স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ১৭)
শামীমা আহমেদ
অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে শিহাবের সন্ধ্যে হয়ে গেলো।এরই মধ্যে বন্ধুদের কয়েকবার কল চলে এলো।'সন্ধ্যার চা' অর্থাৎ ইভিনিং টি পানের নিমন্ত্রণ।বুঝে গেলো শিহাব আজ আর এদের হাত থেকে তার নিস্তার নেই।এখুনি বাসায় ফেরা হচ্ছে না।হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে একটু ফ্রেশ করে নিল।এমনিতেই সারাক্ষনই বন্ধুদের টিপ্পনী শুনতে হয়।শিহাব নাকি মেয়েদের পটাতে ওস্তাদ।কিন্তু এটা সম্পূর্ণই ওদের ভুল ধারণা। মেয়েরা নিজে থেকেই শিহাবের দিকে আকৃষ্ট হয়।তার লুক,বিহেভিয়ার, আইডোলজি কেয়ারিং এটিটিউট,কঞ্জারভেটিভনেস এ মেয়েরা,এমনকি অনেক মহিলারাও ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়ে।
শিহাব তাই খুবই সংযত হয়ে চলাফেরা করে।
একটু সরলতায় কথা বললে অনেকেই সেটা দূর্বলতা ভেবে নেয়। এই জীবনে রিশতিনা এসেছিল খুবই অল্প সময়ের ভালোলাগায় আবার হারিয়েও গেছে খুব দ্রুত সময়ে।তার পর থেকেইতো একাকী জীবন। তবে শিহাব ইচ্ছে করলে দিনে চার পাঁচজনে মেয়ের সাথে ডেট করা তার কাছে কোন ব্যাপারই না। হ্যান্ডসাম লুক, আর্থিক স্বচ্ছলতা, সানগ্লাস পরে বাইক চালানোয় মনে হয় একেবারে স্বয়ং সালমান খানের আদলে একজন নায়কের উপস্থিতি, সর্বোপরি সিঙ্গেল লাইফ! স্ত্রী আছে না নেই,চলে গেছে না গত হয়েছে, ফিরে আসবে নাকি আর ফিরবে না ডিভোর্স না সেপারেশন হয়েছে? আজকাল মেয়েরা এসব ভ্রুক্ষেপ করে।সুপুরুষ দেখলে তারা মৌমাছির মত ঘিরে ধরতে চায়! কিন্তু সবাইতো আর শিহাবের মনের ভেতরের সবটা জানে না। শিহাব এসব কখনো ভাবনায়ও আনে না।শুধু ভাবে যার এত এত আছে তবুও তার একান্ত নিজের বলে কেউ নেই।এটা কী নিয়তি নাকি তার ভূলের মাশুল।
বন্ধুরা সব অপেক্ষায়। দিনশেষে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়া একেবারে একঘেয়েমিতে ধরে গেছে। সারাদিনের অফিসের পর তা একেবারে দমবন্ধ লাগে।তাইতো সব বন্ধুরা দূরে একটা খোলা একটা জায়গায় আড্ডা বসায়।সেখানে পাশেই একটা চায়ের দোকান, ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা 'মায়ের দোয়া' টী স্টল।এর স্পেশালিটি হচ্ছে গরুর খাঁটি দুধের মালাই চা। এরা দুধটাকে বেশ ঘন করে তা দিয়ে চা বানায়। উপরে দুধের মালাই ভাসিয়ে দেয়া! আহ! সেই চা খেলে ঠোঁটে লেগে থাকে।
আকাশে যখন বিশাল চাঁদ উঠে, সেই খোলা যায়গায় আলো আঁধারিতে চা খেতে শিহাবের যেমন ভালো লাগে তেমনি মনটা বিষাদে ভরে যায়। একাকীত্বের এ যন্ত্রণা কাউকে বলা যায় না শুধু বলতে ইচ্ছে করে ঐ চাঁদটিকে।বাইরে বন্ধুদের সাথে গল্পে হাসি আনন্দে মেতে থাকে।কখন যে বেশ কয়েককাপ চা চালান হয়ে যায় তার খেয়ালই থাকে না।
শিহাব সাততলা থেকে নেমে এলো। বাইকে স্টার্ট দিয়ে চললো উত্তরা দিয়া বাড়ির দিকে। সেখানে বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা হওয়া।
বন্ধুরা সব ধনীর ঘরের সন্তান।সবাই পৈতৃক ব্যবসার মালিক। খুবই বিলাসিতায় জীবনযাপন। চারিত্রিক দিক দিয়েও বেশ খোলামেলা। কিন্তু শিহাব এর মাঝেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।কোন বন্ধুর প্রোরচনায় কোন নারীদেহের প্রলোভনে কোথাও পা বাড়ায়নি।শিহাবের সকল কিছু ইচ্ছা বাসনা তাড়না কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।মনের সুক্ষ্ম অনুভুতির অনুভবে তাইতো শিহাব আজো রিশতিনার ছোঁয়া খুঁজে ফিরে।কামুক পুরুষের মত শুধু নারীর দেহভোগ করতে সে শিখেনি। অনেক বন্ধুকে দেখেছে প্রয়োজন ফুরালে প্রেমিকাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, অস্বীকার করতে। শিহাব অন্য এক ধাতুতে গড়া এক লৌহ মানব।যে নিজেকে দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর করছে।
আড্ডা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে শিহাবের রাত দশটা বেজে গেলো। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।তবুও আলসেমিকে প্রশয় দিল না। একেবারে ফ্রেস হয়ে বিছানায় চলে এলো।চায়ের কারণে একেবারেই ক্ষুধা নেই। তাছাড়া সবকিছু গুছিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না।
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। মায়ের ফোন।
কেমন আছিস বাবা?
এই তো মা ভালো আছি।
তোমরা? আরাফ কেমন আছে?
ভালো।ঘুমিয়ে গেছে।
রাতের খাবার কি খেয়েছিস?
এইতো খাবো মা।
শোন,কাল কুরিয়ারে কিছু খাবার পাঠাচ্ছি।
সুমাইয়া আজ সারাদিন সব গুছিয়েছে।
কুরিয়ার থেকে সময় করে নিয়ে আসবি।ওরা ফোন দিবে।সাবধান দেরি করবি না।তবে সব নষট হবে।
মা কেন এসব করো?
মা হলে বুঝতি,কেন করি।
আচ্ছা ঠিক আছে মা।আমি নিয়ে আসবো।
আচ্ছা রাখি।
শিহাব ভেবে নিল কাল তাহলে অফিসে যাওয়া আগেই সুন্দরবন কুরিয়ারে যেতে হবে।সেক্টর ৯ এ। খাবারগুলো আবার বাসায় রেখে একটু গুলশানের দিকে যেতে হবে।কিছু জরুরি কাজ আছে।
শায়লার মেসেজ এলো।
রাতের খাবার খেয়েছেন?
শিহাবের হাত থেকে আর ফোনটি রাখার ফুসরৎ মিললো না।
না, মানে খাইনি, খাবো,আবার খেতে ইচ্ছেও করছে না।
খেতে ইচ্ছে করছে না নাকি খাবার গুছিয়ে নিতে আলসেমি করছেন?
দুটোই।
না, এটা তো ঠিক না।
তাহলে চলে আসেন,গুছিয়ে দিয়ে যান।
শায়লা কথাটা বেশ সহজভাবেই নিলো। বললো হ্যাঁ, বাসার ঠিকানাটা দিন চলে আসি।
আরে না না বলেন কি!
আচ্ছা, কেন আপনি একা সেটা কি বলা যায়?
হ্যাঁ, বলা যায়, তবে এভাবে না কখনো দেখা হলে সামনাসামনি তখন বলবো।
দেখা হবে কিভাবে?
শিহাব হয়তো জানে না ভেতরে ভেতরে শায়লা শিহাবকে দেখার জন্য কেমন উদগ্রীব হয়ে আছে।খুবই রহস্যজনক একজন মানুষ। অন্য সব পুরুষদের মত নয়।যারা পরিচয়ের দুদিন পরেই দেখা করার জন্য নানান বাহানা খোঁজে।
হবে কোন একদিন। একসাথে দেখা করে চা খাবো।চলে আসবেন তো? আপনাকে একটা বিশেষ চা খাওয়াবো। সেখানে আমরা সব বন্ধুরা চা খাই।
এভাবে থাকতে কি আপনার ভালো লাগে?
না লাগে না।কিন্তু থাকতে হয়।
শিহাবের হঠাৎ সকালের কথা মনে পড়লো।
আচ্ছা আপনার মায়ের রিপোর্ট আনতে কখন যাবেন?
এইতো দশটার পরে।আচ্ছা আমিও তখন বেরুবো।মা খাবার পাঠিয়েছে কুরিয়রে।চিনবেন হয়তো।সুন্দরবন কুরিয়রে।সেটা আনতে বেরুবো। আপনি চাইলে তখন আপনার সাথে দেখা করতে পারি।
শায়লার মনে একটা চাপা উত্তেজনা আর ভয় মিশ্রিত আবেগের শিহরণ বয়ে গেলো।
কিন্তু শিহাব নির্বিকারভাবেই সব বলছে।যেন কোন ব্যবসায়িক কারণে মিট করা।
আপনি কোথায় থাকবেন তাহলে আপনাকে
আমার বাইকে তুলে নিলাম।তারপর লুবানায় চলে গেলাম।
শায়লা ভীষণ বিস্মিত হয়ে গেলো।তার জীবনে আচমকা এই লোকটির এমন আগমন, আবার এতটাই আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে শায়লা জীবনের অন্য একটি মানে খুঁজতে লাগলো। ভেবে নিল আমরা যেখানে শেষ বলে ধরে নেই , সেখান থেকেও যে আবার কিছু শুরু হতে পারে সেটা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।
কি হলো? বললেন না কোথায় থাকবেন? আর আপনাকে কিভাবে চিনে নিবো? মানে কী রঙের শাড়িতে থাকবেন?
শাড়ি? শায়লা ভাবলো শাড়ি পরা হয়না বহুদিন।এভাবে কেউ তাকে শাড়িতে দেখতে চায়নি , তার জন্য কেউ ছুটে আসবে, অপেক্ষায় থাকবে!
শায়লা ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে নাতো!
শায়লা জানালো, আমি সকালে জানাবো কী রঙের শাড়ি পরবো।
শিহাব আচ্ছা বলে বিদায় নিয়ে নিলো। হাতে টিভির রিমোট নিলো।আজ একটা ইংলিশ মুভি দেখবে। মুভি শেষ করে তখন কিছু খেয়ে নিবে। শিহাব সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালো।
নির্ঘুম শায়লার পৃথিবীটা আজ উলোটপালোট হয়ে গেছে! শায়লা শুনেছে মনের খুব গভীর থেকে কিছু চাইলে সেটা নাকি একদিন মিলে যায়। শিহাবের মুখখানি বারবার তার সামনে ভাসছে। গত একবছরে শায়লার তার জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুকে সে বিচ্ছিন্ন একটা দূর্ঘটনা ভেবে নিচ্ছে।মনে হচ্ছে এটাই যেন ঘটবার কথা ছিল। তার গাড়িটি ভূল পথে চলে গিয়েছিল। কল্পনায় শায়লা লাল নীল অনেককিছু ভেবে নিচ্ছে।
হঠাৎ টুং করে মেসেজ এলো, রাত তিনটা। শিহাবের মেসেজ।
ঘুমাননি?
শায়লা মিথ্যে করে বললো, হ্যাঁ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।আপনার মেসেজের শব্দে জাগলাম।
ঘুমিয়ে পড়েন। আমি মুভি দেখা শেষ করলাম। কাল সকালে দেখা হচ্ছে ।
চলবে.....