১৪ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"১২

ধারাবাহিক  শামীমা আহমেদ এর  ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ১২)
   শামীমা আহমেদ 


                               বিয়ের পরে যেখানে সবাই হাসি আনন্দে দিন কাটায় সেখানে তাদের দুজনকে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছে। কি জানি কখন বাবা তার লোকবাহিনী পাঠিয়ে মেয়েকে তুলে নেয়। কিন্তু বেশ অবাক করে দিয়ে রিশতিনার বাবা বিয়ের একমাসের মাথায় বিয়েটা মেনে নেয়। সবাই ভেবে নিলো যতই হউক মেয়ের জন্য পিতার হৃদয়তো কাঁদবেই।নিশ্চয়ই মেয়ের সুখের চেয়ে বেশি কিছু বাবা মায়েরা চাইবে না।
একদিন বেশ আয়োজন করেই মেয়ের বাড়ি এসে মেয়ে জামাইকে নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু শিহাব একেবারেই যেতে রাজী হলোনা। আর এখানেই একটা বিরাট বড় ভুল করে ফেললো শিহাব।
সেই যে রিশতিনা বাবা মায়ের হাতে বন্দী হলো আর তাকে নিজের করে পাওয়া হলো না। রিশতিনাও অভিমানে শিহাবের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। আড়ালে শিহাবকে রিশতিনার বাবা ভীষণভাবে অপমানিতও করেছিল আর যেন তার মেয়ের কাছে না আসে। তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিজের স্ত্রীর অধিকারে আর রিশতিনাকে ফিরে পাওয়া হলো না।এমন জাঁদরেল ব্যারিস্টার বাবার সাথে আইনি লড়াইয়ে জিততে পারাও অসাধ্য। যেখানে তাদের কাছে আইনের সব ফাঁক ফোকড় সবই জানা।শিহাবের সেই সব কষ্টকর দিনগুলোর সাক্ষী এই সুমাইয়া ভাবী। তার কাছেই সকল দুঃখ জমা রেখেছে আর সান্ত্বনা  খুঁজেছে।বাবার বাড়িতে বন্দী আর স্বামীর সাথে অভিমানীনি রিশতিনা। বেশ কয়েকমাস পরে বুঝা যায় সে তিনমাসের অন্তঃস্বত্তা। শিহাবের সাথে বিচ্ছেদ আর অতিরিক্ত টেনশনে রিশতিনার জীবন হুমকির মুখে চলে যায়।  রিশতিনার শারীরিক অবস্থার চিন্তা করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে  রিশতিনার বাবা সেই সন্তানের জন্মটা
মেনে নেয়।  এক মাসের শিশু সন্তানকে শিহাবের বাবামায়ের হাতে তুলে দিয়ে তার মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। শোনা যায় সেই ছাত্রের সাথেই তাকে বিয়ে দিয়েছে। শিহাবের সাথে রিশতিনার সকল যোগাযোগ চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সেই 
থেকে শিহাবের একার জীবন। আর আরাফকে  মাতৃস্নেহে বড় করছে সুমাইয়া ভাবী। তাঁর কাছে শিহাবের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কেমন করে একটা মেয়ে বিয়ের পর অচেনা একটি বাড়ি তথা বাড়ির মানুষদের জন্য নিজেকে এতটা উজাড়  করে দিতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সুমাইয়া।সুমাইয়া শিহাবকে
একেবারে রাতের খাবার খাইয়ে 
তবেই বেরুতে দিল। আরাফ ঘুমিয়ে গেলে 
শিহাব রাত প্রায় সাড়ে দশটায়  ঝিগাতলা থেকে উত্তরার দিকে রওনা হলো।শিহাব ভাবলো,রাত যত বাড়ে রাস্তা ততই ফাঁকা পাওয়া যায়।
একটানা বেশ লম্বা সময় বাইক চালিয়ে, প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে ফিরে, শিহাব কাপড়চোপড় না ছেড়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল।ভেতরের অনুভবে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ।মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিহাব অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলো।অসহ্য এ যন্ত্রণা! সারা সপ্তাহ নানান কাজেবনিজেকে ডুবিয়ে রাখা কিন্তু সপ্তাহটা শেষ হয় সেই কষ্টের স্মৃতি স্মরণে আনা।একদিকে রিশতিনার অভিমানী মুখখানি,আরেকদিকে মা হারা সন্তানের মায়া ভরা মুখ! সবকিছুর জন্য শিহাব নিজেকেই দায়ী করে। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। রিশতিনাতো সব ছেড়েই তার কাছে এসেছিল।কেন সে তাকে ধরে রাখতে পারলনা।এই অক্ষমতায় বারবার নিজেকে ধিক্কার দেয়।নিজেকে একজন ব্যর্থ স্বামী ভেবে  ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়।
হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠলো!  শিহাবের ভাবনার ঘোর কাটল। ওহ! আজ পৌঁছে মাকে ফোন দেয়া হইনি। উত্তরার বাসায় ফিরে মাকে কল না দেয়া পর্যন্ত মা ঘুমায় না। 
ফোন রিসিভ করে জানালো, হ্যাঁ, মা আমি ভালোভাবে পৌছেছি।
ঠিকাছে বাবা কাপড় ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
সন্তানদের নিয়ে মায়েদের উৎকন্ঠা আজীবন।
তাহলে রিশতিনা কিভাবে ভুলে আছে তার সন্তানকে।ঐটুকু দুধের শিশুকে ফেলে গেলো! এ কেমন মা! এজন্য তারও  রাগ ক্ষোভ জমে আছে রিশতিনার প্রতি।মনে হয় কখনো দেখা হলে সে জানতে চাইবে কোনপ্রাণে নিজের সন্তানকে ফেলে গেছো উচ্চশিক্ষা আর উন্নত জীবনের আকাংখায়?
এমনি শত প্রশ্ন ভীড় করে শিহাবের মনে।কেন তার জীবনটা এমন একাকীত্বে কাটছে?এমন নিঃসঙ্গ জীবনে যখন হাঁপিয়ে উঠে তখন একা একা বাইক নিয়ে বহু দূরে চলে যায়। কোন অচেনা গাঁয়ের নির্জন কোন খোলা জায়গায় একা একা বসে থাকে।মনে হয় প্রকৃতি যেন তার কথা শুনছে। সবাইকে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে।রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়।  কেবলি হেডফোন  লাগিয়ে নানান ধরণের গান শুনে ভেতরের কষ্ট গুলোকে সেচে ফেলতে চায়।কিন্তু দুঃখের চোরাবালি বারবার তাকে অতলে তলিয়ে নেয়।
তাইতো দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভুলে থাকবার জন্য পৈতৃকবাড়ি থেকে দূরে থাকা।মাকে এক সাগর কান্নায় ভাসিয়ে 
ব্যবসায়িক প্রয়োজনের অজুহাতে শিহাবের উত্তরায় চলে আসা।অবশ্য এতে  অচেনা জায়গায়,  নতুন পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে  কিছুটা হলেও কাজে ডুবে থাকা যায়।
নাহ! উঠতে হবে,
শিহাব আলসেমি ছেড়ে বিছানা থেকে উঠলো। নিয়তির লিখনের কাছে আমরা অসহায়। শিহাব ভাবে,কতজনের অন্তর কত কারণে এভাবে ধিকিধিকি জ্বলছে! কার খোঁজ কে রাখে।শুধু যার যার ক্ষত দগদগে কাঁচা ঘাঁয়ের মত হয়ে আছে। জীবনে কার কী অপ্রাপ্তি,কার জীবনে কী চেয়ে কী পায়নি, কে পেয়েও মূল্য বুঝেনি, কে সবটা উজার করে  দিয়ে হয়েছে নিঃস্ব। কেবলি দিয়ে যাওয়ার আনন্দেই নিজের পাওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে বেশ অনুযোগের সুরেই শিহাব বিধাতার কাছে প্রশ্ন রাখে,দিয়ে যদি নিয়েই যাবে,তবে কেনইবা দিয়েছিলে?
কত সন্তানহীনা মায়ের ক্রন্দন,  আবার কত শিশু মায়ের বুকে ঘুমানোর ভাগ্য নিয়ে আসে না।এ বৈষম্য বুঝাবার ক্ষমতা মানুষের মত ক্ষুদ্র প্রাণীর নেই।
শিহাব সব রাগ ক্ষোভ অভিমান অনুযোগ বিধাতার কাজে পেশ করে  আলসেমি ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠল!
হঠাৎ মেসেঞ্জারের শব্দে মোবাইলে তাকালো।উফ! সেই মহিলার মেসেজ! খুব বিরক্ত করছেন মহিলা।শুধু যে মেয়েরা ছেলেদের দ্বারা  হ্যারাস হয় সেটা নয়,
সিঙ্গেল পুরুষদেরও অনেক যন্ত্রণা সইতে হয়।কোনভাবে কেউ জানতে পারলে আর পিছু ছাড়তে চায় না।মেসেঞ্জারে 
সুমাইয়া ভাবীর মামাতো বোন রুবানা ।একবার ভাবীর বাসায় দেখা হয়েছিল।এরপর থেকেই ভীষণভাবে শিহাবের পিছু নিয়েছে। সে বেশ লোনলি ফিল করে। স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে।আদৌ কোনদিন ফিরবে কিনা! কোন যোগাযোগ আছেই কিনা! তার সময় কাটে না একেবারে। কিন্তু শিহাবতো এই জীবনে আর কাউকে জড়াবে না, সে ব্যাপারে খুবই কঠোর মনভাবে।আজো কোথাও বেড়াতে গেলে  মুরুব্বিদের একই প্রশ্ন এখনো বিয়ে করোনি! আমাদের দেশে কী মেয়ের অভাব? আরে রানাবান্নার জন্যও তো একটা লোক লাগে,শিহাব এইসব কথাগুলো 
খুব ঘৃণার চোখে দেখে। শিহাব রুবানার মেসেজ সিন করে রেখেদিল।কোন উত্তর দিল না। 
ওহ! ভুলেই তো গিয়েছিলাম! নতুন পরিচিত ভদ্রমহিলার সাথে তো সারাদিন আর কথাই হলোনা।নাহ! একটা মেসেজও রাখেনি।কেমন কাটখোট্টা স্বভাবের হায়! শিহাব কে কেউ এড়িয়ে গেছে,সেটা তার পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব। বরাবরই সে মানুষের এটেনশঅন পেয়েছে।
শিহাব কাপড় বদলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিল।খাটের কিনারায় বসে একটা বেনসন স্টিক ধরালো।প্রতি রাতের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে এটা। 
এয়ারকুলারটি সাতাশে সেট করে এস্ট্রেতে সিগারেট ফিল্টারটি পিষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।
সকালে ঘুম ভাঙল শায়লার মেসেজের শব্দে--
কাল বিকেলে ফ্যামিলির সাথে খুব ঘুরে বেড়ালেন বুঝি?,,, 
চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much