অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন ।
টানাপোড়েন (পর্ব-৫)
সংশয়
বাইরে কি বৃষ্টি? বৃষ্টি ই। ঝড়ের মতো বাতাস বইছে। ওল্ড বালিগঞ্জের নির্জন রাস্তায় যে বাড়ীটার নিচে কোন রকমে দাঁড়িয়েছে শিখা। বারবার হাত ঘড়ি দেখছে। এখনো দিব্যেন্দুর দেখা নেই। আর কতক্ষন ওয়েট করবে। এবার তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। আজ কাল প্রায়শই এরকম হচ্ছে। হঠাৎই নজরে এলো একটি ট্যাক্সি ড্রাইভার সিগন্যাল পেরিয়ে সামনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল -কোথায় যাবেন? শিখা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, না তাকে দেখেই তো জিজ্ঞেস করছে? একটু যেন সংশয় হল মনে যাবে, না ওয়েট করবে। ওদিকে এত বৃষ্টি দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। চিন্তাভাবনা না করে উঠে পরল ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে কেমন অসহ্য লাগছিল ট্যাক্সিওয়ালার চাহনিটা। তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় সে নেমে পড়ল। বাড়িতে এসেএকটা ফোন করল দিব্যেন্দুকে। দিব্যেন্দুর ফোন কেন লাগছে না? এদিকে দাদা বৌদির মধ্যে একটা ঝামেলা চলছে কি নিয়ে সেটা সে জানে না। আজকেও বাড়িতে ঢুকে দুজনের ভেতরে কথা কাটাকাটি স্পষ্ট কানে এলো। বৌদি শুধু বলছে -'নিউমার্কেটে তুমি যাওনি?'
রীতাকে আমি চিনি না? রীতার সাথে অত তোমার কিসের মাখো মাখো...
সুরঞ্জন চেঁচিয়ে বলছে-'মুখ সামলে কথা বলো মাধু, ও আমার বোনের বয়সী। '
এবার মাধুরী উত্তেজিত হয়ে বলল-'সে তো তার জানা আছে। কিন্তু সুরঞ্জনের সেটা মাথায় আছে কিনা ,সেটা তো জানে না ।প্রশ্নটা তো সেখানেই?
কান খাড়া করে শোনে শিখা। রীতা আমার ক্লাসমেট কি হয়েছে ওর? আর বৌদি ই বা এভাবে রিঅ্যাক্ট করছে কেন? কি দেখেছে বৌদি? ওর কান যেন গরম হয়ে গেল। ইদানিং রীতা সম্পর্কে অনেক কিছু শুনতে পাচ্ছিল। ও নাকি ক্লাস করার নাম করে আজকাল ডেটিং করে ।এভাবেই টাকা রোজগারে মনোনিবেশ করেছে। কাকা, কাকি মা মারা যাবার পর একটু বেপরোয়া হয়ে গেছে। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এজন্য এখন আর বাড়িতে ডাকাও হয় না। ভালই করেছি বাড়িতে না ডেকে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাথরুমে চলে যায় ।বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে যখন বেরোয় তখন দেখে দাদা বৌদির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎই কেমন বাড়িতে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ। কি হলো একটু ভাবার চেষ্টা করছে। একটু পরে শোনে -'দাদা ,বৌদিকে ডাকছে-''মাধু বিশ্বাস করো, এই তোমার মাথায় হাত রেখে বলছি। বৃষ্টির মাথায় হাত রেখে বলছি।
বৌদির তখন কথা শুনে বোঝা গেল, খুবই ঠান্ডা মেজাজে বলছে-"থাক আমার মেয়ের মাথায় হাত রেখে তোমাকে কিছু বলতে হবে না।'তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো তাহলেই হবে। যেন কখনো আমি ওর সঙ্গে কোন কথা বা কখনো তার সাথে যেন না দেখি।'দাদা বলছে-'এই আমি কান ধরছি।'বৌদি এবার হেসে বললে-'থাক আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। খাবে চলো।
শিখাকে ডাকো।'শিখা যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আসলে বাবা-মা মারা যাবার পর থেকে বৌদির কাছেই সে শাসন ,ভালোবাসা পেয়েছে। তাই হঠাৎ করে বৌদির ভেতরের কষ্টটা শিখা মেনে নিতে পারে না ।তা তার নিজের দাদাই হোক না কেন? ওদিকে সুরঞ্জন হাক দেয়-"শিখা, নিচে আয় ,খাবি।,
শিখা উত্তর দেয়-যাচ্ছি। বলেই খাবার টেবিলে এসে বসে। হঠাৎই বৌদি বলে দিব্যেন্দুর খবর কী রে শিখা? আজকাল আর বাড়িতে তার আসা হয় না কেন? তোদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি? দু বছর তো হলো চাকরি পেয়েছে। তোর এবার ফাইনাল ইয়ার। পরীক্ষা শেষে কিন্তু তোদের চার হাত এক হবে। ওর বাবা-মাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলবি?"
শিখা কোন উত্তর দেয় না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু শিখা খেতে খেতে সত্যি ভেবে পাচ্ছিল না দিব্যেন্দু আজকাল তার সাথে কেন এরকম করছে? একটা দুশ্চিন্তা সংশয় নিয়ে খাবার খেয়ে এসে উপরে চলে যায়। স্টাডি লিভ দিয়ে দিয়েছে ইউনিভার্সিটি থেকে। কয়েক দিন পরেই পরীক্ষা ।এজন্য আজকে সে বেরিয়েছিল দিব্যেন্দু সঙ্গে দেখা করে সব ব্যাপারটা পরিস্কার করবে। কিন্তু দেখা তো দূরের কথা একটা ফোন পর্যন্ত সে করে নি। এবার সে ভাবল দিব্যেন্দুর কথা এত ভাবলে তার পরীক্ষাটাই মাটি হবে।
হয়তো অফিসের কাজে ব্যস্ত সময় দিতে পারছে না। থাক এখন কদিন ওর অফিস নিয়ে। ওকে এখন পড়া-শোনা টা ঠিক করে করতে হবে। হঠাৎই সুমনার ফোন -
'হ্যালো, শিখা। সুমনা বলছিl
হ্যাঁ বল।
বলব না ।তোকে একটা স্ক্রিনশট করে ছবি পাঠালাম হোয়াটসঅ্যাপে দেখ। রাখছি।'
কার ছবি? কিসের ছবি? বলতে বলতেই ফোন কেটে গেল।
হোয়াটসঅ্যাপ খুলল শিখা। কিসের ছবি ।ছবিটা জুম করে বড় করে দেখলো ।দিব্যেন্দুর ছবি ।কাকে পাজা করে ট্যাক্সিতে তুলছে। আরেকটু ভালো করে দেখল ,(অবাক হয়ে) এ তো রীতার ছবি?
একটু পরেই আবার সুমনার ফোন-'কিরে দেখা হল ছবিটা? তুই কদিন আগে আমাকে বলেছিলি না দিব্যেন্দু সঙ্গে তোর দেখা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে না। কথাটা আমার মাথায় ছিল। হঠাৎ করে সেন্টাল এভিনিউ এর দিকে একটা নার্সিংহোম এর পাস দিয়ে আমি যাচ্ছিলাম ।তখনই দেখলাম, ছবিটা তুললাম।'ব্যাপারটা কি বল তো? রীতাটা তো আজকাল বাজে মেয়ে হয়ে গেছে ,আমরা প্রত্যেকেই জানি। কিন্তু দিব্যেন্দুদা মাই গড ভাবতে পারছি না ।আরো কত কথা বলে যেতে লাগলো ।কোন ও কথা আর শিখার কানের ভেতরে ঢুকলো না ।ফোনটা রেখে দিল।
অথচ আজ ই ওর বৌদি বলছিল দিব্যেন্দুর বাবা-মাকে ,শিখার দাদা বৌদির সঙ্গে কথা বলতে। এখন কি কথা বলবে দাদা বৌদিকে?'
পড়াশোনাতে মন লাগছে না। আলোটা নিভিয়ে চুপচাপ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভেতরে হাজারো সংশয় । কি করবে এখন শিখা। রীতাকে নিয়ে দিব্যেন্দু নার্সিংহোমে কেন ?এই চিন্তাটা মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে। আজকাল দিব্যেন্দুর ভালোবাসার স্পর্শ একটু অন্য মাত্রায় যাচ্ছিল ।এটা শিখাও বুঝতে পেরেছিল কিন্তু শিখা এগোতে দেয়নি বেশি দূর।
এই তো ৩ মাস আগের কথা ওরা দুজন ট্যাক্সিতে উঠে ছিল চৌরঙ্গী মার্কেট যাবে। ট্যাক্সি গড়ের মাঠ ছেড়ে চৌরঙ্গীতে পড়তেই রাস্তার আলো যখন খুব ম্রিয়মাণ ।তখন ট্যাক্সির মধ্যেই দিব্যেন্দুর হাত শিখার করতল ছেড়ে উঠে এসেছিল কোমরে ।নরম আঙ্গুল দিয়ে শিখার শরীরের মাংসে যেন আঙ্গুল ঢুকে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে শিখা হাত দুটো চেপে ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল-' এত তাড়া কিসের?'সে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। বিয়ের পর সব হবে।
'সেদিন রেস্তোরাঁয় খেতে ঢুকে দিব্যেন্দু শিখার সাথে তেমন কোনো কথা বলে নি। শুধু একটা কথাই বলেছিল' ভালোবাসায় শরীরটাও প্রয়োজন আছে?'
শিখাও সেদিন কথা বাড়ায় নি। শুধু বলেছিল-'সেটা সে অস্বীকার করে না। তবে সেটা বিয়ের পরের জন্য তোলা থাক।'
এরই মধ্যে কি রীতা ওর জীবনে এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে। রীতা তো ওকে কখনো ভালোবাসবে না? রীতা শুধু টাকা চায়, টাকা? সে ভাবতে থাকে বৌদিকে কথাটা কি সে জানাবে? সেদিন দাদা বৌদির সঙ্গেও রীতাকে নিয়ে তর্ক হচ্ছিল? তবে কি রীতা ওর দাদাকেও ফাঁসাতে চেয়েছিল? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
সে ভাবলো আজকে আর একবার দিব্যেন্দুকে ফোন করবে-বলেই
রিং করল। ওপার থেকে গলার স্বর ভেসে এলো '। হ্যালো। এপার থেকে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শিখা বলল -'নম্বরটা চিনতে পারছ না?'
দিব্যেন্দু বলল-"হ্যাঁ বল।
শিখা বলল- 'কালকে তুমি কোথায় ছিলে? তুমি তো আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিলে। আমি ওয়েট করছিলাম ।তুমি এলে না?
ওদিক থেকে দিব্যেন্দু বলে- 'আরে , কাজে ফেঁসে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল। সরি ,সেটাও পারি নি গো।'
শিখা বললো -অফিসের এত কাজ কাজের চাপ বেড়েছে।
দিব্যেন্দু- হ্যাঁ ।জান তো নতুন চাকরি।
আজকে তো একবার ফোনটা করতে পারতে 'শিখা বলল।
দিব্যেন্দু হেসে বলল-'এই তো তুমি করলে? তাই আমি আর করে উঠতে পারলাম না।'
শিখা ভেতরে ভেতরে এতটাই রেগে যাচ্ছিল কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে শান্ত স্বরে বলল তুমি সেন্টাল এভিনিউ এর দিকে কি করছিলে নার্সিংহোম এর কাছে?
দিব্যেন্দু গলার স্বরটা যেন কেঁপে গেল বলল 'সে আবার ওখানে কি করবে?'তোমাকে। কে এসব ভুলভাল তথ্য দেয় বল তো শিখা?
আমাকে সঠিক তথ্য দেয় দিব্যেন্দু। আজকাল তুমি সব সময় মিথ্যা কথা বলো।
দিব্যেন্দু বলে' আমি মিথ্যে কথা বলি।
শিখা বলে -'চোরের মায়ের বড় গলা জানো তো?'
তোমার হোয়াটসঅ্যাপটা চেক করে দেখো একটা ছবি পাঠিয়েছি। অস্বীকার করতে পারবে ওটা তোমার ছবি নয়?
দেখলে ছবিটা?
দিব্যেন্দু বলে-হ্যাঁ এটা আমার ই ছবি।
শিখা কিছু ভাবতে পারছে না। এ কী কথা শোনাচ্ছে দিব্যেন্দু। ভেতরে যে ঝড় উঠেছে সে ঝড় বোধহয় সবকিছু ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়ে যাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
ওদিকে দিব্যেন্দু বলে যাচ্ছে ওর মাসি ওই নার্সিংহোমে ভর্তি আছে।তাই সে মাসিকে দেখতে গেছিল। তখন দেখে রীতা নার্সিংহোম থেকে বেরোচ্ছে ।হঠাৎই ওর মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম। তখন ওকে ধরে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শিখার ভেতরে যে সংশয় তৈরি হয়েছে সে আর কোন কথা নিতে পারছিল না ফোনটা কেটে দেয়।
ওদিকে দিব্যেন্দু ফোনে 'হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।'
শিখা চেয়েছিল দিব্যেন্দুর কাছ থেকে বুক ভরে টেনে বাতাস নেবে । আর নতুন ফোটা ফুলের গন্ধ যেমন হয় ঠিক সে রকম গন্ধ সেও দিতে চেয়েছিল। হঠাৎই শিখার বৌদি ঘরে ঢোকে ।শিখা, বৌদিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলে-' তার সব শেষ হয়ে গেছে বৌদি। সব শেষ হয়ে গেছে।'
বৌদি বলে 'সে তাদের ফোনের কথা শুনেছে। রীতা মেয়েটা মোটেই সুবিধার নয়। সে যেন ভেঙ্গে না পড়ে।তবে সংশয় নিয়ে কোনো সম্পর্ক টেকে না। তারা শিখার আরো ভালো জায়গায় বিয়ে দেবে। লেখাপড়াটা ঠিক করে করতে বলে।
এভাবে দিন যায় ।মাঝে মাঝে খুব মেঘ করে আসে, বৃষ্টি হয় রোদ ওঠে প্রকৃতির নিয়মে। শুধু শিখার জীবনে দিব্যেন্দুর আর রোদ হয়ে ওঠা হয় না।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" ৫ ক্রমশ