টানাপোড়েন ৬৩
থাবা
উদাসী বাউল মনটাকে রেখা যতই রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে ,ততই যেন বাঁধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের নস্টালজিক স্মৃতিকে সরিয়ে দিয়ে এখন নগরজীবনের ব্যস্ততা, ধোঁয়া ধূসরতা...। স্বপ্নগুলো শুধু ফিকে হবার পালা। সারা রাস্তা আসার সময় রেখা গাড়িতে বসে এসবই ভাবছিল।
আবার সেই শহর। শহর জীবনের ব্যস্ততা ,নাগরিক ক্লেদাক্ততা,অসুস্থতা ।কেমন যেন একটা পাগল পাগল ভাব। গাড়ি এসে যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছালো ।রেখা কলিং বেল টিপল আওয়াজ হলো -জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা ..। যে প্রত্যাশায় দরজা খোলার আওয়াজে মন পুলকিত হয়ে ওঠে, আজ সে দরজা খুলবে পার্থ ।
যথারীতি দরজা খুলে গেল।দরজা খুলে দিলে পার্থকে মনে হল এক দিনে কতটা পরিপক্কতা লাভ করেছে, কি একটা দুশ্চিন্তা তার মনকে গ্রাস করেছে স্পষ্টই বোঝা যায়।
দরজা খুলেই পার্থ বলল' আপনি এসেছেন বৌদি, এবার আমি নিশ্চিন্ত।'
রেখা বলল' পার্থ ভাই ,তুমি কাল রাত্রে যদি দাদার পাশে না থাকতে, কি যে করতাম? সেটা আমি ভাবতেই পারছি না। তাই ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে আমি ছোট করবো না, তুমি তার অনেক ঊর্ধ্বে। তুমি কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থেকো চিরকাল।"
পার্থ বলল 'আমার মায়ের অসুস্থতার সময় দাদা যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তা অন্য কেউ করবেন না?'
রেখা বলল' তা হলেও।'
পার্থ বলল 'এভাবে বলবেন না আমরা তো প্রত্যেকেই মানুষ ,প্রত্যেকের জন্যই আমরা। একটা কথা আছে না সকলের তরে সকলে মোরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। "
রেখা বলল' দাদা কি করছে?'
এবার পার্থ বলল 'দাদা একটু ব্রেকফাস্ট করল, এখন একটু রেস্ট নিচ্ছ ।'
রেখা বললো' দাদা খুব চিন্তায় আছে ,না পার্থ?'
পার্থ বলল ,'দাদাকে দেখে তো সেটা বোঝা যায় না ।তবে কিছু তো একটা চিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা বোঝা যায় ।'
রেখা ভালো করে বাইরের জামাকাপড় সব ছেড়ে হাত মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে ,স্যানিটাইজার ইউজ করে রুমে ঢুকলো।
মনোজ শুয়েছিল চোখ বুজে ।
রেখা যেন কিছুই হয় নি এইভাবে প্রশ্ন করল 'কিগো মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছো?'
মনোজের মুখ শুকনো ।ভেতরে একটা চিন্তা সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে।
মনোজ বলল ' টেস্ট রিপোর্ট কি আসবে কে জানে?'
রেখা বলল 'যা আসবে সেটাকে হাসিমুখে মেনে নিতে হবে ।'
মনোজ বললো 'মিলিদের সঙ্গে দেখা করেছ?'
রেখা হেসে বলল 'না।'
মনোজ বলল 'যাও ওদের সঙ্গে দেখা করে এসো।'
রেখা হেসে বলল 'যাচ্ছি।
মনোজের কথামতো রেখা গেল মিলি ও তার বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতে। রেখা গেটের কাছে গিয়ে বলল'কইরে আমার baby's কোথায় ?'
সঙ্গে সঙ্গে চারটে বাচ্চা ওদের ভাষায় ওরা ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো।গেটটা খুলতেই রেখাকে দেখে বাচ্চাগুলো যে কতটা খুশি হয়েছে, সেটা বোঝানোর জন্য রেখাকে বাচ্চাগুলো দুহাত দিয়ে রেখার গাল দুটো ধরে গাল চেটে তার প্রমাণ দিল। তারপর ওদের সঙ্গে একটু কথা আর খুনসুটি করতে করতেই মনোজের আওয়াজ শুনতে পেল," রেখা, রেখা,..।
সঙ্গে সঙ্গে রেখা মনোজের ঘরে এসে উপস্থিত হলা। এসে দেখছে মনোজ থর থর করে কাঁপছে একটা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে যেন কারো দিকে তাকিয়ে আছে।
রেখা ভয় পেয়ে বলল 'কি হয়েছে ?কি হয়েছে?'
অনেকবার বলার পর মনোজ ফোনটা দেখিয়ে ...?'
রেখা ফোনটা নিয়ে মেসেজ চেক করে দেখলো"
Manoj ** your COVID-19 test result was positive. If you you are in home isolation and you have any symptoms like high fever, cough or difficulty in breathing immediately call COVID-19 helpline *****for medical advice and admission in government hospital. Is there marks and stay in isolation.'
রেখা বলল 'তুমি মেসেজটা দেখে এরকম করছ?'
নিরুত্তর আর অসহায় ভাবে রেখার দিকে তাকিয়ে।
এবার মনোজের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে রেখা বলল' মনের জোর হারাবে না ,আমি আছি তো তোমার সঙ্গে ।তুমি ঠিক হয়ে যাবে।'
মনোজের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রেখা বললো 'আমি তো জানতাম যে তোমার মন এতটা দুর্বল নয় ।কত রকম বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা জীবনে আসে ,সেগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করাটাই তো আমাদের কাম্য, তাই না?'
মনোজ রেখার বুকে মাথা রেখে ঘাড় নাড়লো।
এদিকে পার্থ চলে গেছে ওর বাড়িতে।
রেখা কালবিলম্ব না করে ইমিডিয়েট ডাক্তার বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করল এবং টেস্টের রিপোর্ট টা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাল।
ডাক্তার বাবু সঙ্গে সঙ্গে কাল বিলম্ব না করে ওষুধ প্রেসক্রাইব করে পাঠালেন।
1 cab azithral 500 mg once a day 5 days
2 ***
3 ***
4 ***
5 ***
রেখা নিজেই মেডিকেল শপে গিয়ে ওষুধগুলো সব নিয়ে আসল। মনোজের ওষুধ চালু করে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে খাবারের দিকে নজর দিল। কাজের মেয়ে সুমিতাকে কাজে আসতে বারণ করে দিল। এমনিতেই সুমিতার কামাই।
মনোজ বলল 'সুমিতাকে কাজে বারন করে দিলে?'
রেখা বলল' ও এমনি কাজে কামাই করে। তার থেকে থাক না কিছুদিন রেস্টে।বাইরের লোককে ভেতরে ঢোকানোর কোন দরকার নেই।'
মনোজ বললো 'আর তুমি এত কাজ..?'
রেখা বলল' আমার কথা এখন তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি এখন তোমার সেফটি এবং তোমার দিকেই ধ্যান দিচ্ছি।'
মনোজ বলল' তোমার স্কুল?'
রেখা বলল' স্কুলে যাব না তো? জানিয়ে দেবো ব্যাপারটা।'
মনোজ বলল 'ও'।
রেখা বলল'আমি নিজে হাতে তোমার সেবা করব?'
মনোজ কথাটা শুনে হাসলো।
রেখা বলল 'হাসছো যে, প্রমান দেবো তো।'
মনোজ বলল' তোমাকে প্রমান দিতে হবে ?আমি তোমাকে জানি না?'
রেখা বলল' পজিটিভ ভাবো। ভালো ভালো গান শোন,ভালো কথা চিন্তা করো।'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ ,সেটাই করব।'
রেখা বলল 'দাঁড়াও এক্ষুণি বড়দিকে ফোন করে জানিয়ে দি।'
রেখা ফোনের নম্বর ডায়াল করল**
ফোনে রিং হতে শুরু করল।
ফোন কেটেও গেল।
রেখা আবার ট্রাই করলো এবং ফোন বেজে উঠল
এবার ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ভারী গম্ভীর গলায় বললেন' হ্যালো'।
রেখা তো ফোনে গলার আওয়াজ শুনে একটু চমকে উঠলো। তারপর বলল আমি কি বড়দির সঙ্গে কথা বলতে পারি?'
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বললেন 'কে বলছেন আপনি?'
রেখা বলল ' বড়দি যখন উচ্চারণ করেছি তাহলে উনার স্কুলের কোন কলিগ ই হবো।'
ওই ব্যক্তি আবার বললেন'তবুও নাম তো আছে, নামটা বলুন না?'
রেখা বলল 'ও শিওর। রেখা।'
এর মধ্যে দেখা গেল ফোনে গলা শোনা যাচ্ছে, বড়দি বলছেন' কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি?'
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন 'তোমার স্কুলের কলিগ ফোন করেছে । নাম রেখা।'
বড়দি বললেন 'হ্যাঁ, ফোন টা আমাকে দাও।'
বড়দি ভদ্রলোকের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন 'হ্যালো'।
রেখা বলল 'বড়দি আমি রেখা বলছি।'
বড়দি বললেন 'হ্যাঁ রেখা ,তোমার মনে আছে তো কত তারিখে বলেছিলাম এন্টি ড্রাগের ওপর একটা প্রোগ্রাম আছে ।তোমাকে কিন্তু সেখানে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে?'
রেখা বলল 'বড়দি আমি এ কদিন স্কুলে যেতে পারবো না।'
বড়দি একটু বিরক্তির স্বরে বললেন 'এই তোমাদের দোষ জানো তো ?এত দিন ছুটি খেলে '..?'
রেখা অন্য সময় হলে কিছু কথা বড়দিকে বলতেন কিন্তু আজকে কোন প্রবৃত্তি নেই ।কোন কথা বলতে। বড়দি আবার বললেন'আর এখন ক্লাস শুরু হয়েছে ।এখন তুমি ছুটি নেবে?'
রেখা অবাক হয়ে বলল 'আমার বিশেষ অসুবিধা আছে।'
বড়দি বললেন'কি অসুবিধা?'
রেখা বলল' আমার husband covid-19 positive.
বড়দি অবাক ব্যাঘ্রভাবে বলল -সে কি?'
রেখা বলল'ওই জন্যই আপনাকে ফোনটা করলাম?'
বড়দি বললেন' তোমাকে স্কুলে আসতে হবে না। এই থাবা আর কতজনকে বসাবে কে জানে?'
রেখা বললো 'হ্যাঁ , ভগবানই জানেন?'
বড়দি বললেন'তুমি একটি এপ্লিকেশন দিয়ে রেখো।'
রেখা বললো' নিশ্চয়ই'।'
বড়দি বললেন 'তোমরা কেউ ভেঙে প'ড়ো না। মনের জোর রাখো ।ট্রিটমেন্ট সঠিক করাও ,আর covid 19 বিধি মেনে চলো।'
রেখা বলল' তা আর বলতে?'
বড়দি বললেন'সারা পৃথিবীতেই যেন থাবা বসাচ্ছে?'আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। মনোবল হারালে হবে না কিন্তু ।আমরা সবাই'উই শ্যাল ওভার কাম, উই শ্যাল ওভার কাম ,উই শ্যাল ওভার কাম...।'
রেখা বলল 'একদমই দিদি।'
বড়দি বললেন' স্কুল নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না তুমি তোমার হাজবেন্ডের প্রতি নজর দাও।'
রেখা বলল 'থ্যাংক ইউ দিদি।'