২২ নভেম্বর ২০২১

মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"৪৯

কান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক।  তার নিত্যদিনের  আসা  যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "। 




টানাপোড়েন ৪৯

আয়োজন


                                              হালকা হালকা শীত ।কুয়াশা ঢাকা আকাশ ।সোনালী রোদ্দুর ।কতদিন পর সকালবেলা আকাশটা এমন করে দেখার সুযোগ পেল। ঘুম থেকে উঠে গেল ছাদে । ছাদের যে জায়গাটাতে মাঝে মাঝে গিয়ে বিয়ের আগে বসতো ,শৈশবের অনেক স্মৃতি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ।সেই জায়গাটাকে খুঁজে পেতে চাইল রেখা। ছাদের বেশিরভাগ অংশই দেখা যাচ্ছে যে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে ।তবুও যার সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, যত ই পুরাতন হোক না কেন ?সে তো মনের গভীরে থেকেই যায়। ছাদে আগে প্রচুর ফুল গাছ ছিল এখন অনেক কমে গেছে। তবে নীল অপরাজিতা ফুল গাছটা তেমনি আছে ।
রেখা সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিল । সারা দুপুর ধরে শীত পড়তে না পড়তেই বাড়ির মা ,জেঠিমা ,কাকিমারা সব গা গরম করতে থাকতো ছাদে আর ঠাম্মি তো বিকেল না হতেই সেঁধিয়ে যেত তার বিছানায়।
এখান থেকে নীলদাকে দেখা যেত। কতদিন রেখা এই ছাদের থেকে নীলের সঙ্গে ইশারায় কথা বলেছে। আজও তো সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রেখা। কোন ইশারা, কোন হাতছানি আজ তার জন্য নেই। তবু কেন বারবার রেখা এই জায়গাটাতে এসে দাঁড়াচ্ছে।
হঠাৎ কাকিমা ডাকছে ' ননী, ননী। কোথায় গেলি মা?'
আনমনে উদাসী রেখা ডাক শুনতে পেয়ে ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুঁকে বলল  'আমি ছাদে আছি কাকিমা?'
কাকিমা বললেন  'সাতসকালে ছাদে গেলে মা, চা খেয়ে খেয়ে যাও।'
এরমধ্যেই নিচে ফোনের আওয়াজ পাওয়া গেল বেশ কয়েকবার রিং হয়ে গেল। 
রেখা মনে মনে ভাবতে লাগল' কার ফোন বাজছে সাতসকালে?'
রেখার ফোন হলে তো কাকিমা ডাক তো  'ননী তোর ফোন বাজছে?"
আবারো রিং হতে শুরু করল কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না।  
রেখা ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল ' কাকিমা ,কাকিমা কার ফোন বাজছে গো?'
কাকিমা বলল 'আমার ফোন বাজছে  ননী?'
রেখা বলল 'তুমি ব্যস্ত আছো? ফোনটা তুলছো না কেন?'
কাকিমা বলল 'দেখেছি কার ফোন ?ইচ্ছে করে ফোন ধরছি না।'
রেখা বলল 'কেন কাকিমা? অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে?'
কাকিমা বললেন 'না রে তোর গুনধরি বোনের।'
রেখা বলল 'ও মা সোমু ফোন করেছে ,ধরছো না কেন?'
কাকিমা বললেন 'আমি জানি তো ওর কোন স্বার্থ ছাড়া ও ফোন করে নি ।নিশ্চয়ই কিছু না কিছু মতলব আছে। ওই জন্যই ফোনটা ধরি নি।'
রেখা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো  ' না কোনো প্রয়োজন তো হতে পারে কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'হয় বলবে বাড়িটা লিখে দিতে ,না হয় বলবে ওর ছেলেটাকে আমাদের কাছে রেখে দিতে। আমরা কিভাবে আছি আমাদের কথা একবারও চিন্তা করে না।এখনো আমাদের চিন্তা ভাবনা আমাদেরই করতে হচ্ছে?'
রেখা কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল  'তবু একবার শুনতে পারতে কথাটা?'
কাকিমা বললো ,'তোকে অত সব ভাবতে হবে না ননী ?'আয় মা ,তুই চা টা খেয়ে যা ।তারপর আজকে কি রান্না করবো বল ?তোর সব পছন্দের হবে।"
কাকু বললেন'চিংড়ি মাছের মালাইকারি বা ইলিশ  , ভাঁপা তো করতেই হবে?'
কাকিমা বললেন' এই দুটো আমি ভোলাকে বলেছি বাজারে কোন মাছ পাওয়া যায় নিয়ে আসতে?'
রেখা বলে' ওতেই হবে কাকিমা। আর কিছু করতে হবে না।'
কাকু বললেন ' কেন রে তুই তো মটন কষাও খেতে খুব ভালবাসিস?'
রেখা বল ল 'একদিনে অতো কিছু খেতে পারব না।"
কাকিমা বললেন " অত কিছু কোথায় ?চিংড়ি মাছ বা ইলিশ মাছের মধ্যে যেকোনো একটা করবো আর মটন কষাটা করে দেবো ।
আর কি খাবি বল পোলাও?'
রেখা খুশিতে ডগোমগো হয়ে বলল ' কাকিমা আমার জন্য এত কিছু করবে?'
কাকু বললেন  'কেন করবে না? তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে নয়?'
রেখা  বলল' ' না ,এখন তোমার বয়স হয়েছে কাকিমা ।এত কিছু তোমাকে রান্না করতে হবে না।'
কাকিমা বললেন 'ওরে,এখন তো লোকজন ই   আসে না ।না রান্না করতে করতে তো সবকিছু ভুলে যাবো ?তুই আসলি তাই আবার নতুন করে একটু ঝালাই করতে পারব?'
রেখা বলল  'কাকিমা ,মুড়িঘন্ট বানাবে?'
কাকিমা বললেন 'তুই খাবি?'
রেখা বলল  'হ্যাঁ , মুড়িঘন্ট আমিও বাড়িতে বানাই কিন্তু তোমার মত হয় না কাকিমা ।আজকে আমাকে রেসিপি টা শিখিয়ে দিও।'
কাকিমা হেসে বললেন  'না মা ।তুমি নিজে হাতে রান্না করো তো সেই জন্য মনে হয় ভালো হয় না ।নইলে তোরা আমাদের ই মেয়ে ।রান্না আবার খারাপ হবে বল?'
রেখা কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল ' কাকিমা আজকে গ্রামের বাড়িতে এসে কখনো এক চুলও মনে পড়ছে না যে মা কাছে নেই ।সব সময় মনে হচ্ছে মা যেন পাশে পাশেই আছে। মায়ের মতো করে তুমি সবকিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করছ ।রান্না করবে কি কি? কি খাব ,না খাব ।সব সময় তুমি নজরে রাখছ।'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ সেই তো করবো না ?আমাদের জায়ে জায়ে কত মিল ছিল ।ওর দুর্বলতা আমি জানতাম ।আমার দুর্বলতা ও জানতো?'
রেখা কিছুক্ষণের জন্য দেখল  'কাকিমা উদাস হয়ে গেলেন।'
রেখা কাকিমাকে  একটু ধাক্কা দিয়ে বলল "ও কাকিমা কি ভাবছো?"
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ ,কিছু বলছিস মা?'
রেখা বলল  'বলছিলাম কি ভাবছো হঠাৎ করে এত উদাস হয়ে গেলে?'
কাকিমা বললেন ' আমাদের এই বাড়িতে প্রথম বউ হয়ে আসার পর সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম।"
রেখা বললো  'এরকম কিছু স্মৃতির কথা বলো না গো?'
কাকু বললেন  'তোর কাকিমা ।কাকিমার কাছে অনেক স্মৃতি রয়েছে রে। স্মৃতির ভান্ডার ।এখন খুলে  বসলে  কিন্তু রান্না করতে অনেক দেরি হবে। তখন পেটে ছুঁচো তে ডন মারবে বুঝলি?'
রেখা হেসে বলল ' মারুক গে পেটে ছুঁচোতে ডন । 
আহ্লাদের সুরে বলল'একটা বলো না কাকিমা?''
কাকিমা বললেন'তোর মা যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে ।তখন অনেকেই তোর মাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তোর মা এতটাই বুদ্ধিমতি ।বাড়িতে পা দিয়ে এসেই আমাদের দু 'জাকে আগে হাত করেছিল। হেসে কাকিমা বললেন 'তোর মা প্রথমেই এসে বলেছিল'দিদিভাই তোমরা আমাকে ছোট বোনের মত শাসনে -আদরে রেখো ।ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিও ।বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিও।'
রেখা বলল  'ও প্রথম দিনে এরকম কথা মা বলল তোমাদের?'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ রে আমরাও তো অবাক হয়ে গেছি ।আমরা তো তোর মাকে ছুটকি ছুটকি বলে ডাকতাম।'
ছুটকি এসে কিভাবে আমাদেরকে বলল  'আর ওর ওই মায়াবী চোখ আর আদুরে কথা শুনে আমরাও ভাবলাম তাই তো একে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের বাঁচাতে হবে। কারণ ও আমাদের ছোট বোন ওকে অপমান মানে আমাদের অপমান। কিন্তু আমাদেরকে কেউ তো এই ভাবে বলে নি।'
এদিকে আবার ফোন বেজে চলে।
কাকিমা বলেন 'দেখ তো ননী কার ফোন?'
রেখা বলে 'আমার ফোন কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'জামাই বাবাজি ফোন করেছে মা?'
রেখা বলল 'না কাকিমা আমার স্কুলের এক কলিগ।'
কাকিমা বললেন  'স্কুলের কলিগ তো খুব ভালো রে কালকেও অনেকক্ষণ কথা বললেন ।আজকেও আবার খবর নিচ্ছেন।'
রেখা বলল  'হ্যাঁ ,কাকিমা। খুবই ভালো ।  আমার কপালটা খারাপ?'
কাকিমা বললেন  'কেন রে কপাল খারাপ হবে কেন তোর?'
রেখা বলল  'তবে  এই দিদি আর বেশিদিন স্কুলে নেই। ট্রানসফার পেয়ে গেছে।'
কাকিমা বললেন  'কোথায় ?বাড়ির কাছে নাকি রে?'
রেখা বলল-'হ্যাঁ কাকিমা?'
কাকিমা বলেন ''ঠিক আছে। ফোনটা ধরো কথা বলে নাও।'
কাকু বললেন 'ওই এখন উৎসশ্রী 'কি  সব হয়েছে না ট্রান্সফারের? তাতে করেছেন ?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ, একদম তাই।'
কাকিমা বললেন' 'তুইও পাস তো করে নে।'
রেখা বলল  'হ্যাঁ ,তাই ভাবছি।'
আবার ফোন বেজে উঠল
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল  'হ্যালো',.।
রিম্পা দি বলল  'কিরে ভালো আছিস তো?'
রেখা হেসে বললো  ,'খুব ভালো আছি।
ঠিক আছে আনন্দের সাথে কাটাও।'
এরইমধ্যে ভোলাদা বাজার নিয়ে আসলো।
ভোলা বলল ,' 'মা বাজার?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ , রাখ?'
ভোলা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলো ।তখন কাকিমা  জিজ্ঞেস করল  'হ্যাঁ' রে ,'কী মাছ পেলি?'
ভোলা বলল 'ইলিশ মাছ?'
সঙ্গে আমি একটু কচুর শাক নিয়ে এসেছি।
কাকিমা বললেন 'বেঁচে থাক বাবা।'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,কাকিমা ।কচুর শাক ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে...,।'
কাকিমা বললেন  'ঠিক আছে মা, করে দেব।'
ভোলা বলল 'মামনি কেমন আছো? চিনতে পারছো আমায়?'
রেখা বললো 'হ্যাঁ, কেন পারব না ?ভালো আছো?'
ভোলা বলল;' ওই চলে যাচ্ছে মামনি?'
কাকিমা বললেন  'হ্যাঁ রে, ভোলা। পোলাওর জন্য কাজু কিসমিস নিয়েছিস ?
আমি তো বলতে ভুলে গেছি।'
ভোলা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল  'মা কাজু কিসমিস নেয়া হয় নি।'
কাকিমা এতসব আয়োজন করছে তাদের অভাব থাকা সত্বেও।
 রেখা মনে মনে খুশি হলেও একটু খারাপও লাগছে।'
তবে শুধুমাত্র যে তার জন্য এত আয়োজন দেখে রেখার মন খুশিতে আনন্দে নেচে উঠল । আর ভাবল যে না তার জন্য ও ভাবার লোক আছে। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল  'বাড়িতে গিয়ে কাকু-কাকিমার জন্য অন্তত মাসে কিছু টাকা পাঠাতে হবে যাতে কাকু-কাকিমার কোন কষ্ট না হয়। এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। যতই হোক সে  তো তাদেরই মেয়ে ।নিজের না হোক ।তাদের এই যে এত স্নেহ -ভালোবাসা ,এখানে তো তার বাবা-মা কেউ নেই কিন্তু তাতে তাদের সে ভালোবাসার কোন খামতি রাখেন নি।
আজ নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরে মনে হচ্ছে 'দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছোটে হাওয়া পাগল পারা ...।
এরমধ্যে রেখার ফোন আবার বেজে উঠল'দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী..।'
রেখা ফোন রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
মনোজ বললো  'কি ব্যাপার একবারও ফোন করলে না?'
রেখা বলল "সময় পাইনি।'
মনোজ অবাক হয়ে বললো 'তুমি সময় পাও নি?'
রেখা বলল' 'কিছু মনে করো না। আমি একটু একান্ত আমার মতো করে থাকতে চাইছি।'
মনোজ বলল 'ওকে'।
রেখা মনে মনে ভাবল  'বিয়ের পর থেকে শুধু সংসার ,সংসার আর স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে।নিজেকে নিয়ে ভাবার কোন অবকাশ ছিল না ।আজ দীর্ঘ অবকাশে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অতীতের স্মৃতিগুলোকে আরেকবার ঝালাই করে নিতে চাইছে।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much