কুকুরটা
দেবব্রত সরকার
হালকা শীত। থোকা থোকা কোয়াশার ঝাঁক। মাঝে মাঝে দলা পাকিয়ে ভাসছে। রাস্তায় লোকেদের আনাগোনা কম। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতেই দেখি সাতটা।
তাড়াহুড়ো করে শরীরে জামাটা গলিয়ে ঘরের দরজায় তালা ঝোলাতেই কয়েকটি কুকুরের বাচ্চা সাথে তাদের মা, আমার চারপাশে এসে কুঁ কুঁ, কেউ-কেউ শুরু করে দিয়ে ল্যাজ নাড়ছে। তাদের দিকে অশ্রুপূর্ণ নজর রেখে সোজা হ্যান্ডেল সাইকেলটাই চরে বসি। একশো মিটার দূরত্ব পর্যন্ত কুকুরের বাচ্চাগুলো আমার সাইকেলের পিছন পিছন ছুটে আসে। এটা এখন নিত্য দিনের ঘটনা। বহরমপুর গোরাবাজার নিমতলায় দাঁড়িয়ে ‘অমি’কে একটা ফোন করি। তৎক্ষণাৎ অমি তার মেস ছেড়ে একটি ক্যারিব্যাগ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে।
শীতের সন্ধ্যা। অমি'র গায়ে একটি চাদর। আমি কেবল মাত্র ফুলপ্যান্ট আর একটি কমদামি টেরিভয়েলের জামা পড়েই চলে এসেছি। চারদিকে ঘন অন্ধকার। শীতের কুয়াশার দল আমাদের দু'জনকে আহ্বান করছে ঠোঁটে ঠোঁট মিলতে। লাইটপোস্টের আলোগুলো বেজায় জোর। সদ্য ভেপারের বাল্ব পরিবর্তন করে গেছেন স্থানীয় পুরসভার কর্মী।
অমি আর আমি দু'জনে গল্প করতে করতে এগিয়ে গিয়ে ভাগীরথীর ধারে ছাতিম গাছের নীচে সান বাঁধানো সিঁড়ির উপর বসি। কিছু মুহূর্ত দুই হৃদয়ের প্রেমালাপ জমে উঠতেই ক্যারিব্যাগটা থেকে একটা টিফিন বাক্স বার করে অমি। অমি'র হাতের তৈরী সব খাবারই আমার খুব ভালো লাগে। ওর নিজের হাতে তৈরী করে আনা চাওমিন দুইজন মিলে গভীর সুখে তৃপ্তির সাথে একে অপরকে খাইয়ে দিই। আস্তে আস্তে অন্ধকার থেকে গোল চাঁদ কুয়াশাশরীর ভেঙে মৃদু আলো বিকিরণ করে।
ভাগীরথীর পবিত্র জল কলতান তুলে ছোটো বড় মাছ শুশুকদের নড়ে ওঠার দৃশ্য আমাদের মধুর মিলনের চিহ্ন হয়ে উঠছে। অমি'র কোলে মাথা রেখে অনেক দুর গগনের স্বপ্ন দেখি। ছাতিম গাছের পাতার ফাঁক ভেঙ্গে মৃদু জ্যোৎস্নালো এক নব জীবন নিয়ে আমার দিকে ধেয়ে আসে। ভাগীরথীনদীবুকে জলে ডিঙি বেয়ে ফাঁস জাল পেতে কোন এক অচেনা জেলে তার আপন লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে ঝিলমিল জ্যোৎস্না গায়ে।
অমি, আমাকে হঠাৎ-ই বলে ওঠে তার মা-বাবার কথা, দিদির কথা, এমন কিছু গোপন...কথা যার কারণে তার চোখে জল এসে যায়। টানা সজল চোখে টলটল জল জ্যোৎস্নার আলোয় এক নতুন দিশার চেতনা তৈরী করছে।
তার কোঁকড়ানো চুলগুলি ঘাড় থেকে ক্রমশই এগিয়ে আসছে আমার চোখে। তার চোখের জল আমার ঠোঁটে এসে পড়ে। হৃদয়ে অদ্ভুত আঘাত এসে ধাক্কা মারে। তর্জনী আঙুল দিয়ে তার চোখের জল মুছে আমার জিভে তুলে নিই । সঙ্গে সঙ্গে সেই কষ্টের মুখে প্রেমহাসি হেসে অমি কি যেন আহ্বান করে আমার কাছ থেকে। হৃদয়ন্তরটা বার বার নড়ে ওঠে। ওর হৃদয়টা কি বলতে চায় তা একান্তে আমার হৃদয়ের গোপনযাদুতে মিশে যায়। অমির চোখ দুটি মুছিয়ে দিয়ে ঘাড়টা কাত করে ঠোঁটে আলতো ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করি। এ যেন শরীরের নবউন্মোচন। নিত্যপ্রবাহে ভেসে ওঠে। কোথায় আকাশ, কোথায় বাতাস, কোথায় মাটি সব যেন ভর শূন্য যাদুতত্ত্বে প্রবেশ করছি। যা কেবলই আনন্দ। মূহুর্তের আনন্দ। সব চাওয়া পাওয়ার থেকে অনেক দুরে। যেখানে কেবল প্রেম খেলা করে। কুয়াশা ছাড়া মেঘ নতুন হয়ে ডেকে আনছে পুষ্পদল। কয়েকশো মাইল দূরের হিমালয় যেন তার ভূষার বর্ষণ করে আহ্বান করছে তার দরবারে। বলছে সু-স্বাগতম প্রেমোদেবমৃতা। নিমিষেই সমস্ত দুঃখ কষ্ট দূরে বহুদুরে মিলিয়ে গেল। সে বলে উঠল-'এ ভাবেই চিরদিন তুমি আমার পাশে থাকবে তো! কখনও আমাকে ধোকা দিয়ে চলে যাবেনা তো তুমি? তোমার জন্য আমি সমস্ত কিছু করতে... পারি। শুধু তুমি যেন আমার থেকে দূরে সরে যেওনা।
এমন সব প্রশ্নের কি উত্তর হয় হে সর্বপ্রেমময় পুরুষ প্রেমী পুরুষ তা সবই তোমাদের জানা। আমি তাকে সেই মুহূর্তে উত্তর করি –‘তুমি যদি না যাও আমি তোমার প্রেম ছেড়ে কখনই যাবো না। বাতাস যেন মধু মন্থন করলো এই যুগলের। খুশি হল প্রকৃতি। নব চেতনায় মুখরিত হল চার দিক। নতুন প্রেমপর্বের সূচনা হল এই চিরাচরিত পৃথিবীর বুকে। যে প্রেমে কোন মোহ নেই কোন ক্ষুধা নেই ঋপুর ধারক, ঋপুর বাহক সেই প্রেমধর্মে অধিকার কেবল অঞ্জলিব্রতপ্রেমিক প্রেমিকার।
ভাগীরথীর জল হতে দলা দলা শিশির ধোয়া ধেয়ে আসে আমাদের দিকে। ওপারে ভেসে ওঠে সাদা আলো। অমির স্বপ্ন সে টিভিতে খবর পড়বে। কোন এক দিন পড়বেই। কিন্তু তার পরিবারে বাঁধা। কারণ বর্ধিষ্ণু পরিবারে বড় হয়েছে মেয়ে। বিয়ে দিতে হবে। আর এই ঘরের মেয়ে কখনই কোনদিন এমন কাজ করবে তা ভাবাই পাপ। সৎ চরিত্রবান মেয়ে সরলতায় মোড়া চুলের ডগা থেকে নোেখ। আর ইচ্ছা যে ইচ্ছা পূরণ করা খুব সহজ হয়। এই ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামাজিক কোন আইন এই বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনা। অতএব সে টিভি তে খবর পড়বেই। তা যে কোন ভাবেই হোক । তার জন্য পরিবারে বাবার সঙ্গে নিত্যদিন বচসাও হয়। আমার কপাল বেয়ে তার নরম হাতের আঙুলগুলি স্পর্শ করে ছোট্ট ছোট্ট চুলে। নরম আঙুলের নোখ দিয়ে বিলি কেটে দেয় সেই। ভাগীরথীর জলের দিকে দু'জনে শপথ নেয় যে-যত কষ্টই হউক কেউ কাউকে কোন দিনই ভুল বুঝবোনা। একে অপরকে ছেড়ে কোন দিনও যাবোনা। কখনওই না, কোন দিনও না। তার শরীরে ঢাকা চাদরটি আমার শরীরও ঢেকে নেই। এক চাদরের ভেতর উঠতি যুবক যুবতি। আমার বুকের ভিতর মাথা গুঁজে বিড় বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। আর তখনই শরীরের বয়ে চলা রক্তস্রোত ভাগীরথীর বয়ে যাওয়া জলের মত কলতান তোলে। রাস্তার ভেপারের আলো যে ভাবে ধিরে ধিরে হিট তৈরী করে আলো প্রদান করে ঠিক যেন সেভাবেই আমার শরীরে আলো জেগে উঠছে। এখন আমার শরীর সকালের উদিত সূর্যের তেজের মত ক্রমশ বেড়ে চলেছে মধ্যাহ্নে প্রহরে। জানিনা তার কীরূপ অনুভূতি তবে এটুকু বুঝতে পারছি। কোন এক খালি পাত্র খানি জল ঢেলে পূরণ করতে চাই। যেমন ফাঁকা কলসি জল পূর্ণ হলে তার আত্মতৃপ্তি ঘটে। মরা নদীতে জল এলে যেমন খুশীতে ভেসে ওঠে। ফাটা পুকুরগুলি যে ভাবে জল পেলে বেঁচে ওঠে। বারি বর্ষণ হলে ধরা যে তৃপ্তি যে আনন্দ লাভ করে। ভীষণ খরায় তৃষ্ণার্ভ প্রাণের খালি অংশ জল দ্বারা পূর্ণ করে আনন্দ উপভোগ হয়। পূর্ণিমার আলোর মত তার শরীরে জেগে উঠেছে শরীরীবাহার।
চোখে-চোখে, মুখে-মুখে, বুকে বুকে, কিছু ক্ষয়ের জন্য একে অপরের নিবিড় সান্নিধ্য লাভ। দুটি মনে, দুটি প্রাণে, দুটি দেহে, জাগিয়ে তোলে আনন্দহিল্লোল। চোখের তারায় নামে সুখের বিহ্বলতা। শ্বাস প্রশ্বাসে ছড়িয়ে পড়ে পারিজাতের সৌরভ...। দুই ভিন্ন লিঙ্গ ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় শরীরের সমস্ত অঙ্গের বিষ তুলে। শরীরের বয়ে চলা শূন্যবলয়ের ক্ষিপ্ত সমুদ্রের সমস্ত ঢেউ সামলে, অমি কে বলে উঠি-‘এবার আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলা উচিৎ। আমি আমার বুকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়।' বলে ওঠে-'আমার পরিবার কিছুতেই মেনে নেবে না!” –চলনা আমরা দুজনে মিলে কিছু একটা উপায় খুঁজে বার করি। এক কাজ করি আমরা দু'জনেই তোমার বাবা-মা কে আমাদের
সম্পর্কের কথা বলি।
-না তা হয়না। বাবা তাহলে আমাকে আর এখানে রাখবেনা।
এক চা ওয়ালা চা...! চা...! করে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ভেপারের আলোয় চা-ওয়ালার মুখটা ভেসে উঠতেই তা দেখে চাদরে মুখ ঢাকে অমি। আমি জিজ্ঞাসা করি – “কি হল। চা ওয়ালাকে দেখে এমন করে মুখ ঢাকলে যে?? ফিস্ ফিস্ করে বলে উঠল- এই চা কাকুটা আমাদের বাবাদের অফিসে চা বিক্রি করতে যায়। ও আমাকে ভালো ভাবে চেনে। আর এ ভাবে দেখে ফেললে বাবাকে কাল বলে দেবে।
এভাবে প্রতিদিন কি ভাবে যে নটা বেজে যায় দু'জনে বুঝতেই পারিনা। সেদিনের মত ভাগীরথী, ভাগীরথী ঘেষে বয়ে চলা রাস্তা, ছাতিমগাছ, ভেপারআলো, স্নিগ্ধ বাতাস, মনমুগ্ধ জ্যোৎস্না, ছাতিমজোনাকি, দল বাঁধা কুয়াশাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ি। এক হাতে সাইকেল আর এক হাতে অমির হাত পথ চলছি। ওকে ওর মেসে পৌঁছে দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে যায়। তখনই ওর গায়ের চাদরটি আমাকে দিয়ে বলে এটা ঠিক ভাবে গায়ে জড়িয়ে তারপর যাও। আর কাল থেকে এভাবে শীতের পোষাক না নিয়ে বেড়বে না। হৃদয় প্রিয়া মানে প্রেয়সীর কথা আমি কি ভাবে ফেলি—“যো আজ্ঞা ম্যাডাম!” ও মেসে চলে যায়। আমি ইন্দ্ৰপ্রস্থে গৌতমের চায়ের দোকান হয়ে ঘরে ফিরি। দরজার কাছে এসে সাইকেল থামিয়ে ঘরের তালা খুলতেই কুকুরের বাচ্চাক’টি তার মাকে সঙ্গে নিয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে হাজির। কেউ...কেউ... করতে থাকে । পাচেটে আদর করে। কেউ প্যান্ট কামড়ে আবার কেউবা দু’পা উঠিয়ে দেয় গায়ে। কুঁ... কুঁ...! করতে থাকে। ঘরে ঢুকে বয়াম থেকে কয়েকটি বিস্কুট তাদের ছুঁড়ে দিই তারা মহা আনন্দে, খুশি হয়ে সেগুলি কাড়া কাড়ি করে খাচ্ছে।
এমন ভাবেই দিন কাটে। মাস যায়। অমি'র খবর পড়ার সুযোগও হয়ে যায়। ভুল বোঝাবুঝির কারণে, কাজ কৰ্ম্ম নিয়ে মাঝে মধ্যে মন কষাকষি। ফোনে একাধিক বার বচসাও বাঁধে। ও অফিস থেকে বেড়িয়ে এলে পায়ে পায়ে পথ চলি। একদিন চোয়াপুর সেরিকালচারের ভিতর দিয়ে দু'জনে হাত ধরে আসছি। এমন সময় আবদার করে সরকারী চাকুরীর কথা উল্লেখ করে অমি। আমার মুখ থেকে আনন্দ হাসি দেখে খুশিও হয়। বচসার রেশ থেকে যায়। এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মনেরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার। ফেলে আসা স্মৃতি গুলি অমিকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হই। আমি এখনও বেকার তবুও পূর্ণপ্রেমিকপুরুষ তার জন্য চকলেট কিংবা বিস্কুট, কেক ইত্যাদি নিয়ে যেতে ভুলি না। একদিন অমি বলে ওঠে-“ এসব এনে মায়া সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছো!
আকাশ ভেঙে পড়ে মাটিতে। তার কথার ধাক্কায় বুকের পাঁজড় ছেড়ে যায়। খুব কষ্ট পাই, বুঝতে দিইনে। মনে মনে ভাবি আর প্রার্থনা করি হে বিধাতা ওর শুভ হোক। ওর জীবন রঙিন স্বপ্নে ভরে উঠুক, ওর যাতে আনন্দ লাভ হয় ও তাই করুক । ওকে কখনও কষ্টে রেখোনা প্রভু। ওর কষ্ট যদি হয় তাহলে তোমার সাথে আমার হবে। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরি। সেই সমস্ত নিশুতি জাগা কুকুরগুলি আমাকে সঙ্গ দেয়। অঝর অশ্রু আর হৃদকাপা বদ্ধ কন্ঠস্বর আমাকে প্রবল ধাক্কা মারতে থাকে । সেই ধাক্কা খেতে খেতে সাইকেলটা থেকে নেমে ঘরে ঢুকে বয়াম থেকে কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে এসে রাস্তায় ছড়িয়ে দিই। তারা মহা উল্লাসে কাড়াকাড়ি করে খেতে থাকে।
হঠাৎ জীবনে ঝড় ওঠে, অমি’র ক্ষোভ অভিমান। সমস্ত প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে এখন অন্য পথ দিয়ে হেঁটে যায়। আমার পথ আর ওর পথ এখন আলাদা। ও সরকারী চাকুরীর... খোঁজে...। আর আমি অমির খোঁজে একে অপর দিকে হারিয়ে যায়। দিন কাটে মাস কাটে বছর ঘুরে যায়। অমির আর ফোন আসে না। অমি আর চুলে বিলি কাটেনা। আমি আর সেই আদুরে ভাষা দিয়ে বুকে টানেনা। কিন্তু, সেই কুকুর গুলি এখন যুবক। কয়েকটা কুকুর রোগে ক্ষুধার জ্বালায় মারা গেলেও যে কুকুরটি জীবিত ছিল সে প্রতিদিনই আমার দরজার সামনে সে কেউ... !কেউ...! করে ডাক ছাড়ে আর আমি দরজা খুলে বয়াম থেকে বিস্কুট বার করে দিই। সে উল্লাসে মহাআনন্দে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে কুরমুর করে চিবিয়ে যায়...।
@@@@@@@
কুকুরটা @@@