উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৬৪
আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর জন্য
মমতা রায় চৌধুরী
আজ স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেই ফ্রেশ হয়ে গোপালের ভোগ চাপিয়ে, গোপালকে শয়ন দিয়ে
তাড়াতাড়ি চা বানাল। চা খেতে খেতে পেপারটা উল্টাতে লাগলো ।আজকাল পেপার পড়ার সময়ই পাওয়া যায় না। পেপারের সম্পাদকীয় কলম টা খুব সুন্দর লিখেছেন। মন ভরে গেলো। অনেকদিন পরে একটা সুন্দর লেখা পেল। এরপর পাতা উল্টাতে উল্টাতে কবিতা। কবিতা পড়তে গিয়ে কবির নামই দেখা হয়নি। কবির নাম দেখে পছন্দ হবার নয়। একটি সত্যিকারের নাম ,না ছদ্মনাম? কে জানে? তবে নামে কি এসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক তার সুগন্ধ তো ছড়াবেই।
এই কবির কবিতা প্রথম পড়ল রেখা।
মনে পড়ে গেল রেখার ও কতলেখা বাকি রয়ে গেছে, লেখা পাঠাতে হবে ।এদিকে অন্য আরেকটি পত্রিকার সম্পাদক পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নতুন বছরের কবিতা লিখতে বলেছেন। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় লেখা পাঠানোর আছে।তাই কালবিলম্ব না করে লিখতে বসে গেল। রেখা যখন লিখতে বসে,তখন কোথা থেকে যে শব্দগুচ্ছ মনের ভেতরে তৈরী হতে থাকে নিজেও জানেনা ।কলম আপন তালে এগিয়ে চলে, কবিতার ক্যানভাসে ছবি আঁকে।
এভাবে দুটো পত্রিকার জন্য রেখা লেখা কমপ্লিট করে ফেলে। আর নিজের লেখা নিজেই পড়ে অবাক হয়ে যায়। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ "ওম জয় লক্ষী মাতা…।"
রেখা জানে নিশ্চয় মনোজ এসেছে।
খুব উৎসাহ নিয়ে দরজা খোলো।
কিন্তু না মনোজ নয়। চৈতির মা।
সত্যি কথা বলতে কি রেখা মোটেও এইসময় চৈতি র মাকে এক্সপেক্ট করেনি আর আসাতে খুশিও হয় নি ।কারণ চৈতির মা আসা মানেই বেশ কিছুক্ষণ সময় নষ্ট হবে আর রেখার একচুলও সময় নষ্ট করার মত সময় তার কাছে নেই। তো কিছু করার নেই , সৌজন্য তো দেখাতেই হবে।
রেখা বলল আরে দিদি আপনি?
চৈতি মা এক গাল হেসে বলল একটু বিরক্ত করতে আসলাম না দিদি?
রেখা বলল কি যে বলেন না ।মানুষ মানুষের বাড়ি যায় কি বিরক্ত করতে ।নিশ্চয়ই আপনার কোন দরকার আছে নইলে আপনি তো আজকাল এদিকে আসেন না।
আর তা অবশ্য ঠিকই।
কতদিন পর আসলেন ।ভীষণ ভালো লাগছে।
কথাটা রেখা বলল বটে কিন্তু মন থেকে মোটেও সায় দেয়নি কথাটা বলার জন্য।
"ভেতরে এসে কথা বলুন।"
চৈতির মা বলল "অনেকদিন থেকেই ভাবছি
যাব ।আশা আর হয়ে ওঠে না। আজকে একটু সময় পেলাম, তাই ভাবলাম যাই একটু গল্প করে আসি।"
"তা বেশ করেছেন পাড়া-প্রতিবেশী না আসলে কি যোগাযোগ থাকে?
চৈতির মা বললো 'আপনিতো কখনোই যান না।"
রেখা মনে মনে ভাবল লোকের বাড়ি জ্বালাতে যাওয়া সময়ে-অসময়ের জ্ঞান নেই ।কোন মুখে এসব কথা বলে। তবুওএক গাল হেসে বলল "আসলে সময় পাই না তো?'
ড্রইং রুমে নিয়ে বসাল তারপর বললো " দিদি চা করে আনি।'
চৈতির মা বলল "আবার চা করতে যাবেন?"
আমি বাড়ি থেকে চা খেয়ে এসেছি।
রেখা বলল লোকের বাড়িতে গেলে তাকে অন্তত চা দিয়ে হলেও আপ্যায়ন করা উচিত।
চৈতির মা হেসে উঠলো।
"জানেন দিদি কি হয়েছে পাড়ায়?
রেখা মনে মনে ভাবল এবিপি আনন্দ ।সব খবর এর কাছে । যার যা তথ্য লাগবে পাওয়া যাবে।
"কি করে জানবো দিদি, আমি তো পাড়াতে কারো বাড়িতে যাই না,?'
এমন ভাবে বললো চৈতির মা হাসিমুখটা মুহুর্তের মধ্যে পানসে হয়ে গেল।
পরমুহূর্তেই আবার হাসিটা ফিরিয়ে এনে বলল "আসলে দিদি ,আমরা একটু যাই এবাড়ি ওবাড়ি কথা বলি আমাদের তো আর বাইরে বেরোনোর জায়গা নেই।"
রেখা মনে মনে ভাবল তবে কি চৈতির মার মনে কষ্ট দিয়ে ফেললো কথাটা বলে।"
রেখা এই কথাটা বলতে চায় নি ,যাতে চৈতির মার মনে আঘাত লাগে।
চৈতির মা একগাল হাসি নিয়ে বললো' জানেন দিদি আরে যার বউটা মারা গেল সুইসাইড করে।'
রেখা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল" হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।"
"কেন কি হয়েছে?'
"কি হয়নি বলুন?''ok'
রেখা অবাক হয়ে বলল 'মানে?'
"আরে ওই ছেলের তো নিজের বৌদির সাথেই লটর পটর।"
রেখা বললো' কি যে বলেন না!"
আমি জানি বিশ্বাস করবেন না কিন্তু খোঁজ নিলেই জানা যাবে।
রেখা মনে মনে ভাবে খেয়ে কাজ নেই নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
চৈতির মা আরো বললো' আরে সেই ব্যাপারটা জেনে ফেলে ছিল বলেই তো বউটা সহ্য করতে পারে নি।'
রেখা বলে 'কি সাংঘাতিক,!'
"হ্যাঁ দিদি, তাছাড়া আর বলছি কি?'
ছেলেটাকে দেখে তো সেরকম চালাকচতুর ই মনে হয় না।
"তাহলেই বুঝুন পেটে পেটে কত বুদ্ধি।"
আর ভালো লাগছে না এসব কথা শুনতে অথচ কত লেখা বাকি রয়েছে লিখতে হবে।"
'বলতেও পারছে না।'
রেখাও মুখে হাসি নিয়ে "দিদি, একটু বসুন আমি চা করে আনছি।'
''চা করবেন? আচ্ছা আনুন।'"
রেখা চা করতে গেলে চৈতির মা বলল "এবার সেল থেকে কিছু কেনাকাটা করেন নি দিদি?'
'না সময় পায়নি।'
আরে আমাদের কল্যাণীতে দেখুন কত সেল বসেছে নাকি কাঁচরাপাড়া থেকে করেন?"
"আমি তো বরাবর কাঁচরাপাড়া থেকেই করি।"
চৈতির কি খবর দিদি?
"ও দিদি চৈতির মনে হচ্ছে একটা ভালো খবর দিতে পারব?"
"তাই নাকি? বাহ বেশ ভালো খবর।"
এখনো সে রকম কিছু হয়নি তবে ডাক্তার বলেছেন যে খুব শিগগিরই ভালো খবর দিতে পারবে।
মনে মনে ভাবি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
'এমন ভাবে বললেন যেন মনে হচ্ছে সুখবর হয়েই গেছে।'
'এই তো সামনের সপ্তাহে আসবে এখানে ডাক্তার দেখাতে।'
রেখা চা করে এনে চৈতির মার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিলো সঙ্গে কিছু স্নাক্স।
দেখুনতো দিদি শুধু শুধু চা করতে হলো। কষ্ট দিলাম এসে।"
"রেখা মুখে মিষ্টতা নিয়ে বলল' কি যে বলেন না দিদি। চা খাওয়াতে পারব না?"
তবে মনে মনে একটু বিরক্তই হয়েছে।
চৈতির মা একগাল হাসি নিয়ে বললো" সে তো আমি জানি দিদি।'
আপনাদের বাড়িতে আসলে কমা? আপ্যায়ন তো করেন না।"
"এখন কেমন আছে চৈতি,? বাড়িতে সমস্যা মিটেছে?"
কানের কাছে একটু ফিসফিস করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল" মিটবে না কেন আমি তো ঠাকুরবাড়ি করেছি।'
একটু অবাক হয়ে বললো 'মানে?'
"মানে আমি মদনপুরে ভোলা ঠাকুরের বাড়ি গিয়েছিলাম । ওনকে সব কিছু বলেছি উনি তো তাবিজ কবজ করে দিয়েছেন?:
রেখা মনে মনে ভাবছে কোন যুগে বাস করি এখনো আমরা তাবিজ-কবজ এইসবের বিশ্বাস থেকে নিজেকে কাটিয়ে উঠতে পারছি
না কুসংস্কারের বলি।'
'তা কি মনে হচ্ছে ভোলা ঠাকুরের দেয়া তাবিজ-কবজে এই চৈতি এখন ভালো আছে?"
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল তো কি ?শান্তি হয়েছে ওর শাশুড়ি দর্জাল এখন দেখুঙ্গা মাটির মানুষ হয়ে গেছেন পুরো।
'ওমা তাই নাকি?'
রেখা আবার পরক্ষনেই মনে মনে ভাবল "তাহলে কি সত্যি সত্যি কাজ হয় ?তাহলে একবার কি পরীক্ষা করে দেখবে তার শাশুড়ি মা তার সাথে কেন এরকম ব্যবহার করে ?চৈতির মাকে কি ব্যাপারটা খুলে বলবে ?তবে শিক্ষিত মনে বাসা যে কুসংস্কারকে টেনে নিয়ে আসছে এটা কি ঠিক ?'
চৈতির মা কিছুটা আঁচ করে বল" দিদি কিছু সমস্যা আছে নাকি ?আমায় বলুন আমি তাহলে নিয়ে যাবো আপনাকে ভোলা ঠাকুরের কাছে।"
"সেরকম সমস্যা হলে পরে বলব,"
কেন শুনেছি তো আপনার শাশুড়ি মা সেরকম সুচারু একবার দেখবে নাকি গিয়ে ?এটা কিন্তু সত্যি কথাই হান্ড্রেড পার্সেন্ট কাজ করে।'
রেখাও কেমন একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেল। সত্যি সত্যি তাই মনের ভেতরে একরাশ ভালোবাসার সমুদ্র অপেক্ষা করছে ।শাশুড়ি মার স্নেহ পাবার জন্য কত চেষ্টাই করেছে কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি রেখার মা মারা যাবার পর ভেবেছিল শাশুড়ি মাকে মায়ের মত আপন করে নেবে ।চেষ্টাও করেছে রেখা আপন হতে। পারে
নি ।"একবার চেষ্টা করে দেখবে কিনা 'কিন্তু এই কথা যদি মনোজ জানতে পারে তাহলে তো আর রক্ষে নেই ।কী করবে ?সে নিজেই জানে না। আজ কি সত্যি সত্যি শিবরাম চক্রবর্তী দেবতার জন্ম গল্পটি পড়েছিল ।সেই গল্প পথের ধারে পড়ে থাকা পাথরটি একসময় কিভাবে শিবলিঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে ।তাই নাকি পাতাল ফুঁড়ে শয়ন মহেশ্বর বেরিয়ে এসেছে ।তার কাছেই মাথা নত করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত মানুষ কখনো কখনো সত্যিই এমন দুর্বল হয়ে যায় ,যখন সেই শিক্ষিত মনটাকেও গিয়ে মাথা নোয়াতে হয়।
"ও দিদি আজ আর বসবো না অন্যদিন আসব অনেক সময় নষ্ট করলাম আসছি।'
রেখা যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল বলল.ঠিক আছে দিদি আসুন আর যাবার সময় আবার বলে গেল দিদি আমাকে বলবেন কিন্তু ।আমি বলছি আমার মেয়েকে দিয়ে উপকার পেয়েছি।"
রেখার মন কেমন হয়ে গেল ।সেও চায় তারও কোলজুড়ে একটা বাচ্চা আসুক ।তার সংসারে শান্তি বিরাজ হোক ।তবে কিছুতেই ভোলা ঠাকুরের কাছে যাবে কত ডাক্তার বুদ্ধি করেছে ডাক্তার তো কখনো বলেনি সে মা হতে পারবে
না ।তাহলে কি সত্যি সত্যি ঠাকুরের এমন ম্যাজিক আছে যার জন্য সে পৃথিবীর সব থেকে শ্রেষ্ঠ ডাক শুনতে পাবে ।তার নারীসত্তা পরিপূর্ণতা পাবে।" জীবনে তো কম টানাপোড়েন চলেনি। তাই সেও তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টাকে শান্ত রেখে
কখন যেন অজান্তেই গোপালকে স্মরণ করে ভোলা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে দুই হাত তুলে নমস্কার করল আর মনে মনে চাইলো তার সেই আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি।