একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (৪৬)
চিরন্তন গন্ধ
সবুজে ঘেরা গ্রাম আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ।ওদের মাটির ঘরগুলো এত সুন্দর করে নিকানো। মনে হতো বারবার দেখি।পাখি ,লতা, পাতা, ফুল সুন্দর করে চিত্রিত করা। জায়গাটির পাশে আসলেই মনে পড়ে যায় ছোট্টবেলার সেই দিনগুলোর কথা। গাড়ি অবশেষে এসে পৌঁছাল আদ্রাহাটিতে। মনোজ বলল, রেখা কতদিন পর তুমি তোমার নিজের গ্রামে আসলে। চিনতে পারছো?
রেখা বলল 'চিনতে পারব না?'
ওই তো বারোয়ারি ঠাকুর দালান।
একসময় এই ঠাকুরদালানে বিকেল বেলায় কত আড্ডা হতো বয়:জ্যেষ্ঠদের।
ওতো পঞ্চানন কাকার দোকান। পঞ্চানন কাকাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?'
গাড়ি এসে থামল।
রেখা আরো বললো 'পাশের বাড়ির বুলু জেঠিমা, বুড়োদা,নীলুদা কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
বাড়ির ভেতরে অবশ্য কারুর কারুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।'
মনোজ বললো 'চলো আগে বাড়িতে।'
রেখা বলল ' হ্যাঁ ,ঠিক বলেছ।'
রেখা উঠোনে পা দিয়ে ডাকতে শুরু করলো 'কাকিমা ,কাকিমা ,কাকিমা..,।'
ঘরের থেকে আওয়াজ আসলো 'কে?'
ভেতরের গেটের দরজাটা ছিটকিনি লাগানো ছিল খুললেন।
সন্ধ্যা কাকিমা বেরিয়ে এসে বললেন ' কে?'
রেখা বলল 'আমি ননী ।'
সন্ধ্যা কাকিমা বললেন ' ননী এসেছিস? আয় মা ।কতদিন পর তোকে দেখছি।'
মনোজ বলল 'তোমার নাম আবার ননী নাকি জানতাম না তো?'
কাকিমা শুনতে পেয়ে বলল ' জামাই ও ছোটবেলায় একদম মাখনের মতো ছিল। তাই আমরা ওকে ডাকতাম ননী বলে।'
ঘরের থেকে কাকা আওয়াজ পেয়ে বিছানা থেকে বলল 'কে ?কে এসেছে?'
কাকিমা বলেন 'ওই এক বাতিকগ্রস্ত লোক হয়ে গেছে ।যখনই কারো আওয়াজ পাওয়া যাবে ।মনে হবে যেন তোমরা এসেছ।
আজকে অবশ্য তার অনুমান সঠিক হয়েছে।'
গলাটা বাড়িয়ে সন্ধ্যা কাকিমা বললেন 'ননী এসেছে'।
বলতে বলতেই রেখা আর সন্ধ্যা কাকিমা ভেতরে ঢুকে আসলো।
রেখা ও মনোজ কাকা- কাকিমাকে প্রণাম করলো।
কাকার একটা সাইট প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে ।কাকা অবনীবাবু তাই বলেন 'থাক প্রনাম করতে হবে না ।তোমরা এসেছ এতেই আমার মনের শান্তি। আজকাল তো বড়ো কেউ আসে না।'
কাকা নিজের মনে বলেই চললেন ' অথচ এক সময় এই বাড়ি লোকজনে সব সময় পরিপূর্ণ ছিল।
হাসি -ঠাট্টা, মজা -আনন্দ ,উৎসব বা পূজা-পার্বণেতে অবশ্য অনেক বেশি হত।'
রেখা বললো ' এখন কেমন আছো কাকা?'
কাকা অবনীবাবু বললেন 'ভালো নেই মা ।তবে তোমরা আসাতে মনটা অনেক ভালো লাগছে।'
রেখা বলল 'কাকিমা সোমু এসেছিল?'
কাকিমা বলল 'হ্যাঁ এসেছিল ওর স্বার্থে।
ছেলেটাকে এখানে রাখতে এসেছিল।'
রেখা বলল 'তাই নাকি?'
কাকা বললেন 'ননী মা,বলে দিয়েছি সংসারটা তুমি ভেঙ্গেছ ।সুতরাং তোমার সংসারের দায়-দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। হ্যাঁ, তুমি এখানে বেড়াতে আসতে পারো কিন্তু বাবা-মায়ের ঘাড়ে ছেলে রেখে দিয়ে তুমি ফূর্তি করে বেড়াবে ।সেটা হবে না।'
কাকিমা বললেন 'ছেলেকে সম্পত্তি দিয়েছে বলে মেয়ের রাগ। আবার ছেলেকে সম্পত্তি দিয়েও তাদের কোন সন্তুষ্টি নেই।'
কাকা বললেন 'দানপত্র করেছিলাম তো এখন ফেরতের জন্য মামলা করেছি বুঝলে, ননী মা।'
মনোজ বলল 'কাকা মামলার রায় আপনাদের পক্ষে যাবে ।আর সিনিয়র সিটিজেনশিপ মামলা করলে সেটা আরো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে।'
কাকিমা চা বানিয়ে নিয়ে এসে বলেন'কি আর বলব দুঃখের কথা বাবা ।ছেলের সাথে শেষ পর্যন্ত মামলা করতে হলো।'চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন
এই নাও চা খাও বাবা, ননী তোর চা নে।'
মনোজ ও রেখা দুজনেই বলল 'কি দরকার ছিল কাকিমা এখন চা করার?'
কাকা ও কাকিমা বললেন'কি বলছ তোমরা মেয়ে জামাই বাড়িতে এসেছে চা খাওয়াবো না?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে কাকিমা ।চা টা আমিও তো বানাতে পারতাম ।কষ্ট করে তুমি বানাতে গেলে?'
কাকিমা বললেন 'কষ্ট কিসের ননী ।কতদিন পর তুই আসলি। বাড়িতে যেন লক্ষ্মীর প্রবেশ হল। কী শান্তি যে পাচ্ছি মা, কি বলি? তোমরা বসো আমি একটু তোমাদের খাবার আয়োজন করি দুপুরের।'
রেখা ও মনোজ বলল 'না কাকিমা, তোমাকে কিছু করতে হবে না ।আমরা রায়দার হোটেল থেকে খেয়ে এসেছি ।বর্ধমান আসার পথে যে হোটেলটায় আগে তোমরা দাঁড়াতে ।এখানে ওখানে গেলে। মনে আছে?'
কাকু বললেন 'হ্যাঁ কতবার আমরা ওখানে যেতাম রে ননী,সেসব সোনালী দিনগুলো কোথায় গেলো?'
রেখা বলল 'এই জন্যই তো কাকু ওখানে আমরা খেলাম ।আসলে ওখানে গেলে তোমাদের সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়ে ।স্মৃতি জড়ানো হোটেল।'
কাকু বললেন'হ্যাঁ রে রায়বাবু চিনতে পারলেন?'
রেখা বলল 'না ,উনি ছিলেন না ।তাছাড়া জানো তো কাকু ? হোটেলটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।'
কাকু বললেন ' তাই নাকি?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ কাকু ।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন সবকিছুই পাল্টে যাচ্ছে।'
কাকিমা বললেন 'তোদের সেদিন আসার কথা ছিল তোরা আসলি না ।আর আজকে আসলি একটু তো বলবি যে ,আজকে আসছিস আমি রান্না করে রাখতাম। এটা খারাপ দেখায় মা ।জামাইকে নিয়ে এসেছো। তোমার মা বেঁচে থাকলে এটা করতে পারতে?'
রেখা কাকিমার হাত দুটো ধরে বলল'না কাকিমা তোমাদের বয়স হয়েছে তো বলো,আর কাকুর এরকম অবস্থায় এই জন্যই আমি বলি নি। তুমি কিছু মনে ক'রো না। নইলে তোমার হাতের মান কচু বাটা না খেয়ে যেতাম আমি?'
কাকিমা বললেন 'আমার হাতের মান কচু বাটা তোর এখনো মনে আছে মা?'
রেখা বলল ' শুধু মান কচু বাটা আর কলাই ডালটা মান কচু দিয়ে কি সুন্দর বানাতে তুমি ।সেটা যে খেয়েছে ,তাকে আবার তোমার কাছে এসে খাবার ইচ্ছা জাগবে।(গাল দুটোকে ধরে একটু আদর করে দিলো)।
কাকিমা বললেন 'তুই আগের মতই আছিস মা। এরকমই থাকিস।'
কাকা বললেন 'ননী জিজ্ঞেস করলি না তো ,তোর দাদা এসেছিল কিনা?'
এই কথাটা রেখার জিভের ডগায় এসেছিল কিন্তু কাকার এই সব কথা শোনার পর আর সাহসে কুলায়, নি।
কাকা বললেন 'সেও এসেছিল। তার বউ এক দিন ও রাত্রি বাস করতে চায় নি। ছেলেটা তো পুরো ভেড়া বনে গেছে।'
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকা আরো বললেন 'এই তো আমরা আছি ননী? এখন চলে গেলেই বাঁচি বুঝলে?
রেখা বললো 'এভাবে কেন বলছো কাকা?'
কাকা বললেন'দুনিয়াটা এরকমই মা ।একটা গান আছে না ?'ওরে স্বার্থ ছাড়া বন্ধুবান্ধব কাছে আসে না। বিনা স্বার্থে দুনিয়ায় কেউ ভালোবাসে না। স্বার্থ ছাড়া ভালবাসে শুধু আমার মা।'
কাকিমা বললেন 'ছাড়ো না ওদের কথা।'
রেখা বলল 'তোমাদের সংসার কি করে চলে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'তোমার কাকার পেনশন থেকে।'
রেখা বলল 'দাদা , কিচ্ছু পাঠায় না তোমাদের জন্য?'
কাকিমা বললেন 'মিথ্যে কথা বলব না। প্রথম প্রথম পাঠাতো। এখন তো পুরোই বন্ধ।'
রেখা বলল 'সে কি কথা কাকিমা ?'
কাকিমা বললেন 'তোমার কাকার ওষুধ আছে ।ফিজিওথেরাপি আছে। আমার ওষুধ আছে ।কিভাবে যে চলছে..?'
রেখা বলল 'তোমরা এখানে একা থাকবে কি করে ?একটা কথা বলব?'
কাকিমা বললেন 'বল?'
রেখা বলল 'তোমরা আমার ওখানে চলো না?'
কাকিমা বললেন 'সেটা কখনো হয়?'
মনোজ রেখা দুজনেই বলল 'কেন হয় না কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'নিজের বাড়ি থাকতে ,মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকা শোভা দেখায় না?'
রেখা বলল 'কেন কাকিমা মেয়েরা কি মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারে না।'
কাকু কাকিমা দুজনেই বললেন'নিশ্চয়ই পারে মা। কিন্তু আমার নিজের সন্তানরা বেঁচে থাকতে তোমার শ্বশুর বাড়িতে যাবো ,সেটা কি ভালো দেখায় মা?'
মনোজ রেখা চুপ করে থাকে।
কাকু বললেন 'তাছাড়া তোমার বাড়ি তো যৌথ পরিবার ।এমনিতেই শুনেছি রেখাকে পছন্দ করে না।
আমরা কোন চাপ বাড়াতে চাই না।'
রেখা বললো 'তাহলে কিন্তু আমি একটা কথা বলব ।সেটা তোমাদের মানতে হবে।'
কাকিমা বললেন ' কি কথা?'
রেখা বলল 'আমি মাসে মাসে তোমাদের টাকা মানি অর্ডার করে পাঠাবো ।সেটা তোমাদের নিতে হবে।'
কাকু কাকিমা দুজনে বললেন ' সেটা আমরা কি করে নেব মা?'
রেখা বলল 'কেন কাকু -কাকিমা ,আমি কিছু দিতে পারি না ?আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি না?'
কাকিমা বললেন 'দেখো মেয়ের রাগ হয়ে গেল।'
কাকু বললেন ছোটবেলায় ননীকে আমরা সকলেই ভালোবাসতাম ,অন্য সন্তানদের থেকে বেশি।'
কাকিমা বললেন 'সেইজন্য সোমু কত রাগ করত, ওর সঙ্গে হিংসা করত ,দেখ নি?'
কাকু বললেন 'ছোট থেকেই ও হিংসুটে ছিল?'
কাকিমা বললেন 'কী করে ও আমাদের সন্তান হলো বলো তো?'
রেখা বলল 'থাক কাকিমা, ছাড়ো ।আসলে ও ছোট ছিল তো ,এজন্য আদরটা বেশি পেতে চাই তো?'
কাকিমা বললেন 'দেখলে এই হলো আমাদের ননী। ওর বরাবর ছোট থেকে এই রকম শুভবুদ্ধি ছিল।'
কাকু বললেন 'হ্যাঁ গো ,ওদের ড্রাইভারকে কিছু খেতে দাও ।কি ভাববে বেচারা বলো তো?'
কাকিমা মা বললেন 'হ্যাঁ ,হ্যাঁ ।ওকে কিছু জল মিষ্টি দিয়ে আসি।'
মনোজ বলল 'অতো ব্যস্ত হতে হবে না কাকু- কাকিমা ।ও তো খেয়ে এসেছে আমাদের সাথে।'
কাকিমা বললেন'যতই খেয়ে আসুক বাবা ,আমাদের কর্তব্য এটা করা ।আতিথেয়তা।'
রেখা বলল 'কাকিমা তোমাকে যেতে হবে না ।আমি দিয়ে আসছি।'
কাকিমা উঠার চেষ্টা করল কিন্তু দুপায়ে এতটা ব্যথা কাকিমা বলে উঠলেন 'বাতের ব্যথায় আমাকে কাবু করে ফেলল রে ননী?'
রেখা বলল 'সাবধানে কাকিমা '।(সঙ্গে সঙ্গে কাকিমাকে ধরে নিল)।
কাকিমা বললেন 'চল মা ।আমার সাথে ভেতরে চল।'
রেখার ভেতরে যেতে গিয়ে দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালো।
কাকিমা বললেন ' কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি?'
রেখা বলল' মায়ের ছবি দেখছি কাকিমা?'
তুই চোখে জল পড়ছে রেখার।
কাকিমা রেখাকে বুকের কাছে নিয়ে বলল'কাঁদিস না মা ।চিরদিন কি কেউ থাকে বল?'
কাকু বললেন 'ননী কাঁদছে কেন?'
কাকিমা বললেন ' কাঁদছে কেন বুঝতে পারছ না?'
কাকু বললেন 'তোর মা বাবা দুজনে ই চলে গেলেন ।ভালোই হয়েছে ।এখন আমাদের যাবার পালা।'
কাকিমা বললেন 'তোর মা আর আমি কত খুনসুটি করেছি রে ।এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর কত আমাদের জায়ে জায়ে মিল ছিল।'
রেখা বলল 'তা আর দেখি নি? তোমরা তিনজন মিলে ভাগ ভাগ করে কাজ করতে ,তোমাদের ভেতরে কখনো কোনো ঝগড়া হতে দেখি নি।'
কাকিমা বললেন ' ঝগড়া আমরা করি নি ।তাছাড়া আমাদের করার সাহসও ছিল না। তোমার দাদু ঠাকুমার কড়া শাসন ছিল। যদিও ঝগড়া করার প্রবণতা আমাদের ভেতরে ছিল না।'
রেখা বলল 'কাকিমা কৌটোগুলোতে কি রেখেছো নাড়ু?'
কৌটো খুলেই টপাটপ কটা নাড়ু খেয়ে নিল রেখা।
আর বলল কাকিমা এই নাড়ুগুলোই আমাদের ড্রাইভারকে দিচ্ছি ।তোমাকে এক্সট্রা মিষ্টি দিতে হবে না।'
কাকিমা বলল' তাই হয় ,মিষ্টি না দিলে কি ভাববে?'
রেখা বললো 'কিছুই ভাববে না ।এরকম হাতে বানানো জিনিস ,যেখানে ভালবাসার পরশ পরোতে পরোতে লেগে রয়েছে ।সব সময় তো দোকান থেকে কিনে খাওয়াই হয় ।এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে বল তো কাকিমা?'
কাকিমা এনে প্লেটগুলো রেখার হাতে দিল ।
রেখা তাতে নাড়ু, মোয়া, মুড়কি, নারকেলের শাঁস ছাড়িয়ে প্লেটে করে নিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে দিল।
আর বলল 'এই নিন সঞ্জুদা।'
সঞ্জু বললো 'আরে ব্বাস, দারুন জিনিস তো?'
রেখা বলল 'সেই জন্যই তো আনলাম।'
সঞ্জু বলল ' চিরন্তন খাবার ।যেগুলো প্রায় এখন শহরের বাড়িতে খুব কম হয়। যার বাড়িতে যাও শুধু মিষ্টি আরো মিষ্টি।'
রেখা বলল 'আপনার পছন্দ হয়েছে?'
সঞ্জু বলল 'আলবত। এর মধ্যে দিয়ে আমি আমার মায়ের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি।'
ক্রমশ