টানাপোড়েন ৬২
আবার আসিব ফিরে
ঘুম থেকে উঠেই আজ রেখার একরাশ ক্লান্তি ,চিন্তা হেরাফেরি করতে লাগলো। সূর্যের লাল আভা আজ তার মনকে কেড়ে নিতে পারল না। নগরজীবনের ক্লান্তি যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
ভাবতে ভাবতেই রেখার ফোন বেজে উঠলো। রেখা উদ্বেগগ্রস্ত ভাবে রিসিভ করে বলল ' হ্যালো'।
পার্থ বলল 'বৌদি।'
রেখা বলল ' কি হয়েছে?'
পার্থ একটু আমতা আমতা করে বলল' না মানে দাদার জ্বরটা কিন্তু কমছে না ।
রেখা বলল 'কি বলছ গো?'
পার্থ বলল 'হ্যাঁ বৌদি ।একটা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে?'
রেখা বলল' কিরকম?'
পার্থ বলল' দাদা বলছে মুখে কোন টেস্ট নেই। এমন কি কোনো গন্ধ পাচ্ছে না?'
রেখা আতঙ্কগ্রস্থ ভাবে বলল' সে কি?'
পার্থ বলল'আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না বৌদি। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।'
রেখা বলল 'ডাক্তার কাকাকে ফোন করেছো?'
পার্থ বলল 'হ্যাঁ এবং উনি কতগুলি টেস্ট করাতে বলেছেন ।'
রেখা বলল আজকে ওগুলো টেস্ট হবে তো?
পার্থ বলল' হ্যাঁ বৌদি।'
রেখা বলল'পার্থ ভাই তুমি গাড়ি পাঠাচ্ছো তো?'
পার্থ বলল 'হ্যাঁ বৌদি ,গাড়ি রওনা হয়ে গেছে। আপনি রেডি হয়ে থাকুন।'
কাকিমা বললেন' কি হয়েছে?'
রেখা অত্যন্ত করুণ ভাবে বলল' যেটা মনে মনে আশঙ্কা করেছিলাম কাকিমা। মনে হচ্ছে সেটাই?'
কাকিমা বললেন'অত ভেঙ্গে পরিস না সব ঠিক হয়ে যাবে সঠিক চিকিৎসা নিয়ম মেনে চললেই হবে।'
রেখার চোখে জল।
কাকিমা কাছে টেনে বললেন' মা গো জীবনে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বার বার পড়তে হয় ।দিশেহারা হতে নেই ,দিক ,লক্ষ্য স্থির রেখে সঠিক কর্ম করো ।তাহলে দেখবে সঠিক দিশা খুঁজে পাবে।'
রেখা কাকিমার বুকে আছড়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
কাকু কান্নার আওয়াজ শুনে বললেন' ননী, কাঁদছে কেন?'
কাকিমা বললেন 'এমনি? চলে যাবে তো?'
কাকু বললেন 'জামাই এর কিছু খবর এসেছে নাকি?'
কাকিমা বললেন 'দেখলি ঠিক কানে পৌঁছে যায় ।তোর মিথ্যে বলে উপায় নেই।'
কাকু আবার বললেন 'কি গো?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ।'
কাকু বললেন'কি এক্সপেক্ট করছেন ডাক্তার?'
কাকিমা বললেন ডাক্তার কতগুলো টেস্ট দিয়েছেন আজকে করাবে?'
কাকু বললেন 'অত চিন্তা করতে হবে না, সুস্থ হয়ে যাবে ।যাই হোক না কেন?'
রেখা বলল' কাকু ,কাকিমা তোমরা সাবধানে থেকো।'
কাকিমা বললেন ' আমরা সাবধানে ই থাকবো, তুমি বেশি চিন্তা ক'রো না।'
রেখা বলল 'সকালবেলায় রোজ কিন্তু ওই চা টা করে খাবে আর লেবু দিয়ে খাবে কিন্তু?'
কাকু বললেন 'ননী, কি চা খেতে বলছে?'
কাকিমা বললেন'বলছে আদা, গোলমরিচ ,লবঙ্গ ,তুলসী পাতা এইসব মিক্স করে ভালো করে ফুটিয়ে চা বানিয়ে সেটাকে খেতে ?'
কাকু বললেন 'দেখলে আমার মেয়েটার মাথায় কত বুদ্ধি ।এগুলো ইমিউনিটি পাওয়ার করে না কি রে মা?'
রেখা বলল' হ্যাঁ,এইগুলো খাবে। তার সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খাবে।'
কাকু কাকিমা কে উদ্দেশ্য করে বললেন 'হ্যাঁ ওটাই করবে। আমার মেয়ে যখন বলেছে ,ওটাই কিন্তু করবে ?'
কাকিমা বললেন 'তুমি একবার যখন শুনে নিয়েছো, না করে উপায় আছে?'
রেখা বলল'কাকিমা ব্যাগগুলো গুছিয়ে নিই।'
কাকিমা বললেন 'তার আগে একটু খেয়ে নে।'
রেখা বলল ' আমার খাবার ইচ্ছে নেই কাকিমা।'
কাকিমা বললেন 'না মা তা বললে হয় না ।তুমি কমজোর হয়ে গেলে তো হবে না ।এই সময় তোমাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে ।পেটে তো কিছু দিতে হবে বলো?'
রেখা চুপ করে আছে।
কাকিমা বললেন 'আমি দুপুরের খাবার বানিয়ে দিচ্ছি ।ওটা তুমি বাড়িতে নিয়ে যাবে।'
রেখা বলল 'কাকিমা তোমাকে এত কিছু করতে হবে না।'
কাকু শুনতে পেয়ে ভেতর থেকে বললেন 'কেন করতে হবে না ,কেন মা? তুমি বাড়িতে কি আবার হাত পুড়িয়ে রান্না করবে?'
কাকিমা বললেন 'তোর কাকু ঠিকই বলেছেন।'
রেখা চুপ করে রইলো।
ইতিমধ্যেই রেখার ফোন আবার বেজে উঠল দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী'।
রেখা ফোনটা রিসিভ করল'হ্যালো'।
পার্থ বলল 'বৌদি গাড়ি পৌঁছে গেছে?'
রেখা বললো 'কই এখনো তো এসে পৌঁছায় নি।'
পার্থ বলল 'তাহলে এর মধ্যেই পৌঁছে যাবে দেখুন।'
ফোনটা কাটার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি এসে ঢুকলো।
ইতিমধ্যে কাকিমার সব রান্নাবান্না রেডি হয়ে গেছে।
গাড়ি এসে স্টার্ট বন্ধ করলো ,ড্রাইভার নামল। গেটটা খুলে দিলো রেখা ।ক্যাচ করে আওয়াজ হল গেটে।
রেখা বলল 'আসুন আসুন ভেতরে আসুন।'
ড্রাইভার বলল 'বৌদি আপনি রেডি তো?'
রেখা বললো 'হ্যাঁ আমি রেডি।'
ড্রাইভারকে বসার ঘরে বসতে দিল সোফাটায়।
কাকিমা ড্রাইভার এর জন্য চা, জল, নাস্তা নিয়ে এসে হাজির ,বললেন' এতটা পথ এসেছে বাবা ,কিছু খেয়ে নাও।'
ড্রাইভার বলল 'না কাকিমা, এখন কিছু খাবো না।'
কাকিমা বললেন 'তা বললে তো হবে না ।আমার বাড়িতে এসেছো। না খেয়ে চলে যাবে ?সেটা তো হবে না।'
বাধ্য হয়ে ড্রাইভার তখন জল, একটু মিষ্টি আর চা খেলো।'
অন্যদিকে কাকিমা রেখার জন্য খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দিল। যাতে মেয়েকে হাত পুড়িয়ে গিয়ে রান্না করতে না হয়।
এরপর এল বিদায়ের পালা মেয়ে ও কাঁদছে ,কাকিমা কাকু ও কাঁদছে। রেখার বারবার মনে হচ্ছে'সেই গানটি
'আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে? বসন্তের
বাতাসটুকুর মতো। সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে। ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত। সে চলে গেল বলে গেল না, সে কোথায় গেল ফিরে এল না।'আজ এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বারবার এই গানটি অনুরণিত হতে লাগল রেখার মনে প্রানে। বেদনাতুর মন নিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে তার চেনা ব্যস্ততার সেই বাঁধাধরা জীবনে। গাড়িতে উঠল গাড়ি স্টার্ট করল রেখা জানলা দিয়ে বারবার কাকু কাকিমা আর গ্রামের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে লাগলো । আর হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে উঠতে লাগলো'আবার ফিরে আসবো, আবার ফিরে আসবো এই শান্তি সুধা ধামে।'সকালের ভোর যদি দেখতেই হয়, তবে ফিরে আসতেই হবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো ভালোবেসে এই গ্রামে'
'ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল,
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে...।'