারপর বলব।'
রেখা বলল ' ঠিক আছে।'
অন্য সময় হলে মনোজকে রাগ দেখাত ,অভিমান করতো ।কিন্তু আজকে তার সেই মন কোন কথাই বলল না। সে যেন আজকে একাকী থাকতে চাইছে আর পুরনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে চাইছে। আজ তার ঘুম আসবে না বোধ হয় ।মাথার ভেতর সহস্র ধুনি যেন কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে ।শরীরের ভেতরে রন্ধে রন্ধে যেন অসহ্য জ্বালা। অন্ধকার বৃষ্টির রাত তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ছয় বছর আগে ঘটে যাওয়া দিনগুলোতে। আবার ফোনটা বেজে উঠলো, হ্যালো।
কিন্তু বৃষ্টির শব্দ আর ফোনের লাইনের ডিস্টার্ব এর জন্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অস্পষ্ট ধ্বনি গুলো যেন তার কাছে নুতন করে স্পষ্ট হতে চাইছে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১১ ক্রমশ