শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৬০)
শামীমা আহমেদ
শিহাব হাতের ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে নিলো।ঘড়ির কাঁটায় তখনো চারটা বাজতে আরো প্রায় দশ মিনিট বাকী। গাড়িতে বসেই শিহাব শায়লাকে জানালো, সন্ধ্যে হতে এখনো বেশ সময় আছে। চলো,এখানে একটু বসি। এই রেস্তোরাঁটিতে আমি প্রায়ই আসি। খোলামেলা পরিবেশে সাত তলার উপরে আলো বাতাসে খুব ভালো লাগে। শায়লা শিহাবের অনুরোধ রাখতে উবার থেকে বেরিয়ে এলো। শিহাব উবার ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নামল। যদিও শায়লার একটু কেমন যেন ভয় ভয় করছিল তবুও শিহাবের প্রতি যখন বিশ্বাস এনেছে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। যদিও বিশ্বাসটা সময়ের সাথে সাথে ভেতরে বেশ শক্ত একটা জায়গা করে নিয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে দুজনেই লিফটে উঠল। শিহাব সেভেন বাটনে পুশ করে গন্তব্য স্থির করলো।এ সময়টা একটু ফাঁকাই আছে। লিফটে মানুষের যাতায়াত কম । ছোট্ট লিফটে খুব হলে চারজনের জায়গা নিবে। শায়লা শিহাব খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কিন্তু মনের ভেতরে দুজনারই অতীত ভবিষ্যৎ আর বর্তমানের হিসেব নিকেশ চলছে সে বুঝা যায়। চারপাশে কাঁচঘেরা লিফটের ভেতর দুজন দুজনকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে। দুজনেরই চোখে চোখ পড়তেই শিহাব শায়লার হাতটি শক্ত করে ধরে চোখে অভয় জানালো। এখন যেন শায়লার মাঝে একটু ক্লান্তি এসেছে।একেবারে অপরিচিত একটি পরিবারের সাথে সারাদিন নানানভাবে মিশতে হয়েছে।অনেক কিছু বুঝতে হয়েছে। রিশতিনার আগমনের ঘটনাটিও তাকে বিব্রত করেছে।মনের ভেতর বিক্ষিপ্ত ভাবনায় সে অপরাধবোধে ভুগেছে। এর সাথে নিজের জীবনের যোগ বিয়োগও ভাবতে হয়েছে।ক্ষনিকের আবেগের প্রকাশ যে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে শিহাবের সাথে চলতে গিয়ে আজ সেটাই মনে হচ্ছে। একজন অচেনা মানুষ সময়ের স্রোতে কতটা আস্থা অর্জন করে নিতে পারে। শায়লা গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।
শিহাব জানতে চাইল, শায়লা কি ভাবছো?
শায়লা নিজের মাঝে ফিরে এলো!
না, না কিছু না।
কিছু না বললেও আমি সব বুঝি শায়লা।তুমি রক্ষনশীল ঘরের মেয়ে তোমার জন্য এ বিষয়টি অস্বস্তিকর হতেই পারে।উপরে চলো, ওখানকার পরিবেশে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি।শায়লা মনকে ফ্রি করে নিলো।
লিফট সাততলায় থামতেই শিহাব শায়লার হাত ধরে একসাথেই বেরিয়ে এলো।শায়লা যতটা ভয় পেয়েছিল জায়গাটা তেমনটি নয় একেবারে। বলা যায় নিজ বাড়ির ছাদে গাছপালা ঘেরা থাকলে আর কিছু বসার ব্যবস্থা থাকলে যেমনটি হয়। চারদিকে নানান ধরনের গাছ দিয়ে ঘেরা। কিছু বড় বড় গাছ দিয়ে একটু আড়াল করাও হয়েছে। যেনো অতিথিরা নিজেদের প্রাইভেসি রাখতে পারে। শায়লা সবুজের মাঝে গিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। সারাদিনের ক্লান্তি চলে গেল্য। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি বসার আয়োজন। দুজন, চারজন, তিনজনের এমন করে খুব অল্প অল্প দুরত্বে বসার ব্যবস্থা। বসার চেয়ার, টেবিলগুলোও মনকে টেনে নিলো। রুফ টপের এমন সুন্দর আয়োজনে শায়লার মন ভালো হয়ে গেলো। শিহাব শায়লার মুখের প্রতিক্ষণের অভিব্যক্তি নজরে রাখছিল।এখন শায়লার মুখের ভালোলাগা প্রকাশে শিহাব একটু নিশ্চিন্ত হলো। শায়লা একবার চারপাশে দেখে নিলো।বেশ সুন্দর কিছু বাতিও আছে।উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া। অনেকদিন পর শায়লা এমন খোলামেলা কিন্তু আবার একটু নির্জনতায় শায়লার খুব ভাল লাগল। দুজনের জন্য বসার টেবিলে ওরা বসলো। এখনো তেমন ভরাট হয়নি। শুধু ঐদিকে আরেকটি কাপল বসে কথা বলছে। ওরা কথা বলছে।আসলেই দুজনার বোঝাপড়ার জন্য এমন একটু জায়গা খুবই মন কেড়ে নেয়। বেশ শৈল্পিকভাবে সাজানো সবদিক। একপাশে কিচেন ও ফ্রন্ট টেবিল কর্ণার। সেখানে খাবার অর্ডার করতে হয়। শায়লার মনে হলো নিশ্চয়ই কোন বিদেশি রেস্টুরেন্টের আদলে এটা সাজানো হয়েছে। ওপাশের ছেলেটি প্রচুর স্মোক করছে। সবুজ পরিবেশে এমন ধোঁয়া নিঃশ্বাসে ঢুকে যাচ্ছিল। শায়লার এ বিষয়টি ভালো লাগলো না একেবারে। এ জায়গটা স্মোক ফ্রি জোন করে দেয়া উচিত।এখানে এসেও যদি রাস্তার সেই কালো ধোঁয়াই ঢুকল তবে আর এত সবুজের আয়োজনে কি হবে? শায়লা বেশ বিরক্ত হলো মনে মনে। মানুষের একটু কমনসেন্স আসা উচিত।
শায়লা শিহাব টেবিলে মুখোমুখি বসলো। খুব কাছাকাছি দুজন।শিহাব কথা বললো, আজতো আমাদের বাসায় নিজেদের কোন কথাই হলোনা। একটু কথা বলতে তাই এখানে এলাম। শায়লা, আমাকে তোমার যা বলার আছে এখন তুমি সব বলতে পারো।মোবাইলে কথা হলেও সব কথা বলা হয় না,চোখে চোখ রেখে কথা বলায় অনেক গভীরতা আর বিশ্বাস থাকে। থাকে কথা দেয়া নেয়ার শপথ।কিন্তু ওপ্রান্তে শায়লা নীরব হলেও কেমন যেন নিজেকে পূর্ণ মনে হচ্ছে।শিহাবকে নিয়ে কোন প্রশ্নই তার মাঝে আসেনা। সন্দেহ করার মত কোন কিছু সে শিহাবের মাঝে দেখেনি। শিহাবের এই স্বচ্ছতা মনে কোন প্রশ্ন আনেনা নাকি তার নিজের সরলতায় কোন জিজ্ঞাস্য আসে না? মনে হচ্ছে সে যেন শিহাবকে এতটা কাছে পেয়েই তৃপ্ত হয়ে গেছে।আর কিছু জানার নেই, বলার নেই।তবে মাঝে মাঝে সবই স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু। আবার অজানা আশংকায় ভেতর ভেতরে হু হু উঠছে, চোখ জলে ভরে যাচ্ছে।
শিহাব একটু ব্যস্ত হলো। সে মোবাইল বের করে রাহাতকে কল দিলো। সারাদিন আর কোন আপডেট রাহাতকে দেয়া হয়নি।নিশ্চয়ই ওরা অপেক্ষায় আছে।
রাহাত আর মা আজ সারাদিন উৎকন্ঠায় কাটিয়েছে।সারাদিন পর শিহাবের কল পেয়ে রাহাত এক রিংয়েই রিসিভ করলো। তবে
শিহাবই প্রথম কথা বলে উঠলো।
--রাহাত এইতো আমরা একটু আগে উত্তরায় ঢুকেছি। তোমার আপুকে নিয়ে আমি টেবিল টপে আছি। চিন্তা করোনা, আমরা বিকেলটা এখানে থাকবো। শায়লা সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছে যাবে।
রাহাতকে নিয়ে সেদিন শিহাব এখানেই দেখা করেছিল। রাহাতের কাছে ভালোই লেগেছে। রাহাত বুঝে নিলো।হ্যাঁ, ওদের দুজনের একটু একান্ত সময় প্রয়োজন।
রাহাত জানালো, জ্বী আচ্ছা ভাইয়া।কোন অসুবিধা নেই। আমি বাসায় আছি।শিহাব শায়লার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলো।
এই নাও, শায়লার সাথে কথা বলো।
শিহাব তার মোবাইলটা শায়লার দিকে এগিয়ে দিলো।
শায়লা রাহাতকে বেশ হাসিখুশিতেই জানালো, রাহাত আমরা এইতো রুফটপের রেস্তোরাঁয় আছি। সন্ধ্যের আগে চলে আসবো।
ঠিক আছে আপু,বলে রাহাত শায়লাকে আনতে যেতে হবে কিনা জানতে চাইলে শায়লা জানালো, না আমি নিজেই চলে আসতে পারবো।
এবার শিহাব পুরোপুরি শায়লার দিকেই মনোনিবেশ করলো। বলো শায়লা কিছু বলো আজ আমাদের বাসার সবাইকে কেমন লাগলো? আমি তোমার কাছে থেকে কিছু শুনতে চাই।
শায়লার সবার আগেই ভাবীর কথা বললো।ভাবীকে আমার খুব ভালো লেগেছে।কিভাবে ভাবী সবদিক ম্যানেজ করছেন।
হ্যাঁ, শায়লা ভাবী আছে বলেই সবাইকে নিয়ে এতটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি। ভাবী হলেও সে আমার কাছে বন্ধুর মতো। আমার সবকিছুই ভাবীর জানা। শুধু,,
শুধু? শায়লার মুখ ফুটে শব্দটা বেরিয়ে এলো।
শুধু তোমার কথাটাই বলা হয়নি সেভাবে।
কেন জানতে পারি?
আসলে শায়লা আমি বুঝতেই পারিনি তোমার সাথে এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যাবে।একসময় জীবন নিয়ে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।আরাফকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। বাবা মায়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।ভাবীও নীরবে সবদিক সামলে যাচ্ছিলেন।নিজেকে বেশ অপরাধী লাগছিলো।আর এখন কি জানো শায়লা?
কি?
এখন মনে হয় তোমার উপর আমি যেন আমার সবটা নির্ভরতায় রেখেছি। শায়লা তুমি আমাকে একা করে কোনদিন চলে যেও না।
শায়লা বুঝতে পারলো,রিশতিনার চলে যাওয়ার আঘাত আজো শিহাবের অবচেতন মনকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগাচ্ছে। বারবার শায়লার প্রতি তার আকুলতায় নিজেকে সমর্পন করছে। শায়লা নিজেও জানেনা,দুজনার জীবনে কিভাবে দুজনের নির্ভরতার ভরসা হলো।
ওয়েটার পাশে এসে দাঁড়াতেই দুজন যেন এই জগতে ফিরে এলো। শিহাব দুটো কোল্ড কফির অর্ডার করলো। শায়লাকে জানালো,ওদের কোল্ড কফিটা খুব ভালো হয়।
শায়লা সম্মতি জানাতেই শিহাব মিষ্টি হেসে শায়লার হাতের উপর হাত রাখলো।
শায়লা দেখলো, অপূর্ব এক মায়াভরা চাহনীতে শিহাব তার দিকে তাকিয়ে।
চলবে...