উপন্যাস
টানাপোড়েন ১২৭
ঢেঁকি গেলেও ধান ভানে
মমতা রায়চৌধুরী
দুটো দিন টানা কিছু খেতে পারেনি রেখা যাও বা খেয়েছে সবই বেরিয়ে গেছে ।প্রচন্ড উইক লাগছে কিন্তু বাচ্চাগুলোর কাছে তো যেতেই হবে। না দেখলে যেন প্রাণ আনচান করতে থাকে। ওদের আদর-ভালোবাসা সবথেকে বেশি মূল্যবান বলে মনে হয় ।মিলি যেন রেখার মাতৃত্বটাকে তার বাচ্চা দিয়ে ভরিয়ে দিলো। ঈশ্বরের অশেষ
আশীর্বাদ ।থ্যাংকস গড বারবার জানায় রেখা।
হঠাৎ মনোজ এসে বলল'জানো রেখা।'
রেখা মনেজের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
"তোমার পাইলট কি করছে দেখেছো?'
রেখা বললো কি?
মনোজ হাত দুটোকে গেট ধরার মতো করে দেখিয়ে বলল
'গেটটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর ডাকছে?'
আমি কাছে গেলাম ।লেজ নাড়ল।
তারপরও ডেকে যাচ্ছে।'
কেন?
'তুমি যাওনি আজকে ওদের কাছে।''
'অনেক আগে কিন্তু আদর করিনি।'
"ও বাবা ওই জন্যই বোধহয় ... যাও যাও একবার দেখা করে আসো, আদর করে আসো।
রেখা বলল 'ঠিক আছে, যাই।"
'সত্যিই তো ওরাও তো প্রত্যাশা নিয়ে থাকে, হয়তো "মনটা খারাপ হচ্ছে।'
"হ্যাঁ যাও ,ওদের কাছে যাও।'
রেখার ননদ রেখার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল 'দেখ ,এদিকে বলছে শরীর খারাপ, ও দিকে কুকুরের বাচ্চা গুলোর কাছে গিয়ে কেমন আদর করছে তোমার বৌমা?
সব নাটক বুঝলে মা।'
রেখার শাশুড়ি বললো'আরে বাজা মেয়ে মানুষ, কুকুরের বাচ্চাকে আদর করে একটু না হয় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাল।'
রেখার কানে কথাগুলো আসলো ,যেন মনে হলো কোন হ্যাঁচকা টানে বুকের ভিতর একটা ভাষাহীন বোবা যন্ত্রনা দুমড়ে-মুচড়ে হৃদয়টাকে শূন্য করে দিতে চাইল।
তবুও রেখা তার শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল বাচ্চাদের কাছে।
রেখা কাছে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল। তারপর রেখা গেটটা খুলে ভেতরে যেতেই সবাই যেন হামলে পড়েছে । মনে হচ্ছিলকোনো একটা প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলে হঠাৎ খুঁজে পেলেযেমন মনে খুশির বন্যা বয়ে যায়,আনন্দ হয় ,যে রকম ঠিক সে রকম।
শাশুড়ি আর ননদের কথাগুলো মনে হতে থাকলো রেখার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে থাকল কিন্তু বাচ্চাগুলোর আদর-ভালোবাসা তাদের ভেতরে যে অনুভূতি সেগুলো যখন রেখার কাছে ধরা পড়ে ,রেখাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। রেখা ভুলে যায় সেই যন্ত্রণা।
হঠাৎই মনোজ চিৎকার করে ডাকতে থাকে রেখা ,রেখা,রেখা।
'তোমার ফোন বাজছে?'
রেখা বেশ জোরে বলে কে করেছে?
মনোজ ঘরে টিভি চালিয়েছে। টিভির শব্দে রেখার আওয়াজ প্রথমে শুনতে পায় নি।
তারপর মনোজের মনে হল যেন মনোজকে কেউ কিছু বলছে টিভির সাউন্ড টা কমিয়ে দিয়ে কানটা খাড়া করল শুনতে পেল। রেখাই যেন কিছু বলছে।
মনোজ বলল-কি বলছ. ছ,,. ছ. ছ
বলছি কে ফোন করেছিল?
আমি দেখিনি।
ও আচ্ছা।
তুমি এসে দেখে নাও জরুরী ফোন এলে ফোন করে নাও।
হ্যাঁ, এই যাচ্ছি গো। বাচ্চাগুলোকে মায়ের কাছে রেখে গেটটা তালা দিয়াআসি
রেখা ভেতরে গিয়ে কল লিস্ট চেক করে দেখলো
এই যা t বড়দি ফোন করেছিল তো।
ঠিক আছে তুমি আর একবার ফোন করে
নাও।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ আবার কি করলে দেখো?
এ বাবা দরকার থাকলে তুমি ছুটি নেবে না? এই নকইয়ে আবার গসিপ ?'
রেখা বড়দিদি নম্বরে রিং করল।
রিং হয়ে গেল কেউ ধরলেন না।
আবার ফোন করল । এবার রিং হতে হতেই ফোনটা রিসিভ করে গুরু গম্ভীর স্বরে বলল হ্যালো '।
রেখা বলল ,“আমি রেখা ।আমি বলছি।.'
হ্যাঁ বলো।
না আপনি ফোন করেছিলেন তাই।
আমি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
কালকে স্কুলে ভ্যাকসিন আছে সেকেন্ড ডোজ।
তুমি কিন্তু কাল কামাই করো না অবশ্যই স্কুলে এস।
কিন্তু দিদি এতটা পথ যাব , কি হবে কে জানে?
কিন্তু তুমি না আসলে খুব অসুবিধা হবে রেখা। চেষ্টা করো আর দেখো তুমি নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।
ঠিক আছে দিদি আমি চেষ্টা করব।
এরমধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।
রেখা বললো এই সময় আবার কি আসলো কে জানে?
আবার কলিংবেল বাজল
'গনেশ জয় ,গনেশ জয় 'গনেশ দেবা।
মনোজ উঠে সবেমাত্র দরজার কাছে গেছে গেল।
এবং বলল: কে ,কে জানে?'
দরজা খুলতেই একগাল হাসি নিয়ে পার্থ দাঁড়িয়ে।
মনোজ রেখা কে বলল দেখো কে এসেছে?
রেখা খুশিতে ডগোমগো হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
কি ব্যাপার পার্থ ভাই?
এইতো দিদি।?
ভাবলাম অনেকদিন আপনাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি কাজে ব্যস্ত থাকি।
তা বেশ বেশ ভাল করেছো।
মাসিমা কেমন আছেন।
বসার কুশান টা একটু কুঁচকে গেছে ওটাকে টানটান করে রাখল।
রেখা আবার গেল সবজি কাটতে। পার্থ বলল বৌদি একটু বসুন না।
কিছু বলবে?
বলছি মায়ের সাথে দেখা করেছিলে।
দেখা করতে পারিনি ফোনে কথা বলেছি।
মা কিছু বলেছে?
হ্যাঁ বলেছে?
পার্থ খুব শখ ভরে রেখার দিকে তাকিয়ে কিছু জানতে চাইল আশাব্যঞ্জক কথা।
রেখা বললো মাসীমা যেটা বললেন মাসিমার দিক থেকে ঠিকই বলেছে ন।
কি বলেছে মা?
কাস্ট নিয়ে।
পার্থ একটু চিন্তিত মুখে বলল মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না কাস্ট নিয়ে ধুয়ে কি জল খাব?
পার্থ চিন্তা করো না মাসিমা কে আমি বোঝাবো।
পার্থ বলল আজ এত বছরের সম্পর্ক বৌদি আমি কি করে…?
আমি বুঝতে পারছি।
তাছাড়া এখন তো ওর বাড়ি তো চাপ দিচ্ছে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি এর মধ্যেই যেতাম আমার শরীরটা বাবার বিগড়ে গেল তো।
আশ্চর্য হয়ে পার্থ বলল কি হয়েছে বৌদি?
মনোজ বাইরে থেকে কথাটা শুনতে পেয়ে এসে বলল রেখার তো শরীর খারাপ বমি পায়খানা হলো।
তারপর মায়েরা এসেছে।
পার্থ এদিক ওদিক তাকিয়ে কে মায়েরা বলতে কাকিমা আর মনিদি।
মনোজ বলল হ্যাঁ।
তা আমাদের বাড়িতে গেল না তো।
যাবে এইতো রেখা অসুস্থ ওরা রান্না বান্না করছে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
তারপরই আবার পার্থ রেখা কে বলল বৌদি একটু দেখো ব্যাপারটা বুঝতে পারছো আমার মনের অবস্থা।
রেখা না বুঝে আর পারে উল্টো ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় পার্থর অবস্থাটা বুঝতে পারছে।
রেখা পার্থকে আশ্বাস দিয়ে বলল 'কোন চিন্তা ক'রো না ।আমি দেখছি ব্যাপারটা।
পার্থ বলল তাহলে আমি আসছি বউদি তবে কিন্তু যেও না কিন্তু তোমার কথা শোনে।
রেখা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
পার্থ উঠে দাঁড়ালো।
রেখা বলল পার্থ ভাই উঠে দাঁড়ালে চা খাবে তো একটু একটু ওয়েট করো আমি চা করে দিচ্ছি।
না বৌদি আজকে আর চা খাব না। তোমারও শরীরটা ভালো নেই।
অন্যদিন তোলা থাকলো।
মনোজ বললো ভাইয়া তুমি খেলে আমি একটু পেতাম।
পার্থ হেসে বাইরে বেরিয়ে আসলো।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল মনোজের মা আর দিদি দাঁড়িয়ে।
পার্থ সঙ্গে সঙ্গে মনোজের মাকে গিয়ে প্রণাম করলো।
মনোজের মা বললো' থাক বাবা, বেঁচে থাকো।'
আমাদের বাড়িতে যে ও কাকিমা।
আর বাতের ব্যথা বাবা দেখি এখন তো এখানেই থাকব দেখা হবে মাঝে মাঝে।
পার্থ অবাক হয়ে বললো এখানে থাকবে
কাকিমা। বাহ বেশ ভালো কথা।
মনোজের মা একটু বাঁকা সুরে বলল আর ভালো কথা তোমার কাছে বাবা সবার কি আর ভাল লাগবে?
মনোজ কি বলবে বুঝে না পেয়ে বলল মা ঘরে এসে বসো।
মানুষের মা বলল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আজকে বৌমাকে রান্না করতে বলিস বাবা মনির শরীরটাও ভাল নেই আর আমি তো দাঁড়াতে পারি না হাটুর ব্যাথা তে।
লেখা বুঝতে পারলেই ইচ্ছে করে পার্থ সামনে কথাগুলো বলছে যেন মনে হয় রেখা কিছুই করতে পারেনা উনারাই করছেন কিন্তু কিছু বললো না রেখা।
আসলে যার যার ধর্ম ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
মনোজ রেখার দিকে তাকিয়ে রইল।মনোজ পড়েছে যাঁতাকলে। না পারছে রেখাকে এই অবস্থায় কিছু বলতে আর না পারছে মায়ের কথা ফেলতে।
রেখাই যেন এই অসহায় অবস্থা থেকে মনোজকে মুক্তি দিলো ।রেখা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল 'না ,না আমি আজকে রান্না করবো।'
পার্থ শুধু বলল 'বৌদি তুমি পারবে ?তুমি তো উইক আছো?
মনোজের মা বিড় বিড় করে বললো বাবা এত দরদ মরে যাই ,মরে যাই।
পার্থ বলল বৌদি আসছি, কাকিমা আসছি।
মনোজের মা বিরক্তিভরে বলল-'এসো বাবা।'