১০ মার্চ ২০২২

কবি রেহানা বীথি'র কবিতা




বিরহের বেহাগ 
রেহানা বীথি 


দাঁড়িয়ে থেকো না 
মৃত শীতের অশ্লীল শব্দোচ্চারণে
ভেঙে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে 
কলসির গল্প 
পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে 
রোদ আর কুয়াশা 


একটু বোসো 
না-হয় আধশোয়া হয়ে 
চিবুকে তর্জনি রেখে একটু ভাবো 
দুপুর, ভোর, সন্ধেবেলার গণিত 

অতঃপর শবাসন 
শিথিল... 


পীড়িত মানুষের কাছে 
জ্যোৎস্না চেয়ে বিরক্ত কোরো না 
শবাসন থেকে উঠে বসে
বিরহ চাও তার কাছে 

দু'হাত খুলে দেবে 
 

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২৮




উপন্যাস 


টানাপোড়েন  ১২৮

মনের মানুষ থাকুক মনের মন্দিরে

মমতা রায় চৌধুরী



রেখা  হঠাৎ ই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। পার্থ যে টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। রেখা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কতটা কষ্ট হয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে মিল না হলে। শৈশবকালে রেখা নীলকে হারিয়েছে। সেই ক্ষত এখনো টাটকা আছে। জ্বালা, যন্ত্রণা কিছুটা উপশম কাজের মধ্যে ভোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অতীত স্মৃতি ইতিহাসের পাতার মতো জ্বলজ্বল করে।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভিড় করে আসে মনের আরশিতে।
এর মধ্যেই জীবনে ঘটে গেছে কত কিছু। স্বপ্নীল এসেছে জীবনে সেও অতীত। এটা হবারই কথা ছিল। বিবাহিত জীবনে পরকীয়া এটা কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু মন তো অনেক কিছু চায়। মনের ক্রাইসিস কে দূর করবে? প্রকৃত বন্ধুর দরকার। প্রকৃত বন্ধুকে সবকিছু বলা যায় নিজের স্বামীকে বলা যায়না। তাহলে সে প্রকৃত বন্ধুটা কে? প্রকৃত বন্ধু সেই যে কখনো বন্ধুকে ছেড়ে কোথাও যায় না হ্যা হয়তো সবসময় তাকে কাছে পাওয়া যায় না কিন্তু তার মানে এই নয় তার দুঃখে তার অবসাদে তার কষ্টে সে শামিল হবে না ।দুঃখ বিমোচনে পরামর্শদাতা হবে না?
সবাই ছেড়ে গেলে ও বন্ধু ছেড়ে যাবে না।
সেরকমই বন্ধু পেয়েছিল স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল বন্ধু হয়ে উঠেছিল হয়তো বন্ধুর থেকে আরো একধাপ উঁচুতে। তবে স্বপ্নিলের  সব দাবিতে সাড়া দিতে পারে নি রেখা।
একদিন তো বলেই ফেলল স্বপ্নীল
চলো দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।
কোথায় যাব?
যেখানে তোমাকে আমাকে কেউ চিনতে পারবে না?
শ্রাবণী পূর্ণিমায় তোমাকে নিয়ে পালাবো রসিকতা করে বলেছিল।
রেখা একটু রেগে গেছিল এসব কথা তুমি কি বলছো আমি বিবাহিতা আমি সমাজ-সংসার সকলকে ভয় পাই?
আর আমাকে?
আমি তো তোমাকে ভালোবাসি?
রেখা কিন্তু  বলেছিল' আমি কি তোমাকে বলেছি ভালবাসি?'
অবাক হয়ে স্বপ্নীল বলেছিল "তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
তুমি আমার দিকে তাকিয়ে বলো?'
রেখা বলেছিল 'না।'
ছোট্ট একটা শব্দ '। অথচ এর ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় যা তাতে কারো মন ভেঙে খান খান হয়ে যায় ।অবসাদ চলে আসতে পারে ,দুঃখ-যন্ত্রণা ভরিয়ে দিতে পারে। 
রেখা জানত কিন্তু রেখার কোনো উপায় ছিল না ।এটা রেখাকে বলতেই হত ।নইলে স্বপ্নীল সারাটা জীবন ধরে রেখার পেছনে পড়ে থাকত জীবনটাকে বাজি রেখে । 


রেখা চেয়েছিল ভালো থাকুক। ওর ও একটা ছোট্ট সংসার হোক। মনের ভিতর রেখার প্রতি ভুলটাকে নিয়েই স্বপ্নীল থাকুক।
স্বপ্নীল অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে ছিল।
তারপর বলেছিল ভালোবাসাটা একতরফাই থেকে গেল। তাই থাকুক। কিন্তু আমি তোমাকে ভালবেসে যাব নিরন্তর। ভালোবাসার মৃত্যু নেই। ভালোবাসা চিরজীবী।
স্বপ্নীলের দুচোখ কখনো জলে ভরা আবেগমথিত কন্ঠে বলেছিল
' ঠিক আছে আমি আসছি ।আমি আমার কষ্টটাকে ভাগ করার জন্য চলে যাচ্ছি কদিনের জন্য।
রেখা অবাক হয়ে বলেছিল কোথায় যাচ্ছ?
তোমাকে বলতেই হবে?'
সেটা তোমার ইচ্ছে।'
আমার ইচ্ছেগুলো কি সেটা তুমি সব জানো ।সেই ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উঠতে পারল না। তবে তোমাকে বলে যাচ্ছি আমি সমুদ্রে যাচ্ছি ঢেউ গুনতে।
ঢেউ এর সাথে সাথে কতবার শুধু ভালোবাসার নামটাই উচ্চারিত হয় ।সেটা দেখতে যাব।
স্বপ্নীল এই কথা বলেই দ্রুত বাইকটা স্টার্ট করে চলে 
যায় ।
তার পরে বেশ কয়েকদিন স্বপ্নীলের কোন ফোন নেই ,দেখা নেই।
রেখা জানতো এই নির্দয়তার পরিচয় না দিলে স্বপ্নীল রেখাকে ভুলতে পারবে না। তারপর রেখা
হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল সত্যিই সে স্বপ্নীলকে কতটা ভালোবেসেছে ,এতটা কষ্ট এতটা যন্ত্রণা ,কেন পাচ্ছে ?মনে হচ্ছে স্বপ্নীলের সঙ্গে কথা না বললে রেখার যেন পাগল পাগল লাগছে। একটা শুন্যতা ,রিক্ততা সারাটা মন জুড়ে থেকে 
গেছে ।কতবার ফোন টার দিকে তাকিয়েছিল ।একটা ফোন আসেনি ।রেখা ও যখন ফোন করতে গেছে ফোনটা নট রিচেবল থেকেছে। ওই কদিনে রেখার ভেতরে যে কষ্টের পাহাড় গড়ে উঠেছিল তিল তিল করে সেই হিসেব শুধুমাত্র রেখেছে।
রেখা মনে মনে বলেছে স্বপ্নীল 'তুমি জানো না তোমাকে যদি আমি এই কথাগুলো না বলতাম তুমি সারাটা জীবন আমার জন্যই নিজের জীবনটাকে অতিবাহিত করতে কিন্তু আমি তো সেটা চাই না ।আমি চেয়েছি তুমি সুখী হও  তোমার একটা ঘর সংসার হোক। সারাটা দিন ক্লান্তি শেষে তুমি নিরাপদ আশ্রয়ে এসে দুটো একটা মনের কথা খুলে বলো ।ক্লান্তি, অবসাদে তোমার কাছে বসে যে তোমার কপালটা একটু টিপে দেবে ,কখনো বা আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে তোমাকে । এমনি করেই একদিন তুমি আমাকে ভুলে যাবে , এটাই নিয়ম।
কতটা যে যন্ত্রণা কতটা যে কষ্ট রেখা মনের ভেতরে চেপে রেখেছিল সেই কটা দিনে। মনে হয়েছিল যেন স্বপ্নীল কোথায় চিরদিনের জন্য রেখাকে ছেড়ে চলে গেল। মিনিটে মিনিটে ঘন্টায় ঘন্টায় সারাক্ষণ শুধু স্বপ্নীলের কথা ভেবেছে।
মনে হচ্ছিল যেন ক্রমশ তাদের এই গল্পে যে পাতা জুড়ে গিয়েছিল।দু মুঠো বিকেল ক্রমশই হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভবের চাদরে মুড়ে গেছিল। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুধুই তোমাকে উপলব্ধি । আর ছেলেমানুষি গুলোকে মনের ক্যানভাসে রং তুলির আঁচড় দিয়ে কোন এক শিল্পীর আঁকায় অবয়ব দেবার চেষ্টায় মন ব্যাকুল হয়েছিল। অথচ চলে যাবার পর সবকিছুই যেন ফাঁকা মাঠের মতো হুহু করা এক রিক্ততা।
তারপর যখন ও ফিরে এসেছে সে কি এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠেছিল রেখার মন ও প্রাণ।
হারানো জিনিস ফেরত পেলে যে অভূতপূর্ব, অনির্বচনীয় আনন্দ এর সৃষ্টি হয়।  রেখার ও  ঠিক সেরকমই হয়েছিল।
আজ সেই স্মৃতিচারণ করতে বসে রেখার দু'চোখ জলে ভরে ওঠে।  সত্যি সত্যি রেখা  চেয়েছিল, স্বপ্নীল নিজের মতো করে বাঁচুক।
আর যখন স্বপ্নীল নিজের মতো করেই বাঁচার জন্য রেখার থেকে দূরে চলে গেল তখন রেখা মানার চেষ্টা করলেও ভেতরে কষ্টে যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে হৃদয়টা যেন ভেঙে খান খান করে দিয়ে গেল। এখন স্বপ্নীল কে দুটো কথাও বলতে পারে না কোথায় আছে কে জানে ?কোথায় হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে ।গল্পের পাতা গুলো এভাবেই ছিঁড়ে গেল।
সত্যিই তাই সবকিছু সুন্দর হয়  যদি কাছে থাকে এমন কেউ।
মনে মনে চাইছে স্বপ্নীল আবার ফিরে আসুক জীবনে । ফিকে হয়ে যাওয়া ধূসর জীবনে হাতছানি দিক কৃষ্ণচূড়ার পলাশের রং। ফিরে আসুক আবার বসন্ত কোকিলের কুহুতান আবার ডেকে উঠুক তাদের সুমিষ্ট ধ্বনি।
এমন সময় এক ঝাঁক পায়রা উড়ে চলেছে নীল আকাশে হয়তো বা ওরা গোধুলিবেলায় নিজের নিজের ঠিকানায়। রেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল ওদের। কি মুক্ত স্বাধীন যখন খুশি যেখানে খুশি চলে যেতে পারে ,নেই কোনো বাঁধন। এরকম মুক্ত পাখির মতো যদি ডানা মেলে উড়ে যেতে পারত দূর-দূরান্তে। হয়তো বা ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারত স্বপ্নিলের।
এমন সময় শাশুড়ির চিৎকারে রেখার ধান ভাঙ্গে।
'হ্যাঁ রে মনু, বলি তোর বউটা কি বেআক্কেলে রে।
এতটা সময় হয়ে গেল চা পেলাম না। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, না কিরে?'
মনোজ বললো 'সে কি ?
এখনো চা পাওনি?'
তাহলে কি তোকে আমি  মিথ্যা কথা বলছি? জিজ্ঞেস কর তোর বউকে।'
মনোজ তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো' রেখা রেখা রেখা আ. আ. আ।'
রেখার চমক ভাঙ্গে অবাক হয়ে কাছে এসে বলে কি হয়েছে এভাবে চিৎকার করছো কেন?
এখনো চা দাওনি মায়েদের?
গ্যাস নেই তো।
সেকি?? আগে বলনি তো?
মনে করে দেখো ৫-৬ দিন আগেই বলেছি গ্যাস শেষের মুখে গ্যাস দিতে বলো।
এই যা আমিতো ইসলামকে বলতে ভুলে গেছি। এখন উপায়?
মনে সংশয় নিয়ে রেখার মুখের দিকে তাকায়।
রেখা বলল পার্থদের বাড়ি খোঁজ নাও ওদের থেকে এনে দাও।
একদম ঠিক বলেছ।
রেখা কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে।
রেখা মনে মনে ভাবে শাশুড়ি মা যখন কথাগুলো বলেন মাঝে মাঝে মনে হয় তার জবাব দিই কিন্তু ইচ্ছে হয়না। বোঝানো যাবেনা শুধু শুধু মুখ নষ্ট করে লাভ নেই। অনেকে বলে এডুকেটেড মেয়ে চুপ চাপ থাকিস কেন প্রতিবাদ তো করতে পারিস। তখনই প্রতিবাদ হয় যখন তার থেকে রিটার্ন কিছু পাওয়া যায় । উজবুক দের বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। সেজন্য বোবা হওয়াই সব থেকে বেশি বেটার।
আজকাল এই পলিসি নিয়ে চলছে রেখা। চালাতেই  হবে। না  রোজগারের অশান্তি।
কিন্তু কতদিনই বা এ ভাবে মেনে নেবে জানে না।
ঈশ্বর ধৈর্যশক্তি দিন। ছুটির দিন কোথায় গল্প লিখবে সে ফুসরত নেই। এরমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ" জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা।"
রেখা গিয়ে দরজাটা খুলে দেখে পার্থ একগাল হাসি নিয়ে বললো 'বৌদি ,এই নাও তোমার রান্নার গ্যাস। এতক্ষণ তোমরা চা না করে বসে
 আছো ।আমাকে একটা ফোন করলেই তো হতো।
"হ্যাঁ ,তা হতো আসলে  আমিও একটু  অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
ও বৌদি কবে যাবে মায়ের কাছে?
রেখা বলে ঠিক আছে দেখছি আজকে যদি পারিস সন্ধ্যের পরে যাব।
একটু ভালো করে বুঝাও না বৌদি মাকে।
হাত তুলে আশ্বস্ত করে বলল নিশ্চয় চেষ্টা করব ভাই আমি তোমার মনের কষ্টটা বুঝতে পারছি।
এই জন্যই তো তোমাকে আমি বললাম মা ও তো তোমার কথা শোনে।
ঠিক আছে বৌদি আসছি।
রেখা বলল ঠিক আছে এসো।
পার্থ চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে চলে যাবার সময় পার্থর মুখটা কি অনাবিল আনন্দ আর প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে । পার্থ গান করতে করতে যাচ্ছে 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে। 'রেখা পার্থর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে ভাবতে থাকে 'সত্যিই তো একটা ভালোবাসা যদি পরিপূর্ণতা পায় একটু চেষ্টা করে দেখতে দোষ 
কি ।ভালো থাকুক সবাই।'মনের মানুষটি থাকুক ভালোবেসে মনেরও মন্দিরে।

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২৭




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১২৭
ঢেঁকি  গেলেও ধান ভানে
মমতা রায়চৌধুরী


দুটো দিন টানা কিছু খেতে পারেনি রেখা যাও বা খেয়েছে সবই বেরিয়ে গেছে ।প্রচন্ড উইক লাগছে কিন্তু বাচ্চাগুলোর কাছে তো যেতেই হবে। না দেখলে যেন প্রাণ আনচান করতে থাকে। ওদের আদর-ভালোবাসা সবথেকে বেশি মূল্যবান বলে মনে হয় ।মিলি যেন রেখার মাতৃত্বটাকে তার বাচ্চা দিয়ে ভরিয়ে দিলো। ঈশ্বরের অশেষ
 আশীর্বাদ ।থ্যাংকস গড বারবার জানায় রেখা।
হঠাৎ  মনোজ এসে বলল'জানো রেখা।'
রেখা মনেজের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
"তোমার পাইলট কি করছে দেখেছো?'
রেখা বললো কি?
মনোজ হাত দুটোকে গেট ধরার মতো করে দেখিয়ে বলল
'গেটটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর ডাকছে?'
আমি কাছে গেলাম ।লেজ নাড়ল।
তারপরও ডেকে যাচ্ছে।'
কেন?
'তুমি যাওনি আজকে ওদের কাছে।''
'অনেক আগে কিন্তু আদর করিনি।'
"ও বাবা ওই জন্যই বোধহয় ... যাও যাও একবার দেখা করে আসো, আদর করে আসো।
রেখা বলল 'ঠিক আছে, যাই।"
'সত্যিই তো ওরাও তো প্রত্যাশা নিয়ে থাকে, হয়তো "মনটা খারাপ হচ্ছে।'
"হ্যাঁ যাও ,ওদের কাছে যাও।'
রেখার ননদ রেখার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল 'দেখ ,এদিকে বলছে শরীর খারাপ, ও দিকে  কুকুরের বাচ্চা গুলোর কাছে গিয়ে কেমন আদর করছে তোমার বৌমা?
সব নাটক বুঝলে মা।'
রেখার শাশুড়ি বললো'আরে বাজা মেয়ে মানুষ, কুকুরের বাচ্চাকে আদর করে একটু না হয় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাল।'
রেখার কানে কথাগুলো আসলো ,যেন মনে হলো কোন হ্যাঁচকা টানে বুকের ভিতর একটা ভাষাহীন বোবা  যন্ত্রনা দুমড়ে-মুচড়ে হৃদয়টাকে শূন্য করে দিতে চাইল।
তবুও রেখা তার শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল বাচ্চাদের কাছে।
রেখা কাছে যেতেই  চেঁচিয়ে উঠল। তারপর  রেখা গেটটা খুলে ভেতরে যেতেই সবাই  যেন হামলে পড়েছে । মনে হচ্ছিলকোনো একটা প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে হঠাৎ খুঁজে পেলেযেমন মনে খুশির বন্যা বয়ে যায়,আনন্দ হয় ,যে রকম  ঠিক সে রকম।
শাশুড়ি আর ননদের কথাগুলো মনে হতে থাকলো রেখার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে থাকল কিন্তু বাচ্চাগুলোর আদর-ভালোবাসা তাদের ভেতরে যে অনুভূতি সেগুলো যখন রেখার কাছে ধরা পড়ে ,রেখাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। রেখা ভুলে যায় সেই যন্ত্রণা।
হঠাৎই মনোজ চিৎকার করে ডাকতে থাকে রেখা ,রেখা,রেখা।
'তোমার ফোন বাজছে?'
রেখা বেশ জোরে বলে কে করেছে?
মনোজ  ঘরে টিভি চালিয়েছে। টিভির শব্দে রেখার আওয়াজ প্রথমে শুনতে পায় নি।
তারপর মনোজের মনে হল যেন মনোজকে কেউ কিছু বলছে টিভির সাউন্ড টা কমিয়ে দিয়ে কানটা খাড়া করল শুনতে পেল। রেখাই যেন কিছু বলছে।
মনোজ বলল-কি বলছ. ছ,,. ছ. ছ
বলছি কে ফোন করেছিল?
আমি দেখিনি।
ও আচ্ছা।
তুমি এসে দেখে নাও জরুরী ফোন এলে ফোন করে নাও।
হ্যাঁ, এই যাচ্ছি গো। বাচ্চাগুলোকে মায়ের কাছে রেখে গেটটা তালা দিয়াআসি
রেখা ভেতরে গিয়ে কল লিস্ট চেক করে দেখলো
এই যা t বড়দি ফোন করেছিল তো।
ঠিক আছে তুমি আর একবার ফোন করে
নাও।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ আবার কি করলে দেখো?
এ বাবা দরকার থাকলে তুমি ছুটি নেবে না? এই নকইয়ে আবার গসিপ ?'
রেখা বড়দিদি নম্বরে রিং করল।
রিং হয়ে গেল কেউ ধরলেন না।
আবার ফোন করল । এবার রিং হতে হতেই ফোনটা রিসিভ করে গুরু গম্ভীর স্বরে বলল হ্যালো '।
রেখা বলল ,“আমি রেখা ।আমি বলছি।.'
হ্যাঁ বলো।
না আপনি ফোন করেছিলেন তাই।
আমি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
কালকে স্কুলে ভ্যাকসিন আছে সেকেন্ড ডোজ।
তুমি কিন্তু কাল কামাই করো না অবশ্যই স্কুলে এস।
কিন্তু দিদি এতটা পথ যাব , কি হবে কে জানে?
কিন্তু তুমি না আসলে খুব অসুবিধা হবে রেখা। চেষ্টা করো আর দেখো তুমি নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।
ঠিক আছে দিদি আমি চেষ্টা করব।
এরমধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।
রেখা বললো এই সময় আবার কি আসলো কে জানে?
আবার কলিংবেল বাজল 
'গনেশ জয় ,গনেশ জয় 'গনেশ দেবা।
মনোজ উঠে সবেমাত্র দরজার কাছে গেছে গেল।
এবং বলল: কে ,কে জানে?'
দরজা খুলতেই একগাল হাসি নিয়ে পার্থ দাঁড়িয়ে।
মনোজ রেখা কে বলল দেখো কে এসেছে?
রেখা খুশিতে ডগোমগো হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
কি ব্যাপার পার্থ ভাই?
এইতো দিদি।?
ভাবলাম অনেকদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি কাজে ব্যস্ত থাকি।
তা বেশ বেশ ভাল করেছো।
মাসিমা কেমন আছেন।
বসার কুশান টা একটু কুঁচকে গেছে ওটাকে টানটান করে রাখল।
রেখা আবার গেল সবজি কাটতে। পার্থ বলল বৌদি একটু বসুন না।
কিছু বলবে?
বলছি মায়ের সাথে দেখা করেছিলে।
দেখা করতে পারিনি ফোনে কথা বলেছি।
মা কিছু বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে?
পার্থ খুব শখ ভরে রেখার দিকে তাকিয়ে কিছু জানতে চাইল আশাব্যঞ্জক কথা।
রেখা বললো মাসীমা যেটা বললেন মাসিমার দিক থেকে ঠিকই বলেছে ন।
কি বলেছে মা?
কাস্ট নিয়ে।
পার্থ একটু চিন্তিত মুখে বলল মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না কাস্ট নিয়ে ধুয়ে কি জল খাব?
পার্থ চিন্তা করো না মাসিমা কে আমি বোঝাবো।
পার্থ বলল আজ এত বছরের সম্পর্ক বৌদি আমি কি করে…?
আমি বুঝতে পারছি।
তাছাড়া এখন তো ওর বাড়ি তো চাপ দিচ্ছে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি এর মধ্যেই যেতাম আমার শরীরটা বাবার বিগড়ে গেল তো।
আশ্চর্য হয়ে পার্থ বলল কি হয়েছে বৌদি?
মনোজ বাইরে থেকে কথাটা শুনতে পেয়ে এসে বলল রেখার তো শরীর খারাপ বমি পায়খানা হলো।
তারপর মায়েরা এসেছে।
পার্থ এদিক ওদিক তাকিয়ে কে মায়েরা বলতে কাকিমা আর মনিদি।
মনোজ বলল হ্যাঁ।
তা আমাদের বাড়িতে গেল না তো।
যাবে এইতো রেখা অসুস্থ ওরা রান্না বান্না করছে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
তারপরই আবার পার্থ রেখা কে বলল বৌদি একটু দেখো ব্যাপারটা বুঝতে পারছো আমার মনের অবস্থা।
রেখা না বুঝে আর পারে উল্টো ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় পার্থর অবস্থাটা বুঝতে পারছে।
রেখা পার্থকে আশ্বাস দিয়ে বলল 'কোন চিন্তা ক'রো না ।আমি দেখছি ব্যাপারটা।
পার্থ বলল তাহলে আমি আসছি বউদি তবে কিন্তু যেও না কিন্তু তোমার কথা শোনে।
রেখা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
পার্থ উঠে দাঁড়ালো।
রেখা বলল পার্থ ভাই উঠে দাঁড়ালে চা খাবে তো একটু একটু ওয়েট করো আমি চা করে দিচ্ছি।
না বৌদি আজকে আর চা খাব না। তোমারও শরীরটা ভালো নেই।
অন্যদিন তোলা থাকলো।
মনোজ বললো ভাইয়া তুমি খেলে আমি একটু পেতাম।
পার্থ হেসে বাইরে বেরিয়ে আসলো।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল মনোজের মা আর দিদি দাঁড়িয়ে।
পার্থ সঙ্গে সঙ্গে মনোজের মাকে গিয়ে প্রণাম করলো।
মনোজের মা বললো' থাক বাবা, বেঁচে থাকো।'
আমাদের বাড়িতে যে ও কাকিমা।
আর বাতের ব্যথা বাবা দেখি এখন তো এখানেই থাকব দেখা হবে মাঝে মাঝে।
পার্থ অবাক হয়ে বললো এখানে থাকবে 
কাকিমা। বাহ বেশ ভালো কথা।
মনোজের মা একটু বাঁকা সুরে বলল আর ভালো কথা তোমার কাছে বাবা সবার কি আর ভাল লাগবে?
মনোজ কি বলবে বুঝে না পেয়ে বলল মা ঘরে এসে বসো।
মানুষের মা বলল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আজকে বৌমাকে রান্না করতে বলিস বাবা মনির শরীরটাও ভাল নেই আর আমি তো দাঁড়াতে পারি না হাটুর ব্যাথা তে।
লেখা বুঝতে পারলেই ইচ্ছে করে পার্থ সামনে কথাগুলো বলছে যেন মনে হয় রেখা কিছুই করতে পারেনা উনারাই করছেন কিন্তু কিছু বললো না রেখা।
আসলে যার যার ধর্ম ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
মনোজ  রেখার দিকে তাকিয়ে রইল।মনোজ পড়েছে যাঁতাকলে। না পারছে রেখাকে এই অবস্থায় কিছু বলতে আর না পারছে মায়ের কথা ফেলতে।
রেখাই যেন এই অসহায় অবস্থা থেকে মনোজকে মুক্তি দিলো ।রেখা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল 'না ,না আমি আজকে রান্না করবো।'
পার্থ শুধু বলল 'বৌদি তুমি পারবে ?তুমি তো উইক আছো?
মনোজের মা বিড় বিড় করে বললো বাবা এত দরদ মরে যাই ,মরে যাই।
পার্থ বলল বৌদি আসছি, কাকিমা আসছি।
মনোজের মা বিরক্তিভরে বলল-'এসো বাবা।'

কবি শিবনাথ মণ্ডল এর ছড়া






মাকে পেলেই শিশু খুশি
শিবনাথ মণ্ডল



জন্মেই পেয়ে গেলাম
মায়ের শীতল কোল
আদর স্নেহ দিয় মা
সর্বদা দেয় দোল।
মা,যে আমার দেবীর সোমান
বড়ো করে তোলে
বুকের সুধা দিয়ে বাঁচায়
সব ব‍্যাথা ভুলে।
সব কষ্ট ভুলে যায় মা
দেখলে শিশুর হাসি
মাকে পেলেই ভুলেযায় শিশু
আদরের মাসি।
শিশুর কাছে মায়ের মত
নেইকো কিছু আর
হতোভাগি হয় শিশু
নেই মা যার।
বড়ো হয়ে মাকে যেন
কেউ যেওনা ভুলে
মায়ের স্নেহ মাথায় করে
রেখো সবাই  তুলে।।