উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৪৮
আমরা সবাই রাজা
মমতা রায়চৌধুরী
মনোজ আর রেখা, একান্তে বসে দুজনে কথা বলছে ঠিক তখনই কলিংবেল বাজানোর আওয়াজ "জয় গনেশ ,জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা"।
রেখা বলে 'এই সময় কে আসলো দেখো?'
মনোজ বলল 'তাই তো ।দেখি তো ।আবার কলিং বেল বাজানোর আওয়াজ "জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা।"মনোজ সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল "বাপরে বাপ ,যাচ্ছি ,যাচ্ছি।'
দরজা খুলেই মনোজ অবাক হয়ে যায় 'পার্থ তুমি এত রাত্রে কি ব্যাপার?'
'আরে বাবা ,দরজার বাইরে দঁড়িয়েই সব
বলবো? না ভেতরে ঢুকবো?'
মনোজ বলে "ছি :ছি :ছি :ছি :তাই তো
এসো ।ভেতরে এসো।'
পার্থর হাতে প্যাকেট দেখতে পেল। মনোজ বলল "কি ব্যাপার, আবার কিছু হলো নাকি?"
"অনেক কিছুই ।এক ,সোনাই খুব খুশি সোনার হারটা পেয়ে ।তাই দাদা বৌদির কাছে আমরা একটা ট্রিট চেয়েছি।'
মনোজ বলল' বাহ এতো দারুন ব্যাপার।'
'সে তো দারুণ ব্যাপার তবে আপনারাও বাদ যাচ্ছেন না ।ওটা আপনাদের কেও থাকতে হবে।'
আর এই প্যাকেটে রেখা বৌদি অনেকদিন আগে ইলিশ মাছের কথা বলেছিল ,যে গঙ্গার ইলিশ মাছ খাবে, তা আজকে হঠাৎ করে বাজারে গঙ্গার ইলিশ মাছ দেখতে পেয়ে নিয়ে আসলাম।"
রেখা খুব উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলো 'কই দেখি,
দেখি "
মনোজ বলল" তাই তো দেখি। রেখা আর মনোজ দুজনেই গভীর উৎসাহে ব্যাগটা খুলে দেখে তারপর রেখা বলে ওঠে" আরিব্বাস।"
'থ্যাংক ইউ পার্থ।'
"মাছটা বেশ বড়ো মনে হচ্ছে।"
মনোজ বললো, দেড় কিলো হবে নাকি পার্থ?"
পার্থ বলল , না নাএক কিলো৩৭৫ গ্রাম।'
রেখা বলল "এই মাছটা নিয়ে আমার দেশের বাড়ি কাকু কাকিমার কাছে যাব।"
'ঠিক আছে বৌদি ,রাত হয়ে গেছে তো আসছি আমি।'
'হ্যাঁ এসো পার্থ ভাই।
কাকিমার শরীর ঠিক আছে পার্থ?'
"হ্যাঁ আছে ।tওই বাতের ব্যথা কষ্ট পাচ্ছে।
ও ভালো কথা বৌদি ,মা তোমাকে কিন্তু যেতে বলেছে ।ভুলেই গেছিলাম বলতে ,দেখেছ, কথায় কথায় এবার বাড়ি গেলেই মা জিজ্ঞেস করত বলেছিস রেখাকে।'
সবাই মিলে হো হো করে হেসে ওঠে।
ঠিক আছে আসছি মনোজ দা, বৌদি।
মনোজ রেখা দুজনেই বললে" হ্যাঁ ,এসো, এসো।'
পার্থ চলে গেলে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
এবার রেখা বলল মিলিদের খাবারটা দিয়ে দিয়েছো
"হ্যাঁ গো"
রেখা বলল 'অনেকক্ষণ তো গল্প করলাম এবার বল খাবে কি,?
'আজকে আর কষ্ট করে কি রান্না করবে? 'তারচেয়ে ওটস খাও একটু। কোন কষ্ট করতে হবে না।'
"ঠিক আছে ।তাই হবে।"
"তবে জানো তো মিলিরা আর ছোট ঘরে থাকতে চাইছে না সারাদিন সামনের স্যাটারটা খোলা থাকবে। প্রয়োজনে ওরা ওখানে শুতে পারবে।
রেখা বলল" তাহলে আজকেই ওদেরকে ছেড়ে দিই।"
"তাই হোক ।
আজ থেকে ওরা মুক্ত।"
তবে জানো তো ভয় ভয় ও কাজ করছে। ছুটে রাস্তায় যদি চলে যায়।'
মনোজ বলল প্রকৃতির নিয়মে ওদেরকে থাকতে দাও।
চলো যাই আজ ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে।"
রেখা কাছে গিয়ে বলল' মিলি আজ তুই আর তোর বাচ্চাদেরকে ছেড়ে দিলাম। এমনিতেও বাইরে থাকতিস শুধু বাচ্চাদের জন্য ভেতরে এখন আছিস। এখন তোদের সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছি।
এতদিন শুধু আটকে রেখেছিলাম তোর বাচ্চাগুলো যাতে সেভ থাকে। তোরা বড় হয়েছিস তোরা কি আর বাঁধা থাকতে পারিস? কেমন যেন মনে হয় তোদেরকে শৃঙ্খলে অর্থাৎ বেডই তে বেঁধে রেখেছি। কেন তোদেরকে বেঁধে রাখব বল?
'আজ তোরা সবাই রাজা…..।"
"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে ,কে বাঁচিতে চায়।"
বলেই গেটটা খুলে দিতেই ওরা যে যার মত বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। কতক্ষণ যে ওরা ছুটল 9 ঠিক ঠিকানা নেই। মনোজ আর রেখা দু 'চোখ মেলে দেখতে লাগলো।
অনেকক্ষণ ছোটার পর বাচ্চাগুলো হাঁপাতে লাগলো। তারপর ওদের নাম ধরে ডাকতেই ভেজ নেড়ে এসে চলে এলো তার বসে পড়লো।
নিজের মতো করে ঘুরতে ফিরতে দেখে সত্যি ভালো লাগলো।
মনোজ বলল চলো অনেক রাত হল ভেতরে যাই।
রেখা বলল "এই যা।'
মনোজ বলল' কি হল আবার?'
রেখা জিভ কেটে বললো, পার্থ কে তোর টাকা দেওয়া হলো নাম আছে যা মাছের দামটাও তো জিজ্ঞেস করা হলো না।
ঠিক আছে অতো টেনশন নিচ্ছ কেন ফোন করে জেনে নেব। এখন না না না ফোন করে জানাটা ঠিক হবে না ঠিক আছে কালকে জেনে নেব। দাম দিয়ে দিলেই হবে।
তাছাড়া আমাদের পার্থ এরকম ছেলেও না।
তা যা বলেছ একদমই তাই। এ যুগের ছেলে ওর কোন রকম নেশা নেই দেখেছো?
একদমই তাই।
তুমি ভেতরে ঢুকেছে আমি দরজাটা লাগিয়ে দিচ্ছি।
ও বাবা এই দেখো গেট বন্ধ করতে দিচ্ছে না।।
রেখা ও এগিয়ে আসলো। কি হলো তোদের কি হল তোরা যে বাইরে বেরোবি বলে ছটফট করছিলি? এখন আবার কি ভেতরে কি বাইরে থাকো সোনা আমাদের লাগাতে হবে তোমরা পাহারা দাও কেমন?
তুলি মিলি পাইলট সকলে ঘেউ ঘেউ করে ওরা ওদের ভাষায় কিছু বলল।
"খারাপও লাগছে গো গেটটা দিতে।"
তাছাড়া দিতে তো হবেই।"
অভ্যাস হয়ে গেলে আবার দেখবে ওরা এসব বায়না করবে না।'
'ঠিক আছে রেখা একটু কটা বিস্কিট দাও না।
দাঁড়াও নিয়ে আসছি।'
'গেট খুলে ড্রয়িং রুমে কৌটোতে রাখা ব্রিটানিয়া বিস্কিট। আট দশটা বিস্কুট নিয়ে আসলো।
বিস্কিট গুলো ভেঙে ছড়িয়ে দিল ওরা দিব্যি কি সুন্দর খেতে লাগলো।
এবার মনোজ ইশারায় রেখাকে বলে ভেতরে যেতে বলে। আর মনোজ গেটটা লাগায়।
সব কটা মিলে একটু তাকিয়ে দেখল আবার নিজেরা খাওয়াতে মনোনিবেশ করল।
কলাপসিবল গেট লাগাতে লাগাতে মনোজ রেখাকে বলল 'তোমার একটু কাজ কমলো।
রেখা রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল কি "কাজ কমলো গো?"
"কেন এখন তো আর ওরা ভেতরে পটি করবে না"
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক।
"এ বাবা আমারও মাথা খারাপ হয়েছে দেখো।"
"কেন?"
"রান্নাঘরে খাবার তৈরি করতে যাচ্ছি তারা কিন্তু ফ্রেশ হতে হবে ভালো করে হাত মুখ ধুতে হবে,হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে।"
"হ্যাঁ আমিও তাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।"
বলতে বলতেই রেখা ওয়াশরুমে গেল ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে বেরতে যাবে তখন বলল আমাকে একটু টাওয়াল টা দাও না?
এই দি ই।
টাওয়ালটা রেখাকে দেবার পর রেখা মুখ মুছতে মুছতে বলল'তুমি ওটস এ কলা খাবে তো?'
মনোজ ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, "হ্যাঁ খাবো কিন্তু আপেল খাব না।"
কেন একটু ফ্রুটস খেলে কি হয় গো?
মাংস আর মাংস।
মনোজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল "এই মাংস খাওয়া নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে জানো?'"
রেখা, উদগ্রীব হয়ে বললো' কি?'
'জানো মাংস খেতে এত ভালবাসতাম আমি আমার বাবা, জ্যাঠারা ।তো বাবা বলেছিল জানিস আমরা গত জন্মে বাঘ ছিলাম?'
রেখা হো , হো, হো করে হেসে উঠলো বললো' 'কি?
'হ্যাঁ গো'।
'পারো বটে তোমরা।'
মনোজ এবার সোফাতে খুব আরাম করে বসে
রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলো।
'জানো তো আমাদের এখানে মিলনদার' সুইট কেবিন 'আছে রেস্টুরেন্ট।
হ্যাঁ।
আমাদের এখানে প্রথম মিলন দায়ে এই রেস্টুরেন্ট বানান। মিলন দার তখন রমরমে অবস্থা। আমাদের সব বন্ধুরা আড্ডা দিতাম মিলন দার সুইট কেবিনে।
চলতো জমিয়ে আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া।
একদিন মিলন দা আমার সঙ্গে বাজি ধরলেন।
এই মনোজ তুই যদি কাঁচা মাংস খেতে পারিস তাহলে তোরে এক মাসের খাবার ফ্রি।
আমি তো আলহাদে আটখানা। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
তখন সুরো বলছে"এ মনোজ এই নিয়ে বাজি ধরার কোন দরকার নেই তোর?'
আমি বললাম' আমি বাজি লড়বো হারকিপটে মিলন দা, এক মাসের খাবার দেবে ফ্রিতে ভাবা যায়?'
মিলনদাও তখন বারবার বলে যাচ্ছেন' কিরে এত চিন্তা করছিস কেন বাজি ধর।'
আমি বললাম 'আমি রাজি।'
তখন আমাকে না পেরে মিলনদা কে বললো তুমি একজন বয়জ্যেষ্ঠ ।তুমি কেন ওর সাথে এভাবে বাজি ধরছো বলতো?'
মিলন দা বলছে" আমাকে সবাই হারকিপটে বলে আমি এই নাম ঘুচাবো।'
'ঠিক আছে, তার জন্য তোমাকে বাজি ধরে কিপটে নাম গোছাতে হবে কেন তুমি এমনি আমাদেরকে খাইয়ে দাও না এক মাস ধরে।'
কি বলছিস সুরো?
ইতিমধ্যেই ভোলা দা মাংস নিয়ে ঢুকেছে। মনোজের তখন থেকেই জিভ ে জল এসে গেছে।
একবার জিভটা দিয়ে বেশ করে আপন মনে চেটে নিল।
ভোলা দা ভালো করে মাংসগুলো ধুজছে, ধোঁয়ার শেষে নুন হলুদ মাখিয়েছে কোরমা বানাবে বলে। ঠিক তখনই মনোজগ গিয়ে ভোলা দা কে বলল দাও আমাকে মাংস দাও।
ভোলা দা তো অবাক তুমি কাঁচা মাংস খাবে?
মনোজের তখন শরীরের রক্ত গরম তখন সে হুংকার ছেড়ে বলে 'তোমাকে যা বলছি তুমি সেটাই কর।'
অগত্যা ভোলা দা মাংস দিলো প্রথমে এক পিস।
মনের সেটাও খেয়ে ফেলল।
ভোলা দা আবার এক পিস দিল। সেটাও সাবার।
পরে ভোলাদা আবার এক পিস দিল।
এবার মিলন দা বেগতিক বুঝে ভোলাকে বললেন "আর মাংস দিবি না ওকে"।
"আমি বললাম কেন দেবে না কেন?'
"আমি হার স্বীকার করে নিচ্ছি তুই পারবি খেতে।'
"তাহলে আমারে এক মাসের খাবার ফ্রি। পাক্কা তো?"
মিলন দা কাঁদো কাঁদো ভাবে বললেন"চেয়ে নিচ্ছি আমাকে ক্ষমা কর। বাজিতে হেরে গেছি তুই জিতে গেছিস এক মাসের খাবার আমি ফ্রিতে খাওয়াতে পারব না।'
এবার আমার বন্ধুরা সবাই মিলে বলল এটা কি ব্যাপার হল কথার খেলাপ করলে মিলন দা।
মিলন দা তখনো কেঁদে যাচ্ছেন। অ্যাক্টিংটা ভালো করতে পারেন মিলন দা।
আমাকে পথে বসিয়ে দিস না তোরা, তোদের আমি কাছে জোর হাত করে ক্ষমা চাইছি আমাকে ক্ষমা কর।।
"ছি: ছি: ছি:!! তুমি একজন রেপুটেড বিজনেসম্যান তার কথার কোন দাম থাকবে না অমিত বলল।'
"আমি সব মানছি কিন্তু আমি এক মাস ফ্রিতে খাওয়াতে পারব না রে।'
রেখা বলল" কি সাংঘাতিক কান্ড গো? ভদ্রলোক কথার খেলাপ করলেন?'
আজ বলো তাহলে আর বলছি কি? কি হবে? আমাদের মনটা গলাতেই হল।
সুরো বললো 'ছাড়তে পারি, আজকে তোমার কেবিনে যা যা ভালো খাবার হবে আমাদের এই বন্ধুদের খাওয়াতে হবে।"
মিলনদা দেখলেন বেকায়দায় পড়ে গেছেন এটুকু না করলে তো ছাড়বে না এরা ।তখন তাতেই রাজি হয়ে গেলেন অতি কষ্টে।
রেখা তখন হো হো হো করে হাসছে।
"আরে তখন তো বিয়ের আগে আমরা মাঝে মাঝেই এরকম গিয়ে আড্ডা মারতাম মিলন দার সুইট কেবিনে।"
সেই সোনালী দিনগুলোতে আমরা ছিলাম যেন সবাই রাজা। আমরা প্রত্যেকে গান গেয়ে উঠেছি "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে….।"ওই একদিনের ট্রিট পাওয়াতে। নেই মামার থেকে তো কানা মামা ভালো।
আর এখন আমরা বন্ধুরা জীবন জীবিকার উদ্দেশ্যে কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম।
রেখা বলল সত্যিই তাই বিয়ের আগে তখন সাংসারিক দায়-দায়িত্ব থাকে না প্রত্যেকের একটা আলাদা ইমেজ তৈরি হয়। প্রত্যেকেই যেন সবসময় চার্জ থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো বয়স বেড়ে যায় বলো, সাংসারিক দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায় সাংসারিক বন্ধনে বাঁধা পড়ে যাওয়াতে।
একদমই তাই।
যাক কথা প্রসঙ্গে তবু অনেক কথা বেরিয়ে আসলো একটু হা হা হি করে নিলাম। তখনো গুনগুনিয়ে গান গাইছে "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। নইলে মোদের রাজার সনে মিলব….।"