উপন্যাস
টানাপোড়েন ১২৯
মনের হদিশ কে বা জানে
মমতা রায়চৌধুরী
রেখার গোধূলি বেলা আজ শুধু অন্য ভাবনায়
কেটেছে। সন্ধ্যেবেলাটায় রয়ে গেল তার রেশ। একরাশ টাটকা বাতাস এসেছিল বহুরূপী নৃত্য প্রদর্শনে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার সময় হঠাতই বেখেয়ালি মনে আসে ঢাকঢোল পেটানোর আওয়াজ ,ভাবনা চলে যায় অন্য
জগতে ।তাড়াতাড়ি উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে কি হচ্ছে। মিলি, চুনু,কটা ওরা এত জোরে চেঁচাচ্ছে
বাধ্য হয়েই তাকাতে হল ,ব্যাপারটা কি ,দেখার জন্য।
'ও বাবা কতদিন পর বহুরূপী।'
এই সব শিল্পীদের কদর কোথায়? হারিয়ে যেতে বসেছে।
বহুরূপ ধারণ করে কিছু টাকা উপার্জন করে তারা যেভাবে মানুষের মনোরঞ্জন করছে, উপরী পাওনা হিসেবে মানুষের মনের খিদেটা উপশম হয় বটে
কিন্তু যারা বহুরূপী সেজে মনোরঞ্জন করল তাদের ভাড়ারে কি থাকলো? এটা আমরা কেউ চিন্তা করিনা।
দু এক টাকা দিতেই হাত কেঁপে ওঠে।
রেখার ইচ্ছে হয়েছিল কিছু টাকা ওদের দেয় কিন্তু টাকা বের করে নিচে নামতে নামতে ই বেরিয়ে যায়।
'একজন '' আরেকজন' পার্বতী 'বেশ দারুন লাগছিল?
হঠাৎই শাশুড়িমা আর মনোজের চিৎকারে রেখার ধান ভাঙ্গে।
রেখা ব্যালকনি থেকে কান খাড়া করে শোনে
'বুঝলি মনু চা কিন্তু আর সঠিক সময় পেলাম না?'
মনোজ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তাইতো কি করছে রেখাটা মা এসেছে কোথায় একটু তাড়াতাড়ি করে দেবে তা নয়।
মনোজ আবার ডাকে' রেখা ,রেখা ,রেখা।'
রেখা বেলকনি থেকে উত্তর দিল 'কি বলছ?'
মনোজ বেশ নিচু গলায় বলল 'চা টা দাও?'
'হ্যাঁ দিচ্ছি।'
রেখার শাশুড়ি মা আবার পিএনপিসি শুরু করে দিল। "হ্যাঁ রে মনু ,তোকে কি এই ভাবেই চেয়েছে চা খেতে হয়?
'কেন বলতো?
'না তাই বলছি।'
'না তো?'
"তাহলে কি আমাদের দেখে চা করতে লেট করছে?'
'কোন কিছু করছিল হয়তো?
'ওরকম নয় মা তুমি ওরকম ভেবো না।'
মনামী ওর মাকে ধাক্কা দিয়ে ইশারা করে দেখালো 'দেখলে রেখার নামে কিছু শুনতে চায় না।'
রেখা চা করতে গেল একদিকে চায়ের জল বসিয়েছে অন্যদিকে কুকিজ বিস্কুট নিয়ে গিয়ে মিলি তার বাচ্চাদের খাওয়ালো।
তারপর যথারীতি চা বানিয়ে প্লেটে করে সাজিয়ে নিয়ে গিয়ে দিল।
শাশুড়ি মা প্লেটের দিকে তাকিয়ে কিছু স্নাক্স দেখতে না পেয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল আজ বোধহয় চায়ের সাথে বিস্কুট খেতে হবে বুঝলি?
তাই তো দেখছি।
কথা শুনে তারপর বাইরে এসে রেখাকে বলে চায়ের সাথে কিছু বানিয়ে দিলে না কেন?
রেখা কোন কথা বলে না তারপরেই ফিশ ফ্রাই শাশুড়ি, ননদ, মনোজকে দেয়।
মনোজ বলল 'দেখলে মা তোমাকে বলতে হবে না ও কিন্তু ঠিকঠাক সাজিয়ে দেয়,.'
রেখা তখন রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সব কথা কানে আসে।
ফিশ ফ্রাই টা কেমন হয়েছে রে দিদি!
হয়েছে একরকম।
মনোজ বাইরে বেরিয়ে এসে রেখাকে জিজ্ঞেস করল 'হ্যাঁগো ফিশ ফ্রাই কাকে দিয়ে আনালে?'
'পার্থ কে বলেছিলাম।'
'আমি একটু পার্থদের বাড়ি যাচ্ছি।'
মনো জ বললl' কেন?
আরে সেদিন বলল না যে আর কথা তারপর তো আর যাওয়া হয়নি। ফোনেও আবার বলল।
যাও গিয়ে দেখো কিছু করতে পারো কিনা?
আমার যদি একটু ফিরতে দেরী হয় তাহলে মিলিদের একটু খাবার টা দিয়ে দিও।
ঠিক আছে।
পার্থদের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মা মেয়ে দুজনেই কানাকানি শুরু করে দিল।
একটা কেমন অশালীন ইঙ্গিতও করলো।
রেখা দেখেও না দেখার ভান করল।
রেখা বেরিয়ে গেল পার্থদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রাস্তায় যাওয়ার সময় চৈতির মার সঙ্গে দেখা।
ও দিদি কোথায় চললেন গো?
এইতো পার্থদের বাড়ি যাচ্ছি।
কেন কিছু হয়েছে?
চৈতির মার সব সময় একটা কেমন যেন কৌতুহলী মনোভাব সবকথা জানতেই হবে এই জন্য মাঝেমাঝে রেখা চৈতির মার ওপর একটু বিরক্ত হয়।
"না না ওর মা ডেকে পাঠিয়েছে?'
'ও তাই বলুন।'
'তোমরা কবে ফিরলে?'
এইতো গতকাল।'
চৈতি রা কেমন আছে?
ভালোই আছে।
ঠিক আছে ,দিদি আসছি।
রেখাও ঘাড় নাড়লো। তারপর পার্থদের বাড়ি ঢুকলো।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে পার্থ এসে দরজা খুলল।
পার্থ একগাল হেসে বলল এসো বৌদি, এসো।
দরজা লাগাতে লাগাতে বললো ও মা মা, দেখ কে এসেছে?
পার্থর মা শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল টিভির আওয়াজ টা কমিয়ে দিয়ে খাট থেকে নেমে বলল কে এসেছে?
বলতে বলতেই রেখা গিয়ে হাজির হল
পার্থর মা বললো' ওমা ,ওমা তুমি?'
যেন একেবারে ভূত দেখার মত দেখল।
আজকাল তো আসই না। ভুলে গেলে বৌ মা?
রেখো এক গাল হেসে বলল কি যে বলেন না মাসিমা?
তাহলে আসলাম কি করে বলুন?
এসো মা এসো, আমার পাশটায় বলেই হাত ধরে টেনে বসান।
তোমার শাশুড়ি মা এসেছে শুনলাম।
হ্যাঁ মাসিমা।
উনারা এখন থাকবেন এখানে?
হ্যাঁ শাশুড়ি মা থাকবেন।
থাক ।ছেলে, ছেলে বউ থাকতে অন্য জায়গায় থাকতে ইচ্ছে করে ?ভুল করেছিলেন।
গলাটা বাড়িয়ে পার্থর মা পার্থকে উদ্দেশ্য করে বলল 'হ্যাঁ রে যা না বাবা।'
'হ্যাঁ মা যাচ্ছি।'
পার্থ কোথায় যাচ্ছে মাসিমা?
কোথাও না তুমি বস তো।
না মাসিমা কিছু আনাবেন না যেন।
আরে না না সন্ধ্যেবেলায় আমরা তো কিছু খাবো নাকি?
হ্যাঁ সে আপনার খান।
বেরোনোর সময় পার্থকে রেখা বলল ও পার্থ তুমি কিন্তু আমার জন্য কিছু এনো না ।তুমি তো জানো বাড়িতে তুমি এত কিছু পাঠিয়েছো!
আরে না বৌদি তোমার অনারে যদি কিছু হয় আমাদের।
বলেই হাসতে শুরু করলো।
"কতদিন আসনা মা?'কদিন ধরেই ভাবছিলাম মাসিমা আসব আসব আসার হয়ে উঠল না এদিকে শাশুড়ি মা ,ওরা এসেছেন। তাই আজ সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে আসলাম হুড়মুড়িয়ে। তোমরা কিছু উল্টোপাল্টা ভাবতে বসে আছে কিনা কে জানে?
কি আর ভাববে তুমি তো আমাদের বাড়িতে এসেছো না?
আসলে স্কুল থাকে তো মাসিমা?
হ্যাঁ সেইতো রোজ এত সকাল সকাল বেরিয়ে যাও স্কুলে আবার স্কুল থেকে ফিরে এসে কাজকর্ম থাকে তারপর হুটোপুটি করে ছুটে আসা বড় পরিশ্রমের ব্যাপার।
না পরিশ্রম আর কি এইটুকু আসবো সেটা নয় সময় করে উঠতে পারছিলাম না মাসিমা।
এবার পার্থ রোজি বলে মা ডেকে পাঠিয়েছে মা ডেকে পাঠিয়েছে?
আজকে দেখলাম না আজকে স্কুল ছুটি ছিল।
ওদিকে আবার কাকিমা ফোন করেছিল যেতে বলেছে?
কেন গো উনারা সবাই ভাল আছেন তো?
মুখে তো বলছেন মাসিমা ভালো আছেন কাকার শরীরটা তো এমনিতে ভালো নেই এইবার যেতে হবে। আসলে মানুষের হুট করে যাব সেটাও ভাবছি..
পার্থনা রেখাকে কাছে টেনে বললেন এত চিন্তা ক'রো না বৌমা ।যাওয়া তো আর হয় না । উনারা এসেছেন বুঝবেন নিশ্চয়ই তোমার অধিক তাও তো দেখতে হবে বল?
হ্যাঁ সেই আর কি?.
তারপর মাসিমা বলুন কি জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন?
পার্থর বিয়েটা নিয়ে বড্ড ভাবাচ্ছে গো বৌমা?
এদিকে ও তো ঐ মেয়ে ছাড়া আর বিয়েও করবে না বলছে,?
কিন্তু তুমি তো জানো ওদের বাড়ির কথা।
হে মাসিমা বাড়ি যাই হোক না কেন মেয়েটা কিন্তু ভালো।
আমি চেয়েছিলাম বৌমা আমার ছেলের বউ সুন্দরী হবে ,শিক্ষিতা হবে, ঘরোয়া হবে ভালো ঘরের মেয়ে।
মেয়েটা সুন্দরই না হোক দেখতে খারাপ নয় কিন্তু?
হ্যাঁ ওইতো ফোলা ফোলা ঠোঁট চাপা গায়ের রং গালদুটো টোপা টোপা..
হ্যাঁ মাসিমা তবে মেয়েটার চোখ দুটো দেখেছেন বেশ সুন্দর ,টানাটানা ।অনেকটা চিতল হরিণ এর মত।
আর বাড়ির অবস্থা একটু খারাপ তাতে কি হয়েছে মেয়েটা গ্রাজুয়েট তো। শিক্ষিতা।
পার্থ মা চুপ করে থাকে।
এই আর আপত্তি করবেন না।
তাছাড়া ছেলের যখন পছন্দ। সংসার করবে ওরা। ওদের দিকে তাকিয়ে মেনে নিন।
তবু তবুও পার্থর চুপ করে থাকে।
মাসিমা কিছু বলছেন না?
আমার তো আর একটা ছেলে নেই যে তাকে দিয়ে মনের আশাটা পূর্ণ করব?
সব বুঝতে পারছি মাসিমা কিন্তু কি আর করবেন তবে এটুকু বলতে পারি মনে হয় খারাপ হবে না মেয়েটার সাথে এমনি কথা বলে দেখেছি আমি ।
মাসিমার হাত দুটো ধরে রেখা বলল 'মেনে নিন।
এরমধ্যেই পার্থ এসে হাজির।
ওমা গরম গরম সিংয়ের কচুরি, আলুর দম আর রসগোল্লা।
হ্যাঁ প্লেট নিয়ে আয় তো বাবা।
পার্থ রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দিলেইতো নিয়ে যাচ্ছি।
পার্থ প্লেট এনে হাজির করল।
রেখাকে প্লেটে সাজিয়ে দিলো বললো খাও বৌমা।
এটা ঠিক হলো না মাসিমা আমি বললাম যে আমি খাব না।
পার্থ বলল' বৌদি, তোমার অনারের বলেছি না এজন্য আমরা ওই দুটো খাচ্ছি।'
সে ঠিক আছে তুমি এত কিছু এনেছো কেন?
আরও মা শোনো ভোলা ময়রার দোকান থেকে পান্তুয়া ও এনেছি।ওই দেখো ওই প্যাকেটে আছে।
আমি আর খেতে পারব না মাসিমা।
পার্থ বলল তা বললে তো হবে না বৌদি ভোলা ময়রার নাম জানো না আমাদের এখানে ওর দোকানের পানতোয়া শেষ হয়ে যায় আমি অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। একটা তো খেতেই হবে।
পার্থর মা বলল' খেতে হবে বললে হবে ,দে ওকে।'
পার্থ প্লেটে দুটো পা দিতে যাচ্ছিল তখন বললো ঠিক আছে আমাকে একটা দিয়ে দাও।
পার্থর মা বলল' তোর প্লেট টা নিয়ে যা বাবা।'
রেখা বলল ' আপনারটা মাসিমা?'
মায়ের জন্য ছানা এনেছি বৌদি।
তাহলে বৌমা ,তোমাকে তাহলে একদিন যেতে হবে আমাদের সাথে।
সময় করে আমাকে ব'লো। আমি সেইভাবে তাহলে কথা বলব।'
ঠিক আছে মাসিমা আমি জানিয়ে দেবো।
তাছাড়া বিয়ে দিলে তো তোমার সামনের বৈশাখ ছাড়া হবে ও না। ফাল্গুন মাস ওর জন্ম মাস।
ঠিক আছে।
খেতে খেতেই রেখার ফোন বেজে উঠলো'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা...।'
পার্থ বলল বৌদি তোমার ফোনের রিংটোন দারুণ করেছ?
ভালো লাগছে পার্থ?
অসাধারণ।
দেখো কে আবার ফোন করলো।একবার ফোন হয়ে কেটে গেল।
মাসিমা বল্লো হুটোপাটি করে খেও না তো পরে ফোন ধরবে।
না মাসিমা বাড়ি থেকে ফোন করছে কিনা কে জানে?'
করুক না?
রেখা এসে দেখল' হ্যাঁ ,স্কুল থেকে একটা ফোনএসেছিল?'
স্কুল থেকে ফোন করেছে।আমি ফোনটা করে নিই।
রেখা ফোন ধরাল। রিং হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করলেন।
হ্যাঁ বড় দি ফোন করেছিলেন?
হ্যাঁ কালকে স্কুলে আসবে তো?
ইচ্ছে তো আছে বড়দি।
ইচ্ছেটাই যেন থাকে অনিচ্ছা যেন না হয় হাসতে হাসতে বলেন বড়দি।
কালকে তোমাকে স্কুলে আসতেই হবে যে করেই হোক ভাষা দিবস আছে প্রোগ্রাম সেট করবে?
ঠিক আছে বড়দি।
রাখি।
হ্যাঁ দিদি, রাখুন।
পার্থর মা বললেন' মেয়েটার এত চাপ কেনো তুমি না গেলে কোন কিছুই হবে না?'
আসলে প্রোগ্রামগুলো আমি অ্যারেঞ্জ করেছি তো জয়েন করার পর থেকেই আমার ওপর বাড়তি একটা চাপ রয়েছে।
পার্থ বলল 'ও মা, বৌদির আর একটা গুণ আছে জানো?'
পার্থ-মা উৎসুক ভরে ছেলের দিকে তাকিয়ে তারপর বললেন 'কি?
'বৌদি তোমাদের লেখিকা।'
পার্থ মা অবাক হয়ে বললেন লেখিকা বাহ খুব ভালো তো।'
'আমাকে লেখা পাঠিও তো বৌমা?'
'পাঠাবো।'
ইবাবা সাড়ে আটটা বাজে এখন উঠতে হবে 'মাসিমা।
' উঠবে?'
'ঠিক আছে এসো তাহলে ওই কথাই থাকলো।'
'হ্যাঁ মাসিমা ,আপনি মনের থেকে ওইগুলো তাড়িয়ে দিন ওর ভেতরের ভালো গুণগুলো খোঁজার চেষ্টা করুন ।দেখবেন, একেবারে মনের মত হয়ে যাবে।'
আসলে আমি মনের মতো চেয়েছিলাম বৌমা?
'মনের হদিস কে বা জানে.. কি আছে তার মনের ঘরে, কেউ জানেনা কেউ জানেনা।'
'সে ঠিক আছে ওই আপনার মনের মত হয়ে যাবে দেখবেন।'
'তাই যেন হয় ঈশ্বরের কাছে তোমরাএই প্রার্থনা ই করো।
'তাহলে আসি?'