টানাপোড়েন (৪২)
জ্বলুনি
কতদিন পর রেখাকে মনোজ বাহু বন্ধনে জড়াল। মনোজের বুকে মাথা রেখে মনে হচ্ছে জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারলেই সার্থক ।
মনে হচ্ছে যেন প্রশস্ত আকাশের অফুরন্ত ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আদি-অন্তহীন। 'প্রেমের ও জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে ,বাঁধন খুলে দাও ।দাও দাও দাও...।
রেখা গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে।'
হঠাৎই মনোজ বলে ওঠে'আমার নাটোরের বনলতা সেন )'।রেখার মুখটা নিজের মুখের কাছে তুলে ধরে চেয়ে থাকে)।
রেখা বলে ' কি দেখছ'?
মনোজ বলে ''তোমাকে।
আরো বলে জানো তো রেখা, তোমাকে দেখার যেন আদি, অন্ত নেই ।সীমাহীন।'
রেখা বলে ' তাই?'
এবার মনোজ গান গেয়ে ওঠে'ভুলিবো ভাবনা, পিছনে চাবো না। পাল তুলে দাও..।
হঠাৎই রেখা মনোজের দুই বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে।
মনোজ বলল ' কি হলো? এত সুন্দর রোমান্সের মুহূর্ত আর তুমি...?'
রেখা ব্যগ্রভাবে বলল' আওয়াজ পাচ্ছ না কিছুর?'
মনোজ বলল 'কই না তো ।'(কান খাড়া করে)
রেখা বলল 'আরে বাবা, বাচ্চাগুলোর আওয়াজ পাচ্ছ না?'
মনোজ বলল 'কার বাচ্চা, কিসের বাচ্চা?'
রেখা মনোজকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে 'মানেটা কি?'
মনোজ এবার হেসে বলল 'হ্যাঁ ,তাই তো।'
এবার রেখা দরজার কাছে ছুটে গিয়ে দেখে বাচ্চা গুলো সব লাইন দিয়েছে ,সিঁড়িরওপর দিয়ে উঠে আসার চেষ্টা করছে।
রেখা চিৎকার করে বলল মনোজকে 'এসো। দেখবে এসো।'
মনোজ গিয়ে দেখে তার মধ্যে রেখা দুটোকে কোলে নিয়ে উপরের দিকে আসার চেষ্টা করছে ।
মনোজ বলল 'ও কি করছো?'
রেখা বলল ' কি আবার করছি ।তুমি ওই দুটোকে নাও।'
মনোজ বললো ,'অ্যাই ,পাগল নাকি? আমি অত ছোট বাচ্চা নিতে পারি না।'
রেখা একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল 'নিজের বাচ্চা হলে কি করে নেবে?'
মনোজ বলল 'কি যে বলো না ?নিজের বাচ্চা আর...?
রেখা অবাক হয়ে বলল ,'আমি তোমার কাছ থেকে এরকম আশা করি নি।'
মনোজ হাত দুটো ধরে বলল 'আ্যাই রেখা ,আমি ঠিক ওভাবে বলতে চাই নি।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে ব'কো না, এবার কর্নেল ও পাইলটকে নাও।'
মনোজ হেসে বলল 'ও বাবা তুমি বোঝো কি করে গো,কোনটা কে?'
রেখা বলল ' বুঝতে হয় গো মশাই। বুঝতে হয়।'
মনোজ ব্যস্তভাবে বলল 'অ্যাই রেখা, দেখো দেখো পড়ে গেল ।ধরো ,ধরো ,ধরো।'
রেখা রেগে বলল 'তুমি কি গো কোন কাজ ঠিক করে করতে পারো না ।(ছুটে গিয়ে কর্নেল ও পাইলটকে ধরল।)
মনোজ বলল-এই রেখা এভাবে আমাকে ব'কো না। তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম যে ,আমি এত ছোট...।'
রেখা বলল ( হাত দেখিয়ে) ' থাম ,থাম, অনেক হয়েছে।
মনোজ বললো ' রাগ করছো?'
রেখা বললো 'তাহলে কি আমার করণীয় ছিল নেত্য করা ।
মনোজ বলল 'ঠিক আছে ।আমি চেষ্টা করছি। আমি একজন একজন করে নিচ্ছি।'
রেখা হাতজোড় করে বলল 'থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না।দয়া করে এদের দুজনকে ধরতে পারবে তো ?আমি ক্যাপ্টেন আর তুলিকে আগে রেখে আসি । তারপর এদের কে নিয়ে যাব।'
মনোজ বলল ' জো হুকুম ম্যাডামজি।'(বলেই কর্নেল পাইলটের গায়ে হাত বুলাতে লাগলো)।
রেখা বলল 'ধ্যান দিও।('সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো)।
রেখা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতেই শুনতে পেল মনোজের ফোনের রিংটোন ' যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে....'
রেখা মনে মনে ভাবল এই রিংটোন আবার কার জন্য লাগলো। যা করে করুক গে বলেই রেখা তুলি আর ক্যাপ্টেনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে ওপরে চলে আসলো।
এরমধ্যে মনোজ বিরক্তিভরে ফোনটা রিসিভ করল
'হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে কন্ঠ ভেসে এলো 'কেমন আছো ?খবর কি?'
মনোজ বললো 'ভালো আছি'।
অপরপ্রান্ত থেকে আবার কণ্ঠ ভেসে আসলো ' কি ব্যাপার ,তুমি যে আর আমার সঙ্গে দেখা করলে না?'
মনোজ বলল 'দেখ ,তিথি ।সব সময় তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয় ।আমার তো সংসার আছে ,তুমি জানো তো?'
তিথি বলল ' তা আর জানি না। তুমি মনের সুখে সংসার করবে আর আমি এখানে..?'
মনোজ এবার রেগে গিয়ে বললো 'বাজে কথা একদম বলবে না ,তিথি। তোমাকে সংসার করতে কেউ বারন করে নি।'
তিথি বলল 'সে তো তুমিই কারণ। তা কি তুমি জানো না?'
মনোজ এবার উঠে দাঁড়ালো কর্নেল আর পাইলটকে ছেড়ে দিয়ে' আলবত জানি।'
রেখা বলল' তবে আর আমাকে কেন প্রশ্ন করছো?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ'সে জানায় দুজনার মধ্যে পার্থক্য আছে বৈকি।'
এরমধ্যে কর্নেল আর পাইলট দুজনে বাইরের বারান্দার দিকে চলে গেছে।
রেখা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো ' কই দাও । কর্নেল আর পাইলটকে আমার কাছে দাও।'
মনোজ ফোনটাকে হোল্ডে রেখে বলল 'এ বাবা, এরা দুজন আবার কোথায় গেল?'
রেখা বলল 'তোমাকে কোন কাজ দিয়ে আমার শান্তি নেই ।'
মনোজ বলল 'রেখা আমি ধরেছিলাম ,সত্যি বলছি।'
রেখা বলল 'বলে গেলাম যে ওদেরকে একটু সামলে রেখো, দেখো ।আবার ওইদিকের বারান্দায় চলে গেলে ঝগড়া- অশান্তি শুরু হবে। '
রেখা বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। মনোজ পিছু পিছু গেল। মনোজ ততক্ষণে ফোনটা কেটেও দিয়েছে।
ওদিকে রেখার জ্যেঠি শাশুড়ি জোর চেঁচাচ্ছে'কুকুর তোমাদের ভাল লাগে তোমাদের জায়গায় রাখো না বাপু...।'
রেখা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল 'এবার ষোল কলা পূর্ণ হলো তো ?যে ভয়টা আমি পেয়েছিলাম সেটাই।'
মনোজ বিনীতভাবে বলল ' আমি কি করে বুঝবো বল রেখা?'
রেখা রেগে বলল 'থাক ,তোমাকে আর সাফাই গাইতে হবে না।
রেখা কর্নেল আর পাইলটকে গিয়ে কোলে তুলল। আর বলল'আমার সোনা বাচ্চারা তোমরা কেন দুষ্টু দুষ্টু করো। কত কথা আমাকে শুনতে হচ্ছে।'
ওইটুকু ছোট দুটি অবলা জীব রেখার কথাগুলো যেন মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর এমন মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।মনোজ দেখে অবাক হয়ে গেল।
ওদিক থেকে রেখার এই কাণ্ড দেখে জ্যেঠি শাশুড়ি আর জা টিপ্পনি কাটছে 'মরে যাই এসব আদিখ্যেতা দেখে। বাচ্চার স্বাদ তো পেল না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে ,বুঝলে বৌমা।'
অন্য সময় হলে রেখা হয়তো দু চার কথা বলত কিন্তু মাতৃত্ব নিয়ে কথা বললে রেখা সেখানেই যেন থেমে যায় ও যেন কোনো কথা বলার ভাষা খুঁজে পায় না ।
বুকের ভেতরে কষ্টের হাতুড়িগুলো যেন দড়াম দড়াম ঘা মারতে থাকে।
রেখা ভাবে 'তার মা হওয়ার সময় কি পেরিয়ে গেছে ?'অথচ তাকে এই ভাবে প্রতিনিয়ত কটাক্ষ করা হয়। চোখ জলে ভরে ওঠে।
মনোজ সেটা খেয়াল করে রেখাকে বলে ' বাজে কথা শুনতে নেই , গায়ে মাখতে নেই।ভেতরে চলো।'(ঠেলে ভেতরে নিয়ে গেল)।
মনোজ বলে 'সত্যিই আমার ভুল হয়েছে রেখা। আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না ।আসলে একটা ফোন এসে গেল।'
এরমধ্যে আবার ফোন বেজে ওঠে। কিন্তু মনোজ ফোনটা রিসিভ করে না।
আবার বেজে ওঠে 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...
রেখা বলে 'তোমার ফোন বেজে যাচ্ছে। ফোনটা তোলো।'
মনোজ বলে' বাজুক গে।'
আবার ফোন বেজে ওঠে
মনোজ বলে ' দু'দণ্ড শান্তিতে থাকতে দেবে না।'
রেখা মনে মনে ভাবে তার মানে সেই ভদ্রমহিলার ফোন ।এখনো মনোজকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে?'নির্লজ্জ- বেহায়া হলে এসব পারে?'
মনোজ এবার বাধ্য হয়ে ফোনটা তোলো
'হ্যালো।'
তিথি বলে 'অ্যাই ,এতক্ষণ ফোন ধরছিল না কেন গো?'
কথাটা শুনে মনোজের গা একদম রাগেতে রি রি করে উঠলো।
মনোজ বলল 'সে কৈফিয়ৎ আমি তোমাকে দেবো কেন?'
তিথি বলল 'দিতে বাধ্য তাই।'
এরমধ্যে রেখা বলল 'স্কুলে যেতে হবে আজকে তো ওই ট্রেনটা পাব না ।লেট ই হয়ে যাবে।'
মনোজ ফোনটাকে হোল্ডে রেখে বলল ' আজকে স্কুলে যেতে হবে না।'
রেখা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল' কেন?'
মনোজ বলল 'আমি বলছি তাই ?আজকে তো আমি অফিস যাব না।'
তিথি সমস্ত কথাগুলো শুনছে আর রাগেতে জ্বলছে।
মনে মনে ভাবছে আজকে তিথির ই মনোজের বউ হয়ে থাকার কথা ছিল ।সেখানে অন্য একটি মেয়ে সেই জায়গাটা দখল করেছে ।মনোজের হৃদয়াসনে তিথিই শুধু থাকবে। রেখা নয়। তার জন্য যা যা করা দরকার ।তিথি করবে।
তিথি বললো 'বাবা ব উ এর জন্য এত দরদ। এদিকে আমি তোমাকে কবে থেকে বলছি আমার সঙ্গে দেখা করার কথা..।
মনোজ বললো 'বাজে কথা বলবে না তিথি। আমি তোমাকে একবারও বলি নি ,আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাবো । আর তাছাড়া বউ তো বউই হয়।'
তিথি বলে 'তুমি বল নি?'
মনোজ বলে 'হ্যাঁ বলেছিলাম, কোন সমস্যা হলে ব'লো ।তাহলে যাব।'
তিথি বললো 'আমি তো সমস্যাতেই আছি।'
রেখা বলল 'তোমরা কথা বলো আমি রান্নাঘরের দিকে যাই। মিলিদের খাবারের সময় হয়ে গেল।'
মনোজ শুধু ঘাড় নাড়লো।
তিথি বললো ' বাহ ,তোমার বউটা তো খুব ভালো ।অচেনা একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছ, কিছুই বলল না।'
মনোজ বলল 'এই কথাটা তুমি একদম ঠিক বলেছ ।রেখার মত মেয়ে হয় না।'
তিথির কথাটা শুনে গা জ্বলে গেল।
মনোজ বলল 'এখন ফোনটা রাখছি।'
তিথি বললো 'তাহলে কখন ফোন করবে?'
কথাটা শুনে মনোজ আরো জ্বলতে শুরু করলো।
মনোজ বলল ' আমি কেন তোমাকে অকারণে ফোন করতে যাব ,বল তো?'
তিথি অবাক হয়ে বললো 'অকারণ !।আমি তোমার কাছে অকারণ?'
মনোজ রেগে ফোনটা কেটে দিলো এবং ফোনটাকে নট রিচেবল করে দিল।'
মনোজ মনে মনে ভাবতে লাগল সেই আমাদের দুজনের মুডটাকে অফ করে দিল ।বিরক্তিকর। কবে যে এর থেকে মুক্তি পাব কে জানে?
এরপর তো এই জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আমিই শেষ হয়ে যাবো?'