২২ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"১৭

 স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র  নতুন ধারাবাহিক  উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"






শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ১৭)
   শামীমা আহমেদ 


                                                         অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে  শিহাবের সন্ধ্যে হয়ে গেলো।এরই মধ্যে বন্ধুদের কয়েকবার কল চলে এলো।'সন্ধ্যার চা' অর্থাৎ  ইভিনিং টি  পানের নিমন্ত্রণ।বুঝে গেলো শিহাব আজ আর এদের হাত থেকে তার নিস্তার নেই।এখুনি বাসায় ফেরা হচ্ছে না।হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে একটু ফ্রেশ করে নিল।এমনিতেই সারাক্ষনই বন্ধুদের টিপ্পনী  শুনতে হয়।শিহাব নাকি মেয়েদের পটাতে ওস্তাদ।কিন্তু এটা সম্পূর্ণই ওদের ভুল ধারণা। মেয়েরা নিজে থেকেই শিহাবের দিকে আকৃষ্ট হয়।তার লুক,বিহেভিয়ার, আইডোলজি কেয়ারিং এটিটিউট,কঞ্জারভেটিভনেস এ মেয়েরা,এমনকি অনেক  মহিলারাও ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়ে।
শিহাব তাই খুবই সংযত হয়ে চলাফেরা করে।
একটু সরলতায় কথা বললে অনেকেই সেটা দূর্বলতা ভেবে নেয়। এই জীবনে রিশতিনা এসেছিল খুবই অল্প সময়ের ভালোলাগায় আবার হারিয়েও গেছে খুব দ্রুত সময়ে।তার পর থেকেইতো একাকী জীবন। তবে শিহাব ইচ্ছে করলে দিনে চার পাঁচজনে মেয়ের সাথে ডেট করা তার কাছে কোন ব্যাপারই না। হ্যান্ডসাম লুক, আর্থিক স্বচ্ছলতা, সানগ্লাস পরে বাইক চালানোয় মনে হয় একেবারে স্বয়ং সালমান খানের আদলে একজন নায়কের উপস্থিতি, সর্বোপরি সিঙ্গেল লাইফ! স্ত্রী আছে না নেই,চলে গেছে না গত হয়েছে, ফিরে আসবে  নাকি আর ফিরবে না ডিভোর্স  না সেপারেশন হয়েছে? আজকাল মেয়েরা এসব ভ্রুক্ষেপ করে।সুপুরুষ দেখলে তারা মৌমাছির মত ঘিরে ধরতে চায়! কিন্তু সবাইতো আর শিহাবের মনের ভেতরের সবটা জানে না। শিহাব এসব কখনো ভাবনায়ও আনে না।শুধু ভাবে যার এত এত আছে তবুও তার একান্ত নিজের বলে কেউ নেই।এটা কী নিয়তি নাকি তার ভূলের মাশুল।
বন্ধুরা সব অপেক্ষায়। দিনশেষে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়া একেবারে একঘেয়েমিতে ধরে গেছে। সারাদিনের অফিসের পর তা একেবারে দমবন্ধ লাগে।তাইতো সব বন্ধুরা দূরে একটা খোলা একটা জায়গায়  আড্ডা বসায়।সেখানে পাশেই একটা চায়ের দোকান, ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা 'মায়ের দোয়া' টী স্টল।এর  স্পেশালিটি হচ্ছে গরুর খাঁটি দুধের মালাই চা। এরা দুধটাকে বেশ ঘন করে তা দিয়ে চা বানায়। উপরে দুধের মালাই ভাসিয়ে দেয়া! আহ! সেই চা খেলে ঠোঁটে  লেগে থাকে।
আকাশে যখন বিশাল চাঁদ উঠে, সেই খোলা যায়গায় আলো আঁধারিতে চা খেতে শিহাবের যেমন ভালো লাগে তেমনি মনটা বিষাদে ভরে যায়। একাকীত্বের এ যন্ত্রণা কাউকে বলা যায় না শুধু বলতে ইচ্ছে করে ঐ চাঁদটিকে।বাইরে বন্ধুদের সাথে গল্পে হাসি আনন্দে মেতে থাকে।কখন যে  বেশ কয়েককাপ চা চালান হয়ে যায় তার খেয়ালই থাকে না।

শিহাব সাততলা থেকে নেমে এলো। বাইকে স্টার্ট দিয়ে চললো উত্তরা দিয়া বাড়ির দিকে। সেখানে বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা হওয়া।
বন্ধুরা সব ধনীর ঘরের সন্তান।সবাই পৈতৃক ব্যবসার মালিক। খুবই বিলাসিতায় জীবনযাপন। চারিত্রিক দিক দিয়েও বেশ খোলামেলা। কিন্তু শিহাব এর মাঝেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।কোন বন্ধুর প্রোরচনায় কোন নারীদেহের প্রলোভনে কোথাও পা বাড়ায়নি।শিহাবের সকল কিছু ইচ্ছা বাসনা তাড়না কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।মনের  সুক্ষ্ম অনুভুতির অনুভবে তাইতো শিহাব আজো রিশতিনার ছোঁয়া  খুঁজে ফিরে।কামুক পুরুষের  মত শুধু নারীর দেহভোগ  করতে সে শিখেনি। অনেক বন্ধুকে দেখেছে প্রয়োজন ফুরালে প্রেমিকাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, অস্বীকার করতে। শিহাব অন্য এক ধাতুতে গড়া এক লৌহ মানব।যে নিজেকে দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর করছে।
আড্ডা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে  শিহাবের রাত দশটা বেজে গেলো। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।তবুও আলসেমিকে প্রশয় দিল না। একেবারে ফ্রেস হয়ে বিছানায় চলে এলো।চায়ের কারণে একেবারেই ক্ষুধা নেই। তাছাড়া সবকিছু গুছিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না।
হঠাৎ  মোবাইল বেজে উঠলো। মায়ের ফোন।

কেমন আছিস বাবা?
এই তো মা ভালো আছি। 
তোমরা? আরাফ কেমন আছে?
ভালো।ঘুমিয়ে গেছে।
রাতের খাবার কি খেয়েছিস?
এইতো খাবো মা।
শোন,কাল কুরিয়ারে কিছু খাবার পাঠাচ্ছি।
সুমাইয়া আজ সারাদিন সব গুছিয়েছে।
কুরিয়ার থেকে সময় করে নিয়ে আসবি।ওরা ফোন দিবে।সাবধান দেরি করবি না।তবে সব নষট হবে।
মা কেন এসব করো?
মা হলে বুঝতি,কেন করি।
আচ্ছা ঠিক আছে মা।আমি নিয়ে আসবো।
আচ্ছা রাখি।
শিহাব ভেবে নিল কাল তাহলে অফিসে যাওয়া আগেই সুন্দরবন কুরিয়ারে যেতে হবে।সেক্টর ৯ এ। খাবারগুলো আবার বাসায় রেখে  একটু গুলশানের দিকে যেতে হবে।কিছু জরুরি কাজ আছে।
শায়লার মেসেজ এলো।
রাতের খাবার খেয়েছেন?
শিহাবের হাত থেকে আর ফোনটি রাখার ফুসরৎ মিললো না।
না, মানে খাইনি, খাবো,আবার খেতে ইচ্ছেও করছে না।
খেতে ইচ্ছে করছে না নাকি খাবার গুছিয়ে নিতে আলসেমি করছেন?
দুটোই। 
না, এটা তো ঠিক না।
তাহলে চলে আসেন,গুছিয়ে দিয়ে যান।
শায়লা কথাটা বেশ সহজভাবেই নিলো। বললো হ্যাঁ, বাসার ঠিকানাটা দিন চলে আসি।
আরে না না বলেন কি! 
আচ্ছা, কেন আপনি একা সেটা কি বলা যায়?
হ্যাঁ, বলা যায়, তবে এভাবে না কখনো দেখা হলে সামনাসামনি তখন বলবো।
দেখা হবে কিভাবে? 
শিহাব হয়তো জানে না ভেতরে ভেতরে শায়লা শিহাবকে দেখার জন্য কেমন উদগ্রীব  হয়ে আছে।খুবই রহস্যজনক একজন মানুষ। অন্য সব পুরুষদের মত নয়।যারা পরিচয়ের দুদিন পরেই দেখা করার জন্য নানান বাহানা খোঁজে।
হবে কোন একদিন। একসাথে দেখা করে চা খাবো।চলে আসবেন তো? আপনাকে একটা বিশেষ চা খাওয়াবো। সেখানে আমরা সব বন্ধুরা চা খাই।
এভাবে থাকতে কি আপনার ভালো লাগে?
না লাগে না।কিন্তু থাকতে হয়।
শিহাবের হঠাৎ সকালের কথা মনে পড়লো।
আচ্ছা আপনার মায়ের রিপোর্ট আনতে কখন যাবেন?
এইতো দশটার পরে।আচ্ছা আমিও তখন বেরুবো।মা খাবার পাঠিয়েছে কুরিয়রে।চিনবেন হয়তো।সুন্দরবন কুরিয়রে।সেটা আনতে বেরুবো। আপনি চাইলে তখন আপনার সাথে দেখা করতে পারি।
শায়লার মনে একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয় মিশ্রিত আবেগের শিহরণ বয়ে গেলো।
কিন্তু শিহাব নির্বিকারভাবেই সব বলছে।যেন কোন ব্যবসায়িক কারণে মিট করা।
আপনি কোথায় থাকবেন তাহলে আপনাকে
আমার বাইকে তুলে নিলাম।তারপর লুবানায় চলে গেলাম।
শায়লা ভীষণ  বিস্মিত হয়ে গেলো।তার জীবনে আচমকা এই লোকটির এমন আগমন, আবার এতটাই আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে শায়লা জীবনের অন্য একটি মানে খুঁজতে লাগলো। ভেবে নিল আমরা যেখানে শেষ বলে ধরে নেই , সেখান থেকেও যে আবার কিছু শুরু হতে পারে সেটা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।
কি হলো? বললেন না কোথায় থাকবেন? আর আপনাকে কিভাবে চিনে নিবো? মানে কী রঙের শাড়িতে থাকবেন?

শাড়ি? শায়লা ভাবলো শাড়ি পরা হয়না বহুদিন।এভাবে কেউ তাকে শাড়িতে দেখতে চায়নি , তার জন্য কেউ ছুটে আসবে, অপেক্ষায় থাকবে!
শায়লা ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে নাতো!
শায়লা জানালো, আমি সকালে জানাবো কী রঙের শাড়ি পরবো।
শিহাব আচ্ছা বলে বিদায় নিয়ে নিলো। হাতে টিভির রিমোট নিলো।আজ একটা ইংলিশ মুভি দেখবে। মুভি শেষ করে তখন কিছু খেয়ে নিবে। শিহাব সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালো।

নির্ঘুম শায়লার পৃথিবীটা আজ উলোটপালোট হয়ে গেছে! শায়লা শুনেছে মনের খুব গভীর থেকে কিছু চাইলে সেটা নাকি  একদিন মিলে যায়। শিহাবের মুখখানি বারবার তার সামনে ভাসছে। গত একবছরে শায়লার তার জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুকে সে বিচ্ছিন্ন একটা দূর্ঘটনা ভেবে নিচ্ছে।মনে হচ্ছে এটাই যেন ঘটবার কথা ছিল। তার গাড়িটি ভূল পথে চলে গিয়েছিল। কল্পনায় শায়লা লাল নীল অনেককিছু ভেবে নিচ্ছে।
হঠাৎ টুং করে মেসেজ এলো, রাত তিনটা। শিহাবের মেসেজ।
ঘুমাননি?
শায়লা মিথ্যে করে বললো, হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আপনার মেসেজের শব্দে জাগলাম।
ঘুমিয়ে পড়েন। আমি মুভি দেখা শেষ করলাম। কাল সকালে দেখা হচ্ছে । 






চলবে.....

আমির হাসান মিলন




প্রশান্তি 
  

তোমাকে যখন দেখি , 
আমার বুকের প্রশান্তে প্রবল ভু-কম্পন সৃষ্টি হয় 
হৃদয় ছিটকে গিয়ে চাঁদের মতোন 
পৃথিবী মঙ্গল এর মাঝে স্থবিরতা প্রাপ্ত হয় । 

তোমাকে না দেখে, 
আমার ভিতর কোন এক সুদুর সুখের অব্যক্ত ব্যথায় 
শীতের সন্ধ্যার তারার মতো লাস্যময়ী হয়ে উঠে 
নিজেকে পেয়ে খুঁজে পাই হারানো সুর । 

তোমাকে যখন দেখি , 
হৃদপিণ্ড থেকে আমার উল্কা বৃষ্টি শুরু হয় 
হৃদয়ের অনু ছিঁড়ে ছিঁড়ে 
পাকস্থলীতে ভস্মের মহাস্তুপ সৃষ্টি করে । 

তোমাকে না দেখে,
আমার দুটি চোখ চৈতি পৃথিবীর মতো খর হয়ে উঠে
সেখানে দুঃখের অশ্রু প্রতিহিংসার তাপে 
বাষ্পীভূত হয়ে লীন হয় । 

অসামান্য রূপের আলোক ছটায় 
আলোকিত না হয়ে , ডুবে থাকি আরাধনায় ।

সাফিয়া খন্দকার রেখা




রঙচঙা এক মৃত্যু নিয়ে
শহরময় হাঁটিস


পাথর সমান ভারি যখন মেঘ
চোখে তখন বাঁধনহারা বেগ,
যখন আমার শ্বাসরুদ্ধ অভাব
তখন তোর বেহায়াপনা স্বভাব। 
ইচ্ছে হলে টগবগিয়ে হৃদপিণ্ড ফোটে
তোর আকাশে হাজার শত অলি এসে জোটে,
দাড়িয়ে থাকি দূরে দেখতে থাকি তোকে
ভুল করে তুই ঢুকে পরিস নিত্যনতুন শোকে।
প্রেম নিয়ে তুই খেলতে থাকিস কাটাকুটি খেলা 
যেনো মোমের পুতুল নাচতে থাকে প্রেমযমুনায় ভেলা।
অভাব ঠোঁটে চুমু খেয়ে টলতে থাকিস নেশায় 
নষ্ট প্রেমের হাওয়া এসে উম্মাদনা মেশায়।
উম্মাদ তুই ভাবতে থাকিস এইতো মহা সুখ 
আকড়ে ধরে জাপটে তোকে মস্ত এক অসুখ। 

পরগাছারা শেকরবিহীন তৃষ্ণা নিয়েই বাঁচে
নিজে পোড়ে পোড়ায় হৃদয় মিথ্যা প্রেমের আঁচে।
দূর থেকেই তাকিয়ে দেখি নষ্ট একটা তুই
তোর আঙিনায় কেমন ছিলাম ভালোবাসার ভুঁই।
ফিরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে মায়া
পেছন ফিরে দেখি তুই এক অমাবস্যা কায়া। 
রঙচঙা এক মৃত্যু নিয়ে শহরময় হাঁটিস 
পুষে রাখা দগদগে দাগ হাড়গোড় সব চাটিস।
মনেপ্রাণে ভাবছিস তুই পেলবতা মাখিস!
এই দরোজায় ঐ দরোজায় হৃদয় ছুঁয়ে থাকিস!!
অপগণ্ড মূর্খ তুই হৃদয় পোড়া ছাই
খুঁজে দেখ তোর জন্য কারো মায়া নাই,
আদ্যোপান্ত তোকে জানিস নিত্য আমি পড়ি
ঘৃণার এক বিষবৃক্ষ নিজের ভেতর  গড়ি।

রেবেকা সুলতানা ( রেবা)




স্রষ্টার প্রেমে গড়া


দৃষ্টিতে প্রেম ঝড়ে হাসিতে স্নিগ্ধতা 
যতই দেখি তারে ঘিরে ধরে মুগ্ধতা। 
চোখেতে কামনা সে তো বড় যাতনা
ছিলোনা তো মোর কল্পনা।

ও চোখের দৃষ্টিতে  প্রেমে পড়ি বারংবার 
চোখে যেন আগ্নিঝরে কি করিবো হায়!

অভিমান - অনুযোগের মিশিল চোখের পাতায়,
অব্যক্ত কথাটা ভাসে চোখের কোনায়,
চোখের ভাষারা যেন ঐ হৃদয়ের আরশি।

তবুও চোখে জল জমেছে
যেন ঝরছে অশ্রুবারী।
চোখের পানে তাকিয়ে থাকা দায় চোখে অশ্রুর
সঞ্চার ঘটে রোজ। 

দিকবিদিকশুন্য  আজও চঞ্চল ঐ চোখ।
চোখ নয় যেন দুটি সুখ তারা
পলকে পলকে হয়ে যাই আমি  দিশেহারা।

ছলনাময়ী চোখ কেড়ে নিলো মোর সবি,
ও চোখের গভীরতায় ডুবে যাই রোজ
চোখে চোখ রেখে দেখা হয়
হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।
তোমার এ চোখ যেন স্রষ্টার  প্রেমে গড়া,
তাই তো এতো প্রেম -প্রিতি
সোহাগে ভরা
চোখ  আজও নেশাতুর তোমাতেই ঝোঁক।

নিপুন দাস




অতীত


কেমন আছো?          - এইতো আছি। 
কোথায় থাকো?          - কাছাকাছি। 
বদলে গেছো?           - সবাই বলে। 
তারপর সব ?          - যাচ্ছে চলে। 
বিয়ে - সাদী?           - লাভ কি শুনে। 
কতদিন হলো?           - রাখিনি গুনে। 
ছেলে হয়েছে?           - একটি মেয়ে।
কোথায় এখন?          - ঘুমালো খেয়ে। 
নাম কি ওর?          - 'সোনা মা' ডাকি। 
এই নামটা তো.....          - এখন রাখি। 
ব্যাস্ত খুবই?           - একটু খানি। 
বছর পাঁচেক........          - আমি জানি। 
এড়িয়ে যাচ্ছো?          - এমনটা নয়। 
মনে পড়ে না?           - পাইনা সময়। 
সেদিন যদি........          - থাক সেসব। 
ভুলেই গেছো?           - যথা সম্ভব। 
থাকতো যদি.......        - থাকবে কি আর ? 
ভুলিনি আমি            - যায় আসে কার? 
রাখবো এখন?           - কিছু কি বাকি? 
ভালো থেকো!!           - ভালোই থাকি। 
এত অভিমান ?            - রাখিনি মোটেই। 
এখন কাদোঁ??           - অল্প চোটেই?
হ্যাঁ, কাঁদো কি??          -না, কাঁদি না।
বেণি করো চুল...??          - আর বাধি না। 
বৃষ্টিতে ছাদে??         - যাই না এখন। 
প্রিয় গানগুলো ?           - শুনি কিছুক্ষন। 
কখন শুনো??          - মন খারাপে। 
মন খারাপ হয়??           - ভয়ে তে কাঁপে। 
কিসের ভয়ে??           - থাক আপাতত। 
কিছুটা আছো??           - আগের মতো? 
আবার যদি....          - চাই না আমি। 
আপন কে খুব?           - অন্তর্যামী। 
চাইলে কি দোষ?          - হবে বিপরীত।
আমি কেউ না???        - শুধুই অতীত.....

মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"৪৯

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "। 




টানাপোড়েন ৪৯

আয়োজন


                                              হালকা হালকা শীত ।কুয়াশা ঢাকা আকাশ ।সোনালী রোদ্দুর ।কতদিন পর সকালবেলা আকাশটা এমন করে দেখার সুযোগ পেল। ঘুম থেকে উঠে গেল ছাদে । ছাদের যে জায়গাটাতে মাঝে মাঝে গিয়ে বিয়ের আগে বসতো ,শৈশবের অনেক স্মৃতি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ।সেই জায়গাটাকে খুঁজে পেতে চাইল রেখা। ছাদের বেশিরভাগ অংশই দেখা যাচ্ছে যে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে ।তবুও যার সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, যত ই পুরাতন হোক না কেন ?সে তো মনের গভীরে থেকেই যায়। ছাদে আগে প্রচুর ফুল গাছ ছিল এখন অনেক কমে গেছে। তবে নীল অপরাজিতা ফুল গাছটা তেমনি আছে ।
রেখা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিল । সারা দুপুর ধরে শীত পড়তে না পড়তেই বাড়ির মা ,জেঠিমা ,কাকিমারা সব গা গরম করতে থাকতো ছাদে আর ঠাম্মি তো বিকেল না হতেই সেঁধিয়ে যেত তার বিছানায়।
এখান থেকে নীলদাকে দেখা যেত। কতদিন রেখা এই ছাদের থেকে নীলের সঙ্গে ইশারায় কথা বলেছে। আজও তো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রেখা। কোন ইশারা, কোন হাতছানি আজ তার জন্য নেই। তবু কেন বারবার রেখা এই জায়গাটাতে এসে দাঁড়াচ্ছে।
হঠাৎ কাকিমা ডাকছে ' ননী, ননী। কোথায় গেলি মা?'
আনমনে উদাসী রেখা ডাক শুনতে পেয়ে ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুঁকে বলল  'আমি ছাদে আছি কাকিমা?'
কাকিমা বললেন  'সাতসকালে ছাদে গেলে মা, চা খেয়ে খেয়ে যাও।'
এরমধ্যেই নিচে ফোনের আওয়াজ পাওয়া গেল বেশ কয়েকবার রিং হয়ে গেল। 
রেখা মনে মনে ভাবতে লাগল' কার ফোন বাজছে সাতসকালে?'
রেখার ফোন হলে তো কাকিমা ডাক তো  'ননী তোর ফোন বাজছে?"
আবারো রিং হতে শুরু করল কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না।  
রেখা ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল ' কাকিমা ,কাকিমা কার ফোন বাজছে গো?'
কাকিমা বলল 'আমার ফোন বাজছে  ননী?'
রেখা বলল 'তুমি ব্যস্ত আছো? ফোনটা তুলছো না কেন?'
কাকিমা বলল 'দেখেছি কার ফোন ?ইচ্ছে করে ফোন ধরছি না।'
রেখা বলল 'কেন কাকিমা? অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে?'
কাকিমা বললেন 'না রে তোর গুনধরি বোনের।'
রেখা বলল 'ও মা সোমু ফোন করেছে ,ধরছো না কেন?'
কাকিমা বললেন 'আমি জানি তো ওর কোন স্বার্থ ছাড়া ও ফোন করে নি ।নিশ্চয়ই কিছু না কিছু মতলব আছে। ওই জন্যই ফোনটা ধরি নি।'
রেখা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো  ' না কোনো প্রয়োজন তো হতে পারে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'হয় বলবে বাড়িটা লিখে দিতে ,না হয় বলবে ওর ছেলেটাকে আমাদের কাছে রেখে দিতে। আমরা কিভাবে আছি আমাদের কথা একবারও চিন্তা করে না।এখনো আমাদের চিন্তা ভাবনা আমাদেরই করতে হচ্ছে?'
রেখা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল  'তবু একবার শুনতে পারতে কথাটা?'
কাকিমা বললো ,'তোকে অত সব ভাবতে হবে না ননী ?'আয় মা ,তুই চা টা খেয়ে যা ।তারপর আজকে কি রান্না করবো বল ?তোর সব পছন্দের হবে।"
কাকু বললেন'চিংড়ি মাছের মালাইকারি বা ইলিশ  , ভাঁপা তো করতেই হবে?'
কাকিমা বললেন' এই দুটো আমি ভোলাকে বলেছি বাজারে কোন মাছ পাওয়া যায় নিয়ে আসতে?'
রেখা বলে' ওতেই হবে কাকিমা। আর কিছু করতে হবে না।'
কাকু বললেন ' কেন রে তুই তো মটন কষাও খেতে খুব ভালবাসিস?'
রেখা বল ল 'একদিনে অতো কিছু খেতে পারব না।"
কাকিমা বললেন " অত কিছু কোথায় ?চিংড়ি মাছ বা ইলিশ মাছের মধ্যে যেকোনো একটা করবো আর মটন কষাটা করে দেবো ।
আর কি খাবি বল পোলাও?'
রেখা খুশিতে ডগোমগো হয়ে বলল ' কাকিমা আমার জন্য এত কিছু করবে?'
কাকু বললেন  'কেন করবে না? তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে নয়?'
রেখা  বলল' ' না ,এখন তোমার বয়স হয়েছে কাকিমা ।এত কিছু তোমাকে রান্না করতে হবে না।'
কাকিমা বললেন 'ওরে,এখন তো লোকজন ই   আসে না ।না রান্না করতে করতে তো সবকিছু ভুলে যাবো ?তুই আসলি তাই আবার নতুন করে একটু ঝালাই করতে পারব?'
রেখা বলল  'কাকিমা ,মুড়িঘন্ট বানাবে?'
কাকিমা বললেন 'তুই খাবি?'
রেখা বলল  'হ্যাঁ , মুড়িঘন্ট আমিও বাড়িতে বানাই কিন্তু তোমার মত হয় না কাকিমা ।আজকে আমাকে রেসিপি টা শিখিয়ে দিও।'
কাকিমা হেসে বললেন  'না মা ।তুমি নিজে হাতে রান্না করো তো সেই জন্য মনে হয় ভালো হয় না ।নইলে তোরা আমাদের ই মেয়ে ।রান্না আবার খারাপ হবে বল?'
রেখা কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ' কাকিমা আজকে গ্রামের বাড়িতে এসে কখনো এক চুলও মনে পড়ছে না যে মা কাছে নেই ।সব সময় মনে হচ্ছে মা যেন পাশে পাশেই আছে। মায়ের মতো করে তুমি সবকিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করছ ।রান্না করবে কি কি? কি খাব ,না খাব ।সব সময় তুমি নজরে রাখছ।'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ সেই তো করবো না ?আমাদের জায়ে জায়ে কত মিল ছিল ।ওর দুর্বলতা আমি জানতাম ।আমার দুর্বলতা ও জানতো?'
রেখা কিছুক্ষণের জন্য দেখল  'কাকিমা উদাস হয়ে গেলেন।'
রেখা কাকিমাকে  একটু ধাক্কা দিয়ে বলল "ও কাকিমা কি ভাবছো?"
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ ,কিছু বলছিস মা?'
রেখা বলল  'বলছিলাম কি ভাবছো হঠাৎ করে এত উদাস হয়ে গেলে?'
কাকিমা বললেন ' আমাদের এই বাড়িতে প্রথম বউ হয়ে আসার পর সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম।"
রেখা বললো  'এরকম কিছু স্মৃতির কথা বলো না গো?'
কাকু বললেন  'তোর কাকিমা ।কাকিমার কাছে অনেক স্মৃতি রয়েছে রে। স্মৃতির ভান্ডার ।এখন খুলে  বসলে  কিন্তু রান্না করতে অনেক দেরি হবে। তখন পেটে ছুঁচো তে ডন মারবে বুঝলি?'
রেখা হেসে বলল ' মারুক গে পেটে ছুঁচোতে ডন । 
আহ্লাদের সুরে বলল'একটা বলো না কাকিমা?''
কাকিমা বললেন'তোর মা যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে ।তখন অনেকেই তোর মাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তোর মা এতটাই বুদ্ধিমতি ।বাড়িতে পা দিয়ে এসেই আমাদের দু 'জাকে আগে হাত করেছিল। হেসে কাকিমা বললেন 'তোর মা প্রথমেই এসে বলেছিল'দিদিভাই তোমরা আমাকে ছোট বোনের মত শাসনে -আদরে রেখো ।ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিও ।বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিও।'
রেখা বলল  'ও প্রথম দিনে এরকম কথা মা বলল তোমাদের?'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ রে আমরাও তো অবাক হয়ে গেছি ।আমরা তো তোর মাকে ছুটকি ছুটকি বলে ডাকতাম।'
ছুটকি এসে কিভাবে আমাদেরকে বলল  'আর ওর ওই মায়াবী চোখ আর আদুরে কথা শুনে আমরাও ভাবলাম তাই তো একে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের বাঁচাতে হবে। কারণ ও আমাদের ছোট বোন ওকে অপমান মানে আমাদের অপমান। কিন্তু আমাদেরকে কেউ তো এই ভাবে বলে নি।'
এদিকে আবার ফোন বেজে চলে।
কাকিমা বলেন 'দেখ তো ননী কার ফোন?'
রেখা বলে 'আমার ফোন কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'জামাই বাবাজি ফোন করেছে মা?'
রেখা বলল 'না কাকিমা আমার স্কুলের এক কলিগ।'
কাকিমা বললেন  'স্কুলের কলিগ তো খুব ভালো রে কালকেও অনেকক্ষণ কথা বললেন ।আজকেও আবার খবর নিচ্ছেন।'
রেখা বলল  'হ্যাঁ ,কাকিমা। খুবই ভালো ।  আমার কপালটা খারাপ?'
কাকিমা বললেন  'কেন রে কপাল খারাপ হবে কেন তোর?'
রেখা বলল  'তবে  এই দিদি আর বেশিদিন স্কুলে নেই। ট্রানসফার পেয়ে গেছে।'
কাকিমা বললেন  'কোথায় ?বাড়ির কাছে নাকি রে?'
রেখা বলল-'হ্যাঁ কাকিমা?'
কাকিমা বলেন ''ঠিক আছে। ফোনটা ধরো কথা বলে নাও।'
কাকু বললেন 'ওই এখন উৎসশ্রী 'কি  সব হয়েছে না ট্রান্সফারের? তাতে করেছেন ?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ, একদম তাই।'
কাকিমা বললেন' 'তুইও পাস তো করে নে।'
রেখা বলল  'হ্যাঁ ,তাই ভাবছি।'
আবার ফোন বেজে উঠল
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল  'হ্যালো',.।
রিম্পা দি বলল  'কিরে ভালো আছিস তো?'
রেখা হেসে বললো  ,'খুব ভালো আছি।
ঠিক আছে আনন্দের সাথে কাটাও।'
এরইমধ্যে ভোলাদা বাজার নিয়ে আসলো।
ভোলা বলল ,' 'মা বাজার?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ , রাখ?'
ভোলা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলো ।তখন কাকিমা  জিজ্ঞেস করল  'হ্যাঁ' রে ,'কী মাছ পেলি?'
ভোলা বলল 'ইলিশ মাছ?'
সঙ্গে আমি একটু কচুর শাক নিয়ে এসেছি।
কাকিমা বললেন 'বেঁচে থাক বাবা।'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,কাকিমা ।কচুর শাক ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে...,।'
কাকিমা বললেন  'ঠিক আছে মা, করে দেব।'
ভোলা বলল 'মামনি কেমন আছো? চিনতে পারছো আমায়?'
রেখা বললো 'হ্যাঁ, কেন পারব না ?ভালো আছো?'
ভোলা বলল;' ওই চলে যাচ্ছে মামনি?'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ রে, ভোলা। পোলাওর জন্য কাজু কিসমিস নিয়েছিস ?
আমি তো বলতে ভুলে গেছি।'
ভোলা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল  'মা কাজু কিসমিস নেয়া হয় নি।'
কাকিমা এতসব আয়োজন করছে তাদের অভাব থাকা সত্বেও।
 রেখা মনে মনে খুশি হলেও একটু খারাপও লাগছে।'
তবে শুধুমাত্র যে তার জন্য এত আয়োজন দেখে রেখার মন খুশিতে আনন্দে নেচে উঠল । আর ভাবল যে না তার জন্য ও ভাবার লোক আছে। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল  'বাড়িতে গিয়ে কাকু-কাকিমার জন্য অন্তত মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হবে যাতে কাকু-কাকিমার কোন কষ্ট না হয়। এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। যতই হোক সে  তো তাদেরই মেয়ে ।নিজের না হোক ।তাদের এই যে এত স্নেহ -ভালোবাসা ,এখানে তো তার বাবা-মা কেউ নেই কিন্তু তাতে তাদের সে ভালোবাসার কোন খামতি রাখেন নি।
আজ নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরে মনে হচ্ছে 'দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছোটে হাওয়া পাগল পারা ...।
এরমধ্যে রেখার ফোন আবার বেজে উঠল'দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী..।'
রেখা ফোন রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
মনোজ বললো  'কি ব্যাপার একবারও ফোন করলে না?'
রেখা বলল "সময় পাইনি।'
মনোজ অবাক হয়ে বললো 'তুমি সময় পাও নি?'
রেখা বলল' 'কিছু মনে করো না। আমি একটু একান্ত আমার মতো করে থাকতে চাইছি।'
মনোজ বলল 'ওকে'।
রেখা মনে মনে ভাবল  'বিয়ের পর থেকে শুধু সংসার ,সংসার আর স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে।নিজেকে নিয়ে ভাবার কোন অবকাশ ছিল না ।আজ দীর্ঘ অবকাশে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অতীতের স্মৃতিগুলোকে আরেকবার ঝালাই করে নিতে চাইছে।'